আরজু সাহেব আজমীর মামার শােবার ঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর শরীর কাঁপছে। কপাল ভর্তি ঘাম। কপালের ঘাম নাক বেয়ে টুপটুপ করে পড়ছে। তিনি ভাঙা গলায় বললেন, এখানে কী হয়েছে ? সফিক বলল, তেমন কিছু হয় নি। আমরা কাটাকুটি খেলেছি। তার মানে কী ? সব কিছুর মানে কি পরিষ্কার করে বলা যায়? বলা যায় না। বলা উচিতও ।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
সাবের বলল, বুঝতে না পারাই তাে ভালাে। এই জগতে যত কম বুঝবেন তত ভালাে। বেশি বুঝলে ধরা খেয়ে যাবেন। একজন বেশি বুঝেছিল বলে ধরা খেয়েছে— মামার শােবার ঘরটা নােংরা হয়েছে। আমি যাই।
সাবের বলল, অবশ্যই যাবেন। যাবার আগে আমাদের জন্যে ছােট্ট একটা কাজ করে দিতে হয় যে ।
আরজু সাহেব কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, কী কাজ?
মফিজ বলল, আমাদের বন্ধু যেমন নেংটো হয়ে সিড়ি দিয়ে দৌড়ে গিয়েছিল সে–রকম একটা নেংটা দৌড় দেবেন। আপনার পরনে লুঙি। নেংটা হওয়া আপনার জন্যে কোনাে ব্যাপারই না।
আরজু সাহেব বললেন, বাবা তুমি কী বলছ ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৫)-হুমায়ুন আহমেদ
নেংটা হতে যদি লজ্জা লাগে তাহলে তারও ওষুধ আছে। দু’গ্লাস মাল খেয়ে নিন। দেখবেন লজ্জা–শরম কোথায় চলে যাবে।
ভদ্রলােক বিড়বিড় করে বললেন, মাল খাব। মাল।
মহসিন এগিয়ে এসে আচমকা টান দিয়ে ভদ্রলােকের লুঙি খুলে ফেলল। তিনি কোনাে আপত্তি করলেন না বা চেঁচিয়েও উঠলেন না। অদ্ভুত দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকাতে লাগলেন। একবার শুধু বিড়বিড় করে ডাকলেন— যূথী, ও মা যুথী ।
বেকার মানুষদের জন্যে সপ্তাহের সবচে’ অস্বস্তিকর দিন হলাে ছুটির দিন। যারা কাজেকর্মে থাকে এই দিনে তাদের মধ্যে ঢিলে ভাব চলে আসে যেন পায়জামার গিঠ বেশ খানিকটা আলগা করে দেয়া হলাে। পা নাচানাের অভ্যাস যাদের নেই তাদেরকেও দেখা যায় খবরের কাগজ মুখের সামনে ধরে পা নাচাচ্ছে। বেকাররা পড়ে যায় অস্বস্তিতে। ছুটির দিনগুলির সঙ্গে নিজেদের মিলাতে পারে না। তাদের মধ্যে বােকা বােকা ভাব চলে আসে।
মুহিবকে এখন বেকার বলার কোনাে কারণ নেই। চাকরিতে জয়েন সে করে নি, কিন্তু এক তারিখেই করবে। ছুটির দিনে তার অস্বস্তি বােধ করার কোনাে কারণ নেই। সে অবশ্যই একটা খবরের কাগজ কিনে এনে পা দোলাতে দোলাতে পড়তে পারে। খবরের কাগজ কিনতে হবে কারণ এ বাড়িতে যে দু‘টা কাগজ রাখা হয় তার কোনােটাই দুপুরের আগে রিলিজ হয় না। একটা ইংরেজি কাগজ তৌফিকুর রহমান সাহেব রাখেন। এই কাগজটা তিনি পড়েন দুপুরের খাওয়া–দাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৫)-হুমায়ুন আহমেদ
দুপুরের খবরের কাগজ না পড়লে তার ঘুম হয় না। যে–সব বিশেষ বিশেষ দিনে কাগজ বের হয় না সে–সব দিনগুলিতে তার খুবই সমস্যা হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত বিছানায় গড়াগড়ি করেন। ঘুম আসে না। দ্বিতীয় কাগজটা বাড়ির সবার জন্যে। এই কাগজ হাতে পাওয়া খুব সমস্যা। কাগজটা কে আগে পড়বে এই নিয়ে ঠাণ্ডা স্নায়ুযুদ্ধও হয়। মনােয়ারা বাড়ির কর্তী হিসেবে কাগজটা প্রথম পড়বেন এরকম আশা করেন। তিনি কাগজ কখনােই
আগে হাতে পান না। | মুহিব ঠিক করে রেখেছে যেদিন চাকরিতে জয়েন করবে সেদিন থেকে হকারকে বলে দেবে চারটা বাংলা কাগজ দিয়ে যেতে। নাশতার টেবিলে চারটা কাগজ পড়ে থাকবে, যার যেটা ইচ্ছা উঠিয়ে নাও। তখন যদি কেউ প্রশ্ন করে, ব্যাপার কী ? তখন না হয় বলা যাবে। মুহিব এখনাে কাউকে কিছু বলতে পারছে
