আমার ছেলেবেলা-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

মানুষ অসম্ভব স্মৃতিধরনব্বই বছরের এক জন মানুষও তার ছেলেবেলার কথা মনে করতে পারেমস্তিষ্কের অযুত নিযুত নিওরােনে বিচিত্র প্রক্রিয়ায় স্মৃতি জমা হয়ে থাকেকিছুই নষ্ট হয় নাপ্রকৃতি নষ্ট হতে দেয় নাঅথচ আশ্চর্য, অতি শৈশবের কোন কথা তারমনে থাকে নাদুবছর বা তিন বছর বয়সের কিছুই সে মনে করতে পারে না

আমার ছেলেবেলামাত্র গর্ভের কোন স্মৃতি থাকে না, জন্ম মুহূর্তের কোন স্মৃতিও নাজন্ম সময়ের স্মৃতিটি তার থাকা উচিত ছিলএত বড় একটা ঘটনা অথচ এই ঘটনার স্মৃতি প্রতি মুছে ফেলেমনে হয় প্রকার কোন বিশেষ উদ্দেশ্য এতে কাজ  করেপ্রকৃতি হতো চায় না পৃথিবীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের কথা আমরা মনে করে রাখি। 

আমি যখন মন ঠিক করে ফেললাম ছেলেবেলার কথা লিখব তখন খুব চেষ্টাকরলাম জন্মমুহূর্তের স্মৃতির কথা মনে করতে এবং তারাে পেছনে যেতে, যেমন মাতৃগর্ভকেমন ছিল মাতৃগর্ভের সেই অন্ধকার? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করল

আমার ছেলেবেলা-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

এল এস ডি (LyS Fgic acid dietlylaimide) নামের এক ধরনের ড্রাগ নাকি মাতিগত এবং জমহুর্তের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়আমেরিকা থাকাকালীন সময়ে এই ভ্রামের মানিকটা জোগাড় করেছিলামসাহসের অভাবে খেতে পারি নি | কারণ এই হেলুসিনেটিং ট্রান্স প্রায়ই মানুষের মানসিক অবস্থায় বা বকামল দেই তােলে

 আসল ব্যাপার হচ্ছে খুব পুরানাে কথা আমার কিছুই মনে নেইতবে জন্মের চার বছরের পর থেকে অনেক কিছুই আমি মনে করতে পারিসেই সব কথাই লিখব, শুরুটা করছি শোনা কথার উপর নির্ভর করেশোনা কথার উপর নির্ভর করাও বেশ কঠিন | একই জাল একেক জন দেব একেক রকম করে বলেনযেমন একজন বললেন, তোমার জন্মের সময় খুব বড় বৃষ্টি হচ্ছিলঅন্য একজন বললেন, কৈ না তাে, প্রচণ্ঠ ঠাণ্ডা ছিল এইটা খেয়াল আছে, ঝড় বৃষ্টি তাে ছিল না” 

আমি সবার কথা সুনে শুনে একটি ছবি দাঁড় করিয়েছিএই ছবি খানিকটা এদিক ওদিক হতে পারে তাতে কিছু যায় আসে নাআমি এমন কেউ না যে আমার জন্মমুহূর্তের প্রতিটি ঘটনা হুবহু লিখতে হবেকোন ভুল চুক করা যাবে নাথাকুককিছু ভুলআমাদের জীবনের একটা বড় অংশ জুড়েই তাে আছে ভুল এবং ভ্রান্তি। 

আমার ছেলেবেলা-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

আমার জন্ম ১৩ই নভেম্বর১৯৪৮ সনশনিবার রাত ১০টা তিরিন মিনিটশুনেছি ১৩ সংখ্যাটাই অশুভএই অশুভের সংগে যুক্ত হল শনিবারশনি মঙ্গলবারও নাকি অশুভ | রাতটাও কুঞ্জ পক্ষেরজন্ম মুহূর্তে দপ করে হারিকেন। 

নিভে গেলঘরে রাখা মিলার পানি উলেট গেলএক জন ডাক্তার যিনি গত তিন দিন ধরে মাসংঙ্গে আছেন তিনি টর্চ লাইট জ্বেলে তার আলাে ফেললেন আমার আখেশিল্পে চালায় বললেন, এই জানোয়ারটা দেখি তার মাকে মেরেই হেলছিল

আমি তখন গভীর বিস্ময়ে টর্চ লাইটের ধাধানাে আলাের দিকে তাকিয়ে আছিচোখ বড় বড় করে দেখছিএসব কি ? অন্ধকার থেকে আমি কোথায় এলাম

জিরে পর পর কাদতে হয়তাই নিয়মচারপাশের রহস্যময় জগৎ দেখে কাঁদতেও ভুলে গেছিডাক্তার সাহেব আমাকে তাঁবার জন! ব্রাশ করে গালে চুল বসালেনআমি জন্ম মুহুর্তেই মানুষের হৃদয়হীনতার পরিচয় পেয়ে আকাশ ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলামঘরে উপস্থিত জামার নীজান আনন্দিত স্বরে বললেন বামুন রাশির ছেলেবামুন রাশি বলার সুখ প্লেসেরি সংগে যুক্র রাহী শিরাটি বানানের পিতার মত আমার চালা 

শচিয়ে কাছেশিশুর কান্নার শব্দ আমার নানাজানের কানে যাওয়ামাত্র তিনি ছুটে এসে বললেন, ছলে না মেয়াে । 

ডাক্তার সাহেব রহস্য করবার জন্যে বললেন, মেয়ে, মেয়েফুটফুটে মেয়েনানাজান তৎক্ষণাৎ আধমণ মিষ্টি কিনতে লােক পাঠালেনযখন জানলেন মেয়েনয় ছেলে তখন আবার লােক পাঠালেন আধমণ নয় এবার মিিষ্ট আসবে একমণএই সমাজে পুরুষ এবং নারীর অবস্থান যে ভিন্ন তাও জন্মলগ্নেই জেনে গেলাম

আমার ছেলেবেলা-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

বিস্ময়ে চারপাশের পৃথিবীকে দেখছে, কাঁদতে ভুলে গেছে, এটা বিশ্বাসযােগ্য নয়। 

আমার ধারণা মা যা বলছে ত্রী সনদের কাছ থেকে শুনেই বুলেছেন। 

লৰ নিচ্ছি মা মা বলেছেন সবই সত্যিধরে নিচ্ছি এক সময় গ্রামার || লা কাচা সােনার মত হিলধরে নিচ্ছি আমার জশের আশা প্রকাশের জন্য সেই রাত এক মণ মিষ্টি কিনে বিতরণ করা হয়েছিলমিষ্টি কেনার অংশটি বিশ্বাসযােগ্যনালাজানের অর্থবিত্ত তেমন ছিল না কিন্তু তিনি দিল দরিয়া ধরনের মানুষ ছিলেন

আমার মা ছিলেন তাঁর সবচে দলের প্রথমা কন্যাবিয়ে হয়ে যাবার পরও সে বিয়ের সময়ও তিনি জমি টমি বিক্রি করে খরচের চুড়ান্ত করলেনশিত হণয়ের মমতা প্রকাশ করলেন হাত খুলে টাকা খরচের মাদ্দমে উদাহরণ দেই মােহনগঞ্জ ষ্টেশন থেকে বর আসবে হাঁটা পথ পাঁচ মিনিটের রাস্তালাস্কির ব্যবস্থা করলেই হয়

আমার নানাজান হাতীর ব্যবস্থা করলেনসুসং দুর্গাপুর থেকে দুটি হাতী আনানাে হলযে লােক এই কাজ করতে পারে, সে তার প্রিয় কন্যার প্রথম সন্তান জন্মের খবরে বাজারের সমস্ত মিষ্টি কনে ফেলতে পারে। 

আমার ছেলেবেলা-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

আমার বাবা তখন সিলেটেবিশ্বনাথ থানার সিছেলে হবার খবর তাঁর কাছে পৌছলএঁর মুখ অন্ধকার হয়ে গেলবেচারার খুব নখ ছিল প্রথম সপ্তানটি হবে মেয়েতিনি মেয়ের নাম ঠিক করে বসে আছেনএক গাদা মেয়েদের চুক বানিয়েছেনরূপার মল বানিয়েছেন

তার মেয়ে মল পায়ে দিয়ে ঝম ঝম করে হটিবে তিনি সুশ হয়ে দেখবেনছেলে হওয়ায় সবপরিকল্পনা মাঠে মারা গেলতিনি একগাদা ফুক রূপাৱ মল নিয়ে ছেলেকেদেখতে গেলেনপাঠক পাঠিকাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, এইসব মেয়েলি পােষাক আমাকে লাগানশরতে হয়বাবাকে = করার জন্যে আমার মাথার চুলও লম্বা রেখে দেনসেই বেণী করা চুলে রঙ বেরঙের রীবন পরে আমার শৈশবের শুরু

বাবামার প্রথম সন্তান হচ্ছে চমৎকার একটি জীবন্ত খেলনাএই খেলনার সবই ভালখলনা যন্ত্রন হাসে বাবা মা হাসেনখেলনা যখন কাঁদে বাবামার মুখ অন্ধকার হয়ে যায়আমার বাবা মার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হল নাতারা তাদের শিশু পুত্রের ভেতর নানান প্রতিভার লুণ দেখে বার বার চমৎকৃত হলেনহজ আমাকে চাবি দেয়া একটা ঘােড়া কিনে দেয়া হল, আমি সুগে সংগে ঘােড়া ভেংচোফেললামআমার বাবা প্রতিভায় মগ্ন, হাসিমুখে বললেন, দেখ দেখ ছেলের কি কৌতহল সে ভেতরের কল কজা দেখতে চায়। 

আমার ছেলেবেলা-পর্ব-(১)-হুমায়ুন আহমেদ

হয়ত আমাকে খাওয়ানাের জন্য মা থালায় করে খাবার নিয়ে গেলেন, আমি সেই থালা উড়িয়ে ফেলে দিলামবাবা আমার প্রতিভায়ু মুখ দেখ দেখ, ছেলের রাগ। 

নভেম্বর মাসের দুর্দান্ত শীতগারাে পাহাড় থেকে উড়ে আসছে অসব শীতল হওয়ামাটির মালশায় আগুন কর নানীজান লক দিয়ে আমাকে রিম করার চেষ্টা করছেনআশে পাশের বৌ বয়া একের পর এক আসছে এবং আমাকে দেখে =মিলায় বলাহে সােনার তলাএতক্ষণ যা লিলাম সবই শোনা কথামার কাছ থেকে শােনাকিন্তু আমার কাছে খুব বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় নাকারণ আমি ঘোর কষ্ণ বর্ণের মানুষআমাকে দেখে সােনার পুলা বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার কিছু নেইতাছাড়া জমহতের এসব কথা আমার মা রও মনে থাকার কথা নয়তার তখন জীবনসংশয়

প্রসব বেদনায় পুরাে তিন দিন কাটা মুরগীর মত ছটফট করেছেনঅতিরিক্ত রকমের রক্ত ক্ষরণ হচ্ছেপাড়াগার মত জায়গায় তাঁকে রক্ত দেবার কোন ব্যবস্থা নেইএই অবস্থাতেও তিনি লক্ষ্য করছেন তাঁর সােনার পুতলা গভীর দেখরাগ থাকা ভালএই যে থালা সে উড়িয়ে ফেলে দিল এতে প্রমাণিত হল তার পছন্দ অপছন্দ দুটিই খুব তীব্র। 

এই সময় বই ছিড়ে ফেলার দিকেও আমার ঝোক দেখা গেল। হাতের কাছে বই 

 

 

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *