মিসির আলি দ্রুত বিছানা থেকে নামলেন। দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি টেনে দিলেন। টেবিলের কাছে এসে ঘড়ি দেখলেন। রাত তিনটা পঁচিশ। তিনি পরপর দু’গ্লাস পানি খেলেন। তারপরেও তৃষ্ণা কমছে না। তিনি খুব যে নিশ্চিন্ত বােধ করছেন তাও ।
স্বপ্নে যে কোনাে সময় যে কোনাে কিছু ঘটতে পারে। স্বপ্ন ফিজিক্সের সূত্র মেনে চলে না। হয়ত এক্ষুণি দেখা যাবে কুকুরটা বন্ধ দরজা ভেদ করে চলে এসেছে। সে একা আসে নি, সঙ্গি দু’জনকেও নিয়ে এসেছে। মানুষের মতাে কথা বলাও শুরু করতে পারে। না তা করবে না, স্বপ্ন ফিজিক্সের সূত্র না মানলেও সাধারণ কিছু নিয়ম মানে। আট ন’বছরের বাচ্চা যদি কুকুর স্বপ্নে দেখে তাহলে সেই কুকুর তার সঙ্গে কথা বললেও বলতে পারে। মিসির আলি যে কুকুর দেখবেন সে কুকুর কথা বলবে না।
তিনি কি করবেন বুঝতে পারছেন না। বিছানায় উঠে আবার ঘুমিয়ে পড়ার ব্যবস্থা করবেন ? নাকি হাঁটাহাঁটি করবেন ? মিসির আলি জানালার কাছে চলে গেলেন। যদি কুকুরটাকে দেখা যায়। চেরী গাছের নিচে কেউ কি আছে? হ্যা আছে তাে বটেই। ঐতাে হুইল চেয়ারটা দেখা যাচ্ছে। হুইল চেয়ারের পেছনে আছে বরকত। রাত তিনটা পঁচিশ মিনিটে ওরা দু’জন কি করছে? তারা দেখার প্রস্তুতি ?
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ
হঠাৎ মিসির আলির বুকে একটা ধাক্কার মতাে লাগল। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন হুইল চেয়ারে বসা মানুষটা উঠে দাঁড়িয়েছে। এইত হাঁটতে শুরু করেছে। মন্দিরের দিকে কি যাচ্ছে ? হ্যা ঐ দিকেই যাচ্ছে। এখন সিগারেট ধরিয়েছে। আবার ফিরে আসছে। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট এখন ফেলে দিল। এই মানুষটা যে সুলতান তাতে কি কোনাে সন্দেহ আছে ? না কোনাে সন্দেহ নেই। মানুষটা আবার হাঁটতে শুরু করেছে। মিসির আলি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন। না মানুষটা মন্দিরের দিকে যাচ্ছে না। সে মন্দিরের পেছনে যাচ্ছে। মন্দিরের পেছনে আছে কুয়া। এখান থেকে কুয়া দেখা সম্ভব না । কিন্তু স্বপ্নে সম্ভব। মিসির আলি কুয়া দেখার জন্যে অপেক্ষা করছেন। কুয়া দেখা গেল না। মানুষটা চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত মিসির আলি তাকিয়ে রইলেন।
মিসির আলির মাথায় সমুদ্র গর্জনের মতাে শব্দ হচ্ছে। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ। মনে হচ্ছে কাছেই কোথাও সমুদ্র আছে। বড় বড় ঢেউ উঠছে। ঢেউয়ের মাথায় সমুদ্র ফেনা। মাথা এলােমেলাে লাগছে। কেউ কি ভরাট গলায় কবিতা আবৃত্তি করছে ?
I let myself in at the kitchen door. ‘It is you’, she said, ‘I can’t get up. Forgive me. Not answering your knock. I can no more Let people in than I can keep them out.’
এটা কার কবিতা ? মিসির আলি কিছুতেই মনে করতে পারলেন না। ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তিনি বিছানায় শুয়ে পড়লেন। মাথার ভেতর কবিতাটা ভাঙা রেকর্ডের গানের মতাে বেজে যাচ্ছে—
I let myself in at the kitchen door.
‘It is you’, she said, ‘I can’t get up. Forgive me. আমাকে ক্ষমা কর, আমি উঠতে পারছি না। আমাকে ক্ষমা কর, আমি উঠতে পারছি না। can’t get up. Forgive me,
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ
সূর্য ওঠার আগেই মিসির আলির ঘুম ভাঙল। অন্ধকার মাত্র কাটতে শুরু করেছে। টেবিলে রাখা হারিকেন নিভে গেছে। টেবিল ল্যাম্প দপ দপ করছে। যে-কোনাে মুহূর্তেই নিভবে। মনে হচ্ছে হিসেব করে তেল দেয়া। সূর্যের আলাে ফুটবে আর এরা নিভে যাবে। মিসির আলি প্রথমেই তাকালেন দরজার দিকে ছিটকিনি লাগানাে আছে, দরজা বন্ধ । তিনি বিছানায় উঠে বসে মেঝের দিকে তাকালেন— মেঝে ঝক ঝক করছে। ঝড় বৃষ্টির রাতে কোনাে কুকুর উঠে এলে মেঝেতে তার পায়ের দাগ থাকত। মেঝেতে কোনাে দাগ নেই। গত রাতে তিনি মােটামুটি ভয়াবহ একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন এই বিষয়ে কোনাে সন্দেহ থাকার কারণ নেই, তবু সন্দেহটা যাচ্ছে না।
তিনি বিছানা থেকে নামলেন। দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। সকালের প্রথম আলােয় নদী দেখা যাচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলাে নদীটা পাঁচিল ঘেরা বাড়ির সঙ্গে যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ওই বাড়িটার সঙ্গে নদীর কোনাে যােগ নেই। নদী দেখতে ভালাে লাগছে না।
ভেতরের উঠোনে একটা জলচৌকির উপর বরকত দাড়িয়ে আছে। তার হাতে পেতলের বদনা, সে মিসির আলিকে দেখতে পায় নি। মিসির আলি ডাকলেন, “এই বরকত। বরকত ভয়াবহভাবে চমকে উঠল। হাত থেকে বদনা। জলচৌকিতে পড়ে ঝনঝন শব্দ হলাে। এতটা চমকানাের কোনাে কারণ নেই। মিসির আলি বললেন, কী করছ ?
নামাজের অজু করি। ফজরের নামাজ।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২১)-হুমায়ূন আহমেদ
মিসির আলি বিস্মিত হলেন। এত দীর্ঘ বাক্য বরকত তার সঙ্গে এর আগে ব্যবহার করে নি।
তােমার কুকুর কি বাধা আছে ? জ্বি বান্দা। আসেন নিচে আসেন। মিসির আলি নিচে নেমে এলেন। বরকত বলল, চা খাইবেন ? মিসির আলি বললেন, গরম চা খেতে পারলে ভালাে হতাে। নামাজ শেষ কইরা চা দিতাছি।
তােমার কুকুরগুলি কোথায় একটু দেখি।
বরকত আংগুল উঁচিয়ে পেয়ারা গাছের সঙ্গে বাঁধা কুকুরগুলি দেখাল। গলা নামিয়ে বলল, কাছে যান। শইল্যে হাত দেন। আপনেরে কিছু বলব না।
কিছু বলবে না কেন ?
বরকত চাপা গলায় বলল, একটা ঘটনা ঘটাইছি। আপনের জুতা আর কাপড় শুকাইয়া দিছি। অখন এরা আপনের শইল্যের গন্ধ চিনে।
মিসির আলি বললেন, কাজটা তুমি নিজ থেকে করতে বলাে নি। কেউ তােমাকে করতে বলেছে। কে বলেছে ?
বরকত জবাব দিল না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মিসির আলির মনে। হলাে বরকত তার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। এখন আর কথা বলবে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকবে।
মিসির আলি বললেন, গেট খুলে দাও নদীর পাড়ে বেড়াতে যাব। এত কাছে নদী, অথচ নদীই দেখা হয় নি।
বরকত বলল, গেইট খুলন যাইব না। বড় সাবের নিষেধ আছে । নিষেধ ?
জ্বি নিষেধ । আমি খুলতে চাইলেও খুলতে পারব না। চাবি থাকে বড় সাবের কাছে।
চাবি সব সময় বড় সাহেবের কাছে থাকে ?