রেনু ঠিক করেছিল, ব্লেড দিয়ে হাতের রগ কেটে স্যুইসাইড করবে। এই প্রজেক্ট মনে হচ্ছে বাতিল। সে আনন্দে আছে। একটু আগে নিজের হাতে কফি বানিয়ে খেয়েছে। রেনু ব্লেড দিয়ে হাতের রগ কাটতে চাচ্ছিল? জি। ব্লেড আমি কিনে দিয়ে এসেছিলাম।তুমি কিনে দিয়ে এসেছিলে? জি। জানতে পারি কেন?
আমি সবসময় চাই, সবাই যেন তাদের পরিকল্পনা কার্যকর করতে পারে। অন্যের পরিকল্পনায় সাহায্য করাকে আমি মানবিক ধর্ম মনে করি। তোমার মানসিক সুস্থতা বিষয়ে আমার সন্দেহ হচ্ছে। এটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। একজন মহান দার্শনিক বলেছেন—‘তুমি নিজেকে যা মনে করো তুমি তাই। তুমি যদি নিজেকে মহাপুরুষ ভাব তুমি মহাপুরুষ। আর তুমি যদি নিজেকে পিশাচ ভাব তুমি পিশাচ।’ যে মহান দার্শনিক এই কথা বলেছেন তাঁর নাম জানতে পারি?
তিনি আমার বাবা। মহাপুরুষ বানাবার তিনি একটি স্কুল খুলেছিলেন। তিনি একটি স্কুল চালাতেন। আমি সেই স্কুলের ছাত্র। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে গ্র্যাজুয়েশনের আগেই বাবা মারা গেলেন। দয়া করে চুপ কর, আর কিছু জানতে চাচ্ছি না। খাবার খবরটা কী? খারাপ খবর হলো—আপনার রিলিজ পেতে একটু দেরি হবে। যিনি আপনাকে রিলিজ করবেন, তিনি রাস্তার ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়েছেন। গাড়ি ভাংচুর হচ্ছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তিনি যে গাড়িতে আছেন সেটা ভাঙা হবে। গাড়ি ভাঙচুর হচ্ছে কেন?
আজ হিমুর বিয়ে-পর্ব-৭
আমাদের এখানে গাড়ি ভাঙচুর করতে কারণ লাগে না। যে-কোনো কারণে মেজাজ খারাপ হলে আমরা প্রথম যে কাজটা করি সেটা হচ্ছে গাড়ি ভাঙচুর। আমি এক্ষুনি খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি—গাড়ি ভাঙচুরের অবস্থা কী? তোমাকে কোনো খোঁজ নিতে হবে না।আমি উনার আপত্তি অগ্রাহ্য করেই খালু সাহেবকে টেলিফোন করলাম। তাঁর টেলিফোন ব্যস্ত। অনেক টেপাটিপি করে তাঁকে পাওয়া গেল। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, কী চাও?
আমি আগ্রহের সঙ্গে বললাম, আপনার গাড়ি তো পাওয়া গেছে। খালু সাহেব বললেন, পুলিশ তাই জানিয়েছে। কোথায় গেছে, গাড়িচোর ধরা পড়ল কি-না কিছুই না বলে টেলিফোন রেখে দিল। এরপর থেকে কতবার যে টেলিফোন করলাম—কেউ টেলিফোন ধরে না। খালু সাহেব, গাড়িচোর ধরা পড়েছে। সে হাজতে আছে।বদমাইশ মকবুলটা কি ধরা পড়েছে? না। পুলিশ তার দিকে ধাওয়া করার আগেই সে এক দৌড়ে হাওয়া।গাড়ি আছে কোথায় জানো?গাড়ি আছে ধানমণ্ডি থানায়। ওসি সাহেবের নির্দেশে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুল-টুল দিয়ে গাড়ি সাজানো হবে।ফুল দিয়ে গাড়ি সাজানো হবে মানে? বরের গাড়ি, না সাজালে কি হয়? বর তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে এই গাড়িতে করেই যাবে।বর মানে? বরটা কে?
এত তাড়াতাড়ি সব ভুলে গেলেন? বর আমি। হিমু, Enough is enough. জি আচ্ছা। তুমি কখনো আমার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। কখনো না। সরাসরি দেখা তো করতে পারব? তাও পারবে না। বিয়ের পর আমরা স্বামী-স্ত্রী কি আপনাকে কদমবুসিও করব না?
আজ হিমুর বিয়ে-পর্ব-৭
তুমি কোনো একটা খেলা নিয়ে মেতেছ। বিশেষ কোনো খেলা খেলছ। আমি তোমার খেলায় নেই। জি আচ্ছে। মনে রেখো, টেলিফোনে সরাসরি আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করবে না। আপনি যদি টেলিফোন করেন তখন কি ধরব? আমি তোমাকে নিশ্চিত করছি—কখনো তোমাকে টেলিফোন করব না। Never ever. তোমার খালা এবং আমি ভিন্ন ব্যক্তি। দুইজন দুই গ্রহে বাস করি। তোমার খালা অকারণে তোমাকে দিনের মধ্যে একশবার টেলিফোন করবে। কারণ তার টেলিফোনে কথা বলার ব্যাধি আছে। আমার নেই। এটা তোমার সঙ্গে আমার শেষ সংলাপ। আর তোমার সঙ্গে কথা হবে না।
খালু সাহেবম আমার ধারণা কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি আবার আমাকে টেলিফোন করবেন। আমি সেই টেলিফোন ধরব না। কিন্তু আপনি করতেই থাকবেন। করতেই থাকবেন। Stupid! খালুসাহেব, Stupid শব্দের উৎপত্তি কি আপনি জানেন? সর্বপ্রথম এই শব্দ ব্যবহার করা হয় অ্যাথেন্সবাসীদের প্রতি। সমগ্র অ্যাথেন্সবাসীকেই Stupid বলা হয়েছিল, কারণ তারা গণতান্ত্রিক কার্যক্রমে অংশ নেয় নি।
চুপ ফাজিল! ফাজিল শব্দের অর্থ জানলে আপনি আমাকে এই গালি দিতেন না। এটা আরবি ভাষার একটা শব্দ। এর অর্থ জ্ঞানী। খালুসাহেব লাইন কেটে দিলেন। এই কাজটা তাঁর আরো আগেই করা উচিত ছিল। এতক্ষণ কেন করলেন না কে বলবে! আমি কম্বল মোড়া ডেডবডির দিকে তাকিয়ে খালু সাহেবের টেলিফোনের অপেক্ষা করছি। তিনি টেলিফোন করলেন না। মাজেদা খালা করলেন।
আজ হিমুর বিয়ে-পর্ব-৭
হ্যালো খালা! হ্যালো। কী জন্যে টেলিফোন করেছি ভুলে গেছি। অথচ তোর সঙ্গে জরুরি কথা ছিল। জরুরি কথা বলার জন্যে চুলায় গরুর মাংস রেখেই চলে এসে টেলিফোন করলাম—এখন কিছুই মনে পড়ছে না। কী করি বল তো?আমি বুদ্ধি করে কথাটা তোমার মাথার ভেতর থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারি। চেষ্টা করব?
কর। কেউ একজন তোমাকে এমন কিছু বলছে তা তোমার আমাকে বলার কথা। সেই কেউ একজন তোমার তেমন পরিচিত না পরিচিত হলে নাম মনে পড়ত…। থাক থাক আর বলতে হবে না। এখন সব মনে পড়েছে। রেনুর মা টেলিফোন করেছিলেন। তোকে চাচ্ছিলেন। রেনুর বাবা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলেন। তোর তাঁকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসার কথা।
নিয়ে তো এসেছি।
উনি কোথায়?
উনি হাজতে।
হাজতে মানে?
পুলিশ চুরির অপরাধে তাঁকে হাজতে ঢুকিয়ে দিয়েছে। উনার পেয়েছে বাথরুম। এখনো বাথরুমে যাবার সুযোগ পান নি। শাদা চামড়া হিসেবে পুলিশ যে extra খাতির করবে, তা করছে না। কী আবোলতাবোল বকছিস? আবোলতাবোল হলেও যা বলছি সবই সত্যি। তুমি মনে করে দেখ তো—আমি কিখনো এমন কিছু বলেছি যা পরে দেখা গেছে সেটা মিথ্যা?
আজ হিমুর বিয়ে-পর্ব-৭
উনি কার গাড়ি চুরি করেছেন? খালু সাহেবের গাড়ি। তবে উনি সরাসরি চুরির সঙ্গে যুক্ত না। উনি পাকচক্রে ধরা খেয়েছেন। তোর খালু সাহেব কি ঘটনা জানে? না। তুই নিজে কোথায়? আমিও হাজতে। খালা টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। মনে হয় অধিক শোকে লোহা, পাথরের চেয়েও কঠিন। তোকে আল্লার দোহাই লাগে, সত্যি কথা বল।আমি সত্যি কথাই বলছি। তুমি কি ফার্গুসেন জুনিয়রের সঙ্গে কথা বলবে?
খালা কিছু বললেন না। আমি টেলিফোন ফার্গুসেনের দিকে বাড়িয়ে বললাম, একটু কথা বলুন তো। ওপাশে আমার মাজেদা খালা। বলুন, হ্যালো মাজেদা। হাউ আর ইউ।ফার্গুসেন যন্ত্রের মতো বললেন, হ্যালো মাজেদা। হাউ আর ইউ। যা ভেবেছিলাম তাই হচ্ছে। খালু সাহেবের টেলিফোন আসতে শুরু করেছে। একের পর এক আসছে, আমি কেটে দিচ্ছি। মানুষটা রাগে চিড়বিড় করছে ভেবে আনন্দ পাচ্ছি। আমার আনন্দ পাবার জন্যে আরেকজনকে রাগে ছটফট করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে সমান। অংকের ভাষায়—
আনন্দ = f(x, y, z)
x = কষ্ট, y = বেদনা, z = দুঃখ
দুঃখ = বেদনা
আনন্দ – f(x, y, z) = 0
একজন ম্যাসাজম্যান গা টিপে অন্য একজনকে শারীরিক আরাম দিচ্ছে। অন্য একজনকে এই আরাম দেয়ার জন্যে ম্যাসাজম্যানদে শারীরিক কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে।কম্বলে মুড়ি দেয়া মৃতদেহ নড়ে উঠল। কম্বলের ফাঁক দিয়ে ছোট্ট একটা মুখ বের হয়ে এলো। ডারউইন সাহেবের থিওরি যে সত্যি তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অবিকল বেবুনের মতো মুখ। চিকচিক করার বদলে সে আনন্দিত গলায় চেঁচিয়ে উঠল, হিমু ভাই, আমারে চিনেছেন? আমি ক্ষুর আসলাম। চিনেছি।
আজ হিমুর বিয়ে-পর্ব-৭
র্যাবের হাতে ধরা খাইছি। প্রথমে ভাবছি ক্রসফায়ারে ফেলব। মতলব সেই রকমই ছিল। চাইপ্যা পায়ে ধরনের কারণে মাফ পাইছি।ক্ষুরের কাজ কি চালিয়ে যাচ্ছ? আপনে আমারে একবার ডলা দিলেন, এরপর থাইকা ক্ষুর অফ। এখন ঠগবাজি করি। একদিনে তো ভালো মানুষ হওয়া যায় না। ধাপে ধাপে হইতেছি। খারাপ একদিনে হওয়া যায়, ভালো হইতে টাইম লাগে। আপনের পাশে এই শাদা বান্দরটা কে?
প্রফেসর। ইংরেজির প্রফেসর।প্রফেসর সাবও ধরা খাইছে! শান্তি পাইলাম। কেউ বিপদে পড়ছে দেখলে এমন শান্তি পাই। এর কারণটা কী হিমু ভাই? এর কারণ হচ্ছে, তোমার মতোই একজন পৃথিবীতে আছে যে কাউকে বিপদে পড়তে দেখলেই কষ্ট পায়। তুমি হচ্ছ এ পজেটিভ আর ঐ লোক হচ্ছে এ নেগেটিভ। দুইয়ে যোগফল শূন্য। বুঝেছ?
অবশ্যই বুঝেছি—যত ভালো তত মন্দ। হিমু ভাই, এই শাদা চামড়াটার পাছায় একটা লাথি মারতে ইচ্ছা করতাছে। মারতে ইচ্ছা করলে মারো।ডা. ফার্গুসেন ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। তিনি প্রতিটা বাংলা বাক্য বুঝতে পারছেন, কাজেই আমার দিকে বিস্মিত হয়ে তাকানোর অধিকার তাঁর আছে। আচ্ছা বিস্মিতের বিপরীতটা কী?
ভালোবাসা ঘৃণা
রাগ শান্তি
দুঃখ আনন্দ
বিস্ময়ের উল্টাটা কী? ভাবলেশহীন।বিস্মিত চোখের বিপরীত কি ভাবলেশহীন চোখ?ফার্গুসেন আমার দিকে তাকিয়ে ভীত গলায় বললেন, এ কে?
আজ হিমুর বিয়ে-পর্ব-৭
আমি বললাম, স্যার এর নাম আসলাম। ক্ষুরের কাজের বিশেষ নৈপুণ্যের জন্যে তাকে এখন সবাই চিনে ক্ষুর আসলাম হিসেবে। ক্ষুর এখন তার টাইটেল। ক্ষুরের কাজ মানে কী? ক্ষুরের প্রধান কাজ দাড়িগোঁফ কামানো, মাথা কামানো, তবে আসলাম অন্য কাজে ব্যবহার করত। ছিনতাইয়ের সময় সে পেটের ভিতর ক্ষুর ঢুকিয়ে দিত।কেন?
ঐটাই তার আনন্দ।ফার্গুসেন চোখ বড় বড় করে ক্ষুর আসলামের দিকে তাকালেন। আসলাম হেসে ফেলল। হ্যাণ্ডশেকের জন্যে ফার্গুসেনের দিকে হাত বাড়াল। ভদ্রলোক ভয়ে আঁতকে উঠলেন। আসলাম বলল, আপনে বাংলা ভাষা ভালো জানেন, এই জন্যে হ্যাণ্ডশেক করতে চাই। আমার মায়ের ভাষা যে জানে আমার কাছে তার ভালো কদর।
ফার্গুসেনকে হ্যাণ্ডশেক করতে হলো। তাঁর চোখে রাজ্যের বিভীষিকা। ক্ষুর আসলাম ফার্গুসেনের দিকে ঝুঁকে এসে বলল, ক্ষুরের কাজ করলেও আমার মধ্যে ধর্ম ছিল। কোনো মেয়েছেলের পেটে ক্ষুর ঢুকাই নাই।হাজতের দরজা খোলা হচ্ছে। দরজার ওপাশে ওসি সাহেব কঠিন চোখে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন।হিমু!জি স্যার।এই বার আমি তোমাকে ছাড়ব না। আমার সন্তানের কসম, তোমার শেষ দেখে নিব।মেরে ফেলবেন?
ওসি সাহেব কুইনাইন ট্যাবলেট মুখে দিয়ে আছেন এমন ভঙ্গি করে পাশে দাঁড়ানো কনস্টেবলকে বললেন, হ্যাণ্ডকাফ দিয়ে একে আমার কাছে নিয়ে আসো।কম্বল জড়িয়ে শুয়ে থাকা ক্ষুর আসলাম বলল, ওসি সাব, হিমু ভাইয়ের কিছু হইলে আপনেরে কিন্তু কাঁচা খাইয়া ফেলামু। ওসি সাহেব নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, ক্ষুর আসলামকে আরেক দফা মাইর দেও।
আজ হিমুর বিয়ে-পর্ব-৭
আমি এবং ড. ফার্গুসেন ওসি সাহেবের খাস কামরায় বসে আছি। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি মাইক্রোওয়েভ ওভেনের ভেতর বসে আছেন। তাঁর শরীরে যত পানির অণু আছে সব কয়টা একসঙ্গে উত্তাপে ছটফট করছে। বড় করে হা করলে তাঁর মুখ দিয়ে আগুন বের হবে বলে আমার বিশ্বাস। তিনি বললেন, তুমি এই প্যাঁচটা কেন লাগিয়েছে? একজন সম্মানিত আমেরিকান সিটিজেনকে হাজতে ঢুকিয়েছ?
আমি বললাম, হাজতে তো আমি ঢুকাই নি। পুলিশ ঢুকিয়েছে।তুমি ব্যবস্থা করেছ। আমি থানায় উপস্থিত থাকলে এই ঘটনা ঘটতে দিতাম না। এখন আমার চাকরি যায় যায় অবস্থা। কোন কোন জায়গা থেকে আমার কাছে টেলিফোন এসেছে এটা জানো? অ্যাম্বেসি থেকে যে একটা এসেছে তা বুঝতে আপ্রছি।ওসি সাহেব বললেন, আমার তো মাথাতেই আসছে না সেকেণ্ড অফিসার কী করে কোনো খোঁজখবর না নিয়ে একজন আমেরিকান সিটিজেনকে হুট করে ঢুকিয়ে দিল?
আমি বললাম, আমেরিকান সিটিজেনকে হাজতে ঢুকানো যাবে না এমন তো কোনো আইন নেই। ওরা অনেক বাঙালিকে কি হাজতে ঢুকায় না? তাদের মধ্যে অনেকেই থাকে নিরপরাধী, ঘটনার শিকার। ড. ফার্গুসেনও ঘটনার শিকার হয়েছেন, আর কিছু না।হাজত থেকে বিকট চিৎকার ভেসে আসছে। মনে হয় ক্ষুর আসলাম্মকে বানানো হচ্ছে। ওসি সাহেব তাঁর দরজা ভিড়িয়ে দিলেন। তিনি ভদ্রলোক মানুষ। ভদ্রলোকরা অন্যের আর্তনাদ সহ্য করতে পারেন না।
আজ হিমুর বিয়ে-পর্ব-৭
হিমু, এখন তুমি ঝেড়ে কাশবে। যদি ঝেড়ে না কাশ, আমি কাশির ব্যবস্থা করব। আমি পয়েণ্ট বাই পয়েণ্ট আগাচ্ছি। তুমি গাড়ি চুরি করছ কেন? আজ আমার বিয়ে। গাড়িতে করে বিয়ে করতে যাব বলে গাড়ি চুরি করেছি। এই গাড়ি যার সেখানেই আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। কনে ঐ বাড়িতে। কোনো গাড়িচোর নিশ্চয়ই এক কাজ করবে না। যার গাড়ি তাকে তুমি চনে?
উনি আমার খালু হন। অবশ্যই চিনি। তিনি এক দামি গাড়ি আমাকে বিয়েতে ব্যবহার করতে দেবেন না—তাই তাঁকে না বলে নিয়েছি। তোমার কথার আগামাথা কিছুই মেলাতে পারছি না। তুমি কাকে বিয়ে করছ? ড. ফার্গুসেনের মেয়েকে। এই আমেরিকানের মেয়ে? জি। উনি ড. ফার্গুসেন, ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক।তার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে তোমার সঙ্গে?
ইয়েস স্যার। আপনার এবং পারুল ভাবি দু’জনেরই বিয়েতে দাওয়াত।ক্ষুর আসলামকে যদি বরযাত্রী হিসেবে নিতে পারি খুবই খুশি হবো। দাঁড়াও তোমার খুশি আমি বের করছি। বরযাত্রী যেতে না চাইলে তো জোর করে নিতে পারব না। শুধু যদি ফুল টুল দিয়ে গাড়িটা সাজাবার ব্যবস্থা করে দেন। গাড়ি সাজানোর টাকা আমি দিতে পারছি না। হাত খালি। শুধু হাত খালি না, হাপ-পা সবই খালি। ওসি সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, তোমাকে আমি এমন শিক্ষা দেব যে জীবনে কখনো প্যাঁচ খেলা খেলবে না। প্যাঁচ খেলা আমি পছন্দ করি না। যে-ই প্যাঁচ খেলবে তারই আমি চৌদ্দটা বাড়িয়ে দেব।
আজ হিমুর বিয়ে-পর্ব-৭
স্যার পারবেন না। আসল প্যাঁচ যিনি খেলেন তাঁকে God বলা হয়। উনি যখন খেলাটা দেখান, তখন বিস্মিত হয়ে আমাদের খেলা দেখতে হয়।ওসি সাহেব চুপ করে গেলেন। God-এর প্যাঁচখেলা কথাটায় তিনি সামান্য থমকে গেছেন।আমি বললাম, স্যার, আর একটা কথা বলি? চুপ! কোনো কথা না।খালু সাহেবের গাড়িটা সুন্দর করে ফুলটুল দিয়ে সাজিয়ে দিলে আপনার জন্যে শুভ হবে। কারণ বরযাত্রী যে থানা থেকে যাবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।ওসি সাহেব ফার্গুসেনকে বললেন, এই ছেলের কথা কি সত্যি?
ফার্গুসেন বললেন, কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা সব এলোমেলো হয়ে গেছে। আমি খুব খুশি হবো আপনি যদি আমাকে এক কাপ কফি খাওয়াতে পারেন।ওসি সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। সম্ভবত কফির ব্যবস্থা করতে।ওসি সাহেবের বিদায় এবং খালু সাহেবের প্রবেশ একই সঙ্গে হলো। তিনি এখন তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তাঁর চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে। তাঁর চোখের এক ফুটের কাছে দেয়াশলাইয়ের কাঠি ধরলে অবশ্যই সেই কাঠি জ্বলে উঠবে।ফার্গুসেন আনন্দিত গলায় বললেন, হ্যালো।
বন্ধুর গলার হ্যালো তাঁকে স্পর্শ করল না। তিনি আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। এর মধ্যে ওসি সাহেবও চলে এসেছেন। তাঁর দৃষ্টি খালু সাহেবের দিকে। আমি বললাম, খালু সাহেব চা খাবেন? এরা লেবু চা খুব ভালো বানায়। খালু সাহেব বড় করে নিঃশ্বাস নিলেন। ফার্গুসেনের দিকে এক পলক তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন ওসি সাহেবের দিকে। চোখমুখ কুঁচকে বললেন—এই গাড়িচোরটার শরীরের প্রতিটি হাড্ডি কি মেরে পাউডার বানানো সম্ভব? খরচ আমি দেব। যে গাড়িটা আপনারা উদ্ধার করেছেন সেটা আমার গাড়ি।ওসি সাহেব বললেন, প্রপার ট্রিটমেণ্ট দেয়া হবে। আপনি এই বিষয়ে চিন্তা করবেন না। আমার ড্রাইভার মকবুল কি ধরা পড়েছে?
আজ হিমুর বিয়ে-পর্ব-৭
এখনো ধরা পড়ে নাই, তবে পড়বে। তার বাড়িতে পুলিশ চলে গেছে। খালু সাহেব আরামের নিঃশ্বাস ফেললেন।ওসি সাহেবের খাস কামড়ায় এখন আমরা তিনজন। খালু সাহেব এবং তার বন্ধু চেয়ারে বসেছেন। আমি দাঁড়িয়ে আছি। মূল নাটক শেষ হয়ে গেছে। নাটকের পাত্রপাত্রীরা কে কোথায় যাবে তা নির্দেশক ঠিক করবেন। জীবননাটকের নির্দেশক একেক সময় একেকজন হন। এখন থাকার ওসি সাহেব। তিনি এই মুহূর্তে চূড়ান্ত ব্যস্ত। উপর থেকে বিশেষ কেউ টেলিফোন করেছে। ওসি সাহেবকে প্রতি সেকেণ্ডে একয়াব্র করে—‘স্যার, ইয়েসে স্যার, অবশ্যই স্যার’ বলতে হচ্ছে।
Read more