বরকত শীতল গলায় বলল, সব সময় চাবি উনার কাছে থাকে না। যখন আপনের মতাে কেউ বেড়াইতে আসে তখন চাবি উনার কাছে থাকে।
মিসির আলি বললেন, যাতে অতিথিরা পালিয়ে যেতে না পারে সেই জন্যে ? কি জন্যে সেইটা আমি জানি না বড় সাহেব জানে।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি নামাজ পড়তে যাও। তােমার নামাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে। শেষে নামাজ কাজা হবে।
বরকত গম্ভীর মুখে বলল, ফজরের নামাজ দুপুর পর্যন্ত কাজা হয় না। এর একটা ইতিহাস আছে। ইতিহাসটা শুনবেন ?
বল শুনি।
নবীয়ে করিম একবার দেরি কইরা ঘুম থাইকা উঠছিলেন। নবীয়ে করিমের জন্যে আমরা মাফ পাইছি।
এটা জানতাম না।
ভদ্রলােকরা সব বিষয়ে জানে, ধর্মকর্ম বিষয়ে জানে না। এইটা একটা আফসােস ।
আফসােস তাে বটেই। বরকত তােমার সঙ্গে কথা বলে ভালাে লাগল। আমি বাগানের দিকে যাচ্ছি তুমি নামাজ শেষ করে চা নিয়ে এসাে। দুকাপ চা আনবে। আমার জন্যে এক কাপ তােমার জন্যে এক কাপ। আমরা চা খেতে খেতে গল্প করব। ভালাে কথা আমি যখন তােমাকে ডাকলাম তুমি এত ভয় পেলে কেন ? ভয়ে হাত থেকে একেবারে বদনা পড়ে গেল।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২২)-হুমায়ূন আহমেদ
বরকত জবাব দিল না, তার ঠোটের কোণায় অস্পষ্ট হাসির রেখা দেখা গেল। মিসির আলি হাঁটতে শুরু করলেন, চেরী গাছের নিচে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর দৃষ্টি মাটির দিকে। হুইল চেয়ারের কোনাে দাগ কি মাটিতে আছে ? থাকার কোনােই কারণ নেই। কাল রাতে যা দেখেছেন তার পুরােটাই স্বপ্ন। এই সত্য সন্দেহাতীতভাবে সত্য। তারপরেও দেখা। মানুষের মন এমন যে একবার কোনাে বিষয়ে সন্দেহ উপস্থিত হলে সেই সন্দেহ আর যেতেই চায় না। কাপড়ে ময়লা লেগে যাবার মতাে। যত ভালাে করেই থােয়া হােক অস্পষ্ট দাগ থেকেই যায়। সেই দাগ বারবার ধুতে ইচ্ছা করে।
হুইল চেয়ারের পায়ের রেখা ভেজা মাটিতে আছে। মিসির আলির ভুরু কুঞ্চিত হলাে। স্বপ্নের একটি অংশ কী সত্যি ? মানুষ যেমন মিথ্যা কথা বলার সময় মিথ্যার সঙ্গে কিছু সত্য মিশিয়ে দেয়, স্বপ্নেও কি সে রকম কিছু ঘটে ? মস্তিষ্ক স্বপ্নের সঙ্গে সামান্য বাস্তব মিশায়। মিসির আলি হুইল চেয়ারের দাগ ধরে এগুতে লাগলেন। তাঁকে বেশিদূর যেতে হলাে না, তার আগেই থমকে দাড়াতে হলাে। লাইব্রেরি ঘরের বারান্দা থেকে সুলতান বলল, স্যার কী করছেন ? সুলতানের গলায় চাপা কৌতূহল।
মিসির আলি বললেন, কিছু করছি না। হাঁটছি, প্রাতঃভ্রমণ বলতে পার।
আমার কাছে মনে হচ্ছিল মাটিতে কী যেন খুঁজতে খুঁজতে এগুচ্ছেন। কী খুঁজছেন ? হুইল চেয়ারের পায়ের দাগ?
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২২)-হুমায়ূন আহমেদ
মিসির আলি বললেন, হ্যা। তুমি কাল রাতে হুইল চেয়ার নিয়ে বাগানে ঘুরেছ। কোথায় কোথায় গিয়েছিলে তাই দেখছিলাম।
এই অনুসন্ধানের আপনার বিশেষ কোনাে কারণ আছে কি? না তেমন কোনাে কারণ নেই ?
শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি থামল। আকাশ পরিষ্কার হলাে। আমি বাগানে ঘুরছিলাম, এবং আকাশ দেখছিলাম।
সুলতান হুইল চেয়ার নিয়ে লাইব্রেরি ঘরের বারান্দা থেকে নিচে নামতে শুরু করল। হুইল চেয়ারে বারান্দা থেকে বাগানে নামার জন্যে ব্যবস্থা করা আছে। তার পরেও তাকে নামতে হচ্ছে সাবধানে। সুলতান সহজ গলায় বলল, পঙ্গু মানুষের মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা করে। বাগানে যেতে ইচ্ছা করে।
শীতের সময় বাগানে ঘুরে বেড়ানাে সহজ। বর্ষার সময় বেশ কঠিন। কাদায় চাকা ডেবে যায়। তখন পেছন থেকে কাউকে ঠেলতে হয়। স্যার আপনার রাতের ঘুম ভালাে হয়েছিল ?
হ্যা ভালাে হয়েছে। বেশ ভালাে, নাকি মােটামুটি ভালাে ? বেশ ভালাে। আপনি কি আর্লি রাইজার ?
আজ কীভাবে কীভাবে যেন ঘুম ভেঙে গেছে। আমার কপালে সূর্যোদয় দৃশ্য নেই। শুধুই সূর্যাস্তের দৃশ্য।
সুলতান হালকা গলায় বলল, আমার কপালে সূর্যোদয় দৃশ্য প্রচুর পরিমাণে আছে। আমি রাতে ঘুমাই না। সকালে সূর্য দেখে ঘুমাতে যাই। আমার কপালে সূর্যাস্ত নেই।
মিসির আলি বললেন, আমি তােমাকে ঘুম থেকে বঞ্চিত করছি, যাও শুয়ে পড়।
আমিই মিসির আলি-পর্ব-(২২)-হুমায়ূন আহমেদ
সুলতান বলল, না, আজ আমি আপনার সঙ্গে গল্প করব। চলুন নীল মরিচ ফুল গাছটার কাছে যাই। আপনি বেদীতে বসবেন। আমি বসব হুইল চেয়ারে। আমাদের আই লেভেল ঠিক থাকবে।
মিসির আলি বললেন, বরকতকে চা নিয়ে আসতে বলেছিলাম। তুমি চা খাবে ?
খেতে পারি। চায়ে চিনি কতটুকু খাও ? কেন জানতে চান বলুন তাে? বিশেষ কোনাে কারণ নেই। এমি জিজ্ঞেস করলাম।
দু’চামচ। আমার ধারণা ছিল তুমি চায়ে চিনি খাও না। এ রকম ধারণা হবার কারণ কী ? মধু খাও না তাে তাই ভাবলাম মিষ্টি জাতীয় কিছুই খাও না। সুলতান শীতল গলায় বলল, মধু খাই না আপনাকে কে বলল?
মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, কেউ বলে নি। আমার ধারণা তুমি খাও না। অন্যদের আগ্রহ করে খাওয়াও। আমার ধারণাটা কি ঠিক ?
হ্যা আপনার ধারণা ঠিক। আমি মধু খাই না এই ধারণা আপনার কেন হলাে এটা বুঝতে পারছি না। ব্যাখ্যা করবেন ?
আমার সিক্সথ সেন্স এ রকম বলছিল।
সুলতান কঠিন গলায় বলল, সিক্সথ সেন্স বলে কিছু নেই। এটা আপনি যেমন জানেন, আমিও জানি। আমি মধু খাই না এটা কেন বললেন ?
সুলতান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তার হাতের মুঠি বন্ধ। প্রতিটি লক্ষণ বলে দিচ্ছে সে রেগে গেছে। রাগ সামলাতে পারছে না। মিসির আলি সুলতানের রাগটাকে তেমন গুরুত্ব দিলেন বলে মনে হলাে না। যেন তিনি ধরেই নিয়েছেন সুলতান রাগবে। মিসির আলি গাছের বেদীতে পা তুলে বসলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, সুলতান তােমার কাছে কি সিগারেট আছে ? দিনের প্রথম চা–টা সিগারেট দিয়ে খেতে হয়। আমি আমার প্যাকেট ভুলে উপরে রেখে এসেছি। সিগারেট হাতে নিয়ে বসে থাকি। এর মধ্যে চা চলে আসবে।