ডায়েরি হাতে নিলেন। সেখানে স্বপ্নের কথা কিছু লেখা নেই। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াল ? গত রাতে যা দেখেছেন সবই স্বপ্ন ? গভীর গাঢ় স্বপ্ন?
মিসির আলি হাত মুখ ধুয়ে নিচে নামলেন। লুচি বেগুনভাজা খেলেন। চা খেলেন। লিলি বলল, চাচাজি আপনি ঘুরে ফিরে বাড়ি দেখুন। বাগান দেখুন। লাইব্রেরি ঘর খুলে রেখেছি। লাইব্রেরির বইপত্র দেখতে পারেন।
তােমার কুকুরগুলি কি বাঁধা আছে ? | হা কুকুর বাঁধা। বরকতকে পুঁই পাতার খোঁজে পাঠিয়েছি। বড় বড় পুঁই পাতা ছাড়া পাতুরি হয় না। বরকত এলেই কুকুরগুলির সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব। তখন আপনার কুকুর–ভীতি থাকবে না।
নীল ফুল ফোটে ঐ গাছটা কোথায় ?
পেছনের বাগানে। বিশাল গাছ আপনি দেখলেই চিনতে পারবেন। গাছের শুড়িটা বাঁধানাে। পেছনের বাগানে একটা ভাঙা মন্দির আছে। মন্দিরে ঢুকবেন।
সাপের আড়া।
কী মন্দির ?
কালী মন্দির। হিন্দু বাড়ি ছিল। বাড়ির মালিক অশ্বিনী রায় শাক্ত মতের মানুষ ছিলেন। স্বপ্নে দেখে তিনি কালী প্রতিষ্ঠা করেন। খুবই ইন্টারেস্টিং গল্প।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৪)-হুমায়ূন আহমেদ
আমি ভাসা ভাসা জানি। সুলতানকে জিজ্ঞেস করলেই আপনাকে বলবে।
আচ্ছা তাকে জিজ্ঞেস করব।
লিলি বলল, আমি ঐ দিনের মতাে এক্সপ্রেসাে কফি বানিয়ে আপনার জন্যে নিয়ে আসছি। ঠিক আছে চাচাজি ?
ঠিক আছে।
মিসির আলি বাড়ি দেখতে বের হলেন। রাতে বাড়িটা যত প্রকাণ্ড মনে। হয়েছিল দিনের আলােয় মনে হচ্ছে তার চেয়েও প্রকাণ্ড। তবে প্রকাণ্ড হলেও ধ্বংসস্তুপ। বাড়িটা যেন অপেক্ষা করছে কখন হুমড়ি খেয়ে পড়বে। বাড়িটার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। ভয় ভয় করে। মনে হয় বাড়িটাও কৌতূহলী চোখে তাকে দেখছে।
চিন্তা ভাবনা করছে। চিন্তা ভাবনা শেষ হলেই বাড়ি গম্ভীর গলায় ডাকবে, এই যে ভদ্রলােক আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে, দয়া করে শুনে যান। | মিসির আলি বাড়ির পেছনে চলে গেলেন। তিনি বৃক্ষ প্রেমিক না। গাছপালা নিয়ে তার বাড়াবাড়ি কৌতূহল নেই, কিন্তু নীল মরিচ ফুল গাছটা দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে।
বাড়ির পেছনের জায়গাটা আশ্চর্য–রকমভাবে পরিষ্কার। ঝােপ ঝাড় নেই, বড় বড় ঘাস নেই, গাছের নিচে শুকনাে পাতা পড়ে নেই। মনে হচ্ছে এই কিছুক্ষণ আগে ঝাঁট দেয়া হয়েছে। নীল মরিচ ফুল গাছটা দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। এমন কিছু বিস্ময়কর গাছ বলে মনে হচ্ছে না। তবে মরিচ ফুল গাছের পাশেই চেরী। গাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। পাতাশূন্য গাছ সাদা ফুলে ঢেকে আছে। মিসির আলি বিস্মিত গলায় বললেন, বাহ্ সুন্দর তাে!
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৪)-হুমায়ূন আহমেদ
চেরী গাছের পাতা শীতকালে ঝরে যায়। এখন শীত না, তারপরেও গাছে একটা পাতা নেই কেন ? জন্মভূমি ছেড়ে অন্যদেশে এসে গাছের জীনে কি কোনাে পরির্তন হয়েছে ? না–কি এটা চেরী গাছ না, অন্য কোনাে গাছ। তিনি নাম জানেন ।
ভাঙা মন্দিরটা দেখা যাচ্ছে। মন্দিরের অংশটা ঝােপঝাড়ে ঢাকা। বড় বড় কয়েকটা আম গাছ জায়গাটা অন্ধকার করে রেখেছে। উইয়ের টিবির মতাে কিছু উঁচু মাটি দেখা গেল। মন্দিরের ঠিক সামনে সারি করে লাগানাে জবা গাছ । জবা গাছ এত বড় হতে মিসির আলি দেখেন নি। গাছগুলি আম কাঁঠালের গাছের মতােই প্রকাণ্ড।
একটা গাছেই শুধু ফুল ফুটেছে। কালচে লাল রঙের ফুল। দেখতে ভালাে লাগে না। জবা ফুল ছাড়া কালী পূজা হয় না। পূজার ফুলের জন্যই কি এই গাছগুলি লাগানাে ? এত প্রাচীন গাছ ? মিসির আলি মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
মন্দিরের গায়ে শ্বেত পাথরের ফলকে কী সব লেখা। পড়তে ইচ্ছা করছে।
বাবু অশ্বিনী কুমার রায় কর্তৃক অদ্য শনিবার বঙ্গাব্দ ১২০৮ গৌর কালী মূর্তি অধিষ্ঠিত হইল।
মিসির আলি নামফলকের দিকে তাকিয়ে আছেন। গৌর কালী মূর্তি ব্যাপারটা বােঝা যাচ্ছে না। কালী কৃষ্ণ বর্ণ, গৌর বর্ণ না।
চাচাজি আপনার কফি। আপনাকে বলা হয়েছে মন্দিরের কাছে না আসতে আর আপনি সােজাসুজি মন্দিরে চলে এসেছেন। আপনি দেখি একেবারে বাচ্চাদের মতাে। যেটা করতে না করা সেটাই করেন।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৪)-হুমায়ূন আহমেদ
মিসির আলি কফির মগ হাতে নিতে নিতে বললেন, গৌর কালী ব্যাপারটা কী ? গৌর কালী হলাে যে কালীর গায়ের রঙ গৌর। ধবধবে সাদা। বাবু অশ্বিনী রায় স্বপ্নে দেখেছিলেন মা কালী তাঁকে বলছেন—তুই আমাকে প্রতিষ্ঠা কর। তবে গায়ের রঙ কালাে করিস না বাবা। গৌর বর্ণ করবি। অশ্বিনী কুমার রায় বললেন, ঠিক আছে মা করব। দেবী তখন বললেন, আমি তাের এখানে থাকব নগ্ন অবস্থায়। আমার গায়ে যেন কোনাে কাপড় না থাকে। অশ্বিনী কুমার রায় বললেন, সেটা কি ঠিক হবে মা? কত ভক্তরা তােমাকে দেখতে আসবে! দেবী বললেন, কেউ আমাকে দেখতে আসবে না। তােকে যা করতে বললাম তুই কর।
মিসির আলি বললেন, অশ্বিনী কুমার নগ্ন গৌর বর্ণের কালী প্রতিষ্ঠা করলেন?
লিলি বলল, হ্যা। মন্দিরে কি মূর্তি আছে ?
অশ্বিনী কুমার রায় নিজেই মূর্তিটা মেঘনায় ফেলে দিয়েছিলেন।
গল্পটা আমি পুরােপুরি জানি না। ভাসা ভাসা জানি। দূরবীনওয়ালা, অর্থাৎ সুলতান সাহেব ভালােমতাে জানে। ও আপনাকে গুছিয়ে বলবে।
আগে তােমার কাছ থেকে অগােছালােভাবে শুনি। অগােছালাে গল্প শুনতেই আমার বেশি ভালাে লাগে।
ঘটনাটা হলাে এ রকম যেদিন দেবী প্রতিষ্ঠিত হলাে সেই রাতেই অশ্বিনী বাবুকে দেবী স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, এই বােকা ছেলে! নরবলি ছাড়া শক্তির প্রতিষ্ঠা হয় ? তুই এক কাজ কর আগামী অমাবস্যায় নরবলি দে। অশ্বিনী বাবু বললেন, এইটা পারব না মা। আমি মহাপাতক হব। দেবী বললেন, পাপ–পুণ্যের তুই বুঝিস কী ?
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৪)-হুমায়ূন আহমেদ
তােকে যা করতে বললাম কর। নয়তাে মহাবিপদে পড়বি। অশ্বিনী বাবু স্বপ্নের মধ্যেই কাঁদতে কাঁদতে বললেন, এই কাজটা পারব না মা। নরবলি ছাড়া তুমি যা করতে বলবে তাই করব। দেবী তখন বললেন, তুই যখন পারবি না তখন আমার ব্যবস্থা আমিই করব। তখন তাের দুঃখের সীমা থাকবে নী। অশ্বিনী বাবুর ঘুম ভেঙে গেল। দুশ্চিন্তায় তিনি অস্থির হয়ে গেলেন। খুবই
কান্নাকাটি শুরু করলেন। আগামী অমাবস্যায় না জানি কি হয়?
কিছু হয়েছিল ? হঁ্যা হয়েছিল। অশ্বিনী বাবুর বড় মেয়েকে মন্দিরের ভেতর পাওয়া গেল। বড় মেয়ের নাম শ্বেতা। বয়স আঠারাে উনিশ। বিয়ের কথা চলছিল। সকালে মন্দিরে ঢুকে অশ্বিনী বাবু দেখেন, মেয়ের মাথা একদিকে ধড় আরেক দিকে। দেবীর খাড়ায় চাপ চাপ রক্ত।
কী সর্বনাশ!