উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ

মনােয়ারা বললেন, না, চুলা দুটাই বন্ধতােমার লাগবে কিছু ? নিউ মার্কেটে যাব ভিডিওদোকান থেকে একটা ছবি নিয়ে আসিস

উড়ালপঙ্খি কী ছবি আনব, নাম বলাে। 

কয়লানামে কোনাে ছবি আছে কিনা দেখিস তােবাবার কাহিনীশাহরুখ খান আছে, মাধুরী আছে, অমরেশপুরী আছেসবাই দেখে ফেলেছে, আমার দেখা হয় নি। 

জর্দাটর্দা কিছু লাগবে না

নারান্নাঘরে এতক্ষণ থাকবি নাকাজের মেয়েরা রান্নাঘরে থাকেরান্নার সময় এদের কাপড়চোপড়ের দিকে নজর থাকে নাএই জন্যে পুরুষ মানুষের রান্নাঘরে ঘুরঘুর আমার খুবই অপছন্দ। 

মা, একটু দেখ না এক কাপ চা দেয়া যায় কিনাবললাম তাে নাএকটা কথা পঞ্চাশবার করে বলতে হবে

মুহিব রান্নাঘর থেকে বের হলােতার চোখের অবস্থা মনােয়ারার নজরে পড়ল নাখুবই আশ্চর্যের ব্যাপার! সে কি সত্যি সত্যি ইনভিজিবল ম্যান হয়ে যাচ্ছে ? সব বেকার যুবকের ক্ষেত্রেই কি এটা ঘটে ? থাকে মানুষ এক সময় হয়ে যায় ছায়া মানুষ Shadow Man

খাবার ঘরের ডাইনিং টেবিলে নাশতা দেয়া হয়েছেমুহিবের বড় দুই ভাই পাশাপাশি গম্ভীর মুখে বসে আছেদুজনকেই চরম বিরক্ত বলে মনে হচ্ছেবড় ভাই তােফাজ্জল করিমের হাতে খবরের কাগজখবরের কাগজ আগে কেউ পড়ে ফেললে সে পড়তে পারে নাএই কারণেই ইয়াসমিন বাড়িতে খবরের কাগজ আসা মাত্র স্বামীর হাতে তুলে দেয়সকালবেলার মতাে ইয়াসমিনের কাজ শেষসে চায়ের কাপ হাতে নিজের ঘরে ঢুকে যায়সবার নাশতা খাওয়া শেষ হবার পর বাড়ি যখন নীরব হয় তখন সে ধীরে সুস্থে নাশতা খেতে বের হয়কোনােরকম হৈচৈ ইয়াসমিনের পছন্দ হয় নাতার মাথা ধরে যায়। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ

মেজো ভাই মােফাজ্জল করিমের স্ত্রী রােকেয়ার সকালটা কাটে অসম্ভব ব্যস্ততায়রােকেয়ার দায়িত্ব হলাে তার দুই মেয়েকে স্কুলে পৌছে দেয়ামেয়ে দুটা যমজএকজনের নাম , আরেকজনের নাম যমজ মেয়ে হবার সংবাদে খুশি হয়ে মােফাজ্জল করিম দুই মেয়ের এই অদ্ভুত নাম রেখেছেমেয়ে দু’টির জন্ম একুশে ফেব্রুয়ারিতেসেই হিসেবে নাম দুটির হয়তাে বা খানিকটা গুরুত্ব আছেএবং দুই বােনই স্কুলের যাবার আগে আগে খুব যন্ত্রণা করেকান্নাকাটি না, হৈচৈ চিল্কার নাভারী কোনাে কিছু আঁকড়ে ধরে বসে থাকেকার সাধ্য তাদের ছুটিয়ে নিয়ে স্কুলে যায়দুই বােনের যন্ত্রণায় বাড়ির সবাই অস্থিরতবে যন্ত্রণার পুরােটাই নীরব যন্ত্রণাবাড়ির কেউ দুই মেয়েকে কখনাে কাঁদতে শুনে নি। 

মুহিব বসার ঘরে ঢুকতেই মােফাজ্জল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তোের ভাবিকে একটু সাহায্য কর তােবিচ্ছ দুটাকে রিকশায় তুলে দেএরা আমার জীবন নষ্ট করে ফেলল যেকোনাে একদিন দেখবি বাড়িঘর ছেড়ে সুন্দরবনের দিকে হাঁটা দিয়েছি। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ

মুহিব কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলদুই ভাইকে সুযােগ দিল তার দিকে ভালাে করে তাকাবারচোখ নিয়ে কেউ কিছু বলে কিনা তার জানার শখকেউ কিছু বলল নাবড় ভাই খবরের কাগজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেমেজোজন চামচ দিয়ে ঠানঠ্যানা পাতলা খিচুড়ি মুখে দিচ্ছেতার চোখমুখের ভঙ্গি এরকম যেন চামচে করে ইদুর মারা বিষ খাচ্ছে। 

টা দশ বাজে। 

মুহিব বসে আছে খায়রুল মিয়ার টিস্টলেআল মদিনা রেস্টুরেন্টপরােটা, বুন্দিয়া এবং ডিমের ওমলেট দিয়ে সকালের নাশতা করেছেপ্রথম কাপ চা খাওয়া হয়ে গেছে, এখন খাচ্ছে দ্বিতীয় কাপ চাদ্বিতীয় কাপ চা খাবারইচ্ছা তার ছিল নাখায়রুল মিয়ার জন্যে খেতে চ্ছেসে দুকাপ চা হাতে নিয়ে নিজেই এসে সামনে বসেছেপান খাওয়া কুচকুচে কালাে দাত বের করে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললভাইজান নেন, ইসপিসাল চা।  কাচা পাত্তি । 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ

খায়রুল মিয়া একজন গলাবিহীন মানুষতাকে দেখে মনে হয় তার মাথাটা সরাসরি ঘাড়ে বসিয়ে দেয়া হয়েছেআল্লাহপাক গলার ঝামেলায় যান নিছােটবেলায় কী যেন সমস্যা হয়ে ভােকাল কর্ড নষ্ট হয়ে গেছেতার বেশির ভাগ কথাই অস্পষ্টখায়রুল মিয়া এই সমস্যা জানে বলেই প্রায় সব বাক্যই সে দুবার তিনবার করে বলে। 

আল মদিনা রেস্টুরেন্টে মুহিব দীর্ঘদিন ধরে চা খাচ্ছেমানুষটার সঙ্গে মুহিবের ভালাে খাতির আছেখায়রুল নামের মানুষটার পরিশ্রম করার ক্ষমতাএবং ব্যবসাবুদ্ধি দেখে সে মুগ্ধছাপড়া ঘর দিয়ে টিস্টল শুরু করেছিলতখন সে নিজেই চা বানাতআজ সেই টিস্টল হুলুস্থুল ব্যাপার হয়েছেবিরাট সাইনবাের্ড দি আল মদিনা রেস্টুরেন্টদুপুরে এই রেস্টুরেন্টে সিট পাওয়া কঠিনব্যাপারআল মদিনামুড়িঘণ্ট এবং গরু ভুনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছেপাশের ঘরটাও খায়রুল মিয়া নিয়ে নিয়েছে

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ

সেখানে বসেছে টেলিফোনের দোকানটিএন্ডটি এবং মােবাইল লাইনসস্তায় দেশেবিদেশে টেলিফোনের সুযােগ এর সঙ্গে জিরক্স মেশিন আছে, স্টেশনারি জিনিসপত্র, বইখাতা, পেনসিলও পাওয়া যায়খায়রুল মিয়ার রেস্টুরেন্ট যেমন চালু এই দোকানটাও সেরকমইচালুএখন খায়রুল মিয়ার মাথায় ঢুকেছে শাড়ির দোকানবেইলী রােডে সে একটা শাড়ির দোকান দিতে চায়। 

খায়রুল বলল, ভাইজানের চোখে কী হয়েছে ? মুহিব বলল, জানি নাপােকায় কামড় দিছে ? পােকামাকড় কামড় দিছে ? দিতে পারে। ওষুধপত্র কিছু দিছেন

উহু। ব্যথা আছে ? ব্যথা

মুহিব জবাব দিল না চোখ প্রসঙ্গে এত কথা বলতে তার ইচ্ছা করছে নাখায়রুল তার দিকে ঝুঁকে এসে বলল, শাড়ির দোকানটা নিয়ে চিন্তা নিছেন ? নিছেন কোনাে চিন্তা

কী চিন্তা নেব

আপনাকে কী বলেছিপুরাটা আপনার হাতে দিয়ে দিবক্যাপিটেল আমার, ব্যবসা আপনারমাসের শেষে হিসাবনিকাশ হবে। আরে দূর দূর। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ

দূর দূর কী জন্যে ? ব্যবসা কি খারাপ জিনিস ? আমাদের নবিজি কি ব্যবসা করেন নাই ? করেন নাই ব্যবসা ? আমাদের নবিজি। 

মুহিব বিরক্ত গলায় বলল, নবিজি শাড়ির দোকান দেন নাইমেয়েরা আসবে, গায়ের উপর শাড়ি ফেলে দেখাতে হবে শাড়ি গায়ে দিলে কেমন লাগবেতিনশ শাড়ি নামাবে, কচলায়ে কচলায়ে দেখবে, তারপর না কিনে চলেযাবে পাশের দোকানেআমি এর মধ্যে নাই। 

ভাইজান, এইগুলা তাে আপনি করবেন নাকর্মচারী এইগুলা করবেআমি কী করব? আপনি ক্যাশ দেখবেনব্যবসা দেখবেন। 

আমি ক্যাশবাক্সের সামনে বসে টাকা গুনব? ভুলে যান| ফট করে না বলা ঠিক নাচিন্তা করেনচিন্তা করেনচিন্তা করেনচিন্তার প্রয়ােজন আছে। 

এটা নিয়ে চিন্তা করার কিছু নাই| দোকান শুরু করতে আমার দেরি আছেআরাে দুই তিনমাস লাগবেআপনি চিন্তা করেনআপনাকে তাে আমি কর্মচারী হতে বলতেছি না আমি ব্যবসার শেয়ার দিব। 

চুপ করেন তাে দেখি ফ্যাসফ্যাস করে অনেক কথা বলে ফেলেছেনআরাে কথা বললে গলা পুরােপুরি অফ হয়ে যাবেনিঃশব্দে চা খান

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *