অপেক্ষা পর্ব (৮)- হুমায়ূন আহমেদ

ঐখানে গেলে তােমার ভালই লাগবে। খেলার সঙ্গি-সাথী পাবে । তােমার বড় মামার দুই ছেলে আছে টোকন আর শােভন। ওদের সঙ্গে খেলবে।

অপেক্ষা

এখানে একা একা থাক, তােমার বড় মামা তােমাকে পছন্দও করেন। করেন না ? 

ইমন বুঝতে পারছে না তার বড় মামা তাকে পছন্দ করেন কি-না। তার বড় মামার চেহারাটা রাগি রাগি। চশমা পরেন। চশমার ফাক দিয়ে তাকান। কেমন করে জানি তাকান। তিনি বাসায় এলেই ফুলের গন্ধ পাওয়া যায় । সেই গন্ধে গা কেমন জানি ঝিম ঝিম করে। পরে সে জেনেছে এটা ফুলের গন্ধ না। জর্দার গন্ধ। বড় মামা পান খান না-শুধু শুধু জর্দা খান। তিনি যখনই এ বাসায় আসেন এক প্যাকেট বিসকিট নিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বলেন-ইমন নিয়ে যা। ইমন বিসকিট নিয়ে যায়, কিন্তু তার কোন আনন্দ হয় না, কারণ বিসকিট তার পছন্দ না। শুধু চায়ে ডুবিয়ে বিসকিট খেতেই তার ভাল লাগে। অন্য সময় ভাল লাগে না। বিসকিট খাবার জন্যে কেউতাে আর তাকে চা বানিয়ে দেবে না। সে ছােট মানুষ। কলেজে যখন পড়বে তখনই সে শুধু চা 

খেতে পারবে। 

সুরাইয়া বললেন, কথার জবাব দিচ্ছিস না কেন ? তাের বড় মামা তােকে পছন্দ করে না ? 

মুখ এমন শুকনা করে হু বলছ কেন ? মনে হচ্ছে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। যাও, এখন সামনে থেকে যাও। সারাক্ষণ ভােতা মুখ দেখতে ভাল লাগে না। 

ইমন মা’র ঘর থেকে বের হল। বড় মামার বাড়িতে কি কচ্ছপ দু’টা নিতে দেবে ? মনে হয় দেবে না। কচ্ছপ দু’টা এ বাড়িতেই রেখে যেতে হবে । মা’কে একবার বলে দেখলে হয়। অবশ্যি বললেও লাভ হবে না। বড় মামার ছেলে টোকন আর শােভন হয়ত তার কাছ থেকে কেড়ে কচ্ছপ দু’টা নিয়ে নেবে।

অপেক্ষা পর্ব (৮)- হুমায়ূন আহমেদ

একটা লাভ হয়তাে হবে রাতে মা’র সঙ্গে ঘুমুতে পারবে। তাদের একটা ঘর দেয়া হবে। তারা সবাই সেই ঘরেই থাকবে। এখানে বেশীর ভাগ সময় তাকে ছােট চাচার সঙ্গে ঘুমুতে হয়। সে যখন ঘুমুতে যায় তখনাে ছােট চাচা বাইরে। একা একা ঘুমুতে তার খুবই ভয় লাগে। তবে অনেক রাতে ঘুম ভেঙ্গে যখন সে দেখে ছােট চাচা ঘুমুচ্ছেন তখন তার খুবই ভাল লাগে। সে যদি খুব নরম গলাতেও ডাকে—ছােট চাচা! তাহলেও ছােট চাচা উঠে বসেন, গম্ভীর গলায় বলেন, কি হয়েছেরে হার্ড নাট। বাথরুমে যাবি ? 

‘আয় যাই। ঠিক সময় ডাক দিয়েছিস আমারাে বাথরুম পেয়েছে। ছােটটা। তাের কি বড়টা না-কি ? 

‘আমারও ছােটটা।’ 

‘চল যাই । কে আগে যাবে তুই না আমি? বড় থেকে ছােট না ছােট থেকে বড় ? 

‘তুমি যা বলবে তাই।‘তাহলে তুই বরং আগে যা। কোলে করে নিতে হবে না-কি?’ 

বাথরুম থেকে ফেরার পর ঘুম না আসা পর্যন্ত ছােট চাচা গল্প বলেন। তাঁর গল্পের কোন আগা মাথা নেই, শুরু নেই শেষ নেই। তবু ঘুম ঘুম চোখে শুনতে এত ভাল লাগে । ছােট চাচার সব গল্পই শুরু হয় মাঝখান থেকে 

“তারপর ব্যাঙটা বলল, পানিতে থেকে থেকে আমার সিরিয়াস সর্দি হয়েছে। নাক ঝাড়তে ঝাড়তে অবস্থা কাহিল। অষুধ পত্র কিছু দিয়ে আমাকে বাঁচান ডাক্তার সাহেব। তবে আপনার কাছে একটা রিকোয়েষ্ট তেতাে অষুধ দেবেন না। মিষ্টি অষুধ দেবেন। আবার বেশি মিষ্টিও দেবেন না। অষুধ বেশি মিষ্টি হলে আমার বাচ্চারা মেঠাই ভেবে খেয়ে ফেলবে। 

ডাক্তার বলল, অষুধ দেব। তবে আমি খুবই অবাক হচ্ছি। কারণ ব্যাঙের কখনাে সর্দি হয় না বলে বই পত্রে পড়েছি। আপনার কি সত্যি সর্দি হয়েছে ? 

ক্রমাগত হঁাচ্চো হাজ্জো করছি তারপরেও বিশ্বাস হচ্ছে না?’ ‘তা হচ্ছে। যাই হােক অষুধ দিচ্ছি। ভিজিটের টাকা এনেছেন ? ‘এনেছি। এই নিন আধুলি। আমার শেষ সম্বল- ব্যাঙের আধুলি ।……’ 

অপেক্ষা পর্ব (৮)- হুমায়ূন আহমেদ

বড় মামার বাড়িতে কেউ তাকে এমন অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প শুনাবে না। রাতে বাথরুম পেলে কোলে করে বাথরুমে নিয়ে যাবে না। কি আর করা। বড় মামার বাড়িতেও নিশ্চয়ই অনেক মজার মজার ব্যাপার হবে। কিছু কিছু মজা সব বাড়িতেই থাকে। বড় মামার দুই ছেলে টোকন আর শােভনের সঙ্গে তার হয়ত খুবই ভাব হবে। ওদেরও একটা বােন আছে নাম মিতা, সবাই ডাকে মিতু। তার সঙ্গে ভাব হবে কিনা কে জানে। মনে হয় হবে না। মেয়েদের সঙ্গে হয় মেয়েদের বন্ধুত্ব। ছেলেদের সঙ্গে ছেলেদের। 

গায়ে তেল মাখানাের ব্যাপারটায় সুপ্রভা মনে হয় খুব আরাম পায় । তেল মাখানাের মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়ে। আশ্চর্যের ব্যাপার ঘুমের মধ্যে আবার নাকও ডাকে।

এইটুকু ছােট বাচ্চা নাক ডাকিয়ে ঘুমাবে কেন? তার উপর মেয়ে মানুষ। সুরাইয়ার খুব রাগ লাগে। এখনাে রাগ লাগছে। চড় দিয়ে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। রাগ সামলে সুরাইয়া বারান্দায় গেল। ফিরােজ বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে খবরের কাগজ পড়ছে। তার সামনে গম্ভীর মুখে ইমন বসে আছে। ফিরােজ বলল, কেমন আছেন ভাবী ? 

একই বাড়িতে বাস করছে অথচ দেখা হলে প্রথম বাক্যটি বলছে, কেমন আছেন ভাবী। এর মানে কি এই যে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া আপনি ভাল থাকেন না। 

সুরাইয়া বলল, ফিরােজ তােমার সঙ্গে আমাকিছু জরুরী কথা আছে। ফিরােজ খবরের কাগজ ভাজ করে পাশে রাখতে রাখতে বলল, বলুন।

ইমন উঠে চলে যাচ্ছে। সে জানে বড়রা যখন জরুরী কথা বলে সেখানে ছােটদের থাকার নিয়ম নেই। বড়রা তাদের জরুরী কথার আশে পাশে ছােটদের চায় না। অথচ ছােটদের সমস্ত জরুরী কথায় বড়দের থাকতে হয়। 

অপেক্ষা পর্ব (৮)- হুমায়ূন আহমেদ

সুরাইয়া বেতের মােড়া এনে ফিরােজের সামনে বসল। ফিরােজ শংকিত বােধ করছে। ভাবীর বসার ভঙ্গি কঠিন। ভাবী কি বড় ধরণের ঝগড়ার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে ? কি নিয়ে ঝগড়া করবে ? 

ভাবী চা খাবেন ? চা দিতে বলি—চা খেতে খেতে কথা বলুন। ‘তােমার সঙ্গে আমার এমন কোন কথা নেই যে চা খেয়ে খেয়ে বলতে হবে। ফিরােজ শােন, আমি এখানে থাকব না। আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছি, আমি তার কাছে গিয়ে থাকব।’ 

ফিরােজ বলল, আমি জানি। ইমন আমাকে বলেছে। 

‘তুমি একটা ঠেলাগাড়ি এনে দাও। আমি কিছু জিনিস পত্র নিয়ে যাব। স্টিলের ট্রাংক, ইমনের পড়ার টেবিল-চেয়ার, আমার বড় কালাে ট্রাংকটা। 

কবে যাবেন ভাবী ? 

কবে মানে ? আজই যাব । যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায় ততই ভাল। সবার জন্যেই ভাল । তােমার জন্যেও ভাল, আমার জন্যেও ভাল।’ 

আমার জন্যে ভাল কেন ? ‘তােমার চাকরি বাকরি কিছু নেই, এত বড় সংসার পুষতে হচ্ছে। বাড়ি ভাড়া দিতে হচ্ছে। গ্রামের বাড়ির সম্পত্তি বিক্রি করতে হচ্ছে। তুমি অকারণে এত কিছু করবে কেন ? তুমি কে ? 

ভাবী, আমি ইমনের চাচা। ‘বাপ যখন থাকে না তখন চাচা-ফাচা অনেক দূরের ব্যাপার।’ 

‘আপনার সঙ্গে আমি কোন তর্কে যেতে চাচ্ছি না। তবে আমার মনে হয় এখানে থাকাটাই আপনাদের জন্যে ভাল হবে।’ 

‘কেন ভাল হবে ? 

পরিবেশে অভ্যস্ত হবার ব্যাপার আছে। আপনি এই পরিবেশে থেকে অভ্যস্ত, ইমন অভ্যস্ত। 

অপেক্ষা পর্ব (৮)- হুমায়ূন আহমেদ

‘তুমি জমি বিক্রি করে করে আমাদের খাওয়াবে! ‘া ভাবী। ‘সেটা কতদিন? তােমাদের কি জমিদারী আছে ? 

‘জমিদারী নেই। জমি জমা খুব সামান্যই আছে—ভাবী, আমি ব্যবসা শুরু করেছি। বােতল সাপ্লাইএর কাজ পেয়েছি। সামান্য হলেও কিছু টাকা-পয়সাতাে পাচ্ছি। ব্যবসার নিয়ম কানুন বুঝতে শুরু করেছি—আমার ধারণা আমি ভালই করব।’ 

‘ভাল করলে ভাল। ভাল করতে থাক। কোটিপতি হয়ে যাও। গাড়ি হােক। বাড়ি হােক। তােমরা সুখে থাক। তােমাকে যা বলেছি কর আমাকে একটা ঠেলাগাড়ি এনে দাও।’ 

‘ভাবী শুনুন, মা’র শরীর খুব খারাপ। মা চিকিৎসার জন্যে ঢাকায় আসছেন। মা আসুক তারপর যান। 

‘উনার সঙ্গে আমার যাওয়ার সম্পর্ক কি ? আমি আজই যাব। ‘আচ্ছা ঠিক আছে। 

‘তুমি আরেকটা কাজ করবে- সুপ্রভাকে আমি পালতে পারছি না। তাকে পালক দেবার ব্যবস্থা করবে। 

‘কি বলছেন বুঝতে পারছি না ভাবী। 

‘বাংলাদেশে অনেক ফ্যামিলি আছে যাদের ছেলেপুলে নেই, এমন কোন একটা ফ্যামিলীতে ওকে দিয়ে দাও। সেও সুখে থাকবে আমিও সুখে থাকব। এইসব যন্ত্রনা আমার অসহ্য লাগছে।’ 

“ও আচ্ছা। 

‘মেয়েটা হয়েছে অপয়া ও পেটে আসার পর থেকে যত সমস্যা। আমার আর ভাল লাগে না। 

‘ভাবী আপনি-আজই যাবেন?’ 

‘ইমনের স্কুলতাে অনেক দূর হয়ে যাবে, স্কুল থেকে ওকে আনা নেয়া কে করবে ? 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *