মুহিব বলল, আমার খবর ভালাে । আপনি আমাকে ডেকেছেন ? তাে। ভােরবেলাটা আমি একা থাকতে পছন্দ করি। কাউকে ডাকাডাকি করি না।
মুহিব বলল, বড় ভাবির কাছে শুনলাম আপনি ডেকেছেন। | তৌফিকুর রহমান বই থেকে চোখ তুললেন। ইজিচেয়ারে সােজা হয়ে বসতে বসতে বললেন, মনে পড়েছে। বড় বৌমাকে বলেছিলাম তােকে খবর দিতে। তুই একবার সময় করে স্বর্ণকারের দোকানে যাবি। আমি রুপা এবং সােনা দিয়ে দু’টা হামানদিস্তা বানাব। কত খরচ পড়বে জেনে আসবি। রুপা–সােনা দিয়ে হামানদিস্তা বানাতে হবে কেন ?
তৌফিকুর রহমান আগ্রহের সঙ্গে বললেন, রুপা আর সােনা হলাে নন রি অ্যাকটিভ মেটাল। নােবেল মেটাল। আমি যে–সব ওষুধপত্র বানাচ্ছি তার সঙ্গে নােবেল মেটালের তৈরি হামানদিস্তার কোনাে রি–অ্যাকশন হবে না।
রুপা নন রি–অ্যাকটিভ আপনাকে কে বলল ? কিছুদিন রেখে দিলেই সিলভার অক্সাইডের কালাে আস্তর পড়ে যায়। সােনা দিয়ে বানাতে পারেন। আধ সেরের মতাে সােনা লাগবে। ছয় হাজার টাকা করে তােলা। লাখ দু‘এক টাকা লাগবে। বলিস কী ? এ তাে দেখি বিরাট প্রবলেম!
পাথরের হামানদিস্তা ব্যবহার করতে পারেন। পাথর ইনার্ট বস্তু। পাথর কোনাে রি–অ্যাকশন ফি–অ্যাকশনে যাবে না । ঝিম ধরে থাকবে। তৌফিকুর রহমান উৎসাহের সঙ্গে বললেন, কথাটা ভালাে বলেছিস। পাথরের হামানদিস্তার কথা আমার মনেই আসে নি। সােনা–রুপা নিয়ে ঘটঘট করছি। তুই খোজ নে— কী রকম দাম, কোথায় পাওয়া যায়।
আচ্ছা। জলপাই পাতার এক্সট্রাক্ট খাচ্ছিস তাে ? কী মনে হয়, উপকার পাচ্ছিস ? বুঝতে পারছি না। বুঝতে পারবি না কেন ? শরীরে সতেজ ভাব আসছে না ? আসছে মনে হয়।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(২)-হুমায়ুন আহমেদ
ট্রিটমেন্ট শুরুর আগে একবার লিপিড প্রােফাইল করানাে হয়েছে। এক মাস পার হবার পর একটা লিপিড প্রফাইল করাবি । আগেরটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখব অবস্থা কী। আসলে আমাদের সঙ্গে একজন ফুলটাইম ডাক্তার থাকা দরকার। তাের বন্ধু–বান্ধবের মধ্যে ডাক্তার আছে ?
নাহ্। আমার সবই বেকার বন্ধু–বান্ধব। এদের মধ্যে যারা যারা চাকরি পাচ্ছে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাচ্ছে। বেকাররা বেকার ছাড়া অন্য কারাে সঙ্গে মিশতে পারে না।
চাকরির ব্যাপারটা মাথা থেকে দূর করে দে। স্বাধীনভাবে কিছু করার চিন্তা ভাবনা কর। দুইশ বছর ব্রিটিশদের গােলামি করার ফল এই হয়েছে— জাতিগতভাবে আমাদের ডিএনএ–র ভিতর ঢুকে গেছে যে–কোনােভাবে একটা চাকরি করতে হবে। তুই এর ভেতর থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা কর। দেখি ।
দেখাদেখির কিছু নেই। কনক্রিট চিন্তা–ভাবনা করে আমার কাছে আয়। অল্প–স্বল্প ক্যাপিটেলের ব্যবস্থা করা যাবে। আমার নিজেরও কিছু চিন্তা–ভাবনা আছে।
বড়চাচা, এখন তাহলে যাই ? | আচ্ছা যা, জলপাই এক্সট্রাক্ট–টা খেতে ভুল করবি না। রােজ ভােরবেলা একটা করে ট্যাবলেট। ওষুধটার একটা নাম দেন না কেন! এক্সট্রাক্ট শুনতে যেন কেমন লাগে।
তৌফিকুর রহমান উৎসাহিত গলায় বললেন, ভালাে কথা মনে করেছিস। আমিও নাম নিয়ে ভাবছি। কয়েকটা নাম মনে এসেছে। তুইও চিন্তা–ভাবনা কর। যে–সব নাম মাথায় আসে একটা কাগজে লিখে ফেল। তারপর একদিন বসে নাম সিলেক্ট করে ফেলব।
মুহিব বলল, এই মুহূর্তে আমার মাথায় একটা নাম ঘুরঘুর করছে। জলপাই বটিকা। নামটা আপনার কাছে কেমন লাগছে?
তৌফিকুর রহমানের মুখ সঙ্গে সঙ্গে কঠিন হয়ে গেল। তিনি কড়া গলায় বললেন, জলপাই–বটিকা মানে ? মুহিব মিনমিন করে বলল, দেশী ওষুধের দেশী নাম।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(২)-হুমায়ুন আহমেদ
তৌফিকুর রহমান গম্ভীর গলায় বললেন, তাের কথার ধরন দেখে আমার মনে হচ্ছে, তুই পুরাে ব্যাপারটি খুব হালকাভাবে দেখছিস। আমি এনয়েড বােধ করছি। আমি আর দশটা পেনশন খাওয়া মানুষের মতাে না। আমি কোনো খেলা খেলছি না। আচ্ছা ঠিক আছে, এখন যা । তাের সঙ্গে পরে এই নিয়ে কথা হবে। | মুহিব সিড়ি দিয়ে নামার সময় বা চোখে একবার হাত দিল। যা ভাবা গেছে তাই । জল–চিকিৎসায় উল্টা রিঅ্যাকশন হয়েছে। চোখ আরাে ফুলেছে। বড়চাচার চোখে পড়ে নি । পড়ার কথাও না। তিনি কারাের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না। মুহিবের ধারণা তিনি যদি সরাসরি তার মুখের দিকে তাকিয়েও কথা বলতেন তাহলেও চোখে পড়ত না।
মুহিবের মা মনােয়ারা রান্নাঘরে। চুলা থেকে দূরে দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে উঁচু জলচৌকিতে বসে আছেন। রান্নাবান্না তদারকির জন্যে তিনি অর্ডার দিয়ে জলচৌকিটা বানিয়ে নিয়েছেন। জলচৌকির উপর নারিকেলের ছােবড়া গদিও আছে। সকালের নাশতার সময় তিনি এসে জলচৌকিতে বসেন। দুপুরে রান্না না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকেন। সবকিছু তার চোখের সামনে হতে হয়। তাওয়া থেকে পরােটা নামানাের সময় প্রতিটি পরােটা তাকে দেখিয়ে নিতে হয়। তিনি সারাক্ষণই নির্দেশ দিতে থাকেন— মতির মা! এর নাম পরােটা ভাজা ? এক পিঠ হয়েছে আরেক পিঠ কাচা। তেলে চপচপ করছে। আমার কি তেলের খনি আছে ? একটা পরােটার জন্য যে পরিমাণ তেল দিয়েছ এই তেলে ছােটখাট দু’টা পরিবারের এক মাসের রান্না হয়। তােমাকে দিয়ে আমার পােষাবে না মতির মা। তুমি বরং বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট সাহেবের বাড়িতে বাবুর্চির কাজ পাও কি–না দেখ। আমার বাড়িতে তােমাকে দিয়ে হবে না।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(২)-হুমায়ুন আহমেদ
মনােয়ারার অভ্যাস ঘনঘন চা এবং জর্দা দিয়ে পান খাওয়া। হয় তার মুখে ময়মনসিংহের স্পেশাল জর্দার পান থাকবে আর নয়তাে চা থাকবে। মুখ কখনাে খালি থাকবে না। মাঝে মাঝে দু’টাই এক সঙ্গে থাকে। গালের এক পাশে পান। জর্দা রেখে দিয়ে অন্য পাশ দিয়ে তিনি না–কি চা খেতে পারেন। তাঁর কোনােই সমস্যা হয় না। তিনি প্রেসারের রােগী। রান্নাঘরে চুলার গরমে তাঁর থাকা নিষেধ, কিন্তু তিনি থাকবেন। এবং তার দুই পুত্রবধূর কারাের না কারাের সঙ্গে একটা ঝগড়ার সূত্রপাত করবেন। এই ঝগড়া তিনি একাই অনেকদূর টেনে নিয়ে যাবেন। রাগ দেখিয়ে দুপুরে ভাত না খেয়ে দরজা বন্ধ করে ঘুমুতে যাবেন। অনেক সাধ্য সাধনা করে সন্ধ্যাবেলায় তার রাগ ভাঙানাে হবে। তিনি অবেলায় খেতে বসবেন।
ভাত খাবার ঘণ্টাখানিকের মধ্যে তার মেজাজ পুরােপুরি ঠিক হয়ে যাবে। যার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে রাতে তাকে পাশে নিয়েই ডিভিডি প্লেয়ারে হিন্দি ছবি দেখতে বসবেন। ডিভিডি প্লেয়ারটা তাঁর মেজো মেয়ের জামাই সৌদি আরব থেকে পাঠিয়েছে। এটা তার শােবার ঘরে টেলিভিশনের সঙ্গে সেট করা। তিনি প্রতি রাতে ঘুমুবার আগে একটা ছবি দেখেন। এই সময় বাড়ির সব মেয়েকে (কাজের দুটি মেয়েসহ) তার পাশে থাকতে হয় । ছবি দেখা তার অভ্যাসের মতাে হয়ে গেছে। যে রাতে তিনি ছবি দেখতে পারেন না সে রাতে তাঁর ঘুম হয় না। প্রেসারে সমস্যা হয়। নিচেরটা ১২০–১২৫ হয়ে যায় ।
মুহিব মায়ের খোঁজে রান্নাঘরে ঢুকল। মুহিবের আসল উদ্দেশ্য তার চোখ ফোলাটা মা‘র নজরে পড়ে কি না। মুহিব বলল, মা চা হবে ?