উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৫)-হুমায়ুন আহমেদ

আরজু সাহেব আজমীর মামার শােবার ঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছেনতাঁর শরীর কাঁপছেকপাল ভর্তি ঘামকপালের ঘাম নাক বেয়ে টুপটুপ করে পড়ছেতিনি ভাঙা গলায় বললেন, এখানে কী হয়েছে ? উড়ালপঙ্খিসফিক বলল, তেমন কিছু হয় নিআমরা কাটাকুটি খেলেছিতার মানে কী ? সব কিছুর মানে কি পরিষ্কার করে বলা যায়? বলা যায় নাবলা উচিতও । 

আমি কিছু বুঝতে পারছি না। 

সাবের বলল, বুঝতে না পারাই তাে ভালাে। এই জগতে যত কম বুঝবেন তত ভালােবেশি বুঝলে ধরা খেয়ে যাবেনএকজন বেশি বুঝেছিল বলে ধরা খেয়েছেমামার শােবার ঘরটা নােংরা হয়েছে। আমি যাই। 

সাবের বলল, অবশ্যই যাবেনযাবার আগে আমাদের জন্যে ছােট্ট একটা কাজ করে দিতে হয় যে । 

আরজু সাহেব কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, কী কাজ

মফিজ বলল, আমাদের বন্ধু যেমন নেংটো হয়ে সিড়ি দিয়ে দৌড়ে গিয়েছিল সেরকম একটা নেংটা দৌড় দেবেনআপনার পরনে লুঙিনেংটা হওয়া আপনার জন্যে কোনাে ব্যাপারই না। 

আরজু সাহেব বললেন, বাবা তুমি কী বলছ

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৫)-হুমায়ুন আহমেদ

নেংটা হতে যদি লজ্জা লাগে তাহলে তারও ওষুধ আছেদুগ্লাস মাল খেয়ে নিনদেখবেন লজ্জাশরম কোথায় চলে যাবে। 

ভদ্রলােক বিড়বিড় করে বললেন, মাল খাবমাল। 

মহসিন এগিয়ে এসে আচমকা টান দিয়ে ভদ্রলােকের লুঙি খুলে ফেললতিনি কোনাে আপত্তি করলেন না বা চেঁচিয়েও উঠলেন নাঅদ্ভুত দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকাতে লাগলেনএকবার শুধু বিড়বিড় করে ডাকলেনযূথী, মা যুথী । 

বেকার মানুষদের জন্যে সপ্তাহের সবচেঅস্বস্তিকর দিন হলাে ছুটির দিনযারা কাজেকর্মে থাকে এই দিনে তাদের মধ্যে ঢিলে ভাব চলে আসে যেন পায়জামার গিঠ বেশ খানিকটা আলগা করে দেয়া হলােপা নাচানাের অভ্যাস যাদের নেই তাদেরকেও দেখা যায় খবরের কাগজ মুখের সামনে ধরে পা নাচাচ্ছেবেকাররা পড়ে যায় অস্বস্তিতেছুটির দিনগুলির সঙ্গে নিজেদের মিলাতে পারে নাতাদের মধ্যে বােকা বােকা ভাব চলে আসে। 

মুহিবকে এখন বেকার বলার কোনাে কারণ নেইচাকরিতে জয়েন সে করে নি, কিন্তু এক তারিখেই করবেছুটির দিনে তার অস্বস্তি বােধ করার কোনাে কারণ নেইসে অবশ্যই একটা খবরের কাগজ কিনে এনে পা দোলাতে দোলাতে পড়তে পারেখবরের কাগজ কিনতে হবে কারণ বাড়িতে যে দুটা কাগজ রাখা হয় তার কোনােটাই দুপুরের আগে রিলিজ হয় নাএকটা ইংরেজি কাগজ তৌফিকুর রহমান সাহেব রাখেনএই কাগজটা তিনি পড়েন দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৫)-হুমায়ুন আহমেদ

দুপুরের খবরের কাগজ না পড়লে তার ঘুম হয় নাযেসব বিশেষ বিশেষ দিনে কাগজ বের হয় না সেসব দিনগুলিতে তার খুবই সমস্যা হয়সন্ধ্যা পর্যন্ত বিছানায় গড়াগড়ি করেনঘুম আসে নাদ্বিতীয় কাগজটা বাড়ির সবার জন্যেএই কাগজ হাতে পাওয়া খুব সমস্যাকাগজটা কে আগে পড়বে এই নিয়ে ঠাণ্ডা স্নায়ুযুদ্ধও হয়মনােয়ারা বাড়ির কর্তী হিসেবে কাগজটা প্রথম পড়বেন এরকম আশা করেনতিনি কাগজ কখনােই 

আগে হাতে পান না| মুহিব ঠিক করে রেখেছে যেদিন চাকরিতে জয়েন করবে সেদিন থেকে হকারকে বলে দেবে চারটা বাংলা কাগজ দিয়ে যেতেনাশতার টেবিলে চারটা কাগজ পড়ে থাকবে, যার যেটা ইচ্ছা উঠিয়ে নাওতখন যদি কেউ প্রশ্ন করে, ব্যাপার কী ? তখন না হয় বলা যাবেমুহিব এখনাে কাউকে কিছু বলতে পারছে 

কারণ সে নিজেও চাকরির ব্যাপারে পুরােপুরি নিশ্চিত হতে পারছে নাতার মনে প্রবল সন্দেহএক তারিখে সে যখন জয়েন করতে যাবে তখন তাকে বলা হবে, সামান্য ভুল হয়েছেপরে যােগাযােগ করুন। 

এমন উদাহরণ আছেসফিকের বেলায় ধরনের ঘটনা ঘটেছেনান্দাইল গার্লস কলেজে ইতিহাসের লেকচারার পােস্টে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে সে বিছানা বালিশ নিয়ে জয়েন করতে গেলকলেজের প্রিন্সিপ্যাল সাহেব তাকে চাটা খাইয়ে আদরআপ্যায়ন করে বললেনক্ষুদ্র একটা সমস্যা হয়েছেমন্ত্রীর সুপারিশে এডহক ভিত্তিতে একজনকে নিয়ে নেয়া হয়েছেআপনি বরং গভর্নিং কমিটির সেক্রেটারি সাহেবের সঙ্গে কথা বলেন। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৫)-হুমায়ুন আহমেদ

সফিক বলল, উনার সঙ্গে কথা বলে কী হবে? প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বললেন, কিছুই হবে নামনের শান্তিমনের শান্তি দিয়ে আমি করব কী ? প্রিন্সিপ্যাল সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, সেটাও একটা কথা । 

চাকরি নিয়ে মুহিবের ভালােরকম দুশ্চিন্তা আছে বলেই সে প্রতিরাতেই চাকরি নিয়ে দুঃস্বপ্নের মতাে দেখছেগত রাতের দুঃস্বপ্ন হলােসে জয়েন করতে গিয়েছেম্যানেজার সাহেব একটা কাগজ বের করে বললেন, এখানে সই করুনমুহিব বলল, আপনার কলমটা একটু দিন। ম্যানেজার সাহেব চোখ সরু করে বললেন, কলম ছাড়া চাকরি করতে এসেছেন! এরকম ঘটনা আমার জীবনে ঘটে নিআপনি শুধু যে কলম ছাড়া চাকরি করতে এসেছেন তা না, লুঙ্গি পরে চলে এসেছেনখালি পায়ে এসেছেন, নাকি পায়ে স্যান্ডেল আছে

মুহিব তাকিয়ে দেখল সত্যি সত্যি তার পরনে লুঙ্গিপা খালিএক পা কাদায় মাখামাখি | টেনশনে সে ঘেমে গেলতার বুক ধড়ফড় করতে লাগলবুক ধড়ফড়ানি নিয়েই তার ঘুম ভাঙলযতই দিন যাচ্ছে ততই মুহিব নিশ্চিত হচ্ছে চাকরি হবে 

| দরজায় টুকটুক শব্দ হচ্ছেমুহিব সাড়া দিল নাসকালবেলাতেই টুকটুকানি ভালাে লাগে না। 

মুহিব, দরজা খােল । 

মায়ের গলামুহিব বিছানা থেকে নামলছুটির দিনের সকালবেলায় মাতৃমুখ দর্শন তার জন্যে কোনাে সুখকর ব্যাপার নাতাকে কোথাও যেতে হবেসম্ভাবনা শতকরা ৯০ ভাগ যে মনােয়ারা তাকে তার বড় মেয়ের কাছে গােপন চিঠি দিয়ে পাঠাবেন| মনােয়ারা তার বড় মেয়ের সঙ্গে গােপন চিঠি চালাচালি করেনমুহিব পােস্টম্যানআজও মনে হয় রানারের ভূমিকা পালন করতে হবে। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৫)-হুমায়ুন আহমেদ

মুহিব দরজা খুললমনােয়ারা চায়ের কাপ হাতে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেনএটা একটা বিস্ময়কর ঘটনা। | নে চা খা। 

হঠাৎ চা! ব্যাপার কী মা

বড় বৌমা তােফাজ্জলের জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলআমি বললাম, মুহিবের জন্যেও এক কাপ বানাও| শুধু চা দিতে এসেছ ? নাকি আরাে কিছু বলবেবড় আপার কাছে যেতে 

মনােয়ারা ছেলের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, তুই কি ঘটনা কিছু শুনেছিস

কী ঘটনা ? গতকাল রাতে তুই বাসায় ছিলি না

কোথায় ছিলি ? আমার এক বন্ধুর মামার বাসায় ছিলাম। 

এই জন্যেই তুই কিছু জানিস নাগতকাল রাতে তােফাজ্জলের টাকা চুরি গেছেপঞ্চাশ হাজার টাকার একটা বান্ডিলড্রেসিং টেবিলের উপরে টাকাটা ছিল

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *