মানুষ অসম্ভব স্মৃতিধর। নব্বই বছরের এক জন মানুষও তার ছেলেবেলার কথা মনে করতে পারে। মস্তিষ্কের অযুত নিযুত নিওরােনে বিচিত্র প্রক্রিয়ায় স্মৃতি জমা হয়ে থাকে। কিছুই নষ্ট হয় না। প্রকৃতি নষ্ট হতে দেয় না। অথচ আশ্চর্য, অতি শৈশবের কোন কথা তার। মনে থাকে না। দু’বছর বা তিন বছর বয়সের কিছুই সে মনে করতে পারে না।
মাত্র গর্ভের কোন স্মৃতি থাকে না, জন্ম মুহূর্তের কোন স্মৃতিও না। জন্ম সময়ের স্মৃতিটি তার থাকা উচিত ছিল। এত বড় একটা ঘটনা অথচ এই ঘটনার স্মৃতি প্রতি মুছে ফেলে। মনে হয় প্রকার কোন বিশেষ উদ্দেশ্য এতে কাজ করে। প্রকৃতি হতো চায় না পৃথিবীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের কথা আমরা মনে করে রাখি।
আমি যখন মন ঠিক করে ফেললাম ছেলেবেলার কথা লিখব তখন খুব চেষ্টা। করলাম জন্মমুহূর্তের স্মৃতির কথা মনে করতে এবং তারাে পেছনে যেতে, যেমন মাতৃগর্ভ। কেমন ছিল মাতৃগর্ভের সেই অন্ধকার? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করল।
আমার ছেলেবেলা-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ
এল এস ডি (LyS Fgic acid dietlylaimide) নামের এক ধরনের ড্রাগ নাকি মাতিগত এবং জমহুর্তের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। আমেরিকা থাকাকালীন সময়ে এই ভ্রামের মানিকটা জোগাড় করেছিলাম। সাহসের অভাবে খেতে পারি নি | কারণ এই হেলুসিনেটিং ট্রান্স প্রায়ই মানুষের মানসিক অবস্থায় বা বকামল দেই তােলে।
আসল ব্যাপার হচ্ছে খুব পুরানাে কথা আমার কিছুই মনে নেই। তবে জন্মের চার বছরের পর থেকে অনেক কিছুই আমি মনে করতে পারি। সেই সব কথাই লিখব, শুরুটা করছি শোনা কথার উপর নির্ভর করে। শোনা কথার উপর নির্ভর করাও বেশ কঠিন | একই জাল একেক জন দেব একেক রকম করে বলেন। যেমন একজন বললেন, ‘তোমার জন্মের সময় খুব বড় বৃষ্টি হচ্ছিল। অন্য একজন বললেন, ‘কৈ না তাে, প্রচণ্ঠ ঠাণ্ডা ছিল এইটা খেয়াল আছে, ঝড় বৃষ্টি তাে ছিল না।”
আমি সবার কথা সুনে শুনে একটি ছবি দাঁড় করিয়েছি। এই ছবি খানিকটা এদিক ওদিক হতে পারে তাতে কিছু যায় আসে না। আমি এমন কেউ না যে আমার জন্মমুহূর্তের প্রতিটি ঘটনা হুবহু লিখতে হবে। কোন ভুল চুক করা যাবে না। থাকুক। কিছু ভুল। আমাদের জীবনের একটা বড় অংশ জুড়েই তাে আছে ভুল এবং ভ্রান্তি।
আমার ছেলেবেলা-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ
আমার জন্ম ১৩ই নভেম্বর। ১৯৪৮ সন। শনিবার রাত ১০টা তিরিন মিনিট। শুনেছি ১৩ সংখ্যাটাই অশুভ। এই অশুভের সংগে যুক্ত হল শনিবার। শনি মঙ্গলবারও নাকি অশুভ | রাতটাও কুঞ্জ পক্ষের। জন্ম মুহূর্তে দপ করে হারিকেন।
নিভে গেল। ঘরে রাখা মিলার পানি উলেট গেল। এক জন ডাক্তার যিনি গত তিন দিন ধরে মা–র সংঙ্গে আছেন তিনি টর্চ লাইট জ্বেলে তার আলাে ফেললেন আমার আখে। শিল্পে চালায় বললেন, এই জানোয়ারটা দেখি তার মাকে মেরেই হেলছিল।
আমি তখন গভীর বিস্ময়ে টর্চ লাইটের ধাধানাে আলাের দিকে তাকিয়ে আছি। চোখ বড় বড় করে দেখছি—এসব কি ? অন্ধকার থেকে এ আমি কোথায় এলাম ?
জিরে পর পর কাদতে হয়। তাই নিয়ম। চারপাশের রহস্যময় জগৎ দেখে কাঁদতেও ভুলে গেছি। ডাক্তার সাহেব আমাকে তাঁবার জন! ব্রাশ করে গালে চুল বসালেন। আমি জন্ম মুহুর্তেই মানুষের হৃদয়হীনতার পরিচয় পেয়ে আকাশ ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলাম। ঘরে উপস্থিত জামার নীজান আনন্দিত স্বরে বললেন – বামুন রাশির ছেলে। বামুন রাশি বলার সুখ প্লেসেরি সংগে যুক্র রাহী শিরাটি বানানের পিতার মত আমার চালা
শচিয়ে কাছে।। শিশুর কান্নার শব্দ আমার নানাজানের কানে যাওয়ামাত্র তিনি ছুটে এসে বললেন, ছলে না মেয়াে ।
ডাক্তার সাহেব রহস্য করবার জন্যে বললেন, মেয়ে, মেয়ে। ফুটফুটে মেয়ে। নানাজান তৎক্ষণাৎ আধমণ মিষ্টি কিনতে লােক পাঠালেন। যখন জানলেন মেয়ে। নয় ছেলে — তখন আবার লােক পাঠালেন – আধমণ নয় এবার মিিষ্ট আসবে একমণ। এই সমাজে পুরুষ এবং নারীর অবস্থান যে ভিন্ন তাও জন্মলগ্নেই জেনে গেলাম।
আমার ছেলেবেলা-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ
বিস্ময়ে চারপাশের পৃথিবীকে দেখছে, কাঁদতে ভুলে গেছে, এটা বিশ্বাসযােগ্য নয়।
আমার ধারণা মা যা বলছে ত্রী সনদের কাছ থেকে শুনেই বুলেছেন।
লৰ নিচ্ছি মা মা বলেছেন সবই সত্যি। ধরে নিচ্ছি ।এক সময় গ্রামার || লা কাচা সােনার মত হিল। ধরে নিচ্ছি আমার জশের আশা প্রকাশের জন্য সেই রাত এক মণ মিষ্টি কিনে বিতরণ করা হয়েছিল। মিষ্টি কেনার অংশটি বিশ্বাসযােগ্য। নালাজানের অর্থবিত্ত তেমন ছিল না কিন্তু তিনি দিল দরিয়া ধরনের মানুষ ছিলেন।
আমার মা ছিলেন তাঁর সবচে দলের প্রথমা কন্যা। বিয়ে হয়ে যাবার পরও সে। বিয়ের সময়ও তিনি জমি টমি বিক্রি করে খরচের চুড়ান্ত করলেন। শিত হণয়ের মমতা প্রকাশ করলেন হাত খুলে টাকা খরচের মাদ্দমে। উদাহরণ দেই – মােহনগঞ্জ ষ্টেশন থেকে বর আসবে হাঁটা পথ পাঁচ মিনিটের রাস্তা। লাস্কির ব্যবস্থা করলেই হয়।
আমার নানাজান হাতীর ব্যবস্থা করলেন। সুসং দুর্গাপুর থেকে দুটি হাতী আনানাে হল। যে লােক এই কাজ করতে পারে, সে তার প্রিয় কন্যার প্রথম সন্তান জন্মের খবরে বাজারের সমস্ত মিষ্টি কনে ফেলতে পারে।
আমার ছেলেবেলা-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ
আমার বাবা তখন সিলেটে। বিশ্বনাথ থানার ও সি। ছেলে হবার খবর তাঁর কাছে পৌছল। এঁর মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। বেচারার খুব নখ ছিল প্রথম সপ্তানটি হবে মেয়ে। তিনি মেয়ের নাম ঠিক করে বসে আছেন। এক গাদা মেয়েদের চুক বানিয়েছেন। রূপার মল বানিয়েছেন।
তার মেয়ে মল পায়ে দিয়ে ঝম ঝম করে হটিবে – তিনি সুশ হয়ে দেখবেন। ছেলে হওয়ায় সব। পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল। তিনি একগাদা ফুক এ রূপাৱ মল নিয়ে ছেলেকে। দেখতে গেলেন। পাঠক পাঠিকাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, এইসব মেয়েলি পােষাক আমাকে লাগান। শরতে হয়। বাবাকে স = করার জন্যে আমার মাথার চুলও লম্বা রেখে দেন। সেই বেণী করা চুলে রঙ বেরঙের রীবন পরে আমার শৈশবের শুরু |
বাবা–মা‘র প্রথম সন্তান হচ্ছে চমৎকার একটি জীবন্ত খেলনা। এই খেলনার সবই ভাল। খলনা যন্ত্রন হাসে বাবা মা হাসেন। খেলনা যখন কাঁদে বাবা–মার মুখ অন্ধকার হয়ে যায়। আমার বাবা মার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হল না। তারা তাদের শিশু পুত্রের ভেতর নানান প্রতিভার লুণ দেখে বার বার চমৎকৃত হলেন। হজ আমাকে চাবি দেয়া একটা ঘােড়া কিনে দেয়া হল, আমি সুগে সংগে ঘােড়া ভেংচো। ফেললাম। আমার বাবা প্রতিভায় মগ্ন, হাসিমুখে বললেন, ‘দেখ দেখ ছেলের কি কৌতহল । সে ভেতরের কল কজা দেখতে চায়।
আমার ছেলেবেলা-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ
হয়ত আমাকে খাওয়ানাের জন্য মা থালায় করে খাবার নিয়ে গেলেন, আমি সেই থালা উড়িয়ে ফেলে দিলাম। বাবা আমার প্রতিভায়ু মুখ দেখ দেখ, ছেলের রাগ।
নভেম্বর মাসের দুর্দান্ত শীত। গারাে পাহাড় থেকে উড়ে আসছে অসব শীতল হওয়া। মাটির মালশায় আগুন কর নানীজান লক দিয়ে আমাকে রিম করার চেষ্টা করছেন। আশে পাশের বৌ বয়া একের পর এক আসছে এবং আমাকে দেখে ম =মিলায় বলাহে সােনার তলা। এতক্ষণ যা লিলাম সবই শোনা কথা। মার কাছ থেকে শােনা। কিন্তু আমার কাছে খুব বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। কারণ আমি ঘোর কষ্ণ বর্ণের মানুষ। আমাকে দেখে সােনার পুলা বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার কিছু নেই। তাছাড়া জমহতের এসব কথা আমার মা রও মনে থাকার কথা নয়। তার তখন জীবন। সংশয়।
প্রসব বেদনায় পুরাে তিন দিন কাটা মুরগীর মত ছটফট করেছেন। অতিরিক্ত রকমের রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। পাড়াগার মত জায়গায় তাঁকে রক্ত দেবার কোন ব্যবস্থা নেই। এই অবস্থাতেও তিনি লক্ষ্য করছেন তাঁর সােনার পুতলা গভীর দেখ। রাগ থাকা ভাল। এই যে থালা সে উড়িয়ে ফেলে দিল এতে প্রমাণিত হল তার পছন্দ অপছন্দ দুটিই খুব তীব্র।
এই সময় বই ছিড়ে ফেলার দিকেও আমার ঝোক দেখা গেল। হাতের কাছে বই