মহসিন বলল, দশ টাকা সম্বল আর তুই হাজার টাকার বাজি ধরেছিস ?
হারুন বলল, বাজিতে তুই যদি জিতে যাস— হয় তােকে হাজার টাকা দেব, আর নয় তাে এখান থেকে নেংটো হয়ে বাসায় ফিরব।
রাত একটা দশ । পুরাে দল ঝিমুচ্ছে । শিক কাবাব এবং নানরুটি এসেছে, কেউ কিছু মুখে দেয় নি। শুধু হারুন একাই পাচটা শিক এবং তিনটা নানরুটি খেয়ে ফেলেছে। সফিকের অবস্থা খুব খারাপ। সে পাঁচ–দশ মিনিট করে ঘুমাচ্ছে, আবার জেগে উঠছে। তার চোখ গাঢ় লাল। | শয়তান ফেরেশতা না জ্বিন— এই সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। শয়তান। জ্বিন।
বাজির শর্ত অনুসারে মহসিন নেংটো হয়ে দারােয়ানের কাছে যেতে এবং ফিরে আসতে রাজি হয়েছে । হারুন দয়াপরবশ হয়ে বলেছে— যা মাফ করে দিলাম। নেংটো হওয়ার দরকার নেই। সফিক হুঙ্কার দিয়ে উঠেছে অবশ্যই দরকার আছে। তার উচিত শিক্ষা হতে হবে । না জেনে তর্ক করে। না জেনে। বাজি ধরে ।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ
হারুন বলল, এই কাজটা করলে ফ্ল্যাট বাড়িতে জানাজানি হবে। তাের মামার কানে যাবে । তােরই অসুবিধা। হােক অসুবিধা । আমি কি মামাকে কেয়ার করি ? Who is মামা ?
সাবের চাদর গায়ে দিয়ে কোলবালিস বগলে নিয়ে শুয়েছিল। তার চোখ বন্ধ । এই দলে তার নাম নীরব ঘাতক । সে কখনােই কোনাে কথা বলে না। হঠাৎ হঠাৎ দু’একটা এমন কথা বলে যে পুরাে দলের মুড বদলে যায়। সাবের চোখ না মেলেই বলল, Who is মে মে। মে মে। | বারুদে আগুন পড়ার মতাে হলাে। সবাই বলা শুরু করল মে মে। মে
মে । তারা কিছুক্ষণ মে মে করে, তারপর হাে হাে করে হাসে। আবারাে মে মে। করে আবারাে হাসে। রাত দু‘টার দিকে তাদের হাসি বন্ধ হলাে। মহসিনকে পাঠানাে হলাে বাজির শর্তপূরণের জন্যে। মহসিন নির্বিকার ভঙ্গিতেই কাপড় খুলে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নিচে গেল।
রাত আটটা। সফিক বসার ঘরের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছে । আজ সারাটা দিন তার ঘুমে ঘুমে কেটেছে। মাঝে কয়েকবার ঘুম ভেঙেছে, তাও অল্প সময়ের জন্যে। একবার ঘুম ভাঙল সকাল এগারােটার সময়। সে রেস্টুরেন্ট থেকে হাফ প্লেট তেহারি খেয়ে এসে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। সেই ঘুম ভাঙল বিকাল তিনটায়। রেস্টুরেন্টে গেল। পরােটা আর গােশত খেয়ে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত ঘুমাল।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ
ঘুম ভাঙল টেলিফোনের শব্দে। দিল্লি থেকে সফিকের মামা টেলিফোন করেছেন। তাঁর গলা থমথম করছে। সফিক মামার থমথমে গলা অগ্রাহ্য করে আনন্দিত স্বরে বলল, কেমন আছ মামা ? বেড়ানাে কেমন হচ্ছে? তাজমহল দেখেছ ?
সফিকের মামা বললেন, বাসায় তুই ছাড়া আর কে কে আছে ?
সফিক অবাক হয়ে বলল, আমি আছি, আর কে থাকবে ? জুতিয়ে তাের আমি পিঠের খাল তুলে ফেলব। সফিক বিস্মিত হবার ভঙ্গি করে বলল, এইসব তুমি কী বলছ মামা! ঘটনা কী ?
চুপ শুয়াের। বদমায়েশের বদমায়েশ।মামা, আমি তাে কিছুই বুঝতে পারছি না। কেউ কি তােমার কাছে কিছু লাগিয়েছে ?
শাটআপ হারামি। কী আশ্চর্য, বলবে তাে কী হয়েছে ? আমি খবরাখবর নেয়ার জন্যে আরজু সাহেবের বাসায় টেলিফোন করেছি...
কী বলেছেন আরজু সাহেব... উল্টা পাল্টা কিছু বলেছেন ? মাই গড! মানুষকে বিশ্বাস করা মুশকিল। উনার সঙ্গে একবার আমার দেখা হয়েছিল সিড়িতে। আমার তাে মনে হলাে খুবই ভদ্র মানুষ। | তুই অস্বীকার করতে চাস বন্ধু–বান্ধব নিয়ে আমার বাড়িতে মচ্ছব বসাস নি ? হৈচৈ–চেঁচামেচি–ড্রাগ খাওয়া খাওয়ি করিস নি ? সবাই মিলে নেংটো হয়ে সিড়ি দিয়ে ওঠানামা করিস নি ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ
সফিক মধুর স্বরে বলল, মামা, তুমি রাগের মাথায় কী বলছ নিজেই বুঝতে পারছ না। তােমার রাগ কমানাের জন্যে স্বীকার করলাম তুমি যা বলছ সবই সত্যি। তারপরেও আমার একটা কথা শুনবে। প্লিজ মামা, প্লিজ।
তাের আর কী কথা থাকতে পারে ? | মামা শােন, আমার বন্ধু–বান্ধব সবাই ভদ্র ঘরের ছেলে। শিক্ষিত ছেলে। এমন একজনও নেই যে এম.এ পাস করে নি। আমাদের সমস্যা একটাই— আমরা কোনাে চাকরি পাচ্ছি না। আমরা খুবই মন খারাপ করে থাকি। মাঝে মধ্যে এক সঙ্গে হই, চাকরির কোনাে লাইন পাওয়া যায় কিনা— এই নিয়ে আলাপ আলােচনা করি। আমাদের বয়েসি যুবকদের সবাই সন্দেহের চোখে দেখে বলেই কয়েকজন একত্র হলেই মনে করে কিছু করছি, ড্রাগ নিচ্ছি বা মদ খাচ্ছি। চুপ। চুপ। মিথুক কোথাকার।
ঠিক আছে মামা, তর্কের খাতিরে স্বীকার করলাম আমরা খারাপ। খুবই খারাপ । তােমার বাসায় বসে মদ–ফদ খাচ্ছিলাম। এখন তুমি বলাে মামা, আমরা যত খারাপই হই আমাদের পক্ষে কি সম্ভব নেংটো হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠানামা করা ? এটা কি কোনাে লজিকে পড়ে ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ
আরজু সাহেব মিথ্যা কথা বলছেন ?
এই কথাটা উনি কেন বলছেন মামা আমি সত্যি জানি না। তবে আমি উনাকে জিজ্ঞেস করব। তুমি টেলিফোন রেখে দিলেই আমি তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করব।
তােকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে না । তুই এক্ষুণি আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যা । এক্ষুণি! এই মুহূর্তে।
এখন চলে যাব ?
হ্যা এখন যাবি। আমি টেলিফোন রাখব আর তুই বাসায় তালা লাগিয়ে বের হবি।
মামা, চাবিটা কি আরজু সাহেবকে দিয়ে যাব ? হ্যা দিয়ে যা। আমি ঢাকায় এসে তাের বদমায়েশি বের করছি।
উল্টোটাও হতে পারে মামা। দেখা যাবে তুমি লজ্জিত হয়ে আমার কাছে গেলে বললে, ভুল হয়েছে কিছু মনে করিস না। রাগের মাথায় তােকে অনেক আজেবাজে গালি দিয়েছি।
শাটআপ। এক্ষুণি যা— আরজু সাহেবকে চাবি দিয়ে আয়।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১২)-হুমায়ুন আহমেদ
যাচ্ছি। মামা তুমি ভালাে থেকো। মামিকে আমার সালাম দিও। কুতুব মিনার দেখে আসতে ভুল করাে না। অনেকেই তাজমহল দেখে চলে আসে, কুতুব মিনার দেখে না। | ‘সফিকের কথা শেষ হবার আগেই তার মামা টেলিফোন রেখে দিলেন। সফিক মুখ ভোঁতা করে বসে রইল। এই মুহূর্তে একটা সিগারেট দরকার। তার সঙ্গে সিগারেট নেই। দোকানে গিয়ে সিগারেট কিনতে ইচ্ছা হচ্ছে না। বন্ধু বান্ধবদের আসার সময় হয়ে গেছে। যে কেউ একজন এলেই সিগারেটের সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। শুধু সাবের এবং মহসিন হলে সমস্যার সমাধান হবে না। এই দুই জন সিগারেট খায় না।
মুহিব এলেও হবে না। মুহিব সিগারেট খায় না। মুহিব হাবিজাবি কিছুই খায় না। গল্প–উপন্যাসের ভালাে ছেলে। এদের চেহারা হয় রাজপুত্রের মতাে। এদের চরিত্রে কোনাে ত্রুটি থাকে না। অত্যন্ত রূপবতী মেয়ের সঙ্গে এদের প্রণয় হয়। এরা পরীক্ষায় ফার্স্ট–সেকেন্ড হয়। এদের চাকরি পেতেও কোনাে সমস্যা হয় না। ফর্মুলাতে মুহিব খুব ভালাে মতােই পড়ে, শুধু একটা জায়গায় ফর্মুলা মিলছে না। অনেক ঘােরাঘুরি করেও বেচারা চাকরি পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে তাকে সােনা–রুপার পানি দিয়ে ধােয়াতে হবে। সােনা রুপার পানি দিয়ে ধােয়ালে দোষ কাটা যায়।
সাবের, মুহিব, মহসিন— এই তিনজনের যে কেউ এলে তাৎক্ষণিকভাবে সিগারেট পাওয়া যাবে না। সিগারেট কেনার জন্য এদের আবার নিচে পাঠাতে হবে। মাফিজ ল বলছে আজ এরাই প্রথম আসবে। মাফিজ ল খুবই মজার সূত্র। এই সূত্র বলে— গাদা করে রাখা বইয়ের ভেতর কেউ যদি কোনাে একটা বিশেষ বই খোঁজে তাহলে সেই বইটা থাকবে সবার নিচে। সে যদি বুদ্ধি করে নিচ থেকে বইটা খুঁজতে শুরু করে তাহলে বইটা থাকবে সবার উপরে।