কারণ সে নিজেও চাকরির ব্যাপারে পুরােপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না। তার মনে প্রবল সন্দেহ— এক তারিখে সে যখন জয়েন করতে যাবে তখন তাকে বলা হবে, সামান্য ভুল হয়েছে। পরে যােগাযােগ করুন।
এমন উদাহরণ আছে। সফিকের বেলায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। নান্দাইল গার্লস কলেজে ইতিহাসের লেকচারার পােস্টে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে সে বিছানা বালিশ নিয়ে জয়েন করতে গেল। কলেজের প্রিন্সিপ্যাল সাহেব তাকে চা–টা খাইয়ে আদর–আপ্যায়ন করে বললেন— ক্ষুদ্র একটা সমস্যা হয়েছে। মন্ত্রীর সুপারিশে এডহক ভিত্তিতে একজনকে নিয়ে নেয়া হয়েছে। আপনি বরং গভর্নিং কমিটির সেক্রেটারি সাহেবের সঙ্গে কথা বলেন।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৫)-হুমায়ুন আহমেদ
সফিক বলল, উনার সঙ্গে কথা বলে কী হবে? প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বললেন, কিছুই হবে না। মনের শান্তি। মনের শান্তি দিয়ে আমি করব কী ? প্রিন্সিপ্যাল সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, সেটাও একটা কথা ।
চাকরি নিয়ে মুহিবের ভালােরকম দুশ্চিন্তা আছে বলেই সে প্রতিরাতেই চাকরি নিয়ে দুঃস্বপ্নের মতাে দেখছে। গত রাতের দুঃস্বপ্ন হলাে— সে জয়েন করতে গিয়েছে। ম্যানেজার সাহেব একটা কাগজ বের করে বললেন, এখানে সই করুন। মুহিব বলল, আপনার কলমটা একটু দিন। ম্যানেজার সাহেব চোখ সরু করে বললেন, কলম ছাড়া চাকরি করতে এসেছেন! এরকম ঘটনা আমার জীবনে ঘটে নি। আপনি শুধু যে কলম ছাড়া চাকরি করতে এসেছেন তা না, লুঙ্গি পরে চলে এসেছেন। খালি পায়ে এসেছেন, না–কি পায়ে স্যান্ডেল আছে ?
মুহিব তাকিয়ে দেখল সত্যি সত্যি তার পরনে লুঙ্গি। পা খালি। এক পা কাদায় মাখামাখি । | টেনশনে সে ঘেমে গেল। তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। বুক ধড়ফড়ানি নিয়েই তার ঘুম ভাঙল। যতই দিন যাচ্ছে ততই মুহিব নিশ্চিত হচ্ছে চাকরি হবে
। | দরজায় টুকটুক শব্দ হচ্ছে। মুহিব সাড়া দিল না। সকালবেলাতেই টুকটুকানি ভালাে লাগে না।
মুহিব, দরজা খােল ।
মায়ের গলা। মুহিব বিছানা থেকে নামল। ছুটির দিনের সকালবেলায় মাতৃমুখ দর্শন তার জন্যে কোনাে সুখকর ব্যাপার না। তাকে কোথাও যেতে হবে। সম্ভাবনা শতকরা ৯০ ভাগ যে মনােয়ারা তাকে তার বড় মেয়ের কাছে গােপন চিঠি দিয়ে পাঠাবেন। | মনােয়ারা তার বড় মেয়ের সঙ্গে গােপন চিঠি চালাচালি করেন। মুহিব পােস্টম্যান। আজও মনে হয় রানারের ভূমিকা পালন করতে হবে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৫)-হুমায়ুন আহমেদ
মুহিব দরজা খুলল। মনােয়ারা চায়ের কাপ হাতে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। এটা একটা বিস্ময়কর ঘটনা। | নে চা খা।
হঠাৎ চা! ব্যাপার কী মা ?
বড় বৌমা তােফাজ্জলের জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি বললাম, মুহিবের জন্যেও এক কাপ বানাও। | শুধু চা দিতে এসেছ ? না–কি আরাে কিছু বলবে। বড় আপার কাছে যেতে
মনােয়ারা ছেলের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, তুই কি ঘটনা কিছু শুনেছিস ?
কী ঘটনা ? গতকাল রাতে তুই বাসায় ছিলি না ?
। কোথায় ছিলি ? আমার এক বন্ধুর মামার বাসায় ছিলাম।
এই জন্যেই তুই কিছু জানিস না। গতকাল রাতে তােফাজ্জলের টাকা চুরি গেছে। পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল। ড্রেসিং টেবিলের উপরে টাকাটা ছিল