নভেম্বরের শেষের দিক। পুনে থেকে কলকাতা যাচ্ছি দুরন্ত এক্সপ্রেসে। ছত্তিশগড়ের প্রত্যন্ত সব ছেঁড়াখোড়া গ্রামগুলোর পাশ দিয়ে সকালের ট্রেন দৌড়চ্ছে। একটা ঘরের সামনের দাওয়াতে এক বুড়ি সকালের রোদের তাপ নিচ্ছে। দূর থেকে একটু আব্দুলের মায়ের মতন দেখতে।
আব্দুলের মা আর শোলুর মা আমাদের মামার বাড়ির ধান-কূটনী ছিল। সবুজ রঙের সরু নীল-পাড় মোটা শাড়ি পড়ত, সাথে গাঢ় সবুজ বা নীল রঙের বুশশার্ট এর মতন জামা, যেটাকে কোনমতেই ব্লাউজ বলা যেত না। তার আবার পেটের কাছে সামনের দুদিকে দুটো পকেট, যেখানে ওরা বিড়ি, দেশলাই রাখত আর কিছু টুকটাক জিনিস। অন্য কোনো রঙের জামাকাপড়ে ওদের কখনও দেখিনি। জমির ধান ওঠার পর ওরা আমাদের বাড়ী থেকে রোজ এক বস্তা করে মাথায় চাপিয়ে নিয়ে যেত। আবার কয়েক দিন পরে সেই বস্তাতেই সেই ধান ভাঙ্গিয়ে চাল করে নিয়ে আসত। সাথে সাথে বাড়ীর আরও কিছু খুচখাচ কাজ করে দিত, যেমন কয়লা ভেঙ্গে দেওয়া, উনুনে মাটি লেপে দেওয়া, পুকুরের ঘাট ভালো করে পরিষ্কার করে দেওয়া, উঠোনের শ্যাওলা ঘসে তুলে দেওয়া ইত্যাদি। কিন্ত ওদের দুজনেরই প্রয়োজনীতা অসম্ভব রকম বেড়ে যেত যখন চেনা পরিচিতদের মধ্যে কোনো মহিলা গর্ভবতী হতো। শুধু একমুঠো বালি, মাথার একটা ঊকূন আর নিজেদের ভেতর কিছু ফিসফাস করে মোটামুটি সঠিক ভাবে বলে দিতে পারত যে ছেলে হবে কি মেয়ে। টেকনিকটা আমি জানি, কিন্তু সেটা এই কাহিনীতে অপ্রয়োজনীয়।
আব্দুলের মা আর আমার মা প্রায় সমবয়সী ছিল বলে ওদের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন বন্ধুত্ব ছিল। প্রচ্ছন্ন বলছি এই জন্যেই যে যেকোনো কারণেই হোক, দুজনেই সেই সম্পর্কটা কখনও প্রকট হতে দিত না। হতে পারে সামজিক সংস্কার!
আব্দুলকে আমি কয়েকবার দেখেছি। আমারই বয়সী ছেলে, অমাবস্যার মতন গায়ের রং, পেশীবহুল শরীরটাতে এক আদিম মাদকতlর ছোঁয়া আর মুখে সবসময়ের লেগে থাকা এক দুগ্ধপোষ্যের হাসি। ও আসত বা ওকে ডাকা হতো তখনই যখন বাড়ীতে কোনো ভারি কাজ থাকত। যেমন গোয়ালের চালের খড় পাল্টান, দোতলার ছাতে আলকাতরা দেওয়া (জল চুঁইয়ে পড়া আটকাতে), নিম গাছের কোন একটা ডাল কেটে দেওয়া (হনুমানের উৎপাত কমাবার জন্যে), এইসব আর কি।
এই ভাবেই চলতে চলতে একটা সময় এলো যখন আমরা ভাইবোনেরা যে যার নিজস্ব জীবনের অঙ্ক করতে বেরিয়ে গেলাম। নিজেদের মধ্যেকার যোগযোগগুলো কদাচিত ছুটিছাটা আর বেশিরভাগটাই পোস্টকার্ড অথবা ইনল্যান্ড লেটারের মধ্যেই আটকে পড়লো। এরই মধ্যে একদিন মায়ের চিঠিতে জানলাম শোলুর মা মাটির নীচে শয্যা নিয়েছে। আব্দুলের মায়েরও বয়েসের কারণে আর অত কাজ করতে পারে না, অল্পেই থকে যায়। এইসবের জন্যে ধান ভাঙ্গাতে খুব অসুবিধা হচ্ছে; আব্দুলই এখন বেশির ভাগ সময় এসে ধান নিয়ে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি।
হঠাৎ কোন একটা এক পূজোতে কীভাবে যেন সবাই, মানে আমরা সব ভাইবোনেরা, একসাথে হয়েছিলাম। বাড়ী তো ঐ কদিন একেবারে শীতের হাট হয়ে উঠেছিলো। আব্দুলের মা আব্দুলকে নিয়ে এসেছিল দেখা করতে। ঢেঁকিতে ছাঁটা চিঁড়ে নিয়ে এসেছিল আমাদের খোঁকা-খুঁকীদের (এই উচ্চারণেই আমাদের ডাকত) জন্যে। বয়েসে যতখানি না তার চেয়ে অনেক বেশি চেহারায় বুড়ি হয়ে গেছে তখন। বস্তা ভর্তি ধান আর মাথায় তুলতে পারে না। চলে যাবার সময় ছোট্ট একটা পোঁটলায় ধান বেঁধে মাথায় করে নিয়ে গেল। জীবিকার সাথে আত্মসন্মান ধরে রাখার কী ভীষণ একটা প্রচেষ্টা!
কয়েক মাস পরে মা জানাল দুদিনের কি একটা অসুখে আব্দুল হঠাৎ মারা গ্যাছে। চাঁদপুরের পীর আর ধুলিয়ানের ওঝারা ওকে আটকাতে পারে নি। এই খবরটা নাকি আব্দুলের মা নিজেই এক নিঃঝুম দুপুরে আমাদের বাড়ী বয়ে দিয়ে গেছিল।
এরপর অনেক দিন কেটে গ্যাছে। আব্দুলের মাকে আমরা বা আমাদের বাড়ির কেউই সেই দুপুরের পরে আর কখনও দেখে নি। দাদু, দিদা আর ছোড়দাদু মিলে বহুদিন ধরে বহু চেষ্টা করেছিল যদি কোথাও কোনভাবে খোঁজ পাওয়া যায়। লাভ হয় নি।
মাঝে মধ্যে বড় জানতে ইচ্ছে করে ওর শেষটা কিভাবে শেষ হয়েছিল অথবা শেষটা আদৌ এসেছিলো কিনা। আমরা কেউ কিচ্ছু জানি না। হঠাৎ হঠাৎ আব্দুলের মায়ের কথা মনে পড়লে বড্ড অস্বস্তি হয়। যেমন আজ সকালে হলো।
২২/১১/২০১৫