নামাজের শেষে তিনি এত আবেগের সঙ্গে দোয়া পড়লেন যে মুহিবের চোখ ছলছল করতে লাগল ।
মুহিব! জি ভাবি।
মুহিবের বড়ভাবি দরজার পাশ থেকে তার অতি বিরক্ত মুখ বের করে বললেন— তােমার টেলিফোন এসেছে, ধর । যাকে তাকে নাম্বার দিও না তাে। সময়ে অসময়ে টেলিফোন করে, অতি বিরক্ত লাগে।
মুহিব বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, ইলিশ মাছটা পাঠিয়েছিলাম, কেমন ছিল ভাবি?
ভালাে। টাকাটা পুরােটাই খরচ করেছ ? বাচে নি কিছু ? এক হাজার টাকা দিয়েছিলাম, পুরােটা তাে লাগার কথা না।
একশ টাকার মতাে বেচেছে।
যা বাচে ফেরত দিও। সব সময় চেয়ে টাকা নিতে হবে কেন ? তােমার ভাইয়ের পঞ্চাশ হাজার টাকা যে চুরি গেছে শুনেছ ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ
তােমার ভাই বলছে– সবার বাক্স–প্যাটরা চেক করা হবে। আমি না করেছি, সে শুনছে না। শেষে কার না কার ব্যাগ থেকে টাকা বের হবে, নিজের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে...
ভাবি, তােমরা কি নিশ্চিত যে আমাদের মধ্যে কেউ নিয়েছে ? অবশ্যই। কে নিয়েছে বলে তােমার অনুমান ?
আগে টেলিফোন সেরে আস। তােমার বন্ধু কতক্ষণ টেলিফোন ধরে বসে থাকবে ? মুহিব টেলিফোন ধরতে গেল। টেলিফোন করেছে সফিক। তার গলা উত্তেজনায় কাঁপছে। অতি দ্রুত কথা বলছে বলে কথাও জড়িয়ে যাচ্ছে।সকাল থেকে চেষ্টা করছি তােকে ধরার জন্য। এক্ষুণি চলে আয় । টেলিফোন রেখে দৌড় দিয়ে ঘর থেকে বের হবি। লাফ দিয়ে কোনাে একটা। চলন্ত বেবিটেক্সিতে উঠে পড়বি। স্ট্রেইট আমার বাসায়। কী হয়েছে ? পত্রিকা পড়িস নাই ? ‘প্রথম আলাে‘র লাস্ট পেজটা দেখেছিস ?
তােদের বাসায় কী পত্রিকা রাখা হয় ? জানি না। ‘প্রথম আলাে’র লাস্ট পেজ–এ হারুনের ছবি ছাপা হয়েছে। কেন ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ
সে প্রেসক্লাবের সামনে গতরাত বারােটা থেকে বসে আছে। ঘােষণা দিয়েছে তার জন্মদিনে অর্থাৎ জুলাইয়ের দুই তারিখে বেকার গায়ে কেরােসিন ঢেলে জীবন বিসর্জন দেবে।
কেন ?
বেকার সমস্যার দিকে জনগণের দৃষ্টি ফেরাবার জন্যে। হারুনের পেটে যে এই জিনিস ছিল কোনােদিন বলেছে ? আশ্চর্য ছেলে! সকালে পত্রিকা দেখে আমার তাে ব্রেইন আউলা হয়ে গেল। কোনাে রকম আলােচনা নাই, কিছু নাই, হুট করে এত বড় ডিসিশান! যাই হােক, এখন পুরাে দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে। কবি–সাহিত্যিক, অভিনেতা, গায়ক, বুদ্ধিজীবী সবার কাছে ছােটাছুটি করতে হবে। সিরিয়াস জনমত তৈরি করতে হবে । আমাদের দলের সবাইকে এক হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হবে।
অনেক খরচাপাতির ব্যাপার আছে। একটা পােস্টার ছাপাতে হবে। নীরব ঘাতক সাবেরের মামার প্রেস আছে। সাবেরকে সঙ্গে নিয়ে উনার পায়ে পড়ব। বলব, মামা আপনার পায়ে ধরলাম। রাজি না হওয়া পর্যন্ত পা ছাড়ব না। আমরা কাগজ কিনে দিচ্ছি, আপনি চার কালারের একটা পােস্টার ছেপে দিন। হারুনের সুন্দর একটা ছবিও তুলতে হবে। হতাশ চেহারা বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে টাইপ। তাের চেনাজানা কোনাে ফটোগ্রাফার আছে ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ
ফট করে না বলিস না। চিন্তা করে বল। ভালােমতাে চিন্তা করলে দেখবি কেউ না কেউ বের হয়ে পড়েছে। এক হাজার টাকা ম্যানেজ করে চলে আয়। এক হাজার টাকা হলাে মিনিমাম। যত বেশি হয় তত ভালাে। কথা বলে সময় নষ্ট করিস না। দৌড় দিয়ে ঘর থেকে বের হ।
টাকার জন্যে মুহিব গেল মনােয়ারার কাছে। তিনি অবাক হয়ে বললেন, তাের কত টাকা লাগবে বললি ?
পাঁচ হাজার। এত টাকা দিয়ে তুই কী করবি ? আমার এক বন্ধুর চিকিৎসার জন্যে দরকার। সে মারা যাচ্ছে।
তাের কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে ? বন্ধুর চিকিৎসার জন্যে পাঁচ হাজার টাকা ? টাকা সস্তা হয়ে গেছে!
মা প্লিজ ব্যবস্থা কর। এখন ধার হিসাবে নিচ্ছি। পাই পয়সা হিসাব করে টাকা ফেরত দেব।
আমি টাকা পাব কোথায় ? | ভাইয়ার বান্ডিলটা থেকে দাও। তুমি তাে মাত্র পাঁচশ খরচ করেছ। বাকিটা তাে আছে। এবং এই টাকাটা ভাইজানকে ফেরত দিতে হবে। কোনােই কাজে লাগবে না। মাঝখান থেকে আমার বন্ধুর জীবন রক্ষা হয়।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ
মনােয়ারা ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, তাের এত বড় সাহস! তুই তাে মানুষ না। তুই জানােয়ার। নিজের মাকে চোর বলছিস। তাের স্থান দোজখেও হবে না।
চুরি করেছ বলেই তাে বলেছি। তুমি স্বীকারও করেছ। না স্বীকার করলে বেনিফিট অব ডাউট দেয়া যেত।
চুপ হারামজাদা। | মা একটা কিছু ব্যবস্থা কর। পাঁচ হাজার না পার, চার হাজার, চার না পার তিন....
তুই আমার সামনে থেকে যা। জীবনে আমার সামনে পড়বি না। আমি বাকি জীবন তাের মুখ দেখতে চাই না।
মা শােন, বড় ভাবির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। উনার ভাবভঙ্গি সুবিধার । মনে হয় স্যুটকেস–ট্রাঙ্ক সত্যি সত্যি খােলা হবে। তুমি অবশ্যই আমার ড্রয়ারে রেখে দিও। আগে মান–সম্মানটা বাঁচুক।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ
আমার সামনে থেকে যা। কোনােদিন আমার সামনে পড়বি না। কোনােদিন । আমি বাকি জীবনে তাের মুখ দেখতে চাই না।
হারুন বসেছে প্রেসক্লাবের গেট থেকে একটু দূরে। শতরঞ্জি বিছিয়ে বসেছে। তার ডান পাশে ধবধবে সাদা রঙের বিশাল বালিশ । সামনে পিরিচে গুড়মুড়ি এবং ছােট এলাচ দানা রাখা। তার পেছনে বাঁশ পুতে বাঁশের মাথায় ছাতি দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে। ছাতার ছায়া হারুনের মাথায় পড়ে নি। ঘাড়ের উপর পড়েছে।
হারুনের পেছনে নীল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ার। সফিক চেয়ারগুলি দু’দিনের জন্যে ডেকোরেটরের দোকান থেকে ভাড়া করে এনেছে। চেয়ারগুলি গােল করে বসানাে। সেখানে সফিকের বন্ধুরা গম্ভীর ভঙ্গিতে বসা আছে। একটা বাচ্চা চাওয়ালাকে খবর দিয়ে আনা হয়েছে। তার সঙ্গে কন্ট্রাক্ট— সারাদিন সে সফিকের দলকে চা খাওয়াবে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৮)-হুমায়ুন আহমেদ
বাইরে চা বিক্রি করতে পারবে না। বিনিময়ে চায়ের দাম তাে পাবেই, এক্সট্রা পঞ্চাশ টাকা পাবে। চাওয়ালার নাম— জতু। জতু অত্যন্ত। আনন্দের সঙ্গে প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। সে নিজেকে দলের অংশ হিসেবে ভাবছে। যেন সে এখন এক বিরাট জাতীয় কর্মকাণ্ডের অংশ। গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
সফিক তার দল নিয়ে চেয়ারে গােল হয়ে বসেছে। তাদের সবার হাতে চায়ের কাপ। তারা মাথা নিচু করে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে একমত হবার চেষ্টা করছে। কোনাে ইস্যুতেই কেউ একমত হতে পারছে না। সবারই মেজাজ খারাপ হচ্ছে। হারুনের সামনে একটা পােস্টার লাগানাে হবে— এই বিষয়ে সবাই একমত। পােস্টারের লেখা তৈয়ব লিখেছে।