বাথটাব ভর্তি পানি। আমি গলা ডুবিয়ে পানিতে শুয়ে আছি। আমার হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট।
তুমি কি এখন নিয়মিত সিগারেট খাচ্ছ ?
তা খাচ্ছি। দিনে এক প্যাকেটের বেশি শেষ হচ্ছে। তবে খুব শিগগিরই ছেড়ে দিব । আমি কোনাে কিছুই বেশিদিন ধরে রাখি না। বেশির ভাগ মানুষের স্বভাব পুরনাে জিনিস ধরে রাখা। মানুষ কিছুই ফেলতে পারে না। এই জন্যে মানুষকে বলা হয় The collector. আমি অনেকক্ষণ কথা বললাম। এখন কথা বন্ধ । আমি মেডিটেশনে যাচ্ছি। গােসল করতে আমার দেরি হয় এই কারণে। আমি আধঘণ্টার মতাে মেডিটেশন করি। পানিতে শবাসন হয়ে শুয়ে থাকি। মাথা থেকে সব চিন্তা–ভাবনা দূর করে দেই।
মুহিব ঝিম ধরে চেয়ারে বসে আছে। বাথরুম থেকে কোনাে শব্দ আসছে । মুহিবের ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। সােফাটাকে খুবই আরামদায়ক মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই সােফা তৈরি হয়েছে ঘুমুবার জন্যে। সে চেষ্টা করছে। জেগে থাকার জন্যে। কিন্তু জেগে থাকতে পারছে না। চোখের পাতা ভারী।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(২১)-হুমায়ুন আহমেদ
তার ঘুম ভাঙল। চায়ের কাপে চামচের শব্দ শুনে। চোখ মেলে দেখে নােরা কার্পেটে বসে আছে। তার হাতে কফির কাপ। কফির পােড়া পােড়া গন্ধে ঘর ম ম করছে।
নােরা বলল, তুমি কতক্ষণ ঘুমিয়েছ জানাে? মুহিব বলল, না।
আমি বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি তুমি ঘুমাচ্ছ । কাজেই তােমাকে আর জাগাই নি। তুমি তেতাল্লিশ মিনিট ধরে ঘুমাচ্ছ। গভীর ঘুম।
সরি।
সরি কেন ? সরি বলার মতাে কোনাে কাণ্ড তুমি কর নি। তবে আমার। পরিকল্পনা নষ্ট করে দিয়েছ। তােমার উপর আজ কোনাে হিপনােসিস প্রক্রিয়া চালানাে যাবে না। যে মানুষ গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠেছে তাকে হিপনােটাইজ করা যায় না। আরেক দিন হাতে সময় নিয়ে চলে এসাে।
কবে আসব ?
যে–কোনােদিন। সন্ধ্যার পরে এসাে। আজ সন্ধ্যায় আসব ? আজ না। আজ আমি বাড়িতে থাকব না।
মুহিব মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। এইমাত্র গােসল করার কারণেই হােক বা যে–কোনাে কারণেই হােক কী সুন্দর যে মেয়েটাকে লাগছে! হালকা গােলাপি রঙের একটা টাওয়েল দিয়ে নােরা মাথার চুল ঢেকে রেখেছে। টাওয়েলটাকে মনে হচ্ছে নােরার শরীরের অংশ। | নােরা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, তােমার ভাব–ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তুমি আবারও ঘুমিয়ে পড়ছ। তােমার চোখ ছােট হয়ে আসছে। দয়া করে এখন বিদেয় হও। গাড়ি নিয়ে যাও। তুমি যেখানে যেতে চাও গাড়ি তােমাকে নিয়ে যাবে ।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(২১)-হুমায়ুন আহমেদ
সত্যি সত্যি মুহিবের ঘুম পাচ্ছে। তার কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। সােফাতে হেলান দিয়ে এই ঘরেই ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে। মুহিব অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়াল। নােরা বলল, তােমার যে বন্ধু Death Wish করছে আমি আজ দিনের মধ্যে কোনাে এক সময় তাকে গিয়ে দেখে আসব। | মুহিব বলল, আমি কি তােমার গাড়িটা আজ সারাদিন আমার সঙ্গে রাখতে পারি ?
পার। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি।
মুহিব মুগ্ধ চোখে নােরার দিকে তাকিয়ে আছে। যে লাল কার্পেটের উপর নােরা বসে আছে সেই কার্পেটটাকেও মুহিবের এখন নােরার শরীরের অংশ বলে মনে হচ্ছে। এরকম হচ্ছে কেন?
হারুন কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। বাঁশের আগা থেকে ছাতা নামিয়ে তার মুখের উপর ধরা হয়েছে রােদ আটকাবার জন্যে। চাওয়ালা জতু মিয়া হারুনের মাথার চুলে বিলি করে দিচ্ছে। হারুনের পায়ের কাছে কেরােসিনের টিন এবং টিনের পাশে পিরিচে চারটা দেয়াশলাই। কেরােসিনের টিন এবং দেয়াশলাইয়ের মাহাত্ম্য কেউ বুঝতে পারছে না, কারণ পােস্টার এখনাে লাগানাে হয় নি।
তারপরেও পথচারীদের কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে তাকে দেখছে। হারুনের কাছ থেকে দশ–বার গজ দূরে গাছের ছায়ায় সফিক একা বসে সিগারেট টানছে। তার মুখ দেখেই বােঝা যাচ্ছে মেজাজ খুব খারাপ। | মুহিব সফিকের দিকে এগিয়ে গেল। সফিক বলল, ওদের কাণ্ডজ্ঞান দেখেছিস আড়াইটা বাজে কারাে কোনাে খোঁজ নেই! খাওয়া–দাওয়া তাে করতে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(২১)-হুমায়ুন আহমেদ
মুহিব বলল, এখনাে খান নি ?
সফিক রাগী গলায় বলল, খাব কীভাবে? ফাইভস্টার থেকে খাওয়া আসবে। পকেটে শেষ সম্বল ষাইট টাকা ছিল— এক প্যাকেট বেনসন কিনে ফেলেছি। তুই খেয়েছিস ?
মুহিব বলল, না। সফিকের রাগ সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল। মুহিব বলল, আমি আপনাদের জন্যে খাবার নিয়ে আসি। কোথেকে আনবি ? আমার চেনা একটা রেস্টুরেন্ট আছে। বাকি দেয় ? হ্যা, দেয়।
তাহলে এক কাজ কর, আট–দশ জনের মতাে খাবার নিয়ে আয়। পরে দেখা যাবে সবাই এক এক করে উদয় হচ্ছে কেউ খেয়ে আসে নি। হারুনের জন্যে এক বাটি স্যুপ আনতে পারবি ? ওর তাে জ্বর এসেছে। ভালাে জ্বর। একটা থার্মোমিটারও নিয়ে আসিস। সঙ্গে ভাংতি টাকা–পয়সা আছে ?
আছে।
দু‘টাকার বাদাম কিনে দিয়ে যা। বাদাম খেয়ে আগে ক্ষিধাটা নষ্ট করি। নাড়িভুড়ি হজম হয়ে গেছে। এখন পেটের চামড়া হজম হওয়া শুরু হয়েছে।
মুহিব গরম সিঙাড়া এবং ডালপুরি কিনে আনল। সঙ্গে তেঁতুলের চাটনি । পেঁয়াজ কাটা কাচামরিচ । সিঙাড়া এত গরম যে জিভ পুড়ে যাওয়ার মতাে অবস্থা। সফিক আনন্দিত গলায় বলল, এত কিছু আনার তাে দরকার ছিল না। চট করে কিছু মুখে দিয়ে কাজে বের হয়ে যা । এক সেকেন্ড সময় নষ্ট করা যাবে না। বিভিন্ন জায়গায় যে যাবি রিকশা ভাড়া আছে ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(২১)-হুমায়ুন আহমেদ
আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। গাড়ি আছে মানে? কার গাড়ি ? গান করেন যে নােরা উনার গাড়ি । বলিস কী! গাড়ি ম্যানেজ করলি কীভাবে ? হারুনের ব্যাপারটা বললাম। বিভিন্ন জায়গায় যেতে হবে। এইসব শুনে...
সফিক আনন্দিত গলায় বলল, ভালাে ম্যানেজ করেছিস তাে। উনি আসবেন।
বলেছেন আসবেন। কবে আসবেন ? আজই আসার কথা।
বলিস কী! পাবলিক অপিনিয়ন তাে দেখি এখনই তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে। নােরার মতাে গায়িকার দেখতে আসা সহজ ব্যাপার না। একজন স্টিল।