আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ূন আহমেদ

আমিই মিসির আলি

মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, আমাকে কেউ বলে নিআমি অনুমান করছিএই অনুমানের পেছনে ভিত্তি আছেতােমার সঙ্গে গল্প করার ফাঁকে ফাকে আমি লাইব্রেরিতে সাজানাে বইগুলির উপর চোখ বুলিয়েছিচামড়ায় বাঁধানাে, সােনার জলে নাম লেখা বেশ কিছু পুরনাে বই দেখলাম

আকাশের তারা নিয়ে লেখা দুটা বই চোখে পড়েছেএকটার নাম তারা পরিচিতি, আরেকটার নাম আকাশ পর্যবেক্ষণএকটা ইংরেজি বই আছে Western Hemisphere Stars, এখন তুমি বল এই বইগুলি কি অশ্বিনী বাবুর

হাউনি কি আকাশ দেখতেন

হ্যা দেখতেনতাঁর একটা দূরবীন ছিলম্যাক এলেস্টার কোম্পানির চোঙ দূরবীন। 

উনি তারা দেখতেন বলেই কি তুমি এখন তারা দেখছ ? সুলতান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিচু গলায় বলল, না ব্যাপারটা সে রকম আকাশের বিষয়ে আমার কৌতূহল ছছাটবেলা থেকেই ছিলতবে অশ্বিনী বাবুর লেখা ডায়েরি পড়ে আমি টেলিস্কোপ কিনতে আগ্রহী হই এটা ঠিকতিনি আকাশ দেখতেন এবং কি দেখলেন তা খুব গুছিয়ে লিখে রাখতেন

পড়তে ভালাে লাগেতার মানে এই না যে আমি তার জীবন যাত্রা অনুসরণ করছিআপনি নিশ্চয়ই বলবেন নামন্দিরে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এখন আমি মানুষ বলি দেয়া শুরু করব

মিসির আলি বললেন, অশ্বিনী বাবুর লেখা ডায়েরিটা কি আমি পড়তে 

অবশ্যই পড়তে পারেনআপনি কিন্তু স্যার আমার প্রশ্নের জবাব দেন নিপ্রশ্নটা যেন কী

প্রশ্নটা হলােআপনার কি ধারণা আমিও মানুষ বলি দিচ্ছি ? গ্রাম থেকে মানুষ ধরে এনে গােপনে বলি দিয়ে মন্দিরের পেছনের কুয়ায় ফেলে দিচ্ছি ? আমাকে কি অসুস্থ মানুষ বলে মনে হচ্ছে ? | মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ছােটখাট অসুখগুলি চট করে ধরা যায়কিন্তু ভয়ংকর অসুখগুলি মানুষের মস্তিষ্কের গভীরে বাস করে

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ূন আহমেদ

এদের চট করে ধরা যায় নাযেমন অশ্বিনী বাবুর কথাই ধরা যাকতাঁর ভয়ংকর অসুখ ধরতে অনেক সময় লেগেছিলঅশ্বিনী বাবুর সবচেকাছের মানুষ তার 

স্ত্রী পর্যন্ত ধরতে পারেন নিতিনটি মেয়ের মৃত্যুর পর ধরতে পারলেন। 

সুলতান হতভম্ব গলায় বলল, স্যার আপনি তাে দেখি সত্যি সত্যি আমাকে অশ্বিনী বাবুর দলে ফেলে দিয়েছেনঠিক করে বলুনতাে আপনি আমার সম্পর্কে কি ভাবছেন। 

এখন পর্যন্ত আমি কিছুই ভাবছি নাতবে আমার অবচেতন মন নিশ্চয়ই ভাবছেঅবচেতন মনের কর্মকাণ্ড খুব অদ্ভুতঅবচেতন মনকে মাঝে মাঝে আমার কাছে আত্মভােলা শিশুর মতাে মনে হয়যে শিশু নিজের মনে খেলছেজিগ স পাজলের খেলাএকটা টুকরার সঙ্গে আরেকটা টুকরা জোড়া দিয়ে ছবি বানাচ্ছেছবি ভেঙ্গে ফেলছে

আবার বানাচ্ছেমাঝে মাঝে অদ্ভুত কোনাে বি তৈরি হয়ে গেলে অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ ছবির দিকে তাকিয়ে আবার সেই ছবিও নষ্ট করে ফেলছে। 

সুলতান শান্ত গলায় বলল, স্যার শুনুন আমার কোনাে ছবি দাড় করাতে হলে সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করলেই হবেআমি জবাব দেবঅনুমানের উপর কিছু দাঁড় করানাের প্রয়ােজন নেই। 

