অশ্বিনী বাবুর মাথা খারাপের মতাে হয়ে গেল। তিনি সেই রাতেই দেবী মূর্তি মেঘনা নদীর মাঝখানে ফেলে দিয়ে এলেন।
উনার কি একটাই মেয়ে ছিল ?
ওনার চার মেয়ে ছিল। দু‘মাসের মাথায় দ্বিতীয় মেয়েটিরও একই অবস্থা হলাে। মন্দিরের ভেতর তাকে পাওয়া গেল মাথা একদিকে ধড় আরেক দিকে। অশ্বিনী বাবু বাড়ি ঘর বিক্রি করে বাকি দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে প্রথমে গেলেন ডিব্রুগরে সেখান থেকে শিলিগুড়িতে। শিলিগুড়িতে তার তৃতীয় মেয়েটির একই অবস্থা হলাে। তখন তাঁর স্ত্রী সীতাদেবী মামলা করলেন স্বামীর বিরুদ্ধে। সীতাদেবী বললেন, হত্যার ঘটনাগুলি তার স্বামী ঘটাচ্ছেন। দোষ দিচ্ছেন মা কালীর। ছােট মেয়েটাও বাবার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিল।
মামলার রায় কী হয়েছিল ?
ওনার ফাসি হয়েছিল। তুমি এতসব জানলে কী করে?
এই মামলা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। আমাদের দূরবীনওয়ালা সেইসব লেখা সবই যােগাড় করেছিল। আপনি চাইলেই আপনাকে খুঁজে বের করে দেবে। আপনি কি চান ?
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ
আমি চাই না। লিলি বলল, আমাকে দেখে কি বুঝতে পারছেন যে আমার মনটা খুব খারাপ?
না বুঝতে পারছি না।
আমার মনটা খুবই খারাপ কারণ পুঁই পাতা পাওয়া যায় নি। বড় বড় পুঁই পাতা দিয়ে পেঁচিয়ে পাতুরি করতে হয়। কলাপাতা দিয়েও হয়। তবে ভালাে হয় না। | মিসির আলি হেসে ফেলে বললেন, মন খারাপের কারণটা তাে মনে হয় খুবই গুরুতর।
আপনার কাছে গুরুতর মনে না হতে পারে আমার কাছে গুরুতর। ও যেমন তারা দেখে, আমি করি রান্না। কোনাে রাতে যদি আকাশ মেঘে ঢেকে যায় ওর প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয় ঠিক সে রকম আমি যখন রান্নার জিনিসপত্র পাই না, আমার মেজাজ খারাপ হয়। এটা কি দোষের ?
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ
দোষের না। এত সুন্দর বাগান তুমি এখানে বেড়াতে আস না ? লিলি বলল, কখনাে না । নেংটা দেবীর আশে পাশে আমি থাকব ? পাগল হয়েছেন ? তাছাড়া গাছপালা আমার ভালােও লাগে না। চাচাজি শুনুন আমি চলে যাচ্ছি। খবরদার আপনি কিন্তু মন্দিরের ভেতর ঢুকবেন না।
আচ্ছা ঢুকব না। তােমার স্বামীর ঘুম ভেঙেছে? হুঁ ভেঙেছে। তার নাশতা খাওয়া শেষ ?
সে নাশতা খাবে না। দুপুরে ভাত খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়বে। ঘুম না এলে ঘুমের অষুধ খেয়ে ঘুমাবে।
কেন ? রাত জাগবে। আজ সে আপনাকে নিয়ে তারা দেখবে। আজ কি অমাবস্যা ? আগামীকাল অমাবস্যা।
মিসির আলি বললেন, ক‘দিন ধরেই যেমন মেঘলা মেঘলা যাচ্ছে। অমাবস্যার রাতে যদি আকাশে মেঘ থাকে তাহলে তাে সমস্যা। | লিলি নিচু গলায় বলল, আপনার আর কী সমস্যা। সমস্যা আমার । আকাশে মেঘ দেখলে ও প্রচণ্ড রেগে যায়। হৈ চৈ করে। অমাবস্যা হলাে বৃষ্টির সময়। অন্যদিন বৃষ্টি না হলেও অমাবস্যায় বৃষ্টি হবেই । চাঁদের আকর্ষণ বিকর্ষণের কিছু ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে। আমি জানি না। আপনি নিশ্চয়ই জানেন।
আমিও জানি না।
কফির মগটা দিন আমি নিয়ে চলে যাই। দুপুরের রান্না হলে খবর দেব চলে আসবেন। এখন নিজের মনে ঘুরে বেড়ান। শুধু দয়া করে মন্দিরে ঢুকবেন না।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ
মিসির আলি নীল মরিচ গাছের নিচে বসলেন। কালাে সিমেন্টে বাঁধানাে বেদী, বসার জন্যে সুন্দর । বই সঙ্গে নিয়ে এলে বই পড়া যেত। দোতলায় উঠে বই আনতে ইচ্ছা করছে না। আচ্ছা গতরাতের ঘটনাটা নিয়ে কি কিছু ভাববেন।
থাক এখনাে সময় হয় নি। মন্দিরের ভেতরটা একবার উঁকি দিয়ে দেখতে ইচ্ছা করছে। মেয়েটা যদিও নিষেধ করেছে। নিষেধ অগ্রাহ্য করার একটা প্রবণতা হয়তাে মানুষের ডিএনএ’র ভেতরই আছে। মানুষকে যেটাই নিষেধ করা হয়েছে সেটাই সে করেছে। ব্যাপারটা শুরু করেছিলেন আদি মানব আদম। তাঁকে কোনাে ব্যাপারে নিষেধ করা হয় নি, শুধু বলা হয়েছিল— গন্ধম ফলটা খেও না। আদম প্রথম যে কাজটা করলেন সেটা হলাে গন্ধম ফল খাওয়া।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ
এডমন্ড হিলারীর মার ছিল উচ্চতা ভীতি। তিনি তাঁর পুত্রকে বললেন, তুমি আর যাই কর বাড়ির ছাদে উঠবে না। সেই হিলারী এভারেস্টের চূড়ায় উঠে বসে থাকলেন।
মিসির আলি মন্দিরের দিকে রওনা হলেন। ভেতরে ঢােকার দরকার নেই— তিনি শুধু উঁকি দিয়ে চলে আসবেন। পরিত্যক্ত মন্দিরে সাপ থাকা স্বাভাবিক তবে কাল রাতের ঘটনার পর দিনের সাপ তত ভয়ঙ্কর হবে বলে মনে হয় না।
মন্দিরে ঢােকার দরজাটা কাঠের দরজায় হুক আছে। তালা লাগানাের ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু দরজায় তালা নেই। মিসির আলি ধাক্কা দিতেই দরজা খুলল। মেঝে শ্বেত পাথরের, ঝক ঝক করছে। মনে হচ্ছে এই মাত্র কেউ এসে সাবান পানি দিয়ে ধুইয়ে দিয়ে গেছে। তার চেয়েও বিস্ময়কর ঘটনা হলাে মন্দিরে মূর্তি আছে। গৌর কালীর নগ্ন মূর্তি। | এখানেই বিস্ময়কর সমাপ্তি না। এর চেয়েও বিস্ময়কর ব্যাপার হলাে মূর্তিটি দেখতে অবিকল লিলির মতো। যেন কোনাে ভাস্কর এসে লিলিকে দেখে পাথর কেটে কেটে মূর্তি বানিয়েছে। কাকতালীয়ভাবে একটা মানুষের চেহারার সঙ্গে পুরনাে মূর্তির চেহারা মিলে যাবে এটা বিশ্বাসযােগ্য না। এটা খুবই অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা।
মিসির আলি মন্দির থেকে বের হলেন। চেরী গাছটার নিচে বরকত দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে শলার ঝাড় বাগান ঝাট দিয়ে এসেছে। তবে সে এই মুহূর্তে বাগান ঝাট দিচ্ছে না, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিসির আলির দিকে। সেই দৃষ্টিতে কৌতূহল, বিস্ময় আনন্দ কোনাে কিছুই নেই। সে তাকিয়ে আছে মাছের মত ভাবলেশহীন চোখে। | মিসির আলি মন্দির থেকে বের হয়ে মন্দিরের পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। বরকত চোখের দৃষ্টিতে এখনাে তাকে অনুসরণ করছে। তার দৃষ্টির আড়ালে যাবার জন্যেই মন্দিরের পেছনে চলে যাওয়া দরকার।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৫)-হুমায়ূন আহমেদ
মন্দিরের পেছনটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। একটা কুয়া আছে। কুয়ার পাড় পাথর দিয়ে বাঁধানাে। কুয়ার উপরে তারের জাফরি। সেখানে বাগান বিলাস গাছ। গাছ ভর্তি ফুল। অন্ধকার কুয়া, ফুলের কারণে আলাে হয়ে আছে। নদীর কাছের বাড়িতে কখনাে কুয়া থাকে না। এই কুয়াটাই প্রমাণ করে দিচ্ছে একসময় নদী অনেক দূরে ছিল । মিসির আলি কুয়ার পাড়ে উঠলেন। পানি আছে কি–না দেখতে হবে। পাথর নিয়ে ফেলতে হবে।
মিসির আলি কুয়াতে পাথর ফেলতে পারলেন না। তার আগেই তাকে চমকে উঠতে হল, কারণ আঁটা হাতে বরকত এসে দাঁড়িয়েছে। মিসির আলি বললেন, কিছু বলবে ?