পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সে খারাপ লিখবে না। লেখাটা ভালাে হয়েছে। সমস্যা হলাে পােস্টারটা হাতে লেখা হবে না কম্পিউটারে কম্পােজ করে সেঁটে দেয়া হবে সেটা নিয়ে। একদল বলছে, হাতে লেখা উচিত। হাতে লেখার মধ্যে একটা পার্সোনাল টাচ থাকে। ব্যাপারটা রিয়েলিস্টিকও হবে। বেকার মানুষ কম্পিউটার কম্পােজের টাকা পাবে কোথায় ?
আরেক দলের ধারণা কম্পিউটার কম্পােজ হওয়া উচিত। পােস্টার একটা থাকবে না, কয়েকটা থাকবে। হাতের লেখা পােস্টারের চেয়ে কম্পিউটার কম্পােজ ভালাে। হার্ড ফ্যাক্ট গােটা গােটা হরফে লেখা থাকবে। কোনাে কেলিওগ্রাফি না। বাস্তব সত্য। লেখাটা হলাে—
আমার নাম হারুন–অর–রশিদ। না, আমি বাগদাদের খলিফা হারুন–অর–রশিদ না । আমি বেকার হারুন। গত পাঁচ বছর অনেক চেষ্টা করেও কোনাে ব্যবস্থা করতে পারছি না । জীবনের প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্মে গেছে। আমি প্রতিবাদ হিসেবে গায়ে আগুন জ্বেলে আত্মাহুতি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার মৃত্যুতে কারােরই কিছু যাবে আসবে না।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৯)-হুমায়ুন আহমেদ
তাহলে কাজটা কেন করছি ? প্রতিবাদ জানানাের জন্যে করছি। এ দেশের মানুষদের বেকার সমস্যার ভয়াবহতার দিকে দৃষ্টি ফেরাবার জন্যে করছি। হয়তাে একটি প্রাণের বিনিময়ে হলেও সবাইকে একটা খবর পৌছাতে পারব। আমার মতাে হাজার হাজার যুবকের অবস্থার দিকে একটু নজর দিন। একটু ভাবুন। আত্মাহুতির তারিখ ২ জুলাই, রাত বারােটা এক মিনিট। আপনার যদি কাজ না থাকে, চলে আসুন।
প্রেসক্লাবের সামনে। আত্মাহুতির সময়টা নিয়েও মতভেদ তৈরি হয়েছে। একদল বলছে, রাত বারােটা এক মিনিট ভালাে সময়। মধ্যরাত। একটি দিনের শেষ, আরেকটা দিনের শুরু। আরেকদল বলছে– রাত বারােটা এক মিনিটে ঘটনা ঘটলে পত্রিকায় নিউজ ধরানাে যাবে না। পত্রিকায় নিউজ রাতে হলে সন্ধ্যা ছ‘টার মধ্যে কার্য সমাধা করতে হবে।
এক পর্যায়ে সফিক মহাক্ষিপ্ত হয়ে বলল, আমার ধারণা তােদের সবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। হারুনকে তাে আমরা সত্যি সত্যি আগুনে পুড়তে দেব না। কাজেই রাত বারােটা এক মিনিটও যা, রাত তিনটাও তা। তােরা এমনভাবে কথা বলছিস যেন সে সত্যি সত্যি গায়ে আগুন দেবে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৯)-হুমায়ুন আহমেদ
আমরা কাজটা করছি মিডিয়া অ্যাটেনশনের জন্যে। কাজেই রাত বারােটা এক মিনিট ফাইনাল। এই বিষয়ে আর কথা হবে না। এখন মূল বিষয়ে চলে আয়, আমরা হারুনের পাশে কেরােসিনের টিন, দেয়াশলাই এইসব রাখব কিনা।
তৈয়ব বলল, না। এতে ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে যাবে। মনে হবে আমরা ড্রামা তৈরির চেষ্টা করছি। | সফিক বলল, ড্রামা তাে করতেই হবে। পাবলিসিটির জন্য ড্রামা দরকার। যারা হারুনকে দেখতে আসবে তারা ধাক্কার মতাে খাবে। যে আগুন দিয়ে নিজেকে পুড়াতে চাচ্ছে সে শুধু মুখের কথা বলছে না, একটিন কেরােসিন পর্যন্ত কিনে এনেছে ।...
আলােচনা হৈচৈ তর্ক বিতর্ক। কোনাে কিছুতেই হারুনের মন নেই। সে মােটামুটি মূর্তির মতােই বসে আছে। তাকে সিগারেট দেয়া হয়েছিল। সে বলেছে না।
মহসিন বলেছে, সিগারেট খেতে সমস্যা কোথায় ? তুই তাে অনশন করছিস। আগুন দিয়ে নিজেকে পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে ফেলবি। সেই ঘটনা যখন। ঘটার কথা তখন ঘটবে। ঘটনা ঘটার আগে তুই তাের ইচ্ছামতাে খাওয়া দাওয়া করবি । চা দিয়ে একটা সিগারেট খা।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৯)-হুমায়ুন আহমেদ
তুই আমাদের সঙ্গে রেগে রেগে কথা বলছিস কেন ? আমরা কী করলাম ? হারুন চুপ করে আছে। মহসিন বলল, তাের কি জ্বর না–কি ? চোখ লাল । তারও কোনাে জবাব নেই। হারুনের ব্যাপারটা বােঝা যাচ্ছে না। এমন কী ঘটনা ঘটল যে গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দিতে হবে?
কোনাে মেয়ের সঙ্গে প্রেম–ফ্রেম থাকলে চিত্ত তরল থাকে। হঠাৎ হঠাৎ উদ্ভট কিছু করতে ইচ্ছে করে । হারুনের এরকম কিছুও নেই। বিয়েও করে নি যে বেকার স্বামীকে নিয়ে স্ত্রী ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান করছে। তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে শ্বশুরবাড়ির জ্ঞানী লােকজন। বেকারদের দলে হারুনের অবস্থা ভালাে।
সে তার নিজের বাড়িতে থাকে। তার আলাদা ঘর আছে। হারুনের বাবা রিটায়ার্ড এসপি। মাই ডিয়ার‘ টাইপ মানুষ। হারুনের কোনাে বন্ধু–বান্ধব বাড়িতে উপস্থিত হলে তিনি চোখ সরু করে তাকান না। বরং হাসি মুখে বলেন– এসাে এসাে। বলাে দেখি কী খবর। ইয়াং ম্যানদের দেখলেই শরীরে কেমন যেন ইয়াং ভাব চলে আসে। বৃদ্ধদের এই কারণেই সবচে‘ বেশি সময় কাটানাে উচিত তরুণদের সঙ্গে। সেটা কখনাে হয়ে উঠে না। তরুণরা বৃদ্ধ পছন্দ করে না।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৯)-হুমায়ুন আহমেদ
বেকার তরুণদের মধ্যে হারুন হয়তােবা অতি অল্প কিছু ভাগ্যবানদের একজন যার জন্মদিন পালন করা হয় । আত্মীয়স্বজনরা বাড়িতে গিজগিজ করতে থাকে। বাইরের বাবুর্চি এসে মােরগ–পােলাও রান্না করে। হারুনের বাবা অত্যন্ত আনন্দিত ভঙ্গিতে ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ঘােরাঘুরি করেন। সুযােগ পেলেই ছােটবেলায় হারুন কেমন ছিল, কী করত খুবই আগ্রহের সঙ্গে সেই গল্প করেন— হারুনকে নিয়ে আমি একটা ছড়া বানিয়েছিলাম । ছড়াটা বললেই ক্ষেপে যেত। কান্নাকাটি। ভাত খাওয়া বন্ধ টাইপ ক্ষেপা। অথচ খুবই নির্দোষ ছড়া—
হারুন ঘাড় ধরে মারুন। চড় থাপ্পর কিল ও ঘুসি
মার খেলেই হারুন খুশি।‘ প্রতি জন্মদিনে এই ছড়াটা আমি একবার করে বলি এবং তার রি–অ্যাকশন লক্ষ করি। আট বছর পর্যন্ত সে কাঁদত। আট বছর থেকে বারাে বছর পর্যন্ত রেগে যেত। আমাকে মারতে আসত। বারাে’র পর থেকে বিরক্ত হওয়া শুরু করেছে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(১৯)-হুমায়ুন আহমেদ
এ ধরনের পারিবারিক অবস্থার একটি ছেলে হঠাৎ একদিন বলবে— গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দিব’– তা হয় না। কোথাও কোনাে একটা সমস্যা হয়েছে। সমস্যাটা বােঝা যাচ্ছে না।
মুহিবের উপর দায়িত্ব পড়েছে শশা–বিজনেসের লােকজনের সঙ্গে যােগাযােগ করা। তারা যেন একবার এসে এক মিনিটের জন্যে হলেও হারুনকে দেখে যান। বিবৃতি দেন— আমরা পাশে আছি। হারুনের জন্যে আমাদের সহানুভূতি আছে। মুহিবের হাতে বিশাল এক তালিকা ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে ফিল্মের লােক আছে, নাটকের লােক আছে, গানের শিল্পীরা আছে। এদের মধ্যে
মুহিব চেনে মাত্র চারজনকে। নােরাকে চেনে। সে গায়িকা এবং তার যথেষ্টই। নামডাক আছে। নােরাকে বুঝিয়ে বললে সে শুধু যে আসবে তা না, হারুনের। পাশে সারাদিন বসে থাকতে বললে সারাদিন বসে থাকবে। | নােরা যেহেতু গান করে সে নিশ্চয়ই অন্য গানের শিল্পীদেরও চেনে।
তার মাধ্যমে অন্যদের কাছে যাওয়া। পাখি দিয়ে পাখি শিকার। | নাটকের লােকজনদের মধ্যে জাহিদ হাসানের এক ফুপাতাে ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় আছে। তাকে নিয়ে বাসায় যাওয়া যাবে। ভাগ্য ভালাে হলে জাহিদ হাসানের স্ত্রী মৌ বাসায় থাকবেন। দুজনকেই বলা যাবে। মেয়েদের মন নরম