মনােয়ারা বললেন, না, চুলা দু’টাই বন্ধ। তােমার লাগবে কিছু ? নিউ মার্কেটে যাব । ভিডিও’র দোকান থেকে একটা ছবি নিয়ে আসিস।
কী ছবি আনব, নাম বলাে।
কয়লা‘ নামে কোনাে ছবি আছে কি–না দেখিস তাে। বাবার কাহিনী। শাহরুখ খান আছে, মাধুরী আছে, অমরেশপুরী আছে। সবাই দেখে ফেলেছে, আমার দেখা হয় নি।
জর্দা–টর্দা কিছু লাগবে না ?
না। রান্নাঘরে এতক্ষণ থাকবি না। কাজের মেয়েরা রান্নাঘরে থাকে। রান্নার সময় এদের কাপড়–চোপড়ের দিকে নজর থাকে না। এই জন্যে পুরুষ মানুষের রান্নাঘরে ঘুরঘুর আমার খুবই অপছন্দ।
মা, একটু দেখ না এক কাপ চা দেয়া যায় কি–না। বললাম তাে না। একটা কথা পঞ্চাশবার করে বলতে হবে ?
মুহিব রান্নাঘর থেকে বের হলাে। তার চোখের অবস্থা মনােয়ারার নজরে পড়ল না। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার! সে কি সত্যি সত্যি ইনভিজিবল ম্যান হয়ে যাচ্ছে ? সব বেকার যুবকের ক্ষেত্রেই কি এটা ঘটে ? থাকে মানুষ এক সময় হয়ে যায় ছায়া মানুষ । Shadow Man.
খাবার ঘরের ডাইনিং টেবিলে নাশতা দেয়া হয়েছে। মুহিবের বড় দুই ভাই পাশাপাশি গম্ভীর মুখে বসে আছে। দু’জনকেই চরম বিরক্ত বলে মনে হচ্ছে। বড় ভাই তােফাজ্জল করিমের হাতে খবরের কাগজ। খবরের কাগজ আগে কেউ পড়ে ফেললে সে পড়তে পারে না। এই কারণেই ইয়াসমিন বাড়িতে খবরের কাগজ আসা মাত্র স্বামীর হাতে তুলে দেয়। সকালবেলার মতাে ইয়াসমিনের কাজ শেষ। সে চায়ের কাপ হাতে নিজের ঘরে ঢুকে যায়। সবার নাশতা খাওয়া শেষ হবার পর বাড়ি যখন নীরব হয় তখন সে ধীরে সুস্থে নাশতা খেতে বের হয়। কোনােরকম হৈচৈ ইয়াসমিনের পছন্দ হয় না। তার মাথা ধরে যায়।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ
মেজো ভাই মােফাজ্জল করিমের স্ত্রী রােকেয়ার সকালটা কাটে অসম্ভব ব্যস্ততায়। রােকেয়ার দায়িত্ব হলাে তার দুই মেয়েকে স্কুলে পৌছে দেয়া। মেয়ে দু‘টা যমজ। একজনের নাম ক, আরেকজনের নাম খ। যমজ মেয়ে হবার সংবাদে খুশি হয়ে মােফাজ্জল করিম দুই মেয়ের এই অদ্ভুত নাম রেখেছে। মেয়ে দু’টির জন্ম একুশে ফেব্রুয়ারিতে। সেই হিসেবে নাম দু‘টির হয়তাে বা খানিকটা গুরুত্ব আছে। ক এবং খ দুই বােনই স্কুলের যাবার আগে আগে খুব যন্ত্রণা করে। কান্নাকাটি না, হৈচৈ চিল্কার না। ভারী কোনাে কিছু আঁকড়ে ধরে বসে থাকে। কার সাধ্য তাদের ছুটিয়ে নিয়ে স্কুলে যায়। ক খ দুই বােনের যন্ত্রণায় বাড়ির সবাই অস্থির। তবে যন্ত্রণার পুরােটাই নীরব যন্ত্রণা। বাড়ির কেউ দুই মেয়েকে কখনাে কাঁদতে শুনে নি।
মুহিব বসার ঘরে ঢুকতেই মােফাজ্জল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তোের ভাবিকে একটু সাহায্য কর তাে। বিচ্ছ দু’টাকে রিকশায় তুলে দে। এরা আমার জীবন নষ্ট করে ফেলল । যে–কোনাে একদিন দেখবি বাড়িঘর ছেড়ে সুন্দরবনের দিকে হাঁটা দিয়েছি।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ
মুহিব কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। দুই ভাইকে সুযােগ দিল তার দিকে ভালাে করে তাকাবার। চোখ নিয়ে কেউ কিছু বলে কি–না তার জানার শখ। কেউ কিছু বলল না। বড় ভাই খবরের কাগজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। মেজোজন চামচ দিয়ে ঠানঠ্যানা পাতলা খিচুড়ি মুখে দিচ্ছে। তার চোখমুখের ভঙ্গি এরকম যেন চামচে করে ইদুর মারা বিষ খাচ্ছে।
ন‘টা দশ বাজে।
মুহিব বসে আছে খায়রুল মিয়ার টি–স্টলে। আল মদিনা রেস্টুরেন্ট। পরােটা, বুন্দিয়া এবং ডিমের ওমলেট দিয়ে সকালের নাশতা করেছে। প্রথম কাপ চা খাওয়া হয়ে গেছে, এখন খাচ্ছে দ্বিতীয় কাপ চা। দ্বিতীয় কাপ চা খাবার। ইচ্ছা তার ছিল না। খায়রুল মিয়ার জন্যে খেতে হচ্ছে। সে দুকাপ চা হাতে নিয়ে নিজেই এসে সামনে বসেছে। পান খাওয়া কুচকুচে কালাে দাত বের করে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল— ভাইজান নেন, ইসপিসাল চা। কাচা পাত্তি ।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ
খায়রুল মিয়া একজন গলাবিহীন মানুষ। তাকে দেখে মনে হয় তার মাথাটা সরাসরি ঘাড়ে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। আল্লাহপাক গলার ঝামেলায় যান নি। ছােটবেলায় কী যেন সমস্যা হয়ে ভােকাল কর্ড নষ্ট হয়ে গেছে। তার বেশির ভাগ কথাই অস্পষ্ট। খায়রুল মিয়া এই সমস্যা জানে বলেই প্রায় সব বাক্যই সে দু’বার তিনবার করে বলে।
আল মদিনা রেস্টুরেন্টে মুহিব দীর্ঘদিন ধরে চা খাচ্ছে। মানুষটার সঙ্গে মুহিবের ভালাে খাতির আছে। খায়রুল নামের মানুষটার পরিশ্রম করার ক্ষমতা। এবং ব্যবসাবুদ্ধি দেখে সে মুগ্ধ। ছাপড়া ঘর দিয়ে টি–স্টল শুরু করেছিল। তখন সে নিজেই চা বানাত। আজ সেই টি–স্টল হুলুস্থুল ব্যাপার হয়েছে। বিরাট সাইন। বাের্ড দি আল মদিনা রেস্টুরেন্ট। দুপুরে এই রেস্টুরেন্টে সিট পাওয়া কঠিন। ব্যাপার। আল মদিনা’র মুড়িঘণ্ট এবং গরু ভুনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। পাশের ঘরটাও খায়রুল মিয়া নিয়ে নিয়েছে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ
সেখানে বসেছে টেলিফোনের দোকান। টিএন্ডটি এবং মােবাইল লাইন। সস্তায় দেশে–বিদেশে টেলিফোনের সুযােগ । এর সঙ্গে জিরক্স মেশিন আছে, স্টেশনারি জিনিসপত্র, বই–খাতা, পেনসিলও পাওয়া যায়। খায়রুল মিয়ার রেস্টুরেন্ট যেমন চালু এই দোকানটাও সে–রকমই। চালু। এখন খায়রুল মিয়ার মাথায় ঢুকেছে শাড়ির দোকান। বেইলী রােডে সে একটা শাড়ির দোকান দিতে চায়।
খায়রুল বলল, ভাইজানের চোখে কী হয়েছে ? মুহিব বলল, জানি না। পােকায় কামড় দিছে ? পােকা–মাকড় কামড় দিছে ? দিতে পারে। ওষুধপত্র কিছু দিছেন ?
উহু। ব্যথা আছে ? ব্যথা ?
মুহিব জবাব দিল না । চোখ প্রসঙ্গে এত কথা বলতে তার ইচ্ছা করছে না। খায়রুল তার দিকে ঝুঁকে এসে বলল, শাড়ির দোকানটা নিয়ে চিন্তা নিছেন ? নিছেন কোনাে চিন্তা ?
কী চিন্তা নেব?
আপনাকে কী বলেছি— পুরাটা আপনার হাতে দিয়ে দিব। ক্যাপিটেল আমার, ব্যবসা আপনার। মাসের শেষে হিসাব–নিকাশ হবে। আরে দূর দূর।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৩)-হুমায়ুন আহমেদ
দূর দূর কী জন্যে ? ব্যবসা কি খারাপ জিনিস ? আমাদের নবিজি কি ব্যবসা করেন নাই ? করেন নাই ব্যবসা ? আমাদের নবিজি।
মুহিব বিরক্ত গলায় বলল, নবিজি শাড়ির দোকান দেন নাই। মেয়েরা আসবে, গায়ের উপর শাড়ি ফেলে দেখাতে হবে শাড়ি গায়ে দিলে কেমন লাগবে। তিনশ শাড়ি নামাবে, কচলায়ে কচলায়ে দেখবে, তারপর না কিনে চলে। যাবে পাশের দোকানে। আমি এর মধ্যে নাই।
ভাইজান, এইগুলা তাে আপনি করবেন না। কর্মচারী এইগুলা করবে। আমি কী করব? আপনি ক্যাশ দেখবেন। ব্যবসা দেখবেন।
আমি ক্যাশবাক্সের সামনে বসে টাকা গুনব? ভুলে যান। | ফট করে না বলা ঠিক না। চিন্তা করেন। চিন্তা করেন। চিন্তা করেন। চিন্তার প্রয়ােজন আছে।
এটা নিয়ে চিন্তা করার কিছু নাই। | দোকান শুরু করতে আমার দেরি আছে। আরাে দুই তিনমাস লাগবে। আপনি চিন্তা করেন। আপনাকে তাে আমি কর্মচারী হতে বলতেছি না আমি ব্যবসার শেয়ার দিব।
চুপ করেন তাে দেখি । ফ্যাসফ্যাস করে অনেক কথা বলে ফেলেছেন। আরাে কথা বললে গলা পুরােপুরি অফ হয়ে যাবে। নিঃশব্দে চা খান।