উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ

তুমি কি আজকাল ধর্মকর্ম করছ ? দাড়ি দেখে বলছিস? ফজর আর মাগরেবের নামাজটা পড়ার চেষ্টা করিমুহিব হঠাৎ বলে বসল, বাবা, তুমি কি খুব কষ্টে আছ ? উড়ালপঙ্খিকথাটা মুহিব খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, কিন্তু শামসুদ্দিনের চোখে সঙ্গে সঙ্গে পানি এসে গেলগলা ভারী হয়ে গেলতিনি অবহেলার একটা ভাব চোখেমুখে এনে বললেন, কষ্টে আছি তােকে কে বলল ? সুখে আছি বুঝলিসংসারের টেনশন মাথায় নাইরাতে যখন ইচ্ছা শুয়ে পড়লাম, আবার ইচ্ছা করল সারা রাত বসে রইলামকারাে কিছু বলার নেই

Freedomএর আনন্দের কাছে সব আনন্দ তুচ্ছএই বিষয়ে কোলরিজের একটা বিখ্যাত বাক্য আছেমনে পড়লেই তােকে বলবআজকাল স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে গেছে| মুহিব ফট করে বলে বসল, বাবা, যমুনা মেয়েটা কোথায় ? যার জন্যে তুমি আমাদের সবাইকে ফেলে রেখে চলে এলেযে মেয়ের জন্যে তুমি এতটা করলেসে তােমাকে এই অবস্থায় রেখে চলে গেল কেন ? | শামসুদ্দিন খুবই বিব্রত বােধ করছেনছােটবেলায় মুহিবের অভ্যাস ছিল বাবার বুকের উপর শুয়ে ঘুমানােসেই ছেলে এমন কঠিন প্রশ্ন করছে

মুহিব বলল, তােমার জবাব দিতে ইচ্ছা না হলে জবাব দিও নাচা বানাও চা খাই। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ

শামসুদ্দিন চা বানালেনঘরে দুধ নেই, লিকার চাতিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে খুশি খুশি গলায় বললেন, আদাচা বানিয়ে দিলামখেয়ে দেখ, শরীর ঝরঝরে হয়ে যাবেকোরান শরীফে আদার রেফারেন্স আছে এটা জানিস

আল্লাহপাক বলেছেন, বেহেশতে তােমাকে দেয়া হবে আদা মিশ্রিত পানীয়আল্লাহপাক আদাচায়ের কথাই বলেছেন কিনা কে জানে। 

বাবা, তােমার শরীর কিন্তু খুবই খারাপ করেছেচোখ ফুলে গেছেহাত পা ফুলে গেছেশরীরে মনে হয় পানি এসেছে। 

বুড়াে বয়সে শরীরে পানি তাে আসবেইআমার তাে তাও কম এসেছেঅনেকের এমন পানি আসে যে শরীরেই জোয়ারভাটা হয়হা হা হা হা| মুহিব তাকিয়ে আছেশামসুদ্দিন সাহেব হেসেই যাচ্ছেনঅনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললেন, তাের বন্ধুবান্ধবরা কেমন আছে

কোন বন্ধুরা

যে কিছু বেকার বন্ধুরা ক্লাবের মতাে কী যেন করেছিসক্লাবটাব কিছু নামাঝে মাঝে এক সঙ্গে বসা হয়ওরা আছে কেমন ? ভালাে। একজনকে নিয়ে এসেছিলি, সফিক নাম। 

জি। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ

সফিক ভালাে আছে ? জি, ভালাে আছেঅসাধারণ ছেলেএমন ভালাে ছেলে আমি আমার জীবনে দেখি নিকোন অর্থে ভালাে ছেলে

সব অর্থেতাকে একবার কথায় কথায় বলেছিলাম, ঢাকা শহরে ভালাে ঘি পাওয়া যায় নাসবই ভেজালসে বলল, চাচাজি, আমি শেরপুর থেকে আসল সরে ভাজা ঘি এনে দেবএই ধরনের কথার কথা তাে সবাই বলেকয়জন আর মনে রাখে! সফিক কিন্তু ঠিকই মনে রেখেছেএক কেজি ঘি এনে দিয়েছে যেমন ঘ্রাণ, খেতেও তেমন সুস্বাদুএখনাে আছেএক চামচ খাবি

শুধু শুধু ঘি খাব কেন

শুধু শুধু খাওয়া যায়মাঝে মাঝে শরীর ভালাে থাকে নারান্নাবান্না করতে ইচ্ছা করে নাআমি করি কী, দুই চামচ ঘি আর দুই গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়িদেব তােকে এক চামচ ? লবণের ছিটা দিয়ে খেয়ে দেখঅবশ্যই ভালাে লাগবেদেব

মুহিব বলল, দাও। মুহিব ঘণ্টাখানেক সময় কাটিয়ে ঘর থেকে বের হলাে। 

শামসুদ্দিন সাহেব ছেলেকে এগিয়ে দিতে গেলেননিজেই রিকশা ঠিক করলেনদরদাম করে ভাড়া কমিয়ে ভাড়া দিয়ে দিলেনরিকশা যখন চলতে শুরু করল তখন হঠাৎ বললেন, মুহিব দাড়াতাের সঙ্গে রিকশায় করে কিছু দূর যাইজার্নি বাই রিকশাআমার খারাপ লাগে নাহাওয়া খেতে খেতে যাওয়াশহরের বিষাক্ত হাওয়াএইটাই যা সমস্যা| রিকশা চলছেশামসুদ্দিন ছেলের পাশে বসে আছেনএক সময় ইতস্তত করে বললেন, তাের কি সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ

মুহিব বলল, নাশামসুদ্দিন সাহেব বললেন, যদি অভ্যাস থাকে তাহলে আমাকে লজ্জা করিস একটা বয়সের পর পুত্র হলাে মিত্র বদাচারে অর্থাৎ মিত্রতাের বন্ধুরা তাের কাছে যেমন, আমিও সেরকমবুঝতে পারছিস

তাের বন্ধু সফিকের সঙ্গে তাের কি আজ দেখা হবে দেখা হলে অবশ্যই বলবি তার দেয়া ঘি আমি খুব আরাম করে খেয়েছিবলতে পারবি নাসফিকের মতাে ছেলে বন্ধু হিসাবে পাওয়া ভাগ্যের কথা। আসলে বন্ধু পাওয়াই ভাগ্যের ব্যাপারবন্ধুত্বের বিষয়ে কবি ইয়েটসএর কিছু লাইন আছে অসাধারণ 

Think where mans glory most begins and ends And say, my glory was I had such friends. লাইন দুটা সুন্দর না মুখস্থ করে ফেলমুখস্থ করে ফেললে সময়ে অসময়ে বলতে পারবিআরেকবার বলি

Think where mans glory most begins and ends And say, my glory was I had such friends

মিরপুর দুনম্বরের চারতলা ফ্ল্যাট বাড়ির ডানদিকের ফ্ল্যাটটায় (D4, দরজার পাশে টবে কামিনী ফুলের বড় একটা গাছ) সফিক গত এক সপ্তাহ ধরে বাস করছেফ্ল্যাটের মালিক সফিকের মেজো মামা আব্দুল গফুরতিনি স্বপরিবারে আজমীর শরিফে গিয়েছেন খাজা বাবার দোয়া নিতেবিয়ের পনেরাে বছর পরেও ছেলেমেয়ে হচ্ছে নাখাজা বাবার দরবার শরিফ থেকে স্বামীস্ত্রী হাতে সুতা বেঁধে আসবেনসুতা বাধার পর ইন্ডিয়াতে ঘুরবেন তাজমহলটাজমহলদেখবেনতাদের এক মাসের পরিকল্পনা

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ

সফিকের দায়িত্ব হলাে, সে এক মাস বাড়ির দেখাশােনা করবেকামিনী ফুলের গাছে পানি দেবেভেতরের বারান্দায় টবে পাচটা গােলাপ গাছ লাগানাে হয়েছেগােলাপ গাছে কলি দেখা দিলেই কাঁচি দিয়ে কলি কেটে ফেলবেএতে নাকি পরবর্তীতে ফুল অনেক বড় হবেআব্দুল গফুর সাহেব সফিকের হাতে বসার ঘর এবং রান্নাঘরের চাবি দিয়ে গেছেনবাকি ঘরগুলি তালাবন্ধ করে গেছেনসফিককে তিনি হাতখরচ হিসেবে এক হাজার টাকাও দিয়ে গেছেন

সফিক খুবই ব্ৰিত গলায় বলেছেছিঃ ছিঃ মামা, টাকা দিতে হবে কেন ? অসম্ভব, টাকা তুমি রাখাে তাে।  সফিকের মামা বলেছেন, বেকার মানুষ, তাের টাকা লাগবে না ? পকেটখরচ হিসেবে রেখে দেআর শােন, চব্বিশ ঘণ্টা বাড়িতে থাকতে হবে তানারাতে গিয়ে শুধু ঘুমালেই হবেসােফাতে শুয়ে থাকবিফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিলে মশা ধরবে নামশার কয়েল জ্বালাবি নানতুন কার্পেট কিনেছিকার্পেট পুড়েটুরে যেতে পারে। 

মশা কামড়ে খেয়ে ফেললেও আমি মশার কয়েল ধরাব নাকয়েলের গন্ধেআমার মাথা ধরে যায়। রান্নাঘরে ঢুকে রান্নাবান্নার চেষ্টা যেন আবার করিস নাবেসিন নােংরা করে রাখবি, তাের মামি রাগ করবে। 

আমি খাওয়াদাওয়া করেই বাড়িতে ঢুকবতুমি মােটেই চিন্তা করবে নাবন্ধুবান্ধব জমিয়ে আড্ডা দিস না যেন। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ

আরে নারাত আটটা সাড়ে আটটার দিকে টুক করে বাড়িতে ঢুকবভােরবেলা বের হয়ে আসববন্ধুবান্ধবকে এই বাসার খবরই দেব নাসিগারেট খেয়ে তারা যেখানেসেখানে ছাই ফেলবেদরকার কী

বের হয়ে আসার সময় ভালােমতাে তালা দিবিতালা লাগাবার পরভালােমতাে টেনে টেনে দেখবি ঠিকমতাে লাগল কিনা। 

অবশ্যইফুলগাছে পানি ঠিকমতাে দিবি গােলাপ গাছগুলিতে একদিন পর পরকামিনী গাছে রােজ দিতে হবেআজমীরে যাচ্ছি, তাের জন্যেও দোয়া করবখাজাবাবার কাছ থেকে খালি হাতে কেউ ফিরে না দেখবি বছর না ঘুরতেই চাকরি হবে ইনশাল্লাহ। 

দুইতিন গজ সুতা নিয়ে এসােনিজে পরব, বন্ধুবান্ধবকে দেব। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *