হারুন বিস্মিত গলায় বলল, চাকরি কে পেয়েছে ? সফিক বলল, চাকরি কে পেয়েছে সেটা তাে আমি আজ বলব না। হারুন বলল, তুই না তাে?
সফিক বলল, আমি না। আল্লাহর কসম বল। আল্লাহর কসম বলতে পারব না। তবে আমি না।
হারুন বলল, তাের ভাব–ভঙ্গি, কথাবার্তার ধরন–ধারণ সবই অন্যরকম লাগছে। আমার তাে ধারণা তুই চাকরি পেয়েছিস।
সফিক বলল, আমি চাকরি পেয়েছি এটা বলব না, আবার চাকরি পাই নি। এটাও বলব না। এই বিষয়ে আজ কোনাে ডিক্লারেশন দেয়া হবে না। কথা বলে সবাই সময় নষ্ট করছে কেন— এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। রক্ত কই ? গাজা কই ?
রাত এগারােটার ভেতর গরুর রক্ত দিয়ে ঘর মাখামাখি করে ফেলা হলাে। রক্তের মধ্যে একটা মাছ কাটা বটি ডুবিয়ে রাখা হলাে। ভয়াবহ অবস্থা। মহসিন মিনমিনে গলায় বলল, সর্বনাশ! দেখে তাে আমার নিজেরই ভয় লাগছে। শরীর ঝিমঝিম করছে।
| হারুন বলল, বােতল ভেঙে দেয়ার দরকার নেই। এমনিতেই যথেষ্ট হয়েছে। জিনিসপত্র বেশি থাকলে ‘Fake‘ মনে হতে পারে। কোনাে কিছুই। ওভার ডু করকৃত নেই।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ
ইয়াকুব বলল, একটা ছবি তুলে রাখা দরকার ছিল। জিনিসটা যে এত ইন্টারেস্টিং হবে আগে বুঝতে পরি নি। আগে বুঝতে পারলে বাসা থেকে ক্যামেরা নিয়ে আসতাম। আজমীর মামার খবর আছে। মামার বিচি শুধু যে কপালে উঠে থেমে থাকবে তা না, মাথা ছুঁড়ে বের হয়ে যাবে।
নীরব ঘাতক সাবের বলল, আমরা শুধু আজমীর মামাকে শাস্তি দেয়ার কথা ভাবছি। আসল যে লােককে শাস্তি দেয়া উচিত তার কথা ভাবছি না। মূল অপরাধী শাস্তি পাচ্ছে না।
সফিক বলল, কার কথা বলছিস ? | আরজু সাহেবের কথা বলছি। উনার কারণেই তাে এই অবস্থা। আজ আমরা আশ্রয়হারা। গৃহহারা । আজ আমরা পথহারা পাখি।
সফিক বলল, কথা সত্যি। উনাকে কী শাস্তি দেয়া যায় ? | সাবের বলল, উনাকে ডেকে নিয়ে এসে এই ঘর দেখিয়ে দেই। তাতেই উনার খবর হয়ে যাবে। তারপর উনাকে বলি— ডিয়ার স্যার, আপনি খবর দিয়েছেন আমরা সবাই না–কি নেংটো হয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করেছি। কাজটা তাে স্যার ঠিক করেন নি। আমরা সামান্য রাগ করেছি। এখন আপনি যদি স্যার দয়া করে একবার শুধু নেংটো হয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করেন তাহলে আমাদের রাগটা কমে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ
আমরা আবার রেগে গেলে ভয়ঙ্কর হয়ে যাই। | সাবেরের কথা শেষ হবার পর দলের সবাই কিছুক্ষণের জন্যে নীরব হয়ে গেল। নীরবতা ভঙ্গ করে ইয়াকুব বলল, অসাধারণ আইডিয়া! একবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আইডিয়া! আমার হাতে নােবেল পুরস্কার থাকলে আইডিয়ার জন্যে সাবেরকে নােবেল পুরস্কার দিয়ে দিতাম।
হারুন বলল, আরজু সাহেবকে এখানে কে ডেকে আনবে ? ঘণ্টা কে বাধবে ?
সফিক বলল, এটা কোনাে ব্যাপার না। মুহিব যাবে। মুহিবের রাজপুত্রের মতাে চেহারা । সে যা বলে সবাই তা বিশ্বাস করে। মুহিব উনাকে বলবে যে, আমরা তার হাতে বাড়ির চাবিটা দিতে চাই। চাবি দেয়ার আগে ঘরগুলি খুলে উনাকে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিতে চাই যে সব ঠিক আছে। কী–রে মুহিব, তুই গুছিয়ে সুন্দর করে বলতে পারবি না ?
মুহিব বলল, পারব।
সফিক বলল, মুহিবকে পাঠানাের সবচে‘ বড় সুবিধা হলাে, ওর মুখে কোনাে হাবিজাবির গন্ধ নেই। আমি নিজেই যেতাম কিন্তু আমার মুখ থেকে ভকভক করে হাবিজাবির গন্ধ বের হচ্ছে।
মুহিব বলল, কোনাে অসুবিধা নেই। আমি যাচ্ছি । ইয়াকুব বলল, ঘুমিয়ে পড়লে ঘুম থেকে ডেকে তুলবি।
কলিংবেল বাজতেই আঠারাে–উনিশ বছরের কিশােরী ধরনের মুখের একটা মেয়ে দরজা খুলে দিল। মুহিবকে দেখে সে খুবই হকচকিয়ে গেল। এই সময়ের মেয়ে এত সহজে হকচকিয়ে যায় না। মুহিব বলল, স্লমালিকুম। মেয়েটা এতে আরাে ঘাবড়ে গেল। মুহিব বলল, আরজু সাহেব কি আছেন ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ
মেয়েটি ক্ষীণ গলায় বলল, বাবা শুয়ে পড়েছেন। এখনাে ঘুমান নি। আমি এক্ষুণি উনাকে ডেকে নিয়ে আসছি। বলেই ছুটে বের হয়ে গেল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাবাকে নিয়ে উপস্থিত হলাে।
মুহিব বলল, স্যার, আপনি একটু উপরে আসবেন ? ফ্ল্যাট নাম্বার D4। আব্দুল গফুর সাহেবের ফ্ল্যাট।
কী ব্যাপার বলাে তাে? আমি কিন্তু বাবা তােমাকে চিনতে পারছি না। D4 ফ্ল্যাটের মালিক আব্দুল গফুর সাহেবের ভাগ্নে সফিকের আমি বন্ধু । ও আচ্ছা আচ্ছা।
মুহিব বলল, গফুর মামা সফিকের উপর খুব রাগ করেছেন। উনি বলেছেন। সবগুলি ঘর দেখিয়ে তারপর যেন আপনার হাতে চাবি দেয়া হয়।
বাবা কোনাে দরকার নেই। তুমি চাবিটা আমার কাছে দিয়ে যাও।
গফুর মামা ঘরগুলি দেখিয়ে আপনার হাতে চাবি দিতে বলেছেন। উনি খুবই আপসেট।
| আমার আসলে উনাকে কিছু জানানােই উচিত হয় নি। তােমাকে দেখে। এখন তাে আমার নিজের কাছেই খুব খারাপ লাগছে। আসলে হয়েছে কী, একটা ছেলেকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় সিড়ি দিয়ে নামতে দেখে... আমি নিজেই দেখলাম। সে আমাকে দেখে মােটেই লজ্জা পেল না। খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল, হ্যালাে মিস্টার ।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ
মুহিব ছােট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ও আমাদের বন্ধু । মহসিন নাম। জুলজিতে M.Sc পাস করেছে। অনার্স এমএসসি দুটাতেই ফার্স্টক্লাস পাওয়া । তিন বছর চেষ্টা করেও কোনাে চাকরি পাচ্ছিল না। মনটন খুব খারাপ থাকত। হঠাৎ খবর এসেছে তার মা মারা গেছে। আমরা তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যেই এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। খবরটা শােনার পর হঠাৎ কী যেন হলাে।
বলাে কী! খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আমার বােঝার ভুল।
ভদ্রলােক মেয়ের দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বললেন, যুথী মা, দেখ তাে। কী লজ্জার মধ্যে পড়লাম— মা‘র মৃত্যুতে একটা ছেলের সুখে–দুখে মাথা ইয়ে হয়ে গেছে আর আমি কি–না... ছিঃ ছিঃ।।
যূথী বলল, বাবা, তুমি উনার সঙ্গে যাও। ঐ ভদ্রলােক যদি থাকেন তার কাছে ক্ষমা চাও।
অবশ্যই ক্ষমা চাইব। বাবা, তােমার নাম কী ? আমার নাম মুহিব । চা খাও। জি–না, আমি চা খাব না।
চা তাে খেতেই হবে। চলাে উপরে যাই, সবার সঙ্গে কথা বলে আসি। তারপর না হয় সবার সঙ্গেই চা খাব। মুহিব বাবা শােন, এ হলাে আমার বড় মেয়ে— ডাক নাম যূথী। ভালাে নাম শায়লা। খুবই ভালাে ছাত্রী। এসএসসিতে ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে ফিফথ হয়েছে। মেয়েদের মধ্যে প্রথম। এর ছােট্ট একটা ইন্টারভিউ বিটিভিতে প্রচার করেছিল। টিভি‘তে তাকে অবশ্যি অনেক বড় বড় লেগেছে। আমি নিজেই চিনতে পারি নি।
যূথী লজ্জিত গলায় বলল, বাবা চুপ করাে তাে। ভদ্রলােক মুহিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, বাবা চলাে যাই।