আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ূন আহমেদ

আমিই মিসির আলি

 লিলি বলল, আপনার আসলেই অনেক বুদ্ধিমন্ত্র যে কিছুই না, সময়ের হিসেব এটা আমিও টের পেয়েছিকিন্তু আমার অনেক সময় লেগেছে। আপনি সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলেছেনআপনি কি যেকোনাে সমস্যার সমাধান সঙ্গে সঙ্গে করে ফেলেন ? এই ক্ষমতা কী সত্যি আপনার আছে

মিসির আলি কিছু বললেন নাতিনি লক্ষ করলেন লিলি তীক্ষ্ণ চোখে তাঁকে দেখছেসে কি কিছু বলার চেষ্টা করছে ? প্রশ্নের ভেতরেও লুকানাে প্রশ্ন থাকেমেয়েটির এই প্রশ্নের ভেতর লুকানাে কোন প্রশ্ন কি আছে

লিলি বলল, মিষ্টি জাতীয় কিছু রান্না করি নিআপনি কি মধু খাবেন ? মধু এনে দেব ? দিন খলসা ফুলের মধু খেয়েছেন, আজ কেওড়া ফুলের মধু খান। 

লিলি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, আপনি কি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চান? জিজ্ঞেস করতে চাইলে করতে পারেন। 

মিসির আলি বললেন, সুলতান চিঠিতে একটা মেয়ের কথা বলেছিল মেয়েটি সত্যি আছে ? সালমা নাম, পনেরাে ষােল বছর বয়স। অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাসম্পন্ন মেয়ে। 

লিলি সহজ গলায় বলল, থাকবে না কেন আছেদূরবীনওয়ালাকে বললেই সে আপনাকে দেখাবে। 

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ূন আহমেদ

মিসির আলি বললেন, মেয়েটা থাকে কোথায়

লিলি বলল, মেয়েটা কোথায় থাকে তা দিয়ে কি করবেন ? মেয়েটার সত্যি কোনাে ক্ষমতা আছে কিনা এটা জানা জরুরি তাই না

মেয়েটার সত্যি কি ক্ষমতা আছে ? মেয়েটার শুধু যে ক্ষমতা আছে তা না, ভয়াবহ ক্ষমতা আছে। 

তুমি নিজে দেখেছ ? হ্যাআপনি তাকে দেখে খুবই অবাক হবেনপ্রথমে আপনার বিশ্বাস হবে

ভাববেন ঠাট্টা করা হচ্ছে| মিসির আলি বললেন, তুমিই কি সেই মেয়ে

লিলি হঁসূচক মাথা নেড়ে খিলখিল করে হেসে ফেলল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, চাচাজি শুনুন মধু আপনাকে খেতেই হবেইচ্ছা না করলেও খেতে হবে দূরবীনওয়ালা যদি শােনে আপনাকে মধু দেয়া হয় নি তাহলে খুব রাগ করবেআমাকে বলা হয়েছে আজ যেন কেওড়া ফুলের মধু দেয়া হয়। 

মধু না খেলে সুলতান রাগ করবে ? রাগের চেয়েও যেটা করবে তা হলাে মেজাজ খারাপমিসির আলি বললেন, নিয়ে এসাে তােমার মধু। 

লিলি বলল, সুন্দরবনের বানররা মধু কীভাবে খায় এই গল্প কি আপনি জানেন

না জানি না। 

আপনি আংগুলে মধু মাখিয়ে খেতে শুরু করুনআমি গল্পটা করিছােট বাচ্চাদের যেমন গল্প বলে বলে খাবার খাওয়াতে হয় আপনাকেও সে রকম গল্প বলে বলে মধু খাওয়াব। 

ঠিক আছে, শুরু কর তােমার গল্প। 

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ূন আহমেদ

কোনাে বানরের যখন মধু খেতে ইচ্ছা করে সে তখন নদীর পাড়ে চলে যায়সারা গায়ে কাদা মাখেতারপর রােদে বসে এই কাদা শুকায়আবার যায় কাদায়আবারাে কাদায় হুটুপুটি করে গায়ে কাদা মাখেআবারাে রােদে শুকায়এই প্রক্রিয়াটি কয়েকবার করার পর বানরের গায়ে শক্ত কাদার একটা স্তর পড়ে যায়তখন সে মহানন্দে চাক ভেঙ্গে মধু খায়মৌমাছিরা কাদার স্তরের জন্যে তার গায়ে হুল ফুটাতে পারে নাবুলেট প্রুফ জ্যাকেটের মতাে মৌমাছি প্রুফ কর্দম জামাচাচাজি ঘটনাটা কি আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগছে

হ্যা ইন্টারেস্টিংতাে বটেই। 

সুন্দরবনের মধু নিয়ে আমি এর চেয়েও একশ গুণ ইন্টারেস্টিং একটা গল্প জানিসেটা আজ বলব নাঅন্য একদিন বলব। 

সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছেবৃষ্টি যে মুষলধারে পড়ছে তা না, তবে বাতাস প্রবল বেগে বইছেবাড়ির চারদিকে প্রচুর গাছপালা বলে ঝড়ের মতাে শব্দ হচ্ছেএমন ঝড় বৃষ্টির রাতে আকাশ দেখার প্রশ্নই আসে নামিসির আলি দোতলায় তাঁর ঘরে আধশােয়া হয়ে আছেনকিছুক্ষণ আগেই রাতের খাবারের পর্ব শেষ করে এসেছেনবিছানা থেকে আর নামতে হবে না; এটা ভেবেই শান্তি শান্তি লাগছেঝড় বৃষ্টি শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই আবহাওয়া শীতল হয়েছে

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ূন আহমেদ

ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছেযতই সময় যাচ্ছে ততই ঠাণ্ডা বাড়ছে। মিসির আলি তার গায়ে পাতলা চাদর দিয়েছেনকোলবালিশ আড়াআড়ি রেখে তার উপর পা তুলে দিয়েছেনমােটামুটি আরামদায়ক অবস্থানতাঁর মাথার কাছে টেবিলের উপর একটা হারিকেন এবং কেরােসিনের টেবিল ল্যাম্পতাতেও ঘরে তেমন আলাে হচ্ছে না

মিসির আলির হাতে অশ্বিনী কুমার বাবুর হাতে লেখা ডায়েরিলেখা খুব স্পষ্ট নয় এবং যথেষ্ট পরিমাণে প্যাচানােএই আলােয় পড়তে কষ্ট হচ্ছে তারপরেও স্বস্তির কারণ আছেহঠাৎইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে ঘর অন্ধকার হবে । ঢাকা শহরে ঝড় বৃষ্টি মানেই টেনশন এই বুঝি ইলেকট্রিসিটি চলে গেল

বরকত এসে টেবিলে চায়ের ফ্লাক্স এবং কাপ রেখে গেছেদরজার ছিটকিনি ঠিক করে দিয়ে গেছেমিসির আলির বরকতের সঙ্গে টুকটাক আলাপ চালাবার চেষ্টা করেছিলেনলাভ হয় নিমিসির আলির ধারণা কোনাে এক বিচিত্র কারণে বরকত তাকে পছন্দ করছে না। 

ভালাে দুর্যোগ শুরু হয়েছে। মিসির আলি গাছের ডাল ভাঙ্গার শব্দ শুনলেনঝড় বৃষ্টির সময় গাছের পাখিরা কোনাে ডাকাডাকি করে নাতারা একেবারেই চুপ হয়ে যায়অথচ তাদেরই সবচেবেশি ডাকাডাকি করার কথাকুকুররা মনে হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ পছন্দ করে নামাঝে মাঝেই তাদের ক্রুদ্ধ গর্জন শােনা যাচ্ছে। তারা কেউ আলাদা আলাদা ডাকছে না, যখন ডাকছে তিনজন এক সঙ্গেই ডাকছে। 

আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ূন আহমেদ

মিসির আলি খুব মন দিয়েই ডায়েরি পড়ার চেষ্টা করছেনশুধু কুকুররা যখন ডেকে উঠছে তখন মন সংযােগ কেটে যাচ্ছেকেন জানি কুকুরের ডাকটা 

শুনতে ভালাে লাগছে না। 

অশ্বিনী কুমারের ডায়েরিটি ঠিক ডায়েরির আকারে লেখা নাঅনেক অপ্রয়ােজনীয় জিনিস লেখা আছেকিছু কিছু লেখাতে দিনক্ষণ স্থানকাল উল্লেখ করা। বেশির ভাগ লেখাতেই তারিখ নেইবাজারের হিসাব আছেচিঠির খসড়া আছেআয়ুর্বেদ অষুধের বর্ণনা আছে। ডায়েরির শুরুই হয়েছে আয়ুর্বেদ অষুধের বর্ণনায় । 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *