এত টাকা বাসায় ছিল ?
ওরা কালার টিভি কিনবে। আলাদা টিভি দেখবে। বৌমার বুদ্ধি । এই মেয়ে ছেলেটার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে।আলাদা টিভি দেখার কী আছে তুই বল। এইসব আমার এখন আর ভালাে লাগে না। আমি ঠিক করেছি এদের সঙ্গে থাকব ।
থাকবে কোথায় ? মনােয়ারা চুপ করে রইলেন। চিন্তা করে বের কর কোথায় থাকতে চাও। আমি দিয়ে আসব।
মনােয়ারা সরু গলায় বললেন, মাকে কোথাও ফেলে দিয়ে আসার জন্যে তুই এত ব্যস্ত ? | মুহিব বলল, তুমি যেতে চাচ্ছ বলেই তােমাকে রেখে আসতে চাচ্ছি। মাতৃ আদেশ পালন করছি। চা–টা ভালাে হয়েছে। আরেক কাপ চা খাওয়াতে পারবে?
মনােয়ারা জবাব দিলেন না। চিন্তিত মুখ করে বসে রইলেন।
মুহিব বলল, মা, তােমার কথা শেষ হয়েছে না আরাে কিছু বলবে ? মনােয়ারা বললেন, তাের এখানে বসে থাকলে কি কোনাে সমস্যা আছে ? কোনাে সমস্যা নেই। সারাদিন বসে থাক।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
ফাজিলের মতাে কথা বলছিস কী মনে করে ? বাংলাদেশের কোনাে ছেলেকে দেখেছিস মায়ের সঙ্গে এইভাবে কথা বলে ? সব রসুনের এক পাছা। তােরা তিন ভাই–ই এক রকম। তােদের মধ্যে তােফাজ্জল হচ্ছে হাড়ে গােশতে বদ। বউ–এর চোখের ইশারায় চলে। এখন হুকুম জারি করেছে প্রত্যেকের ট্রাঙ্ক স্যুটকেস খুলে চেক করা হবে। টাকার জন্যে চাকর–বাকরদের পুটলা–পুটলি চেক করা এক কথা, আর প্রত্যেকের ট্রাঙ্ক–স্যুটকেস চেক করা ভিন্ন কথা।
এখন মনে কর, তাের বড়চাচার সুটকেস খােলা হলাে– ব্যাপারটা তাের বড়চাচার কেমন লাগবে? | মুহিব হাই তুলতে তুলতে বলল, যদি বড়চাচার স্যুটকেস খুলে পঞ্চাশ হাজার টাকার বান্ডিলটা পাওয়া যায় তাহলে খুব খারাপ লাগবে । মা শােন, আমি ঠিক করেছি আবার ঘুমিয়ে পড়ব। ঘুমের দ্বিতীয় অধিবেশন। কাজেই এখন চলে যাও।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
ঘর থেকে বের করে দিচ্ছিস! তাের এত বড় সাহস ? নিজের মাকে বলতে পারলি ঘর থেকে এক্ষুণি বের হয়ে যাও।
এরকম কঠিন করে তাে মা বলি নি। সফটলি বলেছি। | মনােয়ারা উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তিনি এক্ষুণি কেঁদে ফেলবেন। মুহিব বিছানায় শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, মা, আমার একটা উপদেশ শােন। ভাইজানের কাছ থেকে তুমি যদি টাকাটা সরিয়ে থাক তাহলে আমার কাছে পাচার করে দাও। তােমার স্যুটকেস থেকে টাকা বের হলে তুমি বিরাট লজ্জার মধ্যে পড়বে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
তুই কী বললি ? কী বললি তুই ? কী বলেছি তুমি তাে শুনেছ।
মনােয়ারা কেঁদে ফেললেন। শাড়ির আঁচলে চোখ ঢেকে ফুপিয়ে উঠলেন। ভাঙা গলায় বললেন নিজের মাকে নিয়ে এমন একটা কুৎসিত কথা তুই কীভাবে ভাবলি ?
মুহিব উঠে বসতে বসতে বলল— মা শােন, আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন তুমি বাবার মানিব্যাগ থেকে তিন হাজার টাকা সরিয়েছিলে। তারপর নিজেই টাকা চুরির জন্যে দোষী সাব্যস্ত করলে আমাদের বাসার কাজের ছেলেটাকে । তার নাম ছিল রুকু। তুমি তাকে এমন মার মারলে যে তার বাঁ হাত ভেঙে গেল । বাবা তাকে হাসপাতালে নিয়ে সেই হাত প্লাস্টার করিয়ে আনলেন।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
মনােয়ারা ফোঁপাতে ফেঁপাতে বললেন, তাের মতাে ছেলে আমি কী করে পেটে ধরলাম ? এই ছেলে নিজের মাকে বলছে চোর ?
মুহিব শান্ত গলায় বলল, মা শােন, ফেঁসফেঁসানি বন্ধ কর। তােমার ভাবভঙ্গি থেকে পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছে টাকাটা তুমি নিয়েছ। বড়ভাবি অবশ্যই তােমাকে সন্দেহ করছেন। সন্দেহ করছেন বলেই বলা হচ্ছে সবার ট্রাঙ্ক স্যুটকেস চেক করা হবে। তােমার কাছে টাকাটা পাওয়া গেলে খুবই কেলেঙ্কারী ব্যাপার হবে। তুমি এক কাজ কর টাকাটা এক্ষুণি এনে আমার ড্রয়ারে রাখ। পুরােটাই আছে, না কিছু খরচ করে ফেলেছ ? মা, ঠিকঠাক জবাব দাও। আমি তােমাকে সাহায্য করতে চাই। পুরাে টাকাটা আছে ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
পাঁচশ খরচ করেছি।
আমার জন্যে এক কাপ চা নিয়ে এসাে, আর বাকি টাকাটা এনে আমার ড্রয়ারে রেখে দাও।
মনােয়ারা চোখ মুছে ছেলের ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
ছুটির দিনের সকাল অনেক দেরিতে শুরু হয়। মুহিব সেই হিসেব করে সাড়ে দশটার দিকে ঘর থেকে বের হলাে। তার কাছে পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। যে টেনশনে মনােয়ারা মুখ শুকনাে করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন কোথাও তার ছোঁয়া দেখা গেল না। মুহিবের বড় ভাই তােফাজ্জল খবরের কাগজ হাতে নাস্তার টেবিলে।
ছুটির দিন হিসেবে স্পেশাল নাশতা বানানাে হয়েছে— খাসির মাংসের তেহারি। তােফাজ্জলের সামনে প্লেট ভর্তি তেহারি । সে খুবই আগ্রহের সঙ্গে তেহারি খাচ্ছে এবং পত্রিকা পড়ছে। পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল চুরি হয়েছে, তার ছাপ তােফাজ্জলের মুখে নেই। বরং তাকে আনন্দিত দেখাচ্ছে। মুহিবকে দেখে সে বলল, যুবরাজের খবর কী?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
মুহিব কিছু বলল না।
তােফাজ্জল বলল, চাকরি–বাকরি নেই, তাের চেহারা তাে চিমসে মেরে যাওয়ার কথা। অথচ যত দিন যাচ্ছে তাের চেহারা খােলতাই হচ্ছে। রহস্যটা
কী ? এই প্রশ্নের জবাব হলাে লজ্জিত ভঙ্গির হাসি। সেই হাসি কেন যেন আসছে।
তুই এক কাজ কর মতিঝিল এলাকায় ঘােরাঘুরি না করে এফডিসি এলাকায় ঘােরাঘুরি কর। কোনাে পরিচালকের নজরে পড়লে তােকে ফিল্মে নিয়ে নিবে। আমি কিন্তু ঠাট্টা করছি না। আমি সিরিয়াস।
মুহিব ভাইয়ের পাশে বসেছে। সকালবেলায় তৈলাক্ত তেহারি দেখে গা গুলাচ্ছে। বেগুন ভাজা দিয়ে রুটি খেতে ইচ্ছা করছে। ঘরে বেগুন অবশ্যই আছে। দুটা রুটি সেঁকে দিতে বেশি যন্ত্রণা হবার কথা না। সেই নির্দেশ মুহিব দিতে পারছে না।
তােফাজ্জল মুখের উপর থেকে পত্রিকা নামিয়ে বলল, সফিক নামে তাের কোনাে বন্ধু আছে ?