নিরাপদ একজন বাঙালি প্রৌঢ়ের নাম, যার কোনও উজ্জ্বল অতীত নেই। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার আছে বলে সে মনে করে না। বর্তমানে সে সদাগরি অফিসে চাকরি করে, যা বেতন পায় তাতে তিন বেলা খাওয়া, ইলেকট্রিক বিল মেটানো, ঠিকে ঝি-এর মাইনে, কেবল এর পাওনা মিটিয়ে মন্দ থাকে না। তবে প্রত্যেক শনিবার সন্ধ্যায় সিনেমা দেখতেই অনেকটা বেরিয়ে যায়।
নিরাপদর অফিসে যাতায়াতের খরচ নেই। তিন কিলোমিটার পথ সে হেঁটেই যায় আসে। এতে
শরীর চাঙ্গা থাকে, পয়সা বাঁচে এবং ধুতি ও শার্ট নষ্ট হয় না। বাসে উঠলে সোমবারে ভাঙা। পোশাক মঙ্গলবারে পরা যায় না। নিরাপদ হেঁটে অফিসে গিয়ে টুলে বসে কাজ করে, চেয়ারে বসলেই হেলান দিতে হয় তাতে শার্ট ভাঁজ পড়তে বাধ্য। কোথাও গেলে কখনই বসে পড়ে না। সোমবারে ভাঙা ধুতি-শার্ট শনিবারে দেখলে যে কেউ ভাববে আজই নিরাপদ পরেছে ওগুলো। শুধু শনিবার সন্ধ্যায় সিনেমাহলের সিটে আরাম করে হেলান দেয় সে। কারণ রবিবার ওগুলো কেচে ফেলবে।
বলা অনাবশ্যক, নিরাপদ অবিবাহিত। গত পঁয়ত্রিশ বছরে হিন্দি চলচ্চিত্রের নায়িকারা ছাড়া কোনও নারী তার জীবনে আসেনি। শনিবারে দেখা সিনেমার নায়িকার সঙ্গে সে দিব্যি সাতদিন থাকতে পারে। বাবা মারা গিয়েছেন ছেলেবেলায়, মা গত হয়েছেন বছর দশেক আগে, দাদার বাসায়। নিরাপদর মনে হয় সে দিব্যি আছে।
নিরাপদ কোনও রাজনীতি করে না, অফিস ইউনিয়নের ঝুট-ঝামেলায় সে নেই। এ কারণে তাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু সে পালটা অজুহাত দেখায় না, হাসিমুখে মেনে নেয়। নিরাপদ এতদিনে বুঝেছে, যে-কোনও উত্তেজনার আয়ু ক্ষণস্থায়ী। ঠিকে ঝি থাকা সত্বেও সে নিজেই রান্না করে। খাওয়া শেষ হওয়ার পর আজকাল মনে হয়, এত পরিশ্রম করে যা তৈরি হল তা খেয়ে ফেললেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। উলটোদিকে প্রবল খিদে সামান্য খাবার পেলেই উধাও হয়ে যায়। এসব বিষয়ে ভাবতে তার ভালো লাগে।
ইদানিং নিরাপদ তার টিভির নব ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে যেসব চ্যানেলে ভূতের গল্প দেখায় তাদের খুঁজে বের করেছে। মানুষ মারা গেলে ভূত হয়। বেঁচে থাকার সময় যাকে কেউ পাত্তা দেয় না ভূত হলে। তার ভয়ে কাঁপে। ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে নিরাপদর কাছে। মুশকিল হল এইসব। অনুষ্ঠান হয় রাত দশটার পরে। ফলে এগারোটার সময় বিছানায় শুয়ে চট করে ঘুম আসে না। ড্রাকুলা, ঘোস্ট, ভূত, পেত্নি, শাকচুন্নিদের মিছিল শুরু হয়ে যায় চোখের সামনে। কয়েকদিন আগে একটু সর্দি হয়েছিল নিরাপদর। কড়া রোদে হেঁটে অফিসে গিয়েছিল, বোধহয় সেই কারণেই বিকেল থেকে শরীর ম্যাজম্যাজ করছিল। সন্ধেবেলায় শুয়ে পড়েছিল, খাওয়ার জন্যেও ওঠেনি। চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোলে বেশ আরাম হয় নিরাপদর।
হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তার। চাদর সরাল মুখ থেকে। ঘর অন্ধকার। শব্দটা মানুষের গলা থেকে বের হচ্ছে, গোঙানির। তাজ্জব হয়ে গেল নিরাপদ। এই ঘরে মানুষ কি করে গোঙাতে আসবে। ঘোস্ট নয় তো? ড্রাকুলা কখনও গোঙাবে না। এবার ভাবল চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে থাকাই উচিত। টিভিতে যাদের দেখলে শিহরন জাগে, সামনাসামনি দেখা ঠিক নয়। কিন্তু সেই সময় ঘরে নীল আলো জ্বলে উঠল। চোখ খুলতেই চমকে গেল নিরাপদ। একটা রোগা বেঁটে লোক চেয়ারের ওপর পা তুলে ঝুঁকে কিছু দেখছে। এই যদি ভূতের চেহারা হয় তাহলে উঠে। বসাই যেতে পারে। চাদর সরিয়ে উঠে বসতেই লোকটা ফিনফিনে নীল আলোয় তাকে দেখতে পেয়েই নাকি খিঁচিয়ে উঠল, অদ্ভুত মানুষ তো! ঘর ভরতি হঁদুর পুষে রেখেছেন। উঃ, বুড়ো আঙুলে এমন কামড়েছে যে রক্ত বন্ধ হচ্ছে না।
ইঁদুর! নিরাপদর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, সেকি!
ন্যাকামি হচ্ছে? জানেন না? এ-ঘরে আপনি ইঁদুর পোষেন না? উঃ!
দিনের বেলায় ওরা থাকে না। তাহলে আজ রাত্রে কোনও গর্ত দিয়ে ঢুকে পড়েছে। নিরাপদ। বিছানা থেকে নেমে বড় আলোটা জ্বালল। সঙ্গে-সঙ্গে লোকটা বলে উঠল, এই সেরেছে, কড়া আলো জ্বালার কি দরকার? উঃ।
নিরাপদ মেঝেতে তাকাল, কোনও ইঁদুরকে দৌড়তে দেখল না। তারপর লোকটিকে দেখল। এরকম নেংটি ইঁদুরের মতো চেহারা সে আগে কখনও দেখেনি। তার ওপর চ্যাপলিনের মতো গোঁফ রেখেছে। নিশ্চয়ই এটা আসল চেহারা নয়। ভূতেরা তো ইচ্ছেমতো চেহারা ধরতে পারে। কড়া আলো তারা সহ্য করতে পারে না।
সে ঢোঁক গিলে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কে? এখানে কেন এসেছেন?
লোকটা গোল-গোল চোখে তাকাল। নিরাপদর মনে হল এখনই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। কিন্তু সুযোগ এসেছে যখন তখন সেটা হতে দেওয়া উচিত নয়। তাই চটপট বলল, আপনি অতিথি, অতিথিকে নারায়ণ বলা হয়।
নারায়ণ? না আমার নাম নারায়ণ নয়। উলটোপালটা বলবেন না।
আপনি এখানে কেন এসেছেন যদি দয়া করে জানান।
মাল হাতাতে। যাকে লোকে চুরি বলে। বুঝলেন? আমি একজন চোর। সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ঢোকার পর অনেকক্ষণ বাইরের দরজাটা খুলে রেখেছিলেন। তখনই নিঃশব্দে ঢুকে পড়েছি। তারপর দেখলাম চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমি ধীরে-সুস্থে খাওয়ার খেয়ে মাল যা নেওয়ার নিয়ে সটকে পড়তাম, টেরও পেতেন না। কিন্তু খাওয়ার পর মনে হল অনেক সময় আছে। একটু রেস্ট নিই। ওই চেয়ারে বসে রেস্ট নিতে গিয়ে একটু ইঁদুরের গায়ে পা দিয়ে ফেলতেই ব্যাটা অসভ্যের মতো কামড়ে দিল। উঃ।
তার মানে আপনি ভূতপ্রেত নন, একজন চোর।
আশ্চর্য! ভূতপ্রেতের কি শরীর থেকে রক্ত বের হয়?
তা ঠিক জানি না। তবে রক্ত চুষে খায়। ড্রাকুলা বলে তাদের।
দূর। ওরা তো সাহেব মেমসাহেব ভূত। বেঁচে থেকে মানুষের রক্ত চুষে বড়লোক হত, মরে গিয়ে খাঁটি রক্ত চোষে। ওষুধ আছে কিছু?
ওষুধ! নিরাপদর খেয়াল হল। তুলো, ডেটল আর ব্যান্ডেজ বের করে বলল, পা চেয়ারে তুলুন ভাই।
ভালো করে বেঁধে দিতেই চেয়ারে বসে পড়ল লোকটা, আমাকে নিতাই বলে ডাকবেন, রাতটা এখানেই থেকে যাই। আপনি মানুষটা খারাপ নন। তাই কথা দিচ্ছি কোনও কিছু চুরি করব না।
আপনি কোথায় থাকেন নিতাইবাবু?
চোরেরা ঠিকানা বলে না। জানেন না? আচ্ছা, একজন চোর দেখেও আপনি চ্যাঁচামেচি করে পুলিশের হাতে তুলে দিলেন না কেন?
আপনাকে প্রথমে চোর বলে ভাবিনি। রোজ ভূতের ছবি দেখি তো, তাই ভেবেছিলাম। লজ্জা-লজ্জা গলায় বলল নিরাপদ।
আপনি স্বচক্ষে তাদের দেখেছেন? নিতাই জিজ্ঞাসা করল।
মাথা নাড়ল নিরাপদ, না।
আপনি কখনও কলকাতার বাইরে যাননি?
আবার মাথা নেড়ে না বলল নিরাপদ।
তাহলে আর কি করে বলবেন। বাপের মুখে শুনেছি, এক কালে এই কলকাতায় চোরেরা বেশ ভালোভাবেই ছিলেন। ভারত স্বাধীন হতেই তেনারা কলকাতার বাইরে চলে গেছেন।
তার মানে? নিরাপদ অবাক।
ওই যে স্বাধীনতার পর দেশদু-টুকরো হল, তখন লক্ষ-লক্ষ মানুষ চলে এল পাকিস্তান থেকে, আর এসে জমে গেল এই কলকাতাতেই, বাপের মুখে শুনেছি। তেনারা আর শান্তিতে থাকতে না পেরে চলে গেলেন গ্রামেগঞ্জে। থাকগে, আঙুলটা কনকন করছে।
একবার ডাক্তার দেখিয়ে নেবেন, ইনজেকশন, টিনজেকশন?
বিরক্ত হল নিতাই, দেখছেন চুরি করে খাই। আজকের রাতটা বেকার গেল। আর খরচা বাড়াতে বলবেন না তো! তার চেয়ে রাত তো বেশি নেই, এখানেই ঘুমিয়ে নিলে কেমন হয়? অবশ্য আলো ফুটলে যদি ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন তাহলে জানিয়ে রাখি, সঙ্গে ছুরি আছে, ক্যাঁক করে পেটে চালিয়ে দেব।
না-না। আপনি নিশ্চিত থাকুন। আপনাকে পুলিশে দিলে আমাকে ঝামেলায় পড়তে হবে।
অফিসে কামাই করে যেতে হবে সাক্ষী দিতে। তা ছাড়া আপনি কত জানেন। ভারত ভাগের জন্যে যেসব সমস্যা হয়েছে তার এই দিকটার কথা তো জানতামই না। আমি চাদর আর বালিশ দিচ্ছি, আপনি ঘুমোন। নিরাপদ বলল।
কিছুক্ষণেই মধ্যেই নিতাই এতজোরে নাক ডাকাতে শুরু করল যে উঠে বসল নিরাপদ। কোনও চোরের এভাবে নাক ডাকা উচিত নয়। শেষপর্যন্ত বাধ্য হল সে নিতাইকে জাগাতে, এত জোরে নাক ডাকছে যে আমি ঘুমোতে পারছি না।
ওই মুশকিল। অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ার পর কিছুতেই আওয়াজটাকে কমাতে পারিনি। একবার এক বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এই শালার নাক ডাকার জন্য ধরা পড়ে রামঠ্যাঙানি খেয়েছি। তবে কি জানেন, যে বাড়িতে কেউ এরকম নাক ডাকে সে বাড়িতে নিশির ডাক শোনা যায় না। নিরাপদে থাকে সবাই। নিতাই উঠে বসল।
নিশির ডাক? নিরাপদ পুলকিত হল।
জলার ভূত। পরিচিত লোকের গলা নকল করে ডেকে বাইরে নিয়ে এসে জলে ডুবিয়ে মারে। শুনেছি সঙ্গীর অভাব হলেই এই রকম করে।
এসব সত্যি।
সত্যি মানে? আপনি বিশ্বাস করবেন না? কাউকে না দেখালে যে মিথ্যে হয়ে যাবে? অদ্ভুত কথা! খেঁকিয়ে উঠল নিতাই।
বিজ্ঞান বলছে ভূতপ্রেত বলে কিছু নেই। ওগুলো নাকি কুসংস্কার। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন ওঁরা।
তাই? ওঁরা কি ভগবান দেখেছেন? কেউ দেখেছে। যে দেখেছে সে কি আর পাঁচজনকে ডেকে দেখাতে পেরেছে? পারেনি। তাহলে ভগবান বলে কিছু নেই। ওদের বলুন না এই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। মেরে পাবলিক বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবে। ভূতেরা অনগ্রসর বলে তাদের নিয়ে যা খুশি করা যায়, না? বেশ খেপে গেল নিতাই। তারপর রায় দিল, শুনুন মশাই মরে গেলে ভূত হয়, মরে যাওয়ার পর কেউ ভগবান হয় না। আপনি দেখতে চান? একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়েও শেষপর্যন্ত মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল নিরাপদ।
নিরাপদর অফিসে পরপর দু-দিন ছুটি। নিতাই বলে গিয়েছিল সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে শালিমার স্টেশনে চলে আসতে। স্টেশনটা ঠিক কোথায় জানা ছিল না। পৌঁছাতে দশ মিনিট দেরি হয়ে গেল। নিতাই পাজামা আর শার্ট পরে দাঁড়িয়েছিল, ঝটপট টিকিট কাটুন। দুটো দীঘা। ট্রেন ছাড়ল বলে।
জনমানুষশূন্য বিশাল প্ল্যাটফর্মের পাশে দাঁড়ানো ট্রেনে পা দিতেই সেটা চলতে শুরু করল। নিতাই শুটকি মাছের চেহারা নিয়ে বসামাত্রই ঢুলতে শুরু করল। নিরাপদ বসল না। এই শার্ট ধুতি আরও দুদিন চালাতে হবে। সে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হেঁটে দরজার পাশে গেল। খবরের কাগজে পড়েছে এরকম একটা ট্রেনের কথা যা সাত তাড়াতাড়ি দীঘায় পৌঁছে দেয়। কিন্তু তারা এই ট্রেনে ফিরতে পারবে না। নিতাই আশ্বাস দিয়েছে, রাতের বাস ধরে ভোরে ফিরে যাবে কলকাতায়। নাঃ, শার্টটা বাঁচানো গেল না। রাতের বাসে তো বসেই যেতে হবে। নষ্ট যখন হবেই তখন আর কষ্ট করে কি লাভ, নিরাপদ একটা ফাঁকা সিটে বসে পড়ল।
ট্রেন থেকে নেমেই নিতাই বলল–শরীর খাওয়ার চাইছে। কষ্ট না দেওয়াই ভালো, চলুন। একটা পাইস হোটেলে ঢুকে সে-ই ভাত তরকারি মাছের অর্ডার দিল। ওই রকম একটা শুটকো লোক যে অত ভাত খেতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করত না নিরাপদ। হাত ধোয়ার পর নিতাই জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি দাম দেবেন?
মানে?
না দিতে চাইলে দৌড়তে হবে। দৌড়তে পারবেন তো?
ভ্যাট।বলে নিরাপদ দাম মিটিয়ে দিতে দেখল পঞ্চাশ টাকা বেরিয়ে গেল।
একটা ভ্যানরিকশাওয়ালার সঙ্গে দরাদরি করে নিরাপদকে নিয়ে উঠে বসল নিতাই। ইচ্ছে করলে আধশোয়া হতে পারেন। অনেকটা পথ।
কোথায় যাচ্ছি আমরা?
তেনাদের দেখতে।
নিরাপদ চারপাশে তাকাল। দূরে বালির ঝড় উঠেছে। ঘণ্টাখানেক বাদে ভ্যানওয়ালা বলল, আর যাবে না।
নিতাই তর্ক করল কিন্তু লোকটা অনড়। অতএব তিরিশটাকা লোকটার হাতে গুনে দিতেই নিরাপদ শুনল, আপসোস করবেন না। সুদে মূলে উশুল হয়ে যাবে।
মানে? খিঁচিয়ে উঠল নিরাপদ।
হাঁটুন। নিতাই হাঁটতে শুরু করল।
বালি, কাঁটাঝোঁপ, চড়াই-উতরাই বিশাল ঝাউগাছের জঙ্গল। নিতাই বলল, এসে গেছি। ওই দেখুন। গাছের ডালে কত ন্যাকড়া বাঁধা রয়েছে, দেখছেন তো, ওগুলো শুধু ন্যাকড়া নয়, তেনাদের আস্তানা। দিনের বেলায় ওখানে থাকেন।
সেকি! গা ছমছম করে উঠল নিরাপদর। কোনও লোক তো চোখে পড়ছে না। একটা ছাগলও নয়। সন্ধের পর জায়গাটা যে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। জীবনে কখনও কোনও ব্যাপারে সে উৎসাহ দেখায়নি। কি দরকার ছিল এই নিতাইয়ের কথায় নাচার? টিভিতে ভূতের অনুষ্ঠান দেখেই তার কাল হল। পকেটে এখন শতিনেক আছে। নিতাই-এর লোকজন যদি সেটা ছিনতাই করে নেয় তাহলে তো কলকাতায় ফেরাই হবে না। এই সময় নিতাই বলল, চলুন, ক্ষেন্তির ঘুম ভাঙার সময় হয়েছে।
ক্ষেন্তি? ক্ষেন্তি কে? নিরাপদ শুনল ঝাউগাছে হাওয়ায় অদ্ভুত শব্দ তুলছে।
আমার ওয়াইফ। ঝাউগাছের জঙ্গলে ঢুকল নিরাপদ।
সামনে কয়েকটা ঝাউগাছের আড়াল, মাঝখানে অনেকটা খোলা বালিতে সে একটি সুন্দর বাঁশ বাখারির ঘর দেখতে পাবে কল্পনা করেনি নিরাপদ। ঘরটির উলটো দিকে একটা চালার নিচে ভয়ঙ্কর নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর সামনে হাঁড়িকাঠ। নিতাই সাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করে বলল, ইনি মানরকেশ্বরী। খুব জাগ্রত দেবী, প্রতি শনিবার এবং অমাবস্যায় এইখানে শয়ে-শয়ে ভক্ত আসেন। এসে তাঁরা সপ্তাহের ভোগ নিয়ে যান অন্যদিন তাঁদের আসা নিষেধ। কুকুরগুলো কোথায়? চারপাশে তাকাল সে।
কুকুর?
হ্যাঁ। ছয়টি কুকুর এই জায়গা পাহারা দেয়। আজ কোথায় গেল? নিতাই ঘরের দরজায় গিয়ে উঁকি মারতেই নারীকণ্ঠের হুঙ্কার শোনা গেল। কে? কে ওখানে? এতবড় সাহস? এখানে আসার দিন যে আজ নয় তা ভুলে গেছিস? তড়িঘড়ি নিতাই বলে উঠল, আমি, আমি গো, নিরাপদ বাবুকে নিয়ে আসতে হল।
আবার শঙ্করাকে সঙ্গে এনেছ। সে তোমাকে কোন বৈতরণী পার করাবে। অ্যাঁ? ঘরের দরজায় যিনি আবির্ভূত হলেন তাঁকে দর্শন করে হাঁ হয়ে গেল নিরাপদ। নিতাই-এর থেকে অন্তত এক ফুট বেশি লম্বা, চুড়া করে বাঁধা চুল, লাঙ্গি হলেও শরীরে বাঁধুনি আছে, গায়ের রং কাঁচা সোনার। মতো, আর চোখ যে কারও অত বড় হয়, টানা হয় জানা ছিল না। সেই চোখ ঘুরিয়ে তিনি। নিরাপদকে দেখলেন। তারপর অদ্ভুত হেসে বললেন, শেষপর্যন্ত আসা হল।
নিরাপদ বলল, অ্যাঁ।
জন্মের মধ্যে কর্ম এই একবারই করলে। পুরুষমানুষ মানেই লোচ্চা, লম্পট, মনে শরীরে কীট কিলবিল করছে। কিন্তু এ তো দেখছি অনাঘ্রাত ফুল। আহা! প্রকৃত আধার। একটা মাদুর বিছিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, বসা হোক।
তবে? মাঝরাতে আলাপ হয়েছে, তবু ঠিক চিনেছি। কুকুরগুলো কোথায়?
ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি। সন্ধের মুখে জাগবে। তা নামখানা কি?
নিরাপদর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন, তাই সে মুখ খুলল, নিরাপদ মিত্র।
কুটিল কায়েত। কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছেনা। আগমনের কারণ?
তেনাদের দেখতে চায়। নিতাই টুক করে বলল।
চুপ! নিশ্চয়ই চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলে। ঠিক কিনা?
মাথা নাড়ল নিতাই, তুমি মাইরি কি করে যে সব ঠিকঠাক বলে দাও। ওই আর কি!
এবার দূর হও।
তা কি করে সম্ভব? ওঁকে নিয়ে এসেছি, ফেরত নিয়ে যেতে হবে। আসলে ওঁর বাসনা তেনাদের দেখবেন। সন্ধের পর যদি দেখিয়ে দাও তাহলে রাতে বাস ধরব আমরা। কথা দিচ্ছি, একটাও কথা বলব না, মুখে কুলুপ মেরে পড়ে থাকব।
তুমি এই চৌহদ্দিতে থাকবে না। যাও, দিঘার বাস গুমটিতে গিয়ে বসে থাক। আপদ। দ্রুত ঘরে ঢুকে গেলেন তিনি। বেরিয়ে গেলেন তখনই, এই নাও, পঞ্চাশ টাকা। যা গিলবার সেখানে গিয়ে গেল।
খপ করে টাকাটা নিয়ে নিতাই নিরাপদ দিকে ঘুরে দাঁড়াল, তাহলে আমি চলি। সাধ মিটে গেলেই চলে আসবেন দিঘার বাসগুমটিতে।
কিন্তু–।
আচ্ছা, আমরা যেখানে ভ্যানরিকশা থেকে নেমেছিলাম সেখানেই আপনার জন্য অপেক্ষা করব। হনহনিয়ে চলে গেল নিতাই।
এই যে গামছা আর ধুতি। পাশেই পুকুর আছে, ডুব দিয়ে আসা হোক। পথের ময়লা ধুয়ে যাবে। আমি ততক্ষণ খাবারের ব্যবস্থা করি।
গামছা আর কাপড় হাতে নিয়ে নিরাপদ জিজ্ঞাসা করল, এসব না করলেই নয়?
দুষ্টু। জলে নামতে এত ভয় কেন? এদিকে যে বেলা পড়ে যাচ্ছে।
স্নান শেষে ধুতি পরে গা মুছে নিজের ধুতি গেঞ্জি শার্ট পরিপাটি ভাঁজ করে ফিরে আসতেই কোথাও শিয়াল ডেকে উঠল ভর বিকেলে।
আয় আয় চলে আয়। খাবারের গন্ধ পেয়েছে। আয় রে। আধ থালা ভাত নিয়ে ঘরের ওপাশে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। সঙ্গে-সঙ্গে জঙ্গলের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এলো শিয়ালটা। মাটিতে ঢেলে দেওয়া ভাত গোগ্রাসে খেয়ে চুপচাপ বসে রইল।
এক থালা ছাড়ানো ফল ঘরের দাওয়ায় রেখে তিনি বললেন, খাওয়া হোক।
নিরাপদর ফল খাওয়া অভ্যেস নেই। বারান্দার এক কোণে শার্ট ধুতি রেখে সে মাথা নাড়ল, আমার খিদে পায়নি।
অ। যখন পাবে খেয়ে নিলে খুশি হব। যাই পুজোয় গিয়ে বসি।
মহিলা গিয়ে বাবু হয়ে বসলেন–মানরকেশ্বরীর সামনে। প্রদীপ জ্বাললেন। তারপর হাতজোড় করে যা গাইতে লাগলেন তার মাথা বুঝল না নিরাপদ। অন্ধকার নেমে এসেছে পৃথিবীতে। আকাশে একটু মেঘ। হাওয়া নেই।
মহিলা মন্ত্রপাঠ করতে-করতে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সোজা বসে থাকা নিরাপদর সামনে এসে তার বুকে হাত রাখলেন, তেনাদের দেখতে চেয়েছিলি? হকচকিয়ে গেল নিরাপদ, না, মানে–
কাকে দেখবি?ব্রহ্মদত্যি?মামদো ভূত, মেছো ভূত, জলার ভূত, ঝাউ ভূত, না শাঁকচুন্নি কাকে দেখার ইচ্ছে তোর? এতক্ষণ ভাববাচ্যে কথা হয়েছে, এবার সরাসরি তুই।
কেঁপে উঠল নিরাপদ, কাউকে না।
তাহলে এসেছিস কেন?
বিশ্বাস হয়নি কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তেনারা আছেন।
না দেখলে ফিরতে পারবি না। ঠিক করে বল, কাকে দেখবি? ভয় নেই তোর, আমি তো আছি। হাত সরাল না নারী।
ডা-ডা-ড্রাকুলা।
সেটা আবার কে? কোনও হিন্দু ভূতের ওই নাম হয় না। ঠিক আছে, তুই বাড়ি যা, তবে তোর সঙ্গে একজন শাঁকচুন্নিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ও এখানে থাকতে চাইছিল না। ও তোকে পাহারা দেবে বাকি জীবন, তোকে বিপদ থেকে রক্ষা করবে। অন্য ভূতেরা টের পাওয়ার আগেই ওকে নিয়ে চলে যা। যাঃ।
সেই ফিনফিনে অন্ধকারে হাঁটা শুরু করে শেষপর্যন্ত দৌড়তে লাগল নিরাপদ। পেছনে যেন কীসের শব্দ হচ্ছে। ঘাড় ফিরিয়ে সে দেখতে সাহস পাচ্ছিল না কোনও শাঁকচুন্নি পেছন-পেছন আসছে কিনা। বাসগুমটিতে যখন পৌঁছাল তখন নিরাপদর শরীরে শক্তি নেই। লোকজন ভিড় করল। নিতাই উদয় হয়ে জিজ্ঞাসা করল, একি! আপনি। ধুতি-শার্ট কোথায়? রেখে এসেছেন ওখানে? চলুন ফেরত নিয়ে আসি।
নিরাপদ কোনওমতে না বলল। নিতাই একটা ট্রাক-ড্রাইভারকে ধরে নিরাপদকে নিয়ে ফিরে এল কলকাতায়। তারপর থেকে সে আর ঘর থেকে বেরুচ্ছে না। কেবলই মনে হচ্ছে তার ঘরে কেউ আছে। উঠতে বসতে পাশ ফিরতে মনে হচ্ছে সে এখন আর একা নেই। নিরাপদ এখন ধুতি জামা পরে খাটে চেয়ারে স্বচ্ছন্দে বসে। এখন আর নিজেকে একা মনে হয় না।
শুধু তার ঘরে ইঁদুরের সংখ্যা খুব বেড়ে গেছে।