ঈদের আগের দিন বিকেলে আমাদের বাসায় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলো। বেশ বড় রকমের দুর্ঘটনা। আমার মেয়ের ঈদের জামাটা তার এক বান্ধবী দেখে ফেললো। দেখার কোন সম্ভাবনা ছিলো না। বাক্সে তালাবন্ধ করে একটা কাগজের প্যাকেটে মুড়ে রাখা হয়েছিলো। কপাল খারাপ থাকলে যা হয়–বোতাম লাগাবার জন্যে জামা বের করা হয়েছে ওমনি বান্ধবী এসে হাজির। আমার মেয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করেও তার জামা। লুকাতে পারলো না। সে আকাশ ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলো–জামা পুরানো হয়ে গেছে। জামা পুরানো হয়ে গেছে।
সবকিছুই পুরানো করা চলে। ঈদের জামা জুতো তো পুরানো করা চলে না। জুতোর প্যাকেটটি বুকের কাছে নিয়ে রাতে ঘুমুতে হয়। জামাটা খুব কম করে হলেও পাঁচবার ইস্ত্রি করতে হয়। এবং দিনের মধ্যে অন্তত তিনবার বাক্স খুলে দেখতে হয় সব ঠিক আছে কি না। কিন্তু অন্য কেউ দেখে ফেললেই সর্বনাশ। ঈদের আনন্দের পনেরো আনাই মাটি।
বান্ধবী জামা দেখে ফেলেছে এই দুঃখে আমার মেয়ে যখন কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলো, তখন বললাম, চল যাই আরেকটা কিনে দেব। রাত দশটায় তাকে নিয়ে জামা কিনতে বেরুলাম। চারদিকে কি আনন্দ! কি উল্লাস! শিশুদের হাতে বেলুন। মায়েদের মুখভর্তি হাসি। হাতে কেনাকাটার ফর্দ। বাবারা সিগারেট ধরিয়ে। গম্ভীর ভঙ্গিতে হাঁটছেন।
আগে যেসব ছোট ছোট শিশু শুকনো মুখে পলিথিনের ব্যাগ বিক্রি করতো, তারা আজ খুব হাসছে। খুব বিক্রি হচ্ছে ব্যাগ। এক ভদ্রলোককে দেখলাম তিনটি ব্যাগ কিনলেন। তিন টাকা দাম। তিনি একটা কচকচে পঁচ টাকার নোট দিয়ে বললেন, যা দুটাকা তোর বকশিশ। ছোট বাচ্চাটি পাঁচ টাকার নোটটি নিশানের মত এক হাতে উঁচু করে ধরে ছুটে চলে গেলো।
আমার মনে হলো আজ রাতে কোথাও কোন দুঃখ নেই। আজ কোন স্বামী-স্ত্রীর ভেতর ঝগড়া হবে না। প্রেমিকারা আজ সুন্দর সুন্দর চিঠি লিখবে ভুলে-যাওয়া। প্রেমিকদের। একজন ভিখিরিও হয়ত তার বহুদিনের শখ মেটানোর জন্যে দেড় টাকা খরচ করে একটা ৫৫৫ সিগারেট কিনে ফেলবে। উড়ির চরে আজ রাতে কোন বৃষ্টি হবে না। শিশুদের আনন্দ আমাদের সব দুঃখ ঢেকে ফেলবে।
বাস্তব অবশ্যই অন্যরকম। অনেক বাড়িতে অন্য সব রাতের মত আজ রাতেও হাঁড়ি চড়বে না। উপোসী ছেলেমেয়েরা মুখ কালো করে ঘুরঘুর করবে। যাদের বাড়িতে হাঁড়ি চড়বে, তাদের দুঃখও কি কম? হয়তো কারোর একটি ছোট ছেলে ছিল, আজ সে নেই। সে তার বাবা মা’র কাছে নতুন শার্ট-প্যান্টের বায়না ধরেনি। ঘুমুতে যাবার সময় মাকে জড়িয়ে ধরে বলেনি, আম্মা, খুব ভোরে ডেকে দিও। আজ রাত ঐ পরিবারটির বড় দুঃখের রাত! বাবা-মা আজ রাতে তাদের আদরের খোকনের ছবি বের করবেন। শূন্য ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখবেন। এখনো খোকনের ছোট্ট জুতো জোড়া সাজানো, তার ছোট্ট শার্ট, ছোট্ট প্যান্ট আলনায় ঝুলছে। শুধু সে নেই। আগামীকাল ভোরে হৈ-হৈ করে সে ঘর থেকে বেরুবে না।
ঈদের নামাজ পড়লাম নিউ মার্কেটের মসজিদে। ফিরবার পথে দেখি আজিমপুর কবরস্থানের গেট খুলে দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ সেখানে। একজন বাবা তার তিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে কবরস্থানে এসেছেন। ছেলেমেয়েদের গায়ে ঝলমলে পোশাক। ওরা একটি কবরের পাশে গোল হয়ে পঁড়িয়ে আছে। কবরটির উপরে একটি ময়লা কাগজ পড়ে ছিলো। বড় মেয়েটি সে কাগজটি তুলে ফেলে গভীর মমতায় কবরের গায়ে হাত রাখলো। বাবাকে দেখলাম রুমাল বের করে চোখ মুছছেন। এটি কার কবর? বাচ্চাগুলির মার? আজকের এই আনন্দের দিনে এই মা ফিনি রান্না করেননি। গভীর মমতায় শিশুদের নতুন জামা পরিয়ে দেননি। নতুন শাড়ি পরে তিনি আজ আর লজ্জিত ভঙ্গিতে স্বামীর পাশে এসে দাঁড়ায়ে বলেননি–কি, তোমাকেও সালাম করতে হবে নাকি?
আসলে আমাদের সবচে’ দুঃখের দিনগুলিই হচ্ছে উৎসবের দিন।*
———-
- এই লেখাটা ঈদের লেখা হিসেবে দৈনিক বাংলায় ছাপা হয়। তার কিছুদিন পর আমার ছোট ছেলেটি মারা যায়। আমি অবিকল এই রচনাটির মত আমার তিনটি বাচ্চা এবং স্ত্রীকে নিয়ে ঈদের দিন আমার বাচ্চাটির কবর দেখতে যাই। আমার বাচ্চারা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে থাকে…