হঠাৎ হিপনােটিজমের বই পড়ছ কেন ? | কী করে মানুষকে হিপনােটাইজ করা যায় এটা শেখার জন্যে। পুরােপুরি শেখার পর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ম্যাজিশিয়ানরা যেমন যাদু দেখায় আমি হিপনােটিজমের খেলা দেখাব। কোনাে একজন দর্শককে স্টেজে ডেকে এনে হিপনােটাইজ করব। তারপর তাকে বলব— আপনি এখন মানুষ না। আপনি একটা বড় সাইজের কোলা ব্যাঙ। আপনি স্টেজে লাফাতে থাকুন। সে তখন ব্যাঙের মতাে লাফাতে লাফাতে স্টেজের এ–মাথা ও–মাথা যাবে। মজা হবে না ?
হবার তাে কথা। এই শােন, তুমি যেখানে আছ সেখান থেকে কি আকাশ দেখা যায় ? হ্যা যায়। আকাশে মেঘ আছে ? সামান্য, বেশি না। কেন বলাে তাে ?
আকাশ যদি খুব মেঘলা হয়ে থাকত আর ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়ত, এক্ষুণি বৃষ্টি হবে, এক্ষুণি বৃষ্টি হবে ভাব থাকত তাহলে তােমাকে আসতে বলতাম। | আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। মনে হয় সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টি হবে। তুমি বললে আমি চলে আসতে পারি। আমার কোনাে কাজ নেই।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ
তােমার কাজ না থাকলেও আমার আছে। আমি এখন গভীর মনােযােগ দিয়ে বই পড়ছি। তবে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি হলে অবশ্যই তােমাকে আসতে বলতাম। আচ্ছা শােন, ঝুমকুম করে বৃষ্টি শুরু হলে তুমি চলে এসাে। আসার সময় আমার জন্যে দু’টা জিনিস নিয়ে আসবে। একটা হচ্ছে লটকন।
অবশ্যই লটকন নিয়ে আসব। আরেকটা কী ? | সিডির দোকানে যাবে। একটা গানের সিডি কিনে আনবে নাম উড়ালপখি‘। সিংগারের নাম বলে দাও। কী আশ্চর্যর কথা, সিংগারের নাম তুমি জানাে না? তােমার গাওয়া না–কি ? হা। কবে বের হয়েছে ? গত মাসে। কই আমাকে তাে কিছু বলাে নি!
এটা কি ঢাক পিটিয়ে বলার মতাে কোনাে ঘটনা ? এমন তাে না এটা আমার জীবনের প্রথম সিডি। কাসুন্দি আনতে পারবে ? কাসুন্দি দিয়ে লটকন মাখিয়ে ভর্তা বানিয়ে খাব। এখন সব বড় বড় গ্রোসারি সপে পাওয়া যায়।
পাওয়া গেলে নিয়ে আসব। | ঝুম বৃষ্টি নামলে তবেই আসবে। খটখটে শুকনা সময়ে যদি আস তাহলে আমি কিন্তু উপর থেকে নিচেই নামব না। আমি টেলিফোন রেখে দিচ্ছি। আমার গায়ের উপর সিগারেটের ছাই পড়ে গেছে। সিগারেট খাবার সবচে’ বিরক্তিকর অংশ হলাে ছাই ঝাড়া। সাইনটিস্টরা এত কিছু আবিষ্কার করছে ছাইবিহীন সিগারেট আবিষ্কার করতে পারছে না কেন ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ
খট করে শব্দ হলাে। নােরা তার অভ্যাসমতাে হঠাৎ টেলিফোন রেখে দিয়েছে। মুহিব এখনাে রিসিভার কানে ধরে আছে। ক্লান্তিকর টু টু শব্দ। মুহিবের মনে হলাে সে অনন্তকাল ধরে টেলিফোন রিসিভার কানে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কান থেকে রিসিভার নামাতে ইচ্ছা করছে না। এখন সে যদি নােরাকে আবারাে টেলিফোন করে, নােরা আগের মতােই বলবে আপনি কে বলছেন জানতে পারি কি ? মুহিব যদি তার পরিচয় দেয় তাহলে সে আবারাে উৎসাহের সঙ্গে কথা বলা শুরু করবে। তারপর এক সময় আচমকা বলবে— রাখি কেমন ? বলেই খট করে টেলিফোন রেখে দেবে।
নােরাকে আরেকবার টেলিফোন করতে ইচ্ছা করছে কিন্তু হাতে সময় নেই। ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে। ছয়–সাতজন গম্ভীর এবং বিরক্ত মুখের মানুষের সামনে হাসি হাসি মুখ করে বসতে হবে । বিরক্ত মানুষরা সবাই ভাব করবে— তারা সাধারণ কেউ না, তারা অতীশ দীপঙ্কর টাইপ মহাজ্ঞানী। এদের মধ্যে একজন থাকবে চার্লি চ্যাপলিন ধাচের। রসিকতা করার চেষ্টা করবে, ফাজলামি করার চেষ্টা করবে। কথা বলবে গ্রাম্য ভাষায়। তার ফাকে ফাকে হঠাৎ খাটি ব্রিটিশ একসেন্টে ইংরেজিতে কথা বলবে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ
বুঝানাের জন্যে যে আমি একটু আগে গ্রাম্য ভাষায় কথা বলছি এটা আমার পরিচয় না। গ্রাম–প্রীতির কারণে কাজটা করেছি। একজন থাকবে, যে–কোনাে প্রশ্ন করবে না তার কাজ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। ভাব এরকম যে, আমার প্রশ্ন করার দরকার নেই। মুখের দিকে তাকিয়েই আমি সবকিছু বুঝে ফেলতে পারি। একজন থাকবে বিজ্ঞানমনস্ক টাইপ । বিজ্ঞানের জটিল সব প্রশ্ন করবে, যার উত্তর দেয়া সম্ভব না। উত্তর না পেয়ে সেই গাধা মাথা নাড়তে নাড়তে মধুর ভঙ্গিতে হাসবে। হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দেবে— এখনকার ছেলেমেয়েরা বিজ্ঞানের কিছুই জানে না । এতে সে অত্যন্ত ব্যথিত।
মুহিব তার চার বছরের বেকার জীবনে অনেক ইন্টারভিউ দিয়েছে। প্রতিটা ইন্টারভিউর একই চেহারা। দ্যা এরনসে সে চার মাস আগে একবার ইন্টারভিউ দিয়েছে। তার দ্বিতীয়বার ডাক পড়েছে। দ্বিতীয়বার ডাকের অর্থ কি এই যে। চাকরি হবে ? মুহিবের তা মনে হয় না। তার ধারণা এই কোম্পানির কোনাে কাজ–কর্ম নেই। কোম্পানির ডিরেক্টররা চার পাঁচবার করে ইন্টারভিউ নিয়ে কাজ দেখাচ্ছেন। প্রথমবারের ইন্টারভিউ মােটেই ভালাে হয় নি। সে কোনাে প্রশ্নের জবাব পারে নি। এক ভদ্রলােক হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন— মর্মাহত’ শব্দটার। মানে কী ? বাংলায় কথা বলার সময় আমরা প্রায়ই বলি— এই ঘটনায় আমি মর্মাহত। অর্থাৎ সে মর্মে আহত। মর্ম জিনিসটা কী ?
মুহিব শুকনা গলায় বলেছিল, জানি না স্যার। মর্ম কী তুমি জানাে না ? জি–না স্যার। তােমার কোনাে অনুমান আছে ? তােমার কী মনে হয়— মর্ম কী ? | আমার ধারণা মর্ম হলাে মন। মন মানে কী?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৫)-হুমায়ুন আহমেদ
মুহিব অস্বস্তির সঙ্গে বলল, মন হলাে চেতনা। ইন্টারভিউ বাের্ডের সবাই হাে হাে করে হাসতে শুরু করল। তাদের ভাব এরকম যেন জীবনে এত হাসির কথা কেউ শুনে নি। তখন চার্লি চ্যাপলিন বাবাজি গম্ভীর গলায় বললেন, আপনার। নাম মুহিব। মুহিব নামের অর্থ কী?
মুহিব বলল, মুহিব নামের অর্থ প্রেমিক।
আবারাে হাসি শুরু হলাে। | এইখানেই তার ইন্টারভিউর সমাপ্তি। বলা যেতে পারে হাস্যকর সমাপ্তি। এ ধরনের ইন্টারভিউর পর আবারাে তাকে কেন ডাকা হলাে সে জানে না। জানার দরকারও নেই। তার জীবনটা একটা রুটিনের ভিতর পড়ে গেছে। এই রুটিনে মাঝে মধ্যে তাকে ইন্টারভিউ দিতে হবে। সে দিয়ে যাচ্ছে। ব্যস।
মাঝারি ধরনের ঠাণ্ডা ঘরে মুহিব বসে আছে। ঘরে এসি চলছে। দরজা–জানালা সবই বন্ধ। মুহিব ছােটখাট এক ভদ্রলােকের সামনে বসে আছে। ভদ্রলােকের বয়স পঞ্চাশের উপরে বলে মনে হচ্ছে। কত উপরে তা ধরা যাচ্ছে না। ভদ্রলােকের চেহারা শান্ত। তাকানাের ভঙ্গি শান্ত। কিছু কিছু মানুষ আছে প্রবল ঝড়–ঝঞার সময়ও যাদের দেখে মনে হয় বেশ শান্তিতে আছেন। ভদ্রলােক ঐ ইপের। তিনিই সম্ভবত মুহিবের ইন্টারভিউ নেবেন।