মিসির আলি সহজ গলায় বললেন, আমাকে কেউ বলে নি। আমি অনুমান করছি। এই অনুমানের পেছনে ভিত্তি আছে। তােমার সঙ্গে গল্প করার ফাঁকে ফাকে আমি লাইব্রেরিতে সাজানাে বইগুলির উপর চোখ বুলিয়েছি। চামড়ায় বাঁধানাে, সােনার জলে নাম লেখা বেশ কিছু পুরনাে বই দেখলাম।
আকাশের তারা নিয়ে লেখা দুটা বই চোখে পড়েছে। একটার নাম তারা পরিচিতি, আরেকটার নাম আকাশ পর্যবেক্ষণ। একটা ইংরেজি বই আছে Western Hemisphere Stars, এখন তুমি বল এই বইগুলি কি অশ্বিনী বাবুর ?
হা। উনি কি আকাশ দেখতেন ?
হ্যা দেখতেন। তাঁর একটা দূরবীন ছিল। ম্যাক এলেস্টার কোম্পানির চোঙ দূরবীন।
উনি তারা দেখতেন বলেই কি তুমি এখন তারা দেখছ ? সুলতান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিচু গলায় বলল, না ব্যাপারটা সে রকম । আকাশের বিষয়ে আমার কৌতূহল ছছাটবেলা থেকেই ছিল। তবে অশ্বিনী বাবুর লেখা ডায়েরি পড়ে আমি টেলিস্কোপ কিনতে আগ্রহী হই এটা ঠিক। তিনি আকাশ দেখতেন এবং কি দেখলেন তা খুব গুছিয়ে লিখে রাখতেন।
পড়তে ভালাে লাগে। তার মানে এই না যে আমি তার জীবন যাত্রা অনুসরণ করছি। আপনি নিশ্চয়ই বলবেন না— মন্দিরে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এখন আমি মানুষ বলি দেয়া শুরু করব ?
মিসির আলি বললেন, অশ্বিনী বাবুর লেখা ডায়েরিটা কি আমি পড়তে
অবশ্যই পড়তে পারেন। আপনি কিন্তু স্যার আমার প্রশ্নের জবাব দেন নি। প্রশ্নটা যেন কী?
প্রশ্নটা হলাে— আপনার কি ধারণা আমিও মানুষ বলি দিচ্ছি ? গ্রাম থেকে মানুষ ধরে এনে গােপনে বলি দিয়ে মন্দিরের পেছনের কুয়ায় ফেলে দিচ্ছি ? আমাকে কি অসুস্থ মানুষ বলে মনে হচ্ছে ? | মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ছােটখাট অসুখগুলি চট করে ধরা যায়। কিন্তু ভয়ংকর অসুখগুলি মানুষের মস্তিষ্কের গভীরে বাস করে।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ূন আহমেদ
এদের চট করে ধরা যায় না। যেমন অশ্বিনী বাবুর কথাই ধরা যাক— তাঁর ভয়ংকর অসুখ ধরতে অনেক সময় লেগেছিল। অশ্বিনী বাবুর সবচে’ কাছের মানুষ তার
স্ত্রী পর্যন্ত ধরতে পারেন নি। তিনটি মেয়ের মৃত্যুর পর ধরতে পারলেন।
সুলতান হতভম্ব গলায় বলল, স্যার আপনি তাে দেখি সত্যি সত্যি আমাকে অশ্বিনী বাবুর দলে ফেলে দিয়েছেন। ঠিক করে বলুনতাে আপনি আমার সম্পর্কে কি ভাবছেন।
এখন পর্যন্ত আমি কিছুই ভাবছি না। তবে আমার অবচেতন মন নিশ্চয়ই ভাবছে। অবচেতন মনের কর্মকাণ্ড খুব অদ্ভুত। অবচেতন মনকে মাঝে মাঝে আমার কাছে আত্মভােলা শিশুর মতাে মনে হয়। যে শিশু নিজের মনে খেলছে। জিগ স পাজলের খেলা। একটা টুকরার সঙ্গে আরেকটা টুকরা জোড়া দিয়ে ছবি বানাচ্ছে। ছবি ভেঙ্গে ফেলছে।
আবার বানাচ্ছে। মাঝে মাঝে অদ্ভুত কোনাে ছবি তৈরি হয়ে গেলে অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ ছবির দিকে তাকিয়ে আবার সেই ছবিও নষ্ট করে ফেলছে।
সুলতান শান্ত গলায় বলল, স্যার শুনুন আমার কোনাে ছবি দাড় করাতে হলে সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করলেই হবে। আমি জবাব দেব। অনুমানের উপর কিছু দাঁড় করানাের প্রয়ােজন নেই।
মিসির আলি বললেন, অবচেতন মন কাউকে জিজ্ঞেস করে কাজ করে না। জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি চেতন মনের, অবচেতন মনের না। তবে চেতন মন থেকে সে যে তথ্য নেয় না, তা না। তথ্য নেয়। যেটা তার পছন্দ তাই নেয় সব তথ্য নেয় না।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ূন আহমেদ
সুলতান ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, স্যার আমার নিজের ধারণা এই বাড়িটা আপনার উপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। জেলখানার মত উচু পাচিলে ঘেরা বিরাট বাড়ি। গেট সব সময় তালাবন্ধ। তিনটা কুকুর বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। আপনার ধারণা হয়েছে আপনি বন্দি হয়ে গেছেন।
যেই মুহূর্তে মানুষ নিজেকে বন্দি ভাবে সেই মুহূর্ত থেকে তার চিন্তার ধারা বদলে যায়। আমি যখন মুক্ত মানুষ ছিলাম তখন একভাবে চিন্তা করতাম।
যেই মুহূর্তে হুইল চেয়ারে বন্দি হয়েছি সেই মুহূর্ত থেকে অন্যভাবে চিন্তা করা শুরু করেছি। আপনার বেলাতেও তাই হচ্ছে। আপনি আমাকে সহজভাবে গ্রহণ করতেই পারছেন না। আপনি ধরেই নিয়েছেন আমি হচ্ছি হুইল চেয়ারে বসা অশ্বিনী বাবু।
মিসির আলি কিছু বললেন না। সুলতান বলল, আপনি খেতে যান। আপনার খাবার দেয়া হয়েছে।
তুমি খাবে না ?
আমার মেজাজ খুবই খারাপ। আপনার কারণে মেজাজ খারাপ না। আকাশ মেঘে ঢাকা, তারা দেখা যাবে না। এই জন্যে মেজাজ খারাপ। মেজাজ খারাপ নিয়ে আমি খেতে পারি না। আপনি খেতে যান, আমি অশ্বিনী বাবুর
ডায়েরিটা খুঁজে বের করি । তাঁর অনেক খাতাপত্রের সঙ্গে ডায়েরিটা আছে। খুঁজে বের করতে সময় লাগবে।
পুঁই পাতা পাওয়া যায় নি কথাটা সত্যি না। পাতা পাওয়া গেছে। সেই পাতায় কৈ মাছের পাতুরি রান্না হয়েছে। লিলি মিসির আলির পাতে মাছ তুলে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল— দেখলেন কেমন বােকা বানালাম!
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ূন আহমেদ
আয়ােজন প্রচুর। মাছই আছে তিন রকমের। চিংড়ি মাছ, মলা মাছ আর কৈ মাছ। নানান ধরনের ভর্তা, ভাজি। কুচকুচে কাল রঙের একটা ভর্তা দেখা গেল। আরেকটার বর্ণ গাঢ় লাল। পাশাপাশি দুটা বাটিতে লাল এবং কাল ভর্তা রাখা হয়েছে যার থেকে ধারণা করা যায় যে শুধু রান্না না, খাবার সাজানাের একটা ব্যাপারও মেয়েটার মধ্যে আছে।
লিলি বলল, চাচাজি এই দেখুন কাল রঙের এই বস্তু হলাে কালিজিরা ভর্তা। কৈ মাছের পাতুরি আপনার পাতে তুলে দিয়েছি বলেই এটা দিয়ে খাওয়া শুরু করবেন না। কালিজিরা দিয়ে কয়েক নলা ভাত খেলে মুখে রুচি চলে আসবে। তখন যাই খাবেন, তাই ভালাে লাগবে ।
মিসির আলি বললেন, আমার রুচির কোন সমস্যা নেই। তারপরেও তুমি যেভাবে খেতে বলবে আমি সেইভাবেই খাব। লাল রঙের বস্তুটা কী ?
মরিচ ভর্তা। শুকনাে মরিচের ভর্তা। আমি ঝাল খেতে পারি না।
এই মরিচ ভর্তার বিশেষত্ব হচ্ছে ঝাল নেই বললেই হয়। বিশেষ প্রক্রিয়ায় শুকনাে মরিচ থেকে ঝাল দূর করা হয়েছে। বিশেষ প্রক্রিয়াটা শুনতে চান ?
শুনে আমার কোন লাভ নেই তবু বল।
শুকনাে মরিচ লেবু পানিতে ডুবিয়ে রাখলে মরিচের ঝাল চলে যায় । ভিনিগারে ডুবিয়ে রাখলেও হয়। আমি ঝাল দূর করেছি লেবু পানিতে ডুবিয়ে।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ূন আহমেদ
বিচিত্র ধরনের রান্না বান্না তুমি কি কারাে কাছ থেকে শিখেছ ? না নিজে মাথা খাটিয়ে বের করেছ ?
বেশির ভাগ রান্নাই আমি আমার নানির কাছ থেকে শিখেছি। নানি আমাকে রান্না শিখিয়েছেন তার চেয়েও বড় কথা রান্নার মন্ত্র শিখিয়েছেন। আমি প্রায় কুড়িটার মতো রান্নার মন্ত্র জানি।।
মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, রান্নার কি মন্ত্র আছে নাকি?
লিলি সহজ ভঙ্গিতে বলল, হঁা মন্ত্র আছে। এই মন্ত্র কাউকে শেখানাে নিষেধ। মন্ত্র শেখালে তার পাওয়ার চলে যায়। কিন্তু আপনি চাইলে আপনাকে শেখাব।
আমি রান্না শিখতে চাচ্ছি না। কিন্তু মন্ত্রটা শিখব। মন্ত্রটা সত্যি শিখতে চান ? শিখতে চাই না, শুধু শুনতে চাই। যে–কোনাে একটা মন্ত্র বললেই হবে।
লিলি বলল, একেক রান্নার একেক মন্ত্র । ছােট মাছ রান্নার মন্ত্রটা বলি। ছােট মাছের সঙ্গে তেল মশলা মাখাতে হয়। চুলায় হাঁড়ি দিয়ে আগুন দিতে হয়। হাড়ি পুরােপুরি গরম হবার পর তেল–মশলা মাখা মাছটা হাঁড়িতে দিয়ে মন্ত্রটা পড়তে হয়। দশবার। তারপর পানি দিতে হয়।
পানি এমনভাবে দিতে হয় যেন মাছের উপর দু আংগুল পানি থাকে। এই মন্ত্রের নাম দশ–দুই মন্ত্র । পানি ফুটতে শুরু করলেই রান্না শেষ। আরেকবার মন্ত্রটা পড়ে ফু দিয়ে হাঁড়ির মুখ বন্ধ করে হাঁড়ি নামিয়ে ফেলতে হবে। তরকারি বাটিতে ঢালার আগে আর ঢাকনা নামানাে যাবে না।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৭)-হুমায়ূন আহমেদ
এখন মন্ত্রটা বল। লিলি বলল, মন্ত্রটা অনেক লম্বা। শুরুটা এরকম—
উত্তরে হিমালয় পর্বত
দক্ষিণে সাগর নদীতে সপ্ত ডিঙ্গায়।
চাঁদ সদাগর। আমি চুলার ধারে
ধোঁয়া বেশুমার অগ্নিবিনা রন্ধন হবে
প্রতিজ্ঞা আমার। অগ্নি আমার ভাই
জল আমার বােন আমি কন্যা চম্পাবতী
শােন মন্ত্র শােন। আশ্বিনে আশ্বিনা বৃষ্টি
কার্তিকে হিম শরীরে দিয়াছি বন্ধন
আলিফ লাম মিম।
মিসির আলি মন্ত্র শুনে হাসলেন। লিলি বলল, চাচাজি হাসবেন না। এই মন্ত্র পড়ে একবার ছােট মাছ রান্না করে দেখুন। দশবার মন্ত্র পড়ার পর দু আংগুল
পানি। আর কিছু লাগবে না।
মিসির আলি বললেন, লিলি আমার ধারণা মন্ত্রটা হলাে— টাইমিং। সেই সময়তাে গ্রামেগঞ্জে ঘড়ি ছিল না। রান্নার মতাে তুচ্ছ বিষয়ে ঘড়ির ব্যবহারের প্রশ্নই আসে না। আমার ধারণা তখন মন্ত্র পড়ে সময়ের হিসাব রাখা হতাে। তুমি যে মন্ত্রটা বললে এই মন্ত্র দশবার বলতে যত সময় লাগে ততটা সময় তেল মশলা মাখানাে মাছ গরম চুলায় রাখলেই হবে। তুমি এক কাজ কর। ঘড়ি দেখে দশবার মন্ত্র পড়তে কত সময় লাগে সেটা বের কর। তারপর মন্ত্র ছাড়া সময় দেখে রান্না কর। দেখবে রান্না ঠিকই হয়েছে।