লিলি বলল, আপনার আসলেই অনেক বুদ্ধি। মন্ত্র যে কিছুই না, সময়ের হিসেব এটা আমিও টের পেয়েছি। কিন্তু আমার অনেক সময় লেগেছে। আপনি সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলেছেন। আপনি কি যে–কোনাে সমস্যার সমাধান সঙ্গে সঙ্গে করে ফেলেন ? এই ক্ষমতা কী সত্যি আপনার আছে ?
মিসির আলি কিছু বললেন না। তিনি লক্ষ করলেন লিলি তীক্ষ্ণ চোখে তাঁকে দেখছে। সে কি কিছু বলার চেষ্টা করছে ? প্রশ্নের ভেতরেও লুকানাে প্রশ্ন থাকে। মেয়েটির এই প্রশ্নের ভেতর লুকানাে কোন প্রশ্ন কি আছে ?
লিলি বলল, মিষ্টি জাতীয় কিছু রান্না করি নি। আপনি কি মধু খাবেন ? মধু এনে দেব ? ঐ দিন খলসা ফুলের মধু খেয়েছেন, আজ কেওড়া ফুলের মধু খান।
লিলি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, আপনি কি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চান? জিজ্ঞেস করতে চাইলে করতে পারেন।
মিসির আলি বললেন, সুলতান চিঠিতে একটা মেয়ের কথা বলেছিল ঐ মেয়েটি সত্যি আছে ? সালমা নাম, পনেরাে ষােল বছর বয়স। অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাসম্পন্ন মেয়ে।
লিলি সহজ গলায় বলল, থাকবে না কেন আছে। দূরবীনওয়ালাকে বললেই সে আপনাকে দেখাবে।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ূন আহমেদ
মিসির আলি বললেন, মেয়েটা থাকে কোথায় ?
লিলি বলল, মেয়েটা কোথায় থাকে তা দিয়ে কি করবেন ? মেয়েটার সত্যি কোনাে ক্ষমতা আছে কি–না এটা জানা জরুরি তাই না?
মেয়েটার সত্যি কি ক্ষমতা আছে ? মেয়েটার শুধু যে ক্ষমতা আছে তা না, ভয়াবহ ক্ষমতা আছে।
তুমি নিজে দেখেছ ? হ্যা। আপনি তাকে দেখে খুবই অবাক হবেন। প্রথমে আপনার বিশ্বাস হবে।
ভাববেন ঠাট্টা করা হচ্ছে। | মিসির আলি বললেন, তুমিই কি সেই মেয়ে?
লিলি হঁ–সূচক মাথা নেড়ে খিলখিল করে হেসে ফেলল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, চাচাজি শুনুন মধু আপনাকে খেতেই হবে। ইচ্ছা না করলেও খেতে হবে দূরবীনওয়ালা যদি শােনে আপনাকে মধু দেয়া হয় নি তাহলে খুব রাগ করবে। আমাকে বলা হয়েছে আজ যেন কেওড়া ফুলের মধু দেয়া হয়।
মধু না খেলে সুলতান রাগ করবে ? রাগের চেয়েও যেটা করবে তা হলাে মেজাজ খারাপ। মিসির আলি বললেন, নিয়ে এসাে তােমার মধু।
লিলি বলল, সুন্দরবনের বানররা মধু কীভাবে খায় এই গল্প কি আপনি জানেন ?
না জানি না।
আপনি আংগুলে মধু মাখিয়ে খেতে শুরু করুন। আমি গল্পটা করি। ছােট বাচ্চাদের যেমন গল্প বলে বলে খাবার খাওয়াতে হয় আপনাকেও সে রকম গল্প বলে বলে মধু খাওয়াব।
ঠিক আছে, শুরু কর তােমার গল্প।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ূন আহমেদ
কোনাে বানরের যখন মধু খেতে ইচ্ছা করে সে তখন নদীর পাড়ে চলে যায়। সারা গায়ে কাদা মাখে। তারপর রােদে বসে এই কাদা শুকায়। আবার যায় কাদায়। আবারাে কাদায় হুটুপুটি করে গায়ে কাদা মাখে। আবারাে রােদে শুকায়। এই প্রক্রিয়াটি কয়েকবার করার পর বানরের গায়ে শক্ত কাদার একটা স্তর পড়ে যায়। তখন সে মহানন্দে চাক ভেঙ্গে মধু খায়। মৌমাছিরা কাদার স্তরের জন্যে তার গায়ে হুল ফুটাতে পারে না। বুলেট প্রুফ জ্যাকেটের মতাে মৌমাছি প্রুফ কর্দম জামা। চাচাজি ঘটনাটা কি আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগছে ?
হ্যা ইন্টারেস্টিংতাে বটেই।
সুন্দরবনের মধু নিয়ে আমি এর চেয়েও একশ গুণ ইন্টারেস্টিং একটা গল্প জানি। সেটা আজ বলব না। অন্য একদিন বলব।
সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টি যে মুষলধারে পড়ছে তা না, তবে বাতাস প্রবল বেগে বইছে। বাড়ির চারদিকে প্রচুর গাছপালা বলে ঝড়ের মতাে শব্দ হচ্ছে। এমন ঝড় বৃষ্টির রাতে আকাশ দেখার প্রশ্নই আসে না। মিসির আলি দোতলায় তাঁর ঘরে আধশােয়া হয়ে আছেন। কিছুক্ষণ আগেই রাতের খাবারের পর্ব শেষ করে এসেছেন। বিছানা থেকে আর নামতে হবে না; এটা ভেবেই শান্তি শান্তি লাগছে। ঝড় বৃষ্টি শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই আবহাওয়া শীতল হয়েছে।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ূন আহমেদ
ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। যতই সময় যাচ্ছে ততই ঠাণ্ডা বাড়ছে। মিসির আলি তার গায়ে পাতলা চাদর দিয়েছেন। কোলবালিশ আড়াআড়ি রেখে তার উপর পা তুলে দিয়েছেন। মােটামুটি আরামদায়ক অবস্থান। তাঁর মাথার কাছে টেবিলের উপর একটা হারিকেন এবং কেরােসিনের টেবিল ল্যাম্প। তাতেও ঘরে তেমন আলাে হচ্ছে না।
মিসির আলির হাতে অশ্বিনী কুমার বাবুর হাতে লেখা ডায়েরি। লেখা খুব স্পষ্ট নয় এবং যথেষ্ট পরিমাণে প্যাচানাে। এই আলােয় পড়তে কষ্ট হচ্ছে তারপরেও স্বস্তির কারণ আছে—হঠাৎইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে ঘর অন্ধকার হবে । ঢাকা শহরে ঝড় বৃষ্টি মানেই টেনশন এই বুঝি ইলেকট্রিসিটি চলে গেল!
বরকত এসে টেবিলে চায়ের ফ্লাক্স এবং কাপ রেখে গেছে। দরজার ছিটকিনি ঠিক করে দিয়ে গেছে। মিসির আলির বরকতের সঙ্গে টুকটাক আলাপ চালাবার চেষ্টা করেছিলেন। লাভ হয় নি। মিসির আলির ধারণা কোনাে এক বিচিত্র কারণে বরকত তাকে পছন্দ করছে না।
ভালাে দুর্যোগ শুরু হয়েছে। মিসির আলি গাছের ডাল ভাঙ্গার শব্দ শুনলেন। ঝড় বৃষ্টির সময় গাছের পাখিরা কোনাে ডাকাডাকি করে না। তারা একেবারেই চুপ হয়ে যায়। অথচ তাদেরই সবচে‘ বেশি ডাকাডাকি করার কথা। কুকুররা মনে হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ পছন্দ করে না। মাঝে মাঝেই তাদের ক্রুদ্ধ গর্জন শােনা যাচ্ছে। তারা কেউ আলাদা আলাদা ডাকছে না, যখন ডাকছে তিনজন এক সঙ্গেই ডাকছে।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ূন আহমেদ
মিসির আলি খুব মন দিয়েই ডায়েরি পড়ার চেষ্টা করছেন। শুধু কুকুররা যখন ডেকে উঠছে তখন মন সংযােগ কেটে যাচ্ছে। কেন জানি কুকুরের ডাকটা
শুনতে ভালাে লাগছে না।
অশ্বিনী কুমারের ডায়েরিটি ঠিক ডায়েরির আকারে লেখা না। অনেক অপ্রয়ােজনীয় জিনিস লেখা আছে। কিছু কিছু লেখাতে দিনক্ষণ স্থানকাল উল্লেখ করা। বেশির ভাগ লেখাতেই তারিখ নেই। বাজারের হিসাব আছে। চিঠির খসড়া আছে। আয়ুর্বেদ অষুধের বর্ণনা আছে। ডায়েরির শুরুই হয়েছে আয়ুর্বেদ অষুধের বর্ণনায় ।