Freedom–এর আনন্দের কাছে সব আনন্দ তুচ্ছ। এই বিষয়ে কোলরিজের একটা বিখ্যাত বাক্য আছে। মনে পড়লেই তােকে বলব। আজকাল স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে গেছে। | মুহিব ফট করে বলে বসল, বাবা, যমুনা মেয়েটা কোথায় ? যার জন্যে তুমি আমাদের সবাইকে ফেলে রেখে চলে এলে। যে মেয়ের জন্যে তুমি এতটা করলে। সে তােমাকে এই অবস্থায় রেখে চলে গেল কেন ? | শামসুদ্দিন খুবই বিব্রত বােধ করছেন। ছােটবেলায় মুহিবের অভ্যাস ছিল বাবার বুকের উপর শুয়ে ঘুমানাে। সেই ছেলে এমন কঠিন প্রশ্ন করছে!
মুহিব বলল, তােমার জবাব দিতে ইচ্ছা না হলে জবাব দিও না। চা বানাও চা খাই।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ
শামসুদ্দিন চা বানালেন। ঘরে দুধ নেই, লিকার চা। তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে খুশি খুশি গলায় বললেন, আদা–চা বানিয়ে দিলাম। খেয়ে দেখ, শরীর ঝরঝরে হয়ে যাবে। কোরান শরীফে আদার রেফারেন্স আছে এটা জানিস?
আল্লাহপাক বলেছেন, বেহেশতে তােমাকে দেয়া হবে আদা মিশ্রিত পানীয়। আল্লাহপাক আদা–চায়ের কথাই বলেছেন কি–না কে জানে।
বাবা, তােমার শরীর কিন্তু খুবই খারাপ করেছে। চোখ ফুলে গেছে। হাত পা ফুলে গেছে। শরীরে মনে হয় পানি এসেছে।
বুড়াে বয়সে শরীরে পানি তাে আসবেই। আমার তাে তাও কম এসেছে। অনেকের এমন পানি আসে যে শরীরেই জোয়ার–ভাটা হয়। হা হা হা হা। | মুহিব তাকিয়ে আছে। শামসুদ্দিন সাহেব হেসেই যাচ্ছেন। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললেন, তাের বন্ধু–বান্ধবরা কেমন আছে ?
কোন বন্ধুরা ?
ঐ যে কিছু বেকার বন্ধুরা ক্লাবের মতাে কী যেন করেছিস। ক্লাব–টাব কিছু না। মাঝে মাঝে এক সঙ্গে বসা হয়। ওরা আছে কেমন ? ভালাে। একজনকে নিয়ে এসেছিলি, সফিক নাম।
জি।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ
সফিক ভালাে আছে ? জি, ভালাে আছে। অসাধারণ ছেলে। এমন ভালাে ছেলে আমি আমার জীবনে দেখি নি। কোন অর্থে ভালাে ছেলে ?
সব অর্থে। তাকে একবার কথায় কথায় বলেছিলাম, ঢাকা শহরে ভালাে ঘি পাওয়া যায় না। সবই ভেজাল। সে বলল, চাচাজি, আমি শেরপুর থেকে আসল সরে ভাজা ঘি এনে দেব। এই ধরনের কথার কথা তাে সবাই বলে। কয়জন আর মনে রাখে! সফিক কিন্তু ঠিকই মনে রেখেছে। এক কেজি ঘি এনে দিয়েছে যেমন ঘ্রাণ, খেতেও তেমন সুস্বাদু। এখনাে আছে। এক চামচ খাবি ?
শুধু শুধু ঘি খাব কেন ?
শুধু শুধু খাওয়া যায়। মাঝে মাঝে শরীর ভালাে থাকে না। রান্নাবান্না করতে ইচ্ছা করে না। আমি করি কী, দুই চামচ ঘি আর দুই গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়ি। দেব তােকে এক চামচ ? লবণের ছিটা দিয়ে খেয়ে দেখ। অবশ্যই ভালাে লাগবে। দেব ?
মুহিব বলল, দাও। মুহিব ঘণ্টাখানেক সময় কাটিয়ে ঘর থেকে বের হলাে।
শামসুদ্দিন সাহেব ছেলেকে এগিয়ে দিতে গেলেন। নিজেই রিকশা ঠিক করলেন। দরদাম করে ভাড়া কমিয়ে ভাড়া দিয়ে দিলেন। রিকশা যখন চলতে শুরু করল তখন হঠাৎ বললেন, মুহিব দাড়া। তাের সঙ্গে রিকশায় করে কিছু দূর যাই। এ জার্নি বাই রিকশা। আমার খারাপ লাগে না। হাওয়া খেতে খেতে যাওয়া। শহরের বিষাক্ত হাওয়া— এইটাই যা সমস্যা। | রিকশা চলছে। শামসুদ্দিন ছেলের পাশে বসে আছেন। এক সময় ইতস্তত করে বললেন, তাের কি সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস আছে ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ
মুহিব বলল, না। শামসুদ্দিন সাহেব বললেন, যদি অভ্যাস থাকে তাহলে আমাকে লজ্জা করিস । একটা বয়সের পর পুত্র হলাে মিত্র বদাচারে অর্থাৎ মিত্র। তাের বন্ধুরা তাের কাছে যেমন, আমিও সে–রকম। বুঝতে পারছিস ?
তাের বন্ধু সফিকের সঙ্গে তাের কি আজ দেখা হবে ? দেখা হলে অবশ্যই বলবি তার দেয়া ঘি আমি খুব আরাম করে খেয়েছি। বলতে পারবি না? সফিকের মতাে ছেলে বন্ধু হিসাবে পাওয়া ভাগ্যের কথা। আসলে বন্ধু পাওয়াই ভাগ্যের ব্যাপার। বন্ধুত্বের বিষয়ে কবি ইয়েটস–এর কিছু লাইন আছে অসাধারণ
Think where man‘s glory most begins and ends And say, my glory was I had such friends. লাইন দু’টা সুন্দর না ? মুখস্থ করে ফেল। মুখস্থ করে ফেললে সময়ে অসময়ে বলতে পারবি। আরেকবার বলি ?
Think where man‘s glory most begins and ends And say, my glory was I had such friends.
মিরপুর দু‘নম্বরের চারতলা ফ্ল্যাট বাড়ির ডানদিকের ফ্ল্যাটটায় (D4, দরজার পাশে টবে কামিনী ফুলের বড় একটা গাছ।) সফিক গত এক সপ্তাহ ধরে বাস করছে। ফ্ল্যাটের মালিক সফিকের মেজো মামা আব্দুল গফুর। তিনি স্বপরিবারে আজমীর শরিফে গিয়েছেন খাজা বাবার দোয়া নিতে। বিয়ের পনেরাে বছর পরেও ছেলেমেয়ে হচ্ছে না। খাজা বাবার দরবার শরিফ থেকে স্বামী–স্ত্রী হাতে সুতা বেঁধে আসবেন। সুতা বাধার পর ইন্ডিয়াতে ঘুরবেন । তাজমহল–টাজমহল। দেখবেন। তাদের এক মাসের পরিকল্পনা।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ
সফিকের দায়িত্ব হলাে, সে এক মাস বাড়ির দেখাশােনা করবে। কামিনী ফুলের গাছে পানি দেবে। ভেতরের বারান্দায় টবে পাচটা গােলাপ গাছ লাগানাে হয়েছে। গােলাপ গাছে কলি দেখা দিলেই কাঁচি দিয়ে কলি কেটে ফেলবে। এতে নাকি পরবর্তীতে ফুল অনেক বড় হবে। আব্দুল গফুর সাহেব সফিকের হাতে বসার ঘর এবং রান্নাঘরের চাবি দিয়ে গেছেন। বাকি ঘরগুলি তালাবন্ধ করে গেছেন। সফিককে তিনি হাতখরচ হিসেবে এক হাজার টাকাও দিয়ে গেছেন।
সফিক খুবই ব্ৰিত গলায় বলেছে— ছিঃ ছিঃ মামা, টাকা দিতে হবে কেন ? অসম্ভব, টাকা তুমি রাখাে তাে। সফিকের মামা বলেছেন, বেকার মানুষ, তাের টাকা লাগবে না ? পকেটখরচ হিসেবে রেখে দে। আর শােন, চব্বিশ ঘণ্টা বাড়িতে থাকতে হবে তা–না। রাতে গিয়ে শুধু ঘুমালেই হবে। সােফাতে শুয়ে থাকবি। ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিলে মশা ধরবে না। মশার কয়েল জ্বালাবি না। নতুন কার্পেট কিনেছি। কার্পেট পুড়ে–টুরে যেতে পারে।
মশা কামড়ে খেয়ে ফেললেও আমি মশার কয়েল ধরাব না। কয়েলের গন্ধে। আমার মাথা ধরে যায়। রান্নাঘরে ঢুকে রান্নাবান্নার চেষ্টা যেন আবার করিস না। বেসিন নােংরা করে রাখবি, তাের মামি রাগ করবে।
আমি খাওয়া–দাওয়া করেই বাড়িতে ঢুকব। তুমি মােটেই চিন্তা করবে না। বন্ধু–বান্ধব জমিয়ে আড্ডা দিস না যেন।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১০)-হুমায়ুন আহমেদ
আরে না। রাত আটটা সাড়ে আটটার দিকে টুক করে বাড়িতে ঢুকব। ভােরবেলা বের হয়ে আসব। বন্ধু–বান্ধবকে এই বাসার খবরই দেব না। সিগারেট খেয়ে তারা যেখানে–সেখানে ছাই ফেলবে। দরকার কী!
বের হয়ে আসার সময় ভালােমতাে তালা দিবি। তালা লাগাবার পর। ভালােমতাে টেনে টেনে দেখবি ঠিকমতাে লাগল কি–না।
অবশ্যই। ফুলগাছে পানি ঠিকমতাে দিবি । গােলাপ গাছগুলিতে একদিন পর পর। কামিনী গাছে রােজ দিতে হবে। আজমীরে যাচ্ছি, তাের জন্যেও দোয়া করব। খাজাবাবার কাছ থেকে খালি হাতে কেউ ফিরে না । দেখবি বছর না ঘুরতেই চাকরি হবে ইনশাল্লাহ।
দুই–তিন গজ সুতা নিয়ে এসাে। নিজে পরব, বন্ধু–বান্ধবকে দেব।