প্রথম দিনেই সন্ধ্যার পর থেকে সফিকের বন্ধু–বান্ধবরা জড়াে হতে শুরু করল। সফিক মাত্র দু‘জনকে খবর দিয়েছিল। সেই দু’জন বাকিদের খবর দিয়েছে। রাত ন’টার মধ্যে সফিকের আট বন্ধু এসে উপস্থিত হয়ে গেল। বসার ঘর ছােট। আটজনের আরাম করে বসা সম্ভব না। সােফা বের করে বারান্দায় নিয়ে যাওয়া হলাে। এখন কার্পেটের উপর আরাম করে পা ছড়িয়ে বসে। আড্ডা দেয়া যায়। সফিক বলল, রাত এগারােটার মধ্যে আড্ডা শেষ। এগারােটা বাজার এক মিনিট পরে যেন আমি কাউকে দেখতে না পাই। এটা কোনাে অনুরােধ না। আদেশ। আরেকটা কথা এখানে যতক্ষণ থাকবি ফিসফিস করে কথা বলবি। কথার শব্দ যেন এক দেড় ফুটের বাইরে না যায়।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ
সফিকের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইয়াকুব বলল, ফিসফিস করে কথা বলতে হবে কেন? এটা ফ্ল্যাটবাড়ি, এখানে হৈচৈ করা যাবে না। ঘটনা ঘটানাে যাবে না।
ইয়াকুব অবাক হয়ে বলল, এখনাে তাে কোনাে ঘটনাই ঘটে নি। তুই রেগে যাচ্ছিস কেন?
সফিক বলল, ঘটনা ঘটে নি কিন্তু তােরা ঘটনা ঘটাবি— এই জন্যে এডভান্স রেগে যাচ্ছি।
ইয়াকুব বলল, জগতের নিয়ম হলাে প্রথমে Cause তারপর Effect. তাের তাে দেখি উল্টা, প্রথমে Effect তারপর Cause। ঠিক আছে, এত চেচেতির দরকার নাই। আমরা চলে যাই। চলে যা, কাউকে আমি পায়ে ধরে সেধে আনি নি।
ইয়াকুব বলল, তুই বরং এক কাজ কর, তিনটা সিডাকসিন ট্যাবলেট খেয়ে ঝিম ধরে সােফায় শুয়ে থাক। আমরা আড্ডা দেই। মামা হিল্লি–দিল্লি করে বেড়াচ্ছে। তার ভয়ে তুই কেঁচোরও অধম হয়ে গেলি। তাের সামনে এখন কেঁচোও আলেকজান্ডার দি গ্রেট।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ
বক্তৃতা দিবি না। আমরা থাকব, না চলে যাব স্ট্রেইট বল। হাংকি পাংকি না। চলে যেতে বলেছি ? ভাব বাচ্যে কথা বলবি না। হয় ‘ইয়েস‘ কিংবা ‘ননা‘। তােদের থাকতে ইচ্ছা হলে থাকবি। চলে যেতে চাইলে চলে যাবি। এত কথার দরকার নাই চলে যাচ্ছি। ঠিক আছে, যা চলে যা।
রাত এগারােটার সময় দেখা গেল কেউই যায় নি। বরং আরাে দু‘জন এসে যুক্ত হয়েছে। সফিককে সবচে‘ আনন্দিত মনে হচ্ছে। সে চোখ বন্ধ করে তার অতি প্রিয় সঙ্গীত গাইছে— আমরা পুতুলওয়ালা, পুতুল বেচে যাই...।‘ সফিকের গানের গলা নেই। কেউ গান গাইলে সে বিরক্ত হয়। কিন্তু নিজে গভীর আবেগে ভুল তালে ভুল সুরে ‘পুতুলওয়ালা‘ গান গায়। তখন কেউ যদি কোরাসে অংশ নেয় সে অত্যন্ত আনন্দিত হয়। তাকে আনন্দ দেয়ার জন্যে অনেকেই তার। সঙ্গে গলা মেলায়।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ
বড় একটা কাচের গ্লাসে বিশেষ এক ধরনের শরবত বানানাে হয়েছে। তার রঙ ঘন কালাে। বিশেষ ধরনের শরবত প্রস্তুতের কাজটা সবসময় করে মহসিন। জিনিসটা বানানাে হয় গােপনে। তাতে কী কী মিশানাে হয় তাও গােপন। অতি সামান্য জিনিস দিয়েও মহসিন অসামান্য জিনিস বানিয়ে ফেলতে পারে। খেতে স্বাদু হয়।
তারচে‘ বড় কথা অতি অল্পতেই নেশা হয়ে যায়। শরবতের দিকে তাকিয়ে ইয়াকুব বলল, রঙ দেখে মনে হচ্ছে মারাত্মক হয়েছে। এই ড্রিংকের নাম দিলাম— শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ শরবত। মহসিন বলল, ঠাণ্ডা না হলে খেয়ে মজা পাওয়া যাবে না।
ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না, কারণ সফিকের মামা ফ্রিজ তালাবন্ধ করে গেছেন।
সফিকের নির্দেশে তার দিয়ে খুঁচিয়ে অতি দ্রুতই ফ্রিজ খুলে ফেলা গেল। জিনিস ডিপ ফ্রিজে ঠাণ্ডা করতে দেয়া হলাে। ইয়াকুব বলল, সফিক, তাের মামার এই বাড়িতে এসি আছে ?
সফিক শঙ্কিত গলায় বলল, মামির শােবার ঘরে আছে। কেন ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ
এসি ছেড়ে দিয়ে ঐ ঘরে সবাই আড্ডা দিতাম। এসি ঘরের সুবিধা হলাে হৈচৈ হলেও দরজা-জানালা টাইট করে বন্ধ থাকে, শব্দ বাইরে যায় না। | সফিক বলল, অসম্ভব! মামা–মামির শােবার ঘর খােলাই যাবে না। মামা যদি টের পায় আমাকে খুন করে ফেলবে। হারুন বলল, নিজের মায়ের আপন ভাই তােকে খুন করে ফেলবে, কারণ। তুই তার শােবার ঘরে কিছুক্ষণ বসে ছিলি ?
কিছুক্ষণ তাে তােরা বসবি না— একবার ঢুকলে ঐখানেই থাকবি। হারুন বলল, খুব ভালােমতাে চিন্তা করে দেখ, মহসিন যে শরবত বানিয়েছে ঐ শরবত খাবার পর অবশ্যই কিছু হৈচৈ হবে। আশেপাশের ফ্ল্যাটের লােক জানবে। তাের মামার কাছে খবর পৌছে যাবে। তারচে‘ কি এসি ঘরে বসা ভালাে না ? ঐ ঘর তালাবন্ধ । আমার কাছে চাবি নেই।
চাবি নেই, চাবির ব্যবস্থা হবে। ফ্রিজ যেভাবে খুলেছে ঐ ঘরের দরজাও সেইভাবে খুলে যাবে। চিচিং ফাক। সফিক হতাশ গলায় বলল, যা ইচ্ছা কর। আসলে তােদের খবর দেয়াই ভূল হয়েছে। মিসটেক অব দা সেঞ্চুরি।
হারুন বলল, ভুল করবার জন্যেই তাে মানুষ হিসেবে আমাদের জন্ম হয়েছে। আল্লাপাক চাচ্ছেন আমরা ভুল করি। এই জন্যেই আমাদের মানুষ বানিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি যদি চাইতেন আমার শুধু শুদ্ধ করি তাহলে আমাদের ফেরেশতা বানিয়ে পাঠাতেন। আমাদের ভুল করার কোনাে উপায় থাকত না।
মহসিন বলল, ফেরেশতাও তাে ভুল করে। শয়তান ফেরেশতা ছিল, সে ভুল করেছে। ভুলিয়ে ভালিয়ে গন্ধম খাইয়েছে। যার ফলে স্বর্গ থেকে পতন। এখন আমরা হা চাকরি হা চাকরি করছি। হারুন বলল, শয়তান ফেরেশতা ছিল তােকে কে বলেছে ? শয়তান ছিল
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ
মহসিন বলল, শয়তান জ্বিন ছিল এই খবর তােকে কে দিয়েছে ? শয়তান এসে তােকে দিয়ে গিয়েছে ? সারা জীবন শুনে এসেছি শয়তান ছিল ফেরেশতা। আদমকে সেজদা না করায় সে অভিশপ্ত। আর আজ তুই জ্বিনের থিওরি নিয়ে এসেছিস। একশ টাকা বাজি শয়তান ফেরেশতা। হাজার টাকা বাজি শয়তান ফেরেশতা।
হাজার টাকা তাের কাছে আছে ? তুই হাজারপতি কবে থেকে ? হাজার টাকা সঙ্গে নাই, তাই বলে এক হাজার টাকা জোগাড় করতে পারব ? আমি পথের ফকির ? জোগাড় করতে পারলে তাে ভালােই আয় হাজার টাকা বাজি। অবশ্যই।
মহসিন গম্ভীর গলায় বলল, আজ রাতের মধ্যেই ফয়সালা হবে। তুই যদি হাজার টাকা দিতে না পারিস তাহলে তুই নেংটো হয়ে চারতলা থেকে সিড়ি বেয়ে একতলায় দারােয়ানের ঘর পর্যন্ত যাবি। দারােয়ানকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলবি, ‘হ্যালাে মিস্টার!‘ তারপর আবার ফিরে আসবি।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ
মহসিনের হাত কাঁপছে। রেগে গেলে তার হাত কাপে। হারুন শান্ত গলায় বলল, ওকে। তুই হারলে তােকেও এই কাজ করতে হবে। তােকেও গিয়ে দারােয়ানকে ‘হ্যালাে মিস্টার’ বলতে হবে। বলব । আমার কোনাে সমস্যা নেই। নাে প্রবলেম। আমি রাজি।
আন্ডারওয়ার পরে দৌড় দিলে হবে না। নেংটা মানে নেংটা। পুরাে নেংটা বাবা ভােম ভােম। নেংটা কুমার। ওকে। নেংটা কুমার।
এসি ঘর খােলা হয়েছে। হাই কুলে দিয়ে ঘর ঠাণ্ডা করে ফেলা হয়েছে। মহসিনের বিশেষ শরবত সবাই দু‘কাপ করে খেয়েছে। জিনিসটার স্বাদ টক মিষ্টি। সফিক বলল, টেস্ট তাে মারাত্মক হয়েছে। এর মধ্যে আছে কী ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ
মহসিন বলল, আছে কী তা দিয়ে দরকার কী ? একশান হচ্ছে কি–না বল। সফিক বলল, একশান হচ্ছে না। খেতে মজা লাগছে, কিন্তু নাে একশান। খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাে একশান হবে না। সময় লাগবে।
হারুন খাটে উঠে বসেছে। তার কোলে টেলিফোন । শয়তান ফেরেশতা না কি জ্বিন––– এই সমস্যা সমাধানের জন্যে সে নানান জায়গায় চেষ্টা চালাচ্ছে। সে এতই ব্যস্ত যে মহসিনের শরবত খাবার প্রতিও তার আগ্রহ নেই। হারুন বলল, রাতে ডিনারের কোনাে ব্যবস্থা আছে ?
সফিক বলল, না। হারুন বলল, চান্দা তুলে কাউকে পাঠা, নানরুটি আর শিক কাবাব নিয়ে আসুক। পারহেড একটা শিক আর একটা নান। আমার পকেটে দশ টাকা আছে। আমি দিয়ে দিলাম। এই আমার সম্বল।।