মিসির আলি বললেন, অবচেতন মন কাউকে জিজ্ঞেস করে কাজ করে নাজিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি চেতন মনের, অবচেতন মনের নাতবে চেতন মন থেকে সে যে তথ্য নেয় না, তা নাতথ্য নেয়যেটা তার পছন্দ তাই নেয় সব তথ্য নেয় না। 

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ূন আহমেদ

সুলতান ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, স্যার আমার নিজের ধারণা এই বাড়িটা আপনার উপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছেজেলখানার মত উচু পাচিলে ঘেরা বিরাট বাড়ি। গেট সব সময় তালাবন্ধতিনটা কুকুর বাড়ি পাহারা দিচ্ছেআপনার ধারণা হয়েছে আপনি বন্দি হয়ে গেছেন

যেই মুহূর্তে মানুষ নিজেকে বন্দি ভাবে সেই মুহূর্ত থেকে তার চিন্তার ধারা বদলে যায়আমি যখন মুক্ত মানুষ ছিলাম তখন একভাবে চিন্তা করতাম

যেই মুহূর্তে হুইল চেয়ারে বন্দি হয়েছি সেই মুহূর্ত থেকে অন্যভাবে চিন্তা করা শুরু করেছিআপনার বেলাতেও তাই হচ্ছেআপনি আমাকে সহজভাবে গ্রহণ করতেই পারছেন নাআপনি ধরেই নিয়েছেন আমি হচ্ছি হুইল চেয়ারে বসা অশ্বিনী বাবু। 

মিসির আলি কিছু বললেন নাসুলতান বলল, আপনি খেতে যানআপনার খাবার দেয়া হয়েছে। 

তুমি খাবে না

 আমার মেজাজ খুবই খারাপআপনার কারণে মেজাজ খারাপ নাআকাশ মেঘে ঢাকা, তারা দেখা যাবে নাএই জন্যে মেজাজ খারাপমেজাজ খারাপ নিয়ে আমি খেতে পারি নাআপনি খেতে যান, আমি অশ্বিনী বাবুর 

ডায়েরিটা খুঁজে বের করি তাঁর অনেক খাতাপত্রের সঙ্গে ডায়েরিটা আছেখুঁজে বের করতে সময় লাগবে। 

পুঁই পাতা পাওয়া যায় নি কথাটা সত্যি নাপাতা পাওয়া গেছেসেই পাতায় কৈ মাছের পাতুরি রান্না হয়েছেলিলি মিসির আলির পাতে মাছ তুলে দিয়ে হাসতে হাসতে বললদেখলেন কেমন বােকা বানালাম

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ূন আহমেদ

আয়ােজন প্রচুরমাছই আছে তিন রকমেরচিংড়ি মাছ, মলা মাছ আর কৈ মাছনানান ধরনের ভর্তা, ভাজিকুচকুচে কাল রঙের একটা ভর্তা দেখা গেলআরেকটার বর্ণ গাঢ় লালপাশাপাশি দুটা বাটিতে লাল এবং কাল ভর্তা রাখা হয়েছে যার থেকে ধারণা করা যায় যে শুধু রান্না না, খাবার সাজানাের একটা ব্যাপারও মেয়েটার মধ্যে আছে

লিলি বলল, চাচাজি এই দেখুন কাল রঙের এই বস্তু হলাে কালিজিরা ভর্তাকৈ মাছের পাতুরি আপনার পাতে তুলে দিয়েছি বলেই এটা দিয়ে খাওয়া শুরু করবেন নাকালিজিরা দিয়ে কয়েক নলা ভাত খেলে মুখে রুচি চলে আসবেতখন যাই খাবেন, তাই ভালাে লাগবে । 

মিসির আলি বললেন, আমার রুচির কোন সমস্যা নেইতারপরেও তুমি যেভাবে খেতে বলবে আমি সেইভাবেই খাবলাল রঙের বস্তুটা কী

মরিচ ভর্তাশুকনাে মরিচের ভর্তাআমি ঝাল খেতে পারি না। 

এই মরিচ ভর্তার বিশেষত্ব হচ্ছে ঝাল নেই বললেই হয়বিশেষ প্রক্রিয়ায় শুকনাে মরিচ থেকে ঝাল দূর করা হয়েছেবিশেষ প্রক্রিয়াটা শুনতে চান

শুনে আমার কোন লাভ নেই তবু বল। 

শুকনাে মরিচ লেবু পানিতে ডুবিয়ে রাখলে মরিচের ঝাল চলে যায় ভিনিগারে ডুবিয়ে রাখলেও হয়আমি ঝাল দূর করেছি লেবু পানিতে ডুবিয়ে। 

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ূন আহমেদ

বিচিত্র ধরনের রান্না বান্না তুমি কি কারাে কাছ থেকে শিখেছ ? না নিজে মাথা খাটিয়ে বের করেছ

বেশির ভাগ রান্নাই আমি আমার নানির কাছ থেকে শিখেছিনানি আমাকে রান্না শিখিয়েছেন তার চেয়েও বড় কথা রান্নার মন্ত্র শিখিয়েছেনআমি প্রায় কুড়িটার মতো রান্নার মন্ত্র জানি। 

মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, রান্নার কি মন্ত্র আছে নাকি

লিলি সহজ ভঙ্গিতে বলল, হঁা মন্ত্র আছেএই মন্ত্র কাউকে শেখানাে নিষেধমন্ত্র শেখালে তার পাওয়ার চলে যায়কিন্তু আপনি চাইলে আপনাকে শেখাব। 

আমি রান্না শিখতে চাচ্ছি নাকিন্তু মন্ত্রটা শিখবমন্ত্রটা সত্যি শিখতে চান ? শিখতে চাই না, শুধু শুনতে চাইযেকোনাে একটা মন্ত্র বললেই হবে। 

লিলি বলল, একেক রান্নার একেক মন্ত্র ছােট মাছ রান্নার মন্ত্রটা বলিছােট মাছের সঙ্গে তেল মশলা মাখাতে হয়চুলায় হাঁড়ি দিয়ে আগুন দিতে হয়হাড়ি পুরােপুরি গরম হবার পর তেলমশলা মাখা মাছটা হাঁড়িতে দিয়ে মন্ত্রটা পড়তে হয়দশবারতারপর পানি দিতে হয়।

পানি এমনভাবে দিতে হয় যেন মাছের উপর দু আংগুল পানি থাকেএই মন্ত্রের নাম দশদুই মন্ত্র পানি ফুটতে শুরু করলেই রান্না শেষআরেকবার মন্ত্রটা পড়ে ফু দিয়ে হাঁড়ির মুখ বন্ধ করে হাঁড়ি নামিয়ে ফেলতে হবেতরকারি বাটিতে ঢালার আগে আর ঢাকনা নামানাে যাবে না। 

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ূন আহমেদ

এখন মন্ত্রটা বল। লিলি বলল, মন্ত্রটা অনেক লম্বাশুরুটা এরকম— 

উত্তরে হিমালয় পর্বত 

দক্ষিণে সাগর নদীতে সপ্ত ডিঙ্গায়। 

চাঁদ সদাগরআমি চুলার ধারে 

ধোঁয়া বেশুমার অগ্নিবিনা রন্ধন হবে 

প্রতিজ্ঞা আমারঅগ্নি আমার ভাই 

জল আমার বােন আমি কন্যা চম্পাবতী 

শােন মন্ত্র শােনআশ্বিনে আশ্বিনা বৃষ্টি 

কার্তিকে হিম শরীরে দিয়াছি বন্ধন 

আলিফ লাম মিম। 

মিসির আলি মন্ত্র শুনে হাসলেনলিলি বলল, চাচাজি হাসবেন নাএই মন্ত্র পড়ে একবার ছােট মাছ রান্না করে দেখুনদশবার মন্ত্র পড়ার পর দু আংগুল 

পানিআর কিছু লাগবে না। 

মিসির আলি বললেন, লিলি আমার ধারণা মন্ত্রটা হলােটাইমিংসেই সময়তাে গ্রামেগঞ্জে ঘড়ি ছিল নারান্নার মতাে তুচ্ছ বিষয়ে ঘড়ির ব্যবহারের প্রশ্নই আসে নাআমার ধারণা তখন মন্ত্র পড়ে সময়ের হিসাব রাখা হতােতুমি যে মন্ত্রটা বললে এই মন্ত্র দশবার বলতে যত সময় লাগে ততটা সময় তেল মশলা মাখানাে মাছ গরম চুলায় রাখলেই হবেতুমি এক কাজ করঘড়ি দেখে দশবার মন্ত্র পড়তে কত সময় লাগে সেটা বের করতারপর মন্ত্র ছাড়া সময় দেখে রান্না করদেখবে রান্না ঠিকই হয়েছে। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *