উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ

প্রথম দিনেই সন্ধ্যার পর থেকে সফিকের বন্ধুবান্ধবরা জড়াে হতে শুরু করলসফিক মাত্র দুজনকে খবর দিয়েছিলসেই দুজন বাকিদের খবর দিয়েছেরাত টার মধ্যে সফিকের আট বন্ধু এসে উপস্থিত হয়ে গেলউড়ালপঙ্খি বসার ঘর ছােটআটজনের আরাম করে বসা সম্ভব নাসােফা বের করে বারান্দায় নিয়ে যাওয়া হলােএখন কার্পেটের উপর আরাম করে পা ছড়িয়ে বসেআড্ডা দেয়া যায়সফিক বলল, রাত এগারােটার মধ্যে আড্ডা শেষএগারােটা বাজার এক মিনিট পরে যেন আমি কাউকে দেখতে না পাইএটা কোনাে অনুরােধ নাআদেশআরেকটা কথা এখানে যতক্ষণ থাকবি ফিসফিস করে কথা বলবিকথার শব্দ যেন এক দেড় ফুটের বাইরে না যায়। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ

সফিকের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইয়াকুব বলল, ফিসফিস করে কথা বলতে হবে কেনএটা ফ্ল্যাটবাড়ি, এখানে হৈচৈ করা যাবে নাঘটনা ঘটানাে যাবে না

ইয়াকুব অবাক হয়ে বলল, এখনাে তাে কোনাে ঘটনাই ঘটে নিতুই রেগে যাচ্ছিস কেন

সফিক বলল, ঘটনা ঘটে নি কিন্তু তােরা ঘটনা ঘটাবিএই জন্যে এডভান্স রেগে যাচ্ছি। 

ইয়াকুব বলল, জগতের নিয়ম হলাে প্রথমে Cause তারপর Effect. তাের তাে দেখি উল্টা, প্রথমে Effect তারপর Causeঠিক আছে, এত চেচেতির দরকার নাইআমরা চলে যাই। চলে যা, কাউকে আমি পায়ে ধরে সেধে আনি নি। 

ইয়াকুব বলল, তুই বরং এক কাজ কর, তিনটা সিডাকসিন ট্যাবলেট খেয়ে ঝিম ধরে সােফায় শুয়ে থাকআমরা আড্ডা দেইমামা হিল্লিদিল্লি করে বেড়াচ্ছেতার ভয়ে তুই কেঁচোরও অধম হয়ে গেলিতাের সামনে এখন কেঁচোও আলেকজান্ডার দি গ্রেট। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ

বক্তৃতা দিবি নাআমরা থাকব, না চলে যাব স্ট্রেইট বলহাংকি পাংকি নাচলে যেতে বলেছি ? ভাব বাচ্যে কথা বলবি নাহয় ইয়েসকিংবা ননাতােদের থাকতে ইচ্ছা হলে থাকবিচলে যেতে চাইলে চলে যাবিএত কথার দরকার নাই চলে যাচ্ছিঠিক আছে, যা চলে যা। 

রাত এগারােটার সময় দেখা গেল কেউই যায় নিবরং আরাে দুজন এসে যুক্ত হয়েছেসফিককে সবচেআনন্দিত মনে হচ্ছেসে চোখ বন্ধ করে তার অতি প্রিয় সঙ্গীত গাইছেআমরা পুতুলওয়ালা, পুতুল বেচে যাই...সফিকের গানের গলা নেইকেউ গান গাইলে সে বিরক্ত হয়কিন্তু নিজে গভীর আবেগে ভুল তালে ভুল সুরে পুতুলওয়ালাগান গায়তখন কেউ যদি কোরাসে অংশ নেয় সে অত্যন্ত আনন্দিত হয়তাকে আনন্দ দেয়ার জন্যে অনেকেই তারসঙ্গে গলা মেলায়। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ

বড় একটা কাচের গ্লাসে বিশেষ এক ধরনের শরবত বানানাে হয়েছেতার রঙ ঘন কালােবিশেষ ধরনের শরবত প্রস্তুতের কাজটা সবসময় করে মহসিনজিনিসটা বানানাে হয় গােপনেতাতে কী কী মিশানাে হয় তাও গােপনঅতি সামান্য জিনিস দিয়েও মহসিন অসামান্য জিনিস বানিয়ে ফেলতে পারেখেতে স্বাদু হয়

তারচেবড় কথা অতি অল্পতেই নেশা হয়ে যায়শরবতের দিকে তাকিয়ে ইয়াকুব বলল, রঙ দেখে মনে হচ্ছে মারাত্মক হয়েছেএই ড্রিংকের নাম দিলামশ্রীকৃষ্ণশ্রীকৃষ্ণ শরবতমহসিন বলল, ঠাণ্ডা না হলে খেয়ে মজা পাওয়া যাবে না। 

ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না, কারণ সফিকের মামা ফ্রিজ তালাবন্ধ করে গেছেন। 

সফিকের নির্দেশে তার দিয়ে খুঁচিয়ে অতি দ্রুতই ফ্রিজ খুলে ফেলা গেলজিনিস ডিপ ফ্রিজে ঠাণ্ডা করতে দেয়া হলােইয়াকুব বলল, সফিক, তাের মামার এই বাড়িতে এসি আছে

 সফিক শঙ্কিত গলায় বলল, মামির শােবার ঘরে আছেকেন ?

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ

 এসি ছেড়ে দিয়ে ঘরে সবাই আড্ডা দিতামএসি ঘরের সুবিধা হলাে হৈচৈ হলেও দরজা-জানালা টাইট করে বন্ধ থাকে, শব্দ বাইরে যায় না| সফিক বলল, অসম্ভব! মামামামির শােবার ঘর খােলাই যাবে নামামা যদি টের পায় আমাকে খুন করে ফেলবে।  হারুন বলল, নিজের মায়ের আপন ভাই তােকে খুন করে ফেলবে, কারণতুই তার শােবার ঘরে কিছুক্ষণ বসে ছিলি

কিছুক্ষণ তাে তােরা বসবি নাএকবার ঢুকলে ঐখানেই থাকবি। হারুন বলল, খুব ভালােমতাে চিন্তা করে দেখ, মহসিন যে শরবত বানিয়েছে শরবত খাবার পর অবশ্যই কিছু হৈচৈ হবেআশেপাশের ফ্ল্যাটের লােক জানবেতাের মামার কাছে খবর পৌছে যাবেতারচেকি এসি ঘরে বসা ভালাে না ঘর তালাবন্ধ আমার কাছে চাবি নেই। 

চাবি নেই, চাবির ব্যবস্থা হবেফ্রিজ যেভাবে খুলেছে ঘরের দরজাও সেইভাবে খুলে যাবেচিচিং ফাক। সফিক হতাশ গলায় বলল, যা ইচ্ছা করআসলে তােদের খবর দেয়াই ভূল হয়েছেমিসটেক অব দা সেঞ্চুরি। 

হারুন বলল, ভুল করবার জন্যেই তাে মানুষ হিসেবে আমাদের জন্ম হয়েছেআল্লাপাক চাচ্ছেন আমরা ভুল করিএই জন্যেই আমাদের মানুষ বানিয়ে পাঠিয়েছেনতিনি যদি চাইতেন আমার শুধু শুদ্ধ করি তাহলে আমাদের ফেরেশতা বানিয়ে পাঠাতেনআমাদের ভুল করার কোনাে উপায় থাকত না। 

মহসিন বলল, ফেরেশতাও তাে ভুল করেশয়তান ফেরেশতা ছিল, সে ভুল করেছেভুলিয়ে ভালিয়ে গন্ধম খাইয়েছেযার ফলে স্বর্গ থেকে পতনএখন আমরা হা চাকরি হা চাকরি করছি। হারুন বলল, শয়তান ফেরেশতা ছিল তােকে কে বলেছে ? শয়তান ছিল 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ

মহসিন বলল, শয়তান জ্বিন ছিল এই খবর তােকে কে দিয়েছে ? শয়তান এসে তােকে দিয়ে গিয়েছে ? সারা জীবন শুনে এসেছি শয়তান ছিল ফেরেশতাআদমকে সেজদা না করায় সে অভিশপ্তআর আজ তুই জ্বিনের থিওরি নিয়ে এসেছিসএকশ টাকা বাজি শয়তান ফেরেশতা। হাজার টাকা বাজি শয়তান ফেরেশতা। 

হাজার টাকা তাের কাছে আছে ? তুই হাজারপতি কবে থেকে ? হাজার টাকা সঙ্গে নাই, তাই বলে এক হাজার টাকা জোগাড় করতে পারব ? আমি পথের ফকির জোগাড় করতে পারলে তাে ভালােই আয় হাজার টাকা বাজিঅবশ্যই। 

মহসিন গম্ভীর গলায় বলল, আজ রাতের মধ্যেই ফয়সালা হবেতুই যদি হাজার টাকা দিতে না পারিস তাহলে তুই নেংটো হয়ে চারতলা থেকে সিড়ি বেয়ে একতলায় দারােয়ানের ঘর পর্যন্ত যাবিদারােয়ানকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলবি, হ্যালাে মিস্টার!তারপর আবার ফিরে আসবি। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ

মহসিনের হাত কাঁপছেরেগে গেলে তার হাত কাপে। হারুন শান্ত গলায় বলল, ওকেতুই হারলে তােকেও এই কাজ করতে হবেতােকেও গিয়ে দারােয়ানকে হ্যালাে মিস্টারবলতে হবে। বলব আমার কোনাে সমস্যা নেইনাে প্রবলেমআমি রাজি। 

আন্ডারওয়ার পরে দৌড় দিলে হবে নানেংটা মানে নেংটাপুরাে নেংটা বাবা ভােম ভােমনেংটা কুমার। ওকেনেংটা কুমার। 

এসি ঘর খােলা হয়েছেহাই কুলে দিয়ে ঘর ঠাণ্ডা করে ফেলা হয়েছেমহসিনের বিশেষ শরবত সবাই দুকাপ করে খেয়েছেজিনিসটার স্বাদ টক মিষ্টিসফিক বলল, টেস্ট তাে মারাত্মক হয়েছেএর মধ্যে আছে কী

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ

মহসিন বলল, আছে কী তা দিয়ে দরকার কী ? একশান হচ্ছে কিনা বলসফিক বলল, একশান হচ্ছে নাখেতে মজা লাগছে, কিন্তু নাে একশানখাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাে একশান হবে নাসময় লাগবে। 

হারুন খাটে উঠে বসেছেতার কোলে টেলিফোন শয়তান ফেরেশতা না কি জ্বিনএই সমস্যা সমাধানের জন্যে সে নানান জায়গায় চেষ্টা চালাচ্ছেসে এতই ব্যস্ত যে মহসিনের শরবত খাবার প্রতিও তার আগ্রহ নেইহারুন বলল, রাতে ডিনারের কোনাে ব্যবস্থা আছে

সফিক বলল, নাহারুন বলল, চান্দা তুলে কাউকে পাঠা, নানরুটি আর শিক কাবাব নিয়ে আসুকপারহেড একটা শিক আর একটা নানআমার পকেটে দশ টাকা আছেআমি দিয়ে দিলামএই আমার সম্বল। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *