সফিক চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল, আল্লাহপাক, তুমি দয়া করে সবার প্রথম সাবের, মুহিব কিংবা মহসিন— এই তিনজনের একজনকে আমার কাছে পাঠাও গাে দয়াময় । তুমি দয়ার সাগর। তােমার কাছে এটা কোনাে ব্যাপারই না। সফিক এই প্রার্থনা করল কারণ সে দেখেছে আল্লাহর কাছে সে যেটা চায় তার উল্টোটা হয়। যেহেতু সাবের, মুহিব কিংবা মহসিনকে চাওয়া হয়েছে— এই তিনজন আসবে না।
অন্য যে কেউ আসবে। তাৎক্ষণিকভাবে সিগারেট সমস্যার সমাধান হবে। | আজ সফিকের দোয়া আল্লাহ ঠিকঠাকমতাে শুনলেন। সবার প্রথম মুহিব এসে উপস্থিত হলাে। মুহিব এই আড্ডার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। সফিক তাকে বিশেষ স্নেহ করে। মুহিব গত তিনদিনের আসরে অনুপস্থিত। আজ তাকে দেখে সফিকের ভালাে লাগছে, তবুও সে বিরক্তি চাপতে পারছে না।
সফিক বলল, মুহিব, তুই চট করে নিচে যা তাে, আমার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আয়। টাকা নিয়ে যা। যাবি আর আসবি।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ
মুহিব কিছু বলল না। পলিথিনের ব্যাগে মােড়া এক প্যাকেট সিগারেট বের করে এগিয়ে দিল।
সফিক বিস্মিত হয়ে বলল, ব্যাপার কী! সিগারেট ধরেছিস ? মুহিব বলল, না। আপনার জন্যে এনেছি। সিগারেট এনেছিস কেন? কারণ কী ? ভালাে খবর আছে ? জি। চাকরি পেয়েছিস ?
জি।
অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার সাথে আছে ? আছে। দেখি কী ব্যাপার। সফিক গভীর মনােযােগে অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার পড়ল। আনন্দিত গলায় বলল, চাকরি তাে খুবই ভালাে পেয়েছিস। মুহিব চুপ করে রইল।
সফিক বলল, আজ আর কাউকে কিছু বলিস না। সবাই মন খারাপ করবে। চেপে যা।
মুহিব হা–সূচক মাথা নাড়ল।
সফিক বলল, আগামীকাল কোনাে এক সময় সবাইকে তাের খবরটা দেব। তুই কিন্তু আর আড্ডায় আসবি না। বুঝেছিস? তুই তাের মতাে থাকবি। নতুন বন্ধু–বান্ধব তৈরি করবি। বাসার সবাই খুশি ?
বাসায় কাউকে বলি নি।
কেন ? ইচ্ছা করল না।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ
ইচ্ছা করল না কেন ? আচ্ছা থাক, ইচ্ছা না করলে বলতে হবে না। কারাে। উপর এখন রাগ রাখবি না। মন দিয়ে চাকরি করবি। মামার টেলিফোন পেয়ে মনটা অত্যন্ত খারাপ হয়ে গিয়েছিল, এখন তাের চাকরির খবর শুনে মনের কিছুটা রিপেয়ারিং হয়েছে। হাবিজাবি কিছু খেতে পারলে ফুল রিপেয়ারিং হয়ে যাবে।
মুহিব বলল, আজকের হাবিজাবির খরচ আমি দিব। তুই দিলে সবাই সন্দেহ করবে। টাকা আমার কাছে দে। কত দিবি ? এক হাজার টাকা সঙ্গে আছে।
দেখি দে টাকাটা অন্য সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে আজ না হয় কিছু ভালাে হাবিজাবি খাই। গতকাল মহসিন এমন এক জিনিস বানিয়ে দিয়েছে যে ঘুমায়ে কূল পাই না। মনে হয় আফিম–টাফিম মিশিয়েছে। মহসিনের এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ করতে হবে। কোন দিন দেখা যাবে সবাই মরে পড়ে আছি। আজ রাতে কি তােকে বাসায় ফিরতে হবে ?
না ফিরলেও চলে।
তাহলে আজ রাতে থেকে যা। বাসায় যদি দুশ্চিন্তা করে একটা টেলিফোন করে দে। আজ রাতটা সবাই মিলে হৈচৈ করে কাটাই— কারণ অদ্য শেষ । রজনী।
শেষ রজনী কেন ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ
এই বাড়িতে শেষ রজনী। মামা গেট আউট করে দিয়েছে। খুবই খারাপ ব্যবহারও করেছে। কুৎসিত গালাগালি । আমি আপন ভাগ্নে, সেই দিকে খেয়াল। নেই। কুত্তার বাচ্চা শুয়ােরের বাচ্চা বলে যাচ্ছে। এর ফল মামাকে ভােগ করতে হয়। মামা হােক চাচা হােক— সস্তায় পার পাবে কেন ?
আপনি কী করবেন ? | অনেকগুলি প্ল্যান মাথার ভেতর আছে। কোন প্ল্যান এক্সিকিউট করব বুঝতে পরছি না। দেখি সবাই আসুক । সবার সাথে আলােচনা করে দেখি। একা একা ডিসিশান নেয়া ঠিক হবে না ।
রাত নটা পঁচিশ। এমন কিছু রাত না, কিন্তু আসর জমে গেছে। ঝড়–বৃষ্টির। কারণে সবাই আগে–ভাগে এসে পড়েছে। দুই দফা হাবিজাবি’ খাওয়া হয়েছে। সবাই উৎফুল্ল এবং সামান্য উত্তেজিত। তবে অন্যদিনের মতাে কারাে গলাই চড়ছে না। সবাই কথা বলছে নিচু গলায় । আজ আবহাওয়া শীতল। সবার খানিকটা শীত শীতও করছে। তারপরেও এসি চলছে। ঘর ক্রমেই ঠাণ্ডা হচ্ছে।
আজকের আলােচনার বিষয়বস্তু সফিকের মামাকে (ইতিমধ্যে তাঁর নাম হয়েছে আজমীর মামা) কী শাস্তি দেয়া যায়? অনেকগুলি প্রস্তাব এসেছে। প্রথম প্রস্তাব দামি দামি সমস্ত ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র নষ্ট করে দেয়া। এসি, টিভি, ফ্রিজ, মিউজিক সিস্টেম।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ
সফিক এই প্রস্তাবে রাজি হয় নি। সে বলেছে মামা খুবই কৃপণ মানুষ। এই জিনিসগুলি তাঁর সন্তানের মতাে। নিজের কোনাে সন্তান নেই বলে এইগুলিকে তিনি সন্তানের চেয়েও বেশি স্নেহ করেন। এদের ক্ষতি হলে তিনি হার্টফেল করে মারা যাবেন। তাকে শাস্তি দিতে হলে মানসিক শাস্তির লাইন ধরতে হবে।
তখন প্রস্তাব হলাে (নীরব ঘাতক সাবেরের প্রস্তাব) গরু, ছাগলের রক্ত এনে শােবার ঘরে রক্ত দিয়ে মাখামাখি করে রাখা হােক। রক্তমাখা একটা ছুরি রেখে দেয়া হবে। রক্ত শুকিয়ে জমে থাকবে। বিছানার চাদরেও রক্ত মাখানাে থাকবে । সব থাকবে লণ্ডভণ্ড। ভদকার একটা বােতল ভেঙে চারদিকে কাচ ছড়িয়ে রাখা
হবে। যাতে এই ঘরে ঢুকেই মনে হবে এখানে একটা হত্যাকাণ্ড হয়েছে। তখন আজমীর মামার ‘বিচি‘ আসল জায়গা ছেড়ে কপালে উঠে যাবে।
| প্রস্তাব সবার পছন্দ হলাে। শুধু মহসিন বলল, আজমীর মামা যদি থানা পুলিশ করেন, তখন কী হবে? পুলিশ তাে আমাদের খােজ করবে।
সফিক বলল, খোজ করলে করবে। আমরা তাে কাউকে খুন করি নি । আমাদের সমস্যা কী! দু‘একদিন যদি থানাতে থাকতে হয় থাকলাম।
রেজা বলল, রক্ত এনে কখন ফেলা হবে ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ
সাবের বলল, এখন ফেলা হবে। কাল ভােরে তাে আমরা চলে যাচ্ছি। আজমীর মামার বাসায় আর আসব না।
রেজা বলল, রক্ত কে আনবে ?
হারুন বলল, আমি আনব। আমাদের বাসার কাছে সাত মসজিদ রােডে কসাই আছে। আমার পরিচিত। দুলা ভাইয়ের কুকুরের জন্যে তার কাছ থেকে প্রায়ই মাংসের ছােবড়া কিনি। মাঝে মাঝে রক্ত কেনা হয় ।
সফিক বলল, তাহলে দেরি করছিস কেন, চলে যা। পরে দেখা যাবে কসাই চলে গেছে।
কসাই চলে গেলে নিউমার্কেট থেকে নিয়ে আসব। রক্ত নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। দেখি আমাকে ভর্তি করে এক গ্লাস হাবিজাবি দাও। গাঁজা থাকলে ভালাে হতাে। আমার কাছে খুবই একসাইটিং লাগছে। এর মধ্যে গাঁজার বাতাস পড়লে...।
সফিক বলল, একজন কেউ গাঁজা নিয়ে আস। আজ একটা বিশেষ দিন। আমাদের মধ্যে একজন চাকরি পেয়েছে। একজন মেম্বার আমরা হারাতে যাচ্ছি। সেই উপলক্ষে একই সঙ্গে আনন্দ এবং নিরানন্দ পার্টি। গাঁজা ছাড়া এই পার্টি হবে কীভাবে?