ইবনে খালদুন [১৩২২ –১৪০৬ খ্রিঃ]
মানব জাতির কল্যাণে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন যুগে যুগে এ ধারাতে পাঠিয়েছেন অসংখ্য নবী-রাসূল ও মনীষীদেরকে । যে ক’জন মুসলিম মনীষী মানুষের কল্যাণে বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসা, শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস, প্রভৃতি বিষয়ে তাঁদের অমূল্য অবদানের জন্য আজও সমগ্র বিশ্বে অমর হয়ে আছেন, ব্যক্তি স্বার্থের জন্যে যারা কখনো অন্যায় ও অসত্যের কাছে মাথা নত করেননি, যারা জ্ঞান সাধনার উদ্দেশ্যে দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন ।
ভোগ বিলাসকে উপেক্ষা করে যারা সারাটা জীবন কাটিয়েছেন মানুষের কল্যানে, যারা জালেম শাসকদের স্বৈরাশাসনকে সমর্থন না দিয়ে কারাগারে কাটিয়েছেন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, তাঁদের মধ্যে ইবনে খালদুন অন্যতম ।
১৩২২ খ্রিস্টাব্দের ২৭মে আফ্রিকার তিউনিসিয়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন । ইবনে খালদুনের পুরো নাম আবু জায়েদ ওয়ালী উদ্দিন ইবনে খালদুন । তাঁর পিতার নাম মুহাম্মদ ইবনে খালদুন । ‘খালদুন’ হচ্ছে বংশের উপাধি । তাঁর পূর্ব পুরুষগণ ইয়েমেন থেকে এসে তিউনিসিয়া বসতি স্থাপন করেন । তাঁর পিতামহ তিউনিসিয়ার সুলতানের মন্ত্রী ছিলেন । পিতা ছিলেন খুব জ্ঞান পিপাসু ।
Biography Of IBN Khaldun In Bangla
বাল্যকাল থেকে ইবনে খালদুন জ্ঞান সাধনায় মশগুল হন । তাঁর মেধা ও স্মরণশক্তি ছিল বিস্ময়কর । মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি পবিত্র কুরআনের তাফসীর শিক্ষা শেষ করেন । দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ বিজ্ঞান, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান সাধনার প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ । যে কোন বিষয়ে কোন বই পেলেই তা তিনি পড়ে শেষ করে ফেলতেন । ফলে অল্প বয়সেই তিনি বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞান লাভ করেন ।
পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায় যে, প্রায় প্রত্যেক মনীষীই নিজ মাতৃভূমিতে মর্যাদা পাননি বরং নির্যাতিত, বিতাড়িত এবং ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন । ইবনে খালদুন ও তাঁদের থেকে আলাদা নন । তিউনিসিয়ার ‘বগী’ রাজ্যে তিনি বেশি দিন অবস্থান করতে পারেননি । সেখানে তিনি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হন । সুলতান আবু আবদুল্লাহকে তাঁর ভাই আবুল আব্বাস হত্যা করে রাজ্য ছিনিয়ে নেন এবং ইবনে খালদুনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করেন । তিনি কোন উপায়ে বগী রাজ্য ত্যাগ করে চলে যান তেলেমচীন রাজ্যে যা মরক্কোর একটি ক্ষুদ্র রাজ্য ছিল ।
Biography Of IBN Khaldun In Bangla
মরক্কোর সুলতান আবদুল আজীজ ইবনে আল হাসান এ ক্ষুদ্র রাজ্যটি দখল করে নিলে তিনি সুলতানের হাতে বন্দি হন । সুলতান ইবনে খালদুনের জ্ঞান প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে মুক্তি দানের আদেশ দেন । তখন প্রায় অধিকাংশ দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত । আন্দলুসিয়ার সুলতান কর্তৃক মরক্কো দখল হলে ইবনে খালদুন পুনরায় গ্রেফতার হন এবং আনুমানিক ১৩৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মুক্তি লাভ করেন ।
মুক্তি পেয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ে তিনি চলে আসেন আন্দলুসিয়ায় এবং জ্ঞান সাধনা ও ইতিহাস রচনায় মনোনিবেশ করেন । কিন্তু এখানেও তিনি শান্তি ও নিরাপত্তা পেলেন না । জালেম, নিষ্ঠুর ও ক্ষমতা লিপ্সু শাসকদের ষড়যন্ত্রের কারণে তাঁকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে, পোহাতে হয়েছে অনেক দুর্ভোগ । এ সময় আন্দালুসিয়ার সুলতান ছিলেন আল আহমার । তিনি ইবনে খালদুনকে খুব সম্মান দিয়েছিলেন । কিন্তু এ সময় মরক্কোর নতুন আমীর ইবনে খালদুনকে গ্রেফতার করার জন্যে লোক পাঠালেন ইবনে খালদুন আন্দালুসিয়া ত্যাগ করে চলে যান উত্তর আফ্রিকায় । সে সময় উত্তর আফ্রিকায় ইবনে খালদুনের খুব প্রভাব ও সুখ্যাতি ছিল ।
Biography Of IBN Khaldun In Bangla
তিনি ছিলেন এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব । যিনি দুঃখ কষ্টকে বরণ করে নিয়েছেন । কিন্তু সত্য ও ন্যায়কে প্রকাশ করতে কাউকে ভয় করতেন না । তখন তেলেমচীনের আমীর আবু হামুর এর মন্ত্রী ছিলেন তাঁর ভাই ইয়াহিয়া । তিনি এখানে সর্ব সাধারণ বিশেষ করে গরীব ও সমাজের নির্যাতীত ও নিপীড়িত মানুষের সাথে মেলামেশা করতে লাগলেন । ক্রমে ক্রমে ইবনে খালদুনের মানব সেবা, প্রতিভা ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে জনগণ তাঁর ভক্ত হতে লাগল এবং তাঁর নিকট তাদের বিভিন্ন অভাব অভিযোগের কথা প্রকাশ করতে শুরু করল ।
আমীর আবু হামু ভাবলেন, জনগণ ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে ইবনে খালদুনের বিরুদ্ধে প্রজা বিদ্রোহের অভিযোগ উত্থাপন করেন । এতে ইবনে খালদুন তেলেমচীন ত্যাগ করে বানু আরিফ প্রদেশে চলে যান এবং শান্তিতে বসবাস শুরু করেন । এখানে তিনি আমীর মুহাম্মদ ইবনে আরিফের দেয়া নিরাপত্তা ও সহযোগিতায় বিশ্ববিখ্যাত কিতাব ‘আল্ মোকাদ্দিম’ রচনা করেন । এ কিতাবের মাধ্যমে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ বিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক ও দার্শনিক হিসাবে সুখ্যাতি লাভ করেন ।
’আল মুকাদ্দিমায়’ তিনি যে মৌলিক চিন্তা ধারার পরিচয় দিয়েছেন তা পৃথিবীতে আজও বিরল । তিনি সুস্পষ্ট ভাষাই বলেছেন যে, ঐতিহাসিক বিবরণ ও ঘটনাপঞ্জী লিপিবদ্ধ করাই ঐতিহাসিকের কাজ নয় এবং জাতির উত্থান পতনের কারণগুলো সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন ।
Biography Of IBN Khaldun In Bangla
১৩৮০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মাতৃভূমি তিউনিসে পুনরায় ফিরে আসেন কিন্তু মাতৃভূমির জনগণ তাঁকে সম্মান দেয়নি । অবশেষে ১৩৮২ খ্রিস্টাব্দে চলে যান মিসরে । সেখানে তিনি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং পরবর্তীতে মিসরের সুলতান তাঁকে প্রধান বিচারপতির পদে নিযুক্ত করেন ।
মিসরের কায়রোতে তিনি প্রায় ২৪ বছর কাটিয়েছিলেন । এখানেই তিনি ‘আত তারিক’ নামক আত্মচারিত্র গ্রন্থ রচনা করেন । তিনি সমাজ বিজ্ঞান ও বিবর্তনবাদ সম্পর্কে অনেক নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করেন । বিবর্তনবাদের নতুন তথ্য ইবনে খালদুনই সর্ব প্রথম উদ্ভাবন করেছিলেন । ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর লেখা ‘কিতাব আল ইবর’ বিশ্বের প্রথম এবং সর্ববৃহৎ ইতিহাস গ্রন্থ ।
ইবনে খালদুনের বিভিন্ন রচনাবলী ইউরোপে বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হবার পর সমগ্র বিশ্বে তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে । উল্লেখ্য যে, এমন এক সময় ছিল যখন মুসলিম জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যে পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত ছিল । পরবর্তীতে ইউরোপের লোকের মুসলিম মনীষীদের জ্ঞান বিজ্ঞান ও শিল্প সাহিত্যকে চর্চা করে ক্রমান্বয়ে আজ শিখরে উঠেছে । কিন্তু মুসলিম জাতি তাদের পূর্ব পুরুষদের সুবিশাল জ্ঞান ভান্ডারকে উপেক্ষা করায় আজ বিশ্বের বুকে অশিক্ষ, দারিদ্র ও পরমুখাপেক্ষী জাতি হিসেবে পরিণত হয়েছে ।
Biography Of IBN Khaldun In Bangla
১৪০০ খ্রিস্টাব্দে দিগ্ধিজয়ী বাদশা তৈমুর সিরিয়া আক্রমাণ করেন এবং মিসর অভিযানের প্রস্তুতি নেন । ঠিক এ সময় ইবনে খালদুন মিসরের সুলতানের অনুরোধে একটি শান্তি চুক্তির প্রস্তাব নিয়ে বাদশা তৈমুরের দরাবরে উপস্থিত । দীর্ঘ আলোচনার পর বাদশা তৈমুর ইবনে খালদুনের জ্ঞান, বুদ্ধি ও প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর শান্তি প্রস্তাব মেনে নেন ।
তৈমুর তাঁর মিসর অভিযান স্থগিত ঘোষণা করেন । এভাবে ইবনে খালদুন তাঁর জ্ঞান ও প্রতিভা দিয়ে একটি অনিবার্য সংঘাত থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করলেন । বাদশা তৈমুরের বিশেষ অনুরোধে ইবনে খালদুন দামেস্কে কিছুদিন অবস্থান করেন । এরপর ফিরে আসেন মিসরে । মিসরেই এ বিখ্যাত মনীষী ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন । এ মনীষী মুসলিম জাতির জন্যে যে জ্ঞান রেখে গেছেন তা ইতিহাসে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে ।