মৌ ভাবি হয়তাে বা রাজি হয়ে যাবেন কিছুক্ষণের জন্যে আসতে। নাটকের আরেকজন শিল্পীর বাসায় মুহিব একবার গেছে। শীলা আহমেদ। তাকে বললে সে অবশ্যই রাজি হবে । তবে মেয়েটা এখন নাটক ছেড়ে দিয়েছে। নাটক ছেড়ে দিলেও লােকজন তাকে চিনে। এখন নিশ্চয়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবার জন্যে লােকজন তার পেছনে লেগে থাকে না। সেখানে হঠাৎ একজন কেউ উপস্থিত হলে খুশিতেই রাজি হয়ে যাবার কথা।
একটা গাড়ির ব্যবস্থা রাখতে হবে। কেউ রাজি হলাে, সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি গিয়ে তাকে নিয়ে এলাে। নােরাদের তিনটা গাড়ি। দু’জন ড্রাইভার । একটা গাড়ি কখনাে ব্যবহারই করা হয় না। গাড়ি চাইলে নােরা কি দেবে ? দেয়ার তাে কথা।
মুহিব নােরার বাড়ির দিকে রওনা হলাে। এগারােটা বাজে। নােরাকে বাড়িতে পাওয়ার সম্ভাবনা একশ দশ ভাগ। নােরা রাত তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে ঘুমুতে যায়। এগারােটার আগে সে ঘুম থেকেই উঠে না। ইউনিভার্সিটি খােলা থাকলেও না। সকালের সব ক্লাস তার মিস যায়। এখন ইউনিভার্সিটি বন্ধ। এগারােটার আগে ঘুম থেকে উঠার তার প্রশ্নই আসে না। নােরার বাবা কি বাসায় আছেন ? ভদ্রলােকের পায়জামা-পাঞ্জাবিটা নিয়ে এলে হতাে। ধােপাখানায় দিয়ে ইস্ত্রি করে রাখা উচিত ছিল। | নােরা বাড়িতে আছে। ঘুম থেকে উঠেছে অনেক আগে। সাজসজ্জা দেখে। মনে হচ্ছে এক্ষুণি বের হবে। মুহিব কিছু বলার আগেই নােরা বলল, তুমি হাতে সময় নিয়ে এসেছ তাে ?
মুহিব বলল, হ্যা।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(২০)-হুমায়ুন আহমেদ
মিনিমাম দু‘ঘণ্টার জন্যে তুমি কিন্তু আটকা পড়ে গেলে। তুমি খুবই ভুল সময়ে এসেছ।
মুহিব কথার পিঠে সুন্দর কোনাে কথা বলার চেষ্টা করল। কোনাে কিছুই মনে আসছে না। এদিকে সফিকের কোনাে তুলনা নেই। কথার পিঠে কথা সফিকের মতাে সুন্দর করে কেউ বলতে পারে না।
চা খাবে না কফি খাবে ?
নােরা বলল, চা না কফি খাও। কারণ আমার কফি খেতে ইচ্ছা করছে। আচ্ছা কফি দাও।
আমার ঘরে চলে এসাে। ঘর খুবই এলােমেলাে। তাতে নিশ্চয়ই তােমার সমস্যা হবে না। আমি মাঝে মাঝে ঘর খুব গুছিয়ে রাখি । মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে ঘর এলােমেলাে করে রাখি। তুমি এসেছ এলােমেলাে সময়ে।
৭২
মুহিব মনে মনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল । তুমি এসেছ এলােমেলাে সময়ে। কী সুন্দর কথা! এই কথার পিঠে যদি এরচে’ও সুন্দর কোনাে কথা বলা যেত! যখন মুহিব মােটামুটি ইন্টারেস্টিং একটা সেনটেন্স মনে মনে গুছিয়ে এনেছে তখনই নােরা বলল, তুমি কি কোনাে কাজে এসেছ না সৌজন্য সাক্ষাৎ ?
কাজে এসেছি। তুমি কি বাংলাদেশের গায়ক–গায়িকাদের চেন ? চিনব না কেন! অবশ্যই চিনি।
তাদের সঙ্গে কি তােমার খাতির আছে ? তুমি কোনাে কথা বললে কি তারা রাখবে ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(২০)-হুমায়ুন আহমেদ
রাখবে না। কারণ আমি তাদের কাউকেই সহ্য করতে পারি না। ওরাও আমাকে সহ্য করতে পারে না। ওদের ধারণা আমি গান গাইতে পারি না। আমার গলায় সুর নেই । অকারণেই আমাকে নিয়ে মাতামাতি হয়। আর আমার ধারণা, ওরা কেউ ঠিকমতাে গাইতে পারে না। ওদের গলায় সবই আছে, মমতা নেই। তােমার কি গায়ক–গায়িকা দরকার ? কোনাে ফাংশনে গান গাইতে হবে ?
তা না ।
অল্প কথায় গুছিয়ে বলতে পারলে বলাে। আমি তােমাকে আমার ঘরে বসিয়ে রেখে গােসলে ঢুকব। আমার গােসল সারতে এক ঘণ্টা লাগে। এক ঘণ্টা পরে তােমাকে নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করব। দু‘ঘণ্টা শেষ । তুমি তােমার কাজে চলে যেতে পারবে।
মুহিব হারুনের ব্যাপারটা বলল। একটু বাড়িয়েই বলল— যেমন হারুন নিজেই এক টিন কেরােসিন কিনে এনেছে। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এখন মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে।
নােরা বলল, তােমার ঐ বন্ধু তাে মানসিকভাবে অসুস্থ। গায়ক–গায়িকা জোগাড় না করে তাকে বরং কোনাে মানসিক ডাক্তার দেখাও। সবচে ভালাে কী। জান কোনাে হিপনােটিস্ট দিয়ে তাকে হিপনােটাইজ করে সাজেশান দেয়া। হিপনােটাইজ করাটা যদি আমি ভালােমতাে শিখতে পারতাম তাহলে আমি নিজেই করতাম। আমি অনেককে নিয়ে চেষ্টা করেছি। আমার সাকসেস রেন্ট অনলি টুয়েন্টি পারসেন্ট। তুমি কি কাউকে হিপনােটাইজড হতে দেখেছ ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(২০)-হুমায়ুন আহমেদ
খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। তােমাকে নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করব বলছিলাম না ? হিপনােসিস নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট। তােমার আপত্তি নেই তাে?
না। রিলাক্সড হয়ে বসাে। কোনােরকম টেনশন করবে না। টেনশন করার কিছু নেই।
মুহিব রিলাক্সড হয়েই বসে আছে। সে যে ঘরে বসে আছে সেটা নােরার শােবার ঘর । নােরার খুবই ব্যক্তিগত একটা জায়গা। সে বসেছে হালকা সবুজ রঙের নিচু একটা সােফায় । সােফাটা নােরার বিছানার সঙ্গে লাগানাে। বিছানার চাদর এবং সােফা মনে হয় একই কাপড় দিয়ে বানানাে। ঘরের পর্দাগুলির রঙও সবুজ। ধবধবে শাদা মার্বেলের মেঝে। মাঝখানে গাঢ় লাল রঙের কার্পেট । ঘরটায় রঙ ঝলমল করছে অথচ কোনাে রঙ চোখে লাগছে না।
| নােরা বাথরুমে ঢুকে গেছে। শােবার ঘরের সঙ্গে লাগানাে বাথরুম। মুহিব যেখানে বসেছে সেখান থেকে বাথরুমের দরজা দেখা যায়। দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতে মুহিবের লজ্জা লাগছে বলে সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। শাওয়ার দিয়ে পানি ঝরার শব্দ কানে আসছে। সেই শব্দের সঙ্গে গলা মিলিয়ে মাঝে মাঝেই নােরা ঝিনিনি ঝিনিনি নি...র মতাে সুর করছে। শুনতে এত অদ্ভুত লাগে! বাথরুমের ভেতর থেকে সে মাঝে মাঝে মুহিবের সঙ্গে কথা বলছে । কথাগুলি শােনাচ্ছে অদ্ভুত। মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে অন্য কেউ কথা বলছে...
একা একা বাের হচ্ছ? না।
আমার ঘরে অনেক ম্যাগাজিন আছে। যে–কোনাে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে পাতা উল্টাও, সময় কেটে যাবে।
দরকার নেই। সময় কাটাবার খুব ভালাে বুদ্ধি কী জানাে ? না।।
সময় কাটাবার সবচে‘ ভালাে বুদ্ধি মানুষকে যে প্রাণীটা দিয়েছে তার নাম গরু, The cow. জানাে ব্যাপারটা ?
। গরু কী করে ? জাবর কাটে। সময় কাটাবার জন্যে মানুষ এই কাজটা করতে পারে। কাজটা একটু অন্যভাবে করতে হবে। স্মৃতির জাবর কাটতে হবে। কোনাে একটা ইন্টারেস্টিং স্মৃতি নিয়ে জাবর কাটা। আমি এই কাজটা প্রায়ই করি। এখন আমি কী করছি অনুমান করতে পার ?
না।