উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ

নামাজের শেষে তিনি এত আবেগের সঙ্গে দোয়া পড়লেন যে মুহিবের চোখ ছলছল করতে লাগল উড়ালপঙ্খি 

মুহিব! জি ভাবি। 

মুহিবের বড়ভাবি দরজার পাশ থেকে তার অতি বিরক্ত মুখ বের করে বললেনতােমার টেলিফোন এসেছে, ধর যাকে তাকে নাম্বার দিও না তােসময়ে অসময়ে টেলিফোন করে, অতি বিরক্ত লাগে। 

মুহিব বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, ইলিশ মাছটা পাঠিয়েছিলাম, কেমন ছিল ভাবি

ভালােটাকাটা পুরােটাই খরচ করেছ ? বাচে নি কিছু ? এক হাজার টাকা দিয়েছিলাম, পুরােটা তাে লাগার কথা না। 

একশ টাকার মতাে বেচেছে। 

যা বাচে ফেরত দিওসব সময় চেয়ে টাকা নিতে হবে কেন ? তােমার ভাইয়ের পঞ্চাশ হাজার টাকা যে চুরি গেছে শুনেছ ?

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ

তােমার ভাই বলছেসবার বাক্সপ্যাটরা চেক করা হবেআমি না করেছি, সে শুনছে নাশেষে কার না কার ব্যাগ থেকে টাকা বের হবে, নিজের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে..

ভাবি, তােমরা কি নিশ্চিত যে আমাদের মধ্যে কেউ নিয়েছে ? অবশ্যইকে নিয়েছে বলে তােমার অনুমান

আগে টেলিফোন সেরে আসতােমার বন্ধু কতক্ষণ টেলিফোন ধরে বসে থাকবে ? মুহিব টেলিফোন ধরতে গেলটেলিফোন করেছে সফিকতার গলা উত্তেজনায় কাঁপছেঅতি দ্রুত কথা বলছে বলে কথাও জড়িয়ে যাচ্ছেসকাল থেকে চেষ্টা করছি তােকে ধরার জন্যএক্ষুণি চলে আয় টেলিফোন রেখে দৌড় দিয়ে ঘর থেকে বের হবিলাফ দিয়ে কোনাে একটাচলন্ত বেবিটেক্সিতে উঠে পড়বিস্ট্রেইট আমার বাসায়। কী হয়েছে ? পত্রিকা পড়িস নাই ? প্রথম আলােলাস্ট পেজটা দেখেছিস

তােদের বাসায় কী পত্রিকা রাখা হয় ? জানি নাপ্রথম আলােলাস্ট পেজহারুনের ছবি ছাপা হয়েছেকেন

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ

সে প্রেসক্লাবের সামনে গতরাত বারােটা থেকে বসে আছেঘােষণা দিয়েছে তার জন্মদিনে অর্থাৎ জুলাইয়ের দুই তারিখে বেকার গায়ে কেরােসিন ঢেলে জীবন বিসর্জন দেবে। 

কেন

 বেকার সমস্যার দিকে জনগণের দৃষ্টি ফেরাবার জন্যেহারুনের পেটে যে এই জিনিস ছিল কোনােদিন বলেছে ? আশ্চর্য ছেলে! সকালে পত্রিকা দেখে আমার তাে ব্রেইন আউলা হয়ে গেলকোনাে রকম আলােচনা নাই, কিছু নাই, হুট করে এত বড় ডিসিশান! যাই হােক, এখন পুরাে দায়িত্ব আমাদের নিতে হবেকবিসাহিত্যিক, অভিনেতা, গায়ক, বুদ্ধিজীবী সবার কাছে ছােটাছুটি করতে হবেসিরিয়াস জনমত তৈরি করতে হবে আমাদের দলের সবাইকে এক হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হবে

অনেক খরচাপাতির ব্যাপার আছেএকটা পােস্টার ছাপাতে হবেনীরব ঘাতক সাবেরের মামার প্রেস আছেসাবেরকে সঙ্গে নিয়ে উনার পায়ে পড়ববলব, মামা আপনার পায়ে ধরলামরাজি না হওয়া পর্যন্ত পা ছাড়ব নাআমরা কাগজ কিনে দিচ্ছি, আপনি চার কালারের একটা পােস্টার ছেপে দিনহারুনের সুন্দর একটা ছবিও তুলতে হবেহতাশ চেহারা বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে টাইপতাের চেনাজানা কোনাে ফটোগ্রাফার আছে

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ

ফট করে না বলিস নাচিন্তা করে বলভালােমতাে চিন্তা করলে দেখবি কেউ না কেউ বের হয়ে পড়েছেএক হাজার টাকা ম্যানেজ করে চলে আয়এক হাজার টাকা হলাে মিনিমামযত বেশি হয় তত ভালােকথা বলে সময় নষ্ট করিস নাদৌড় দিয়ে ঘর থেকে বের । 

টাকার জন্যে মুহিব গেল মনােয়ারার কাছেতিনি অবাক হয়ে বললেন, তাের কত টাকা লাগবে বললি

পাঁচ হাজারএত টাকা দিয়ে তুই কী করবি ? আমার এক বন্ধুর চিকিৎসার জন্যে দরকারসে মারা যাচ্ছে। 

তাের কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে ? বন্ধুর চিকিৎসার জন্যে পাঁচ হাজার টাকা ? টাকা সস্তা হয়ে গেছে

মা প্লিজ ব্যবস্থা করএখন ধার হিসাবে নিচ্ছিপাই পয়সা হিসাব করে টাকা ফেরত দেব। 

আমি টাকা পাব কোথায় ? | ভাইয়ার বান্ডিলটা থেকে দাওতুমি তাে মাত্র পাঁচশ খরচ করেছবাকিটা তাে আছেএবং এই টাকাটা ভাইজানকে ফেরত দিতে হবেকোনােই কাজে লাগবে নামাঝখান থেকে আমার বন্ধুর জীবন রক্ষা হয়। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ

মনােয়ারা ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, তাের এত বড় সাহস! তুই তাে মানুষ নাতুই জানােয়ার। নিজের মাকে চোর বলছিসতাের স্থান দোজখেও হবে না। 

চুরি করেছ বলেই তাে বলেছিতুমি স্বীকারও করেছনা স্বীকার করলে বেনিফিট অব ডাউট দেয়া যেত। 

চুপ হারামজাদা| মা একটা কিছু ব্যবস্থা করপাঁচ হাজার না পার, চার হাজার, চার না পার তিন...

তুই আমার সামনে থেকে যাজীবনে আমার সামনে পড়বি নাআমি বাকি জীবন তাের মুখ দেখতে চাই না। 

মা শােন, বড় ভাবির সঙ্গে আমার কথা হয়েছেউনার ভাবভঙ্গি সুবিধার মনে হয় স্যুটকেসট্রাঙ্ক সত্যি সত্যি খােলা হবেতুমি অবশ্যই আমার ড্রয়ারে রেখে দিওআগে মানসম্মানটা বাঁচুক। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ

আমার সামনে থেকে যাকোনােদিন আমার সামনে পড়বি নাকোনােদিন আমি বাকি জীবনে তাের মুখ দেখতে চাই না। 

হারুন বসেছে প্রেসক্লাবের গেট থেকে একটু দূরেশতরঞ্জি বিছিয়ে বসেছেতার ডান পাশে ধবধবে সাদা রঙের বিশাল বালিশ সামনে পিরিচে গুড়মুড়ি এবং ছােট এলাচ দানা রাখাতার পেছনে বাঁশ পুতে বাঁশের মাথায় ছাতি দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছেছাতার ছায়া হারুনের মাথায় পড়ে নিঘাড়ের উপর পড়েছে

হারুনের পেছনে নীল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ারসফিক চেয়ারগুলি দুদিনের জন্যে ডেকোরেটরের দোকান থেকে ভাড়া করে এনেছেচেয়ারগুলি গােল করে বসানােসেখানে সফিকের বন্ধুরা গম্ভীর ভঙ্গিতে বসা আছেএকটা বাচ্চা চাওয়ালাকে খবর দিয়ে আনা হয়েছেতার সঙ্গে কন্ট্রাক্টসারাদিন সে সফিকের দলকে চা খাওয়াবে

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ

বাইরে চা বিক্রি করতে পারবে না। বিনিময়ে চায়ের দাম তাে পাবেই, এক্সট্রা পঞ্চাশ টাকা পাবেচাওয়ালার নামজতুজতু অত্যন্তআনন্দের সঙ্গে প্রস্তাবে রাজি হয়েছেসে নিজেকে দলের অংশ হিসেবে ভাবছেযেন সে এখন এক বিরাট জাতীয় কর্মকাণ্ডের অংশগুরুত্বপূর্ণ সদস্য। 

সফিক তার দল নিয়ে চেয়ারে গােল হয়ে বসেছেতাদের সবার হাতে চায়ের কাপতারা মাথা নিচু করে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে একমত হবার চেষ্টা করছেকোনাে ইস্যুতেই কেউ একমত হতে পারছে নাসবারই মেজাজ খারাপ হচ্ছেহারুনের সামনে একটা পােস্টার লাগানাে হবেএই বিষয়ে সবাই একমতপােস্টারের লেখা তৈয়ব লিখেছে

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *