অপেক্ষা পর্ব (৯)- হুমায়ূন আহমেদ

‘জানি না। স্কুল বদলে দিব কিংবা ঘরে বসে থাকবে-বাপ নেই ছেলের আবার স্কুল কিসের? তার কি পড়াশােনা হবে ? হবে না। বড় হয়ে ইট ভাঙ্গবে কিংবা রিকশা চালাবে।

অপেক্ষা

সুপ্রভার ঘুম ভেঙ্গেছে। কাঁদতে শুরু করেছে। সুরাইয়া উঠে চলে গেল। ফিরােজ বসে রইল । পত্রিকা পড়া হয়নি। এখন আর পড়তে ইচ্ছে করছে না। ভাবী যখন চলে যাবে বলে ঠিক করেছে তখন যাবেই। তাকে বুঝানাের কেউ নেই। সে কারাে কথা শুনবে না।

ইমন ছােট ছােট পা ফেলে আসছে। ছােট চাচার দিকে একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল। ফিরােজ হাত ইশারায় কাছে ডাকল। ইমন আসছে কিন্তু অন্য দিকে তাকিয়ে এগুচ্ছে। একবারাে তার চাচার দিকে তাকাচ্ছে না। ছেলেটা অদ্ভুত হয়েছে। অদ্ভুত কিন্তু অসাধারণ। 

‘খবর কিরে ব্যাটা হার্ড নাট ? 

ভাল।’ ‘বড় মামার বাড়িতে চলে যাচ্ছিস তাহলে ? 

গুড । যাবার সময় কাঁদবি নাতাে ? না।’ 

‘ভেরী গুড । বােকা ছেলেরাই কাদে বুদ্ধিমানরা কাদে না । তুই বােকা না বুদ্ধিমান ? 

‘জানি না।’ 

‘আয় পরীক্ষা করে দেখি- বােকা না, বুদ্ধিমান। কোলে এসে বােস। আমি তাের চুলে বিলি কেটে কেটে আদর করব । তখন যদি কেঁদে ফেলিস তখন বুঝব তুই বােকা। আর না কেঁদে থাকতে পারলে বুদ্ধিমান।’ | ইমন গুটিসুটি মেরে তার চাচার কোলে বসে আছে। তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে চোখের পানি আটকানোের, কোন লাভ হচ্ছে না। চোখ ভর্তি করে পানি আসছে সে সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছে ফেলছে। ছােট চাচার কাছে সে বােকা প্রমাণিত হচ্ছে এই দুঃখবােধেও সে আক্রান্ত তবে সে জানে না—ছােট চাচাও তারমতই বােকা । ছােট চাচার চোখও ভিজে উঠছে। পানি জমতে শুরু করেছে। 

হার্ড নাট! 

‘যেখানেই থাকিস, যে ভাবেই থাকিস—ভাল থাকবি। ‘আচ্ছা।’ ‘কোন কিছু নিয়েই মন খারাপ করবি না।’ “আচ্ছা।’ ‘গল্প শুনবি ? 

‘একদেশে ছিল এক ব্যাঙ। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ বেচারার সর্দি লেগে গেল। সর্দি এবং কফ। সারাদিন নাক ঝাড়ে আর খক খক করে কাশে। ব্যাঙের স্ত্রী বলল, “ওগাে ডাক্তারের কাছে যাও। তােমার কাশির শব্দে বাচ্চারা ঘুমুতে পারছে না।” ব্যাঙ বলল, ডাক্তারের কাছে যে যাব ভিজিটের টাকা লাগবে না ? তার স্ত্রী বলল, “আধুলীটা নিয়ে যাও।” ব্যাঙ বলল, আধুলীটাই আমাদের শেষ সম্বল সেটা নিয়ে যাব ? | হ্যাঁ যাও। শরীরটাতাে আগে দেখবে। টাকা গেলে টাকা পাওয়া যায়। শরীর গেলে কি আর পাওয়া যায় ? 

ব্যাঙ বলল, বউ কথাটাতাে ভালই বলেছ। আচ্ছা যাই ডাক্তারকে বরং দেখিয়েই আসি।। 

ব্যাঙের স্ত্রী বলল, “ব্লাড প্রেসারটাও একটু চেক করিও। আমার ধারণা তােমার প্রেসারও বেড়েছে। কাল রাতে বৃষ্টির সময় তুমি যখন ডাকছিলে তখন তােমার গলা কেমন যেন অন্য রকম শুনাচ্ছিল।” 

ছােট চাচা দম নেবার জন্যে থামতেই ইমন বলল, বাবা কি আর ফিরে আসবে না চাচা ? 

বুঝতে পারছি না। ধরে নে ফিরে আসবে না। তাহলে কষ্ট কম পাবি। ফিরে আসবে ভেবে অপেক্ষা করছিস মানুষটা ফিরছে না—কষ্ট বেশী না ? 

‘তাের মা সারাক্ষণ ভাবছে—এই বুঝি মানুষটা ফিরল। রাতে ঘুমায় না। জেগে থাকে, গেটে সামান্য শব্দ হলে ছুটে আসে—এই অবস্থাটাতাে ভয়ংকর। 

সুপ্রভা খুব কাঁদছে। সুরাইয়া মেয়ের কান্না থামানাের কোন চেষ্টা করছে। । কাঁদুক। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে এক সময় নিজেই থেমে যাবে । সে যখন কাদে তখনতাে কেউ তার কান্না থামাতে আসে না। সে কেন যাবে ? তার এত কি দায় পড়েছে ? 

পৌষ মাস। প্রচণ্ড শীত পড়েছে। শীতের সঙ্গে কুয়াশা। ইমন বসে আছে তার বড় মামার বাড়ির দোতলার বারান্দায়। সে অবাক হয়ে দেখছে কুয়াশায় সব ঢেকে আছে। একটু দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। বাড়ির সামনে কাঁঠাল গাছটাকে মনে হচ্ছে ছােট একটা পাহাড়। তার ছােট চাচা বলেছিলেন কুয়াশা আসলে মেঘ। আকাশের মেঘ যখন মাটিতে নামে তাকে বলে কুয়াশা। ইমনের খুব অদ্ভুত লাগছে এই ভেবে যে সে মেঘের ভেতর বসে আছে। আজ ছুটির দিন, তার বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকার কথা না। ছুটির দিনের সকাল বেলায় এই বাড়িতে নানান ধরণের খেলা হয়। টোকন আর। শােভন টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট খেলে। টোকনের খুবই কাঁদুনে স্বভাব । কিছু হতেই কান্না শুরু করে। আর শােভন মারামারিতে ওস্তাদ।

হুট করে মারামারি শুরু হয়ে যায়। শােভন ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে ধমাধম ভাইকে মারে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে কেউ কখনাে নালিশ করে না। মারামারি এবং কান্নাকাটি কিছুক্ষণের মধ্যে থেমে যায় । আবার খেলা শুরু হয়। মিতু একা একা রান্না বাটিখেলে। ক্রিকেট খেলায় তাকে নেয়া হয় না, মিতুও রান্নাবাটি খেলায় তাকে নেয় না। একদিন শুধু বলেছিল, এই তুই চাকর হবি ? তুই চাকর হলে খেলতে নেব। যা বাজার করে নিয়ে আয়। মনে করে কাঁচা মরিচ আনবি। আর খবর্দার পয়সা সরাবি না। | ইমনের খেলতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু চাকর হওয়াটা মেনে নিতে পারছিল 

বলে খেলে নি। তবে না খেললেও সে বেশির ভাগ সময় আশে পাশে ঘুর ঘুর করে। | আজ ইমন এখনাে নিচে নামছে না কারণ নিচে নামিয়ে নেয়ার জন্যে মিতু আসেনি। বড় মামার বাড়ির দোতলার সিঁড়ি পুরােপুরি শেষ হয় নি। রেলিং দেয়া বাকি। এ রকম সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে ইমনের অসম্ভব ভয় লাগে। মিতু বয়সে তার সমান হলেও, ঠিক সমানও না, পাঁচ দিনের বড়। ভয়ংকর সাহসী । একবার সে চোখ বন্ধ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠেছিল । মিতু শুধু যে চোখ 

বন্ধ করে সিড়ি দিয়ে উঠতে পারে তাই না। তিন তলার ছাদে পা ঝুলিয়ে বসতেও পারে। সেই ছাদেরও রেলিং নেই। ইমনের বড় মামা ছাদে রেলিং দেবেন না। শুধু শুধু বাজে খরচ । ইমনের ধারণা বাজে খরচ হলেও রেলিং দেয়া উচিত। তা না হলে কোন একদিন মিতু ছাদ থেকে পড়ে যাবে। ইমনের ধারণা দোতলার সিঁড়িতেও রেলিং দেয়া উচিত। রেলিং দেয়া না হলে সে নিজেই কোন একদিন পড়ে যাবে । 

ইমন!’ 

ইমন চমকে উঠে দাঁড়াল। মা ডাকছেন। আগে মা ডাকলেই আনন্দ হত, এখন হয় না। মা’র ডাকা মানেই কিছু একটা নিয়ে ধমকা ধমকি হবে। ধমক খাবার মত কিছু অবশ্যি সে করেনি। সকালে বই নিয়ে বসে অনেকক্ষণ পড়েছে। মা যখন বললেন, যথেষ্ট ঘ্যানঘ্যানানি হয়েছে এখন যাও। তখনি শুধু সে উঠে এসেছে। 

ইমন ভয়ে ভয়ে মা’র ঘরের দরজা ধরে দাড়াল। মা’র রাতে জ্বর ছিল, এখনাে বােধ হয় জ্বর। মা শুয়ে আছেন। সুপ্রভা মা’র পাশে বসে নিজে নিজেই খেলছে। ইমনের কাছে খুবই আশ্চর্য লাগে যে সুপ্রভা নিজে নিজে বসতে পারে। হামাগুড়ি দিতে পারে। কিছু দেখলেই দু’হাতের দুই আঙুল উচু করে বলে—“যে যে যে।” মানুষ কাউকে কিছু দেখাতে চাইলে এক আংগুল দিয়ে দেখায়- সুপ্রভা দু’হাতের দু’আংগুলে দেখায়। এটাও তার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়। 

সুপ্রভা ইমনকে দেখা মাত্র দু’হাতের দুই আংগুল উঁচু করে তাকে দেখাল এবং ক্রমাগত বলতে লাগল, যে যে যে। 

সুরাইয়া বলল, কোথায় ছিলি ? ইমন ভীত গলায় বলল, বারান্দায়। 

রান্নাঘরে গিয়ে বলতাে আমাকে চিনি দুধ ছাড়া লিকার দিয়ে এক কাপ চা দিতে। লেবু যেন না দেয় । চায়ের মধ্যে লেবুর গন্ধ —-অসহ্য।’ 

‘তােমার জ্বর কমেছে মা ? 

সুরাইয়া বিরক্ত গলায় বলল, আমার জ্বরের খবর তােকে নিতে হবে না । যা করতে বলছি কর। তাের গলা খালি কেন ? মাফলার যে একটা দিয়েছিলাম সেটা কই ? ঠাণ্ডা লাগিয়ে রাতে যদি খুক খুক করে কাশিস তাহলে গলা চেপে ধরব। তখন বুঝবি কত ধানে কত চাল। যা এখন সামনে থেকে। 

ইমন দোতলা থেকে এক তলায় নামছে। নামতে গিয়ে সে লজ্জায় মরে যাচ্ছে কারণ সে নামছে বসে বসে। কেউ দেখলেই হাসবে। বিশেষ করে মিতু যদি দেখে তাহলে সর্বনাশ হবে। খুব হাসাহাসি করবে। এম্নিতেই মিতু তাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করে। তাকে ডাকে ক্যাবলা বাবা। এই অবস্থায় দেখে 

ফেললে হয়ত আরাে ভয়ংকর কোন নামে ডাকবে। 

ইমন ঠিকমতই নামল। কেউ তাকে দেখল না। রান্নাঘরে বুয়াকে চায়ের কথা বলল। বুয়া বিরক্ত গলায় বলল, “আমার হাত বন্ধ, এখন চা দেওন যাইব 

বুয়ার কথা শুনে ইমনের ভয় ভয় লাগছে। বুয়া যদি চা না পাঠায় মা বুয়ার উপর রাগ করবে না তার উপরই রাগ করবে। চড় মারবে বা চুলে ধরে ঝাঁকুনি দিবে। ইমন বিড় বিড় করে বলল, বুয়া মার খুব জ্বর। সকালে কিছু খায়নি—এই জন্যে চা চাচ্ছে। দুধ-চিনি-লেবু ছাড়া শুধু লিকার । 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *