উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ

এই ভদ্রলােক কি প্রথম ইন্টারভিউসময় ছিলেন ? মুহিব মনে করতে পারছে নামনে হয় ছিলেন নাথাকলে চেহারা মনে থাকতভদ্রলােক একাই মনে হয় ইন্টারভিউ নেবেনপ্রথম প্রশ্নটা কী হবেআপনার নাম ? উড়ালপঙ্খিবেশির ভাগ সময়ই এই প্রশ্ন দিয়ে শুরু হয়দ্বিতীয় প্রশ্নএই নামের অর্থ কী ? নামের অর্থ শুনে তিনি হাসাহাসি শুরু করবেন না তাে ? এইবার নামের অর্থ জিজ্ঞেস করলে ভুল অর্থ বলতে হবেনামের অর্থ প্রেমিক না বলে সে বলবে সন্দেহকারী। 

মুহিবের সামনের দ্রলােক রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেনযারা রিভলভিং চেয়ারে বসে তারা সারাক্ষণই চেয়ার নিয়ে কিছু নড়াচড়া করেএই ভদ্রলােক তা করছেন নাপ্রশ্ন করবার সময় হয়তাে করবেনমুহিব প্রথম প্রশ্নের জন্যে অপেক্ষা করছেঘরটা বেশি ঠাণ্ডাতার রীতিমতাে শীত করছেহয়তােবা বাইরে বৃষ্টি পড়ছেবাইরের আবহাওয়া ঠাণ্ডা হয়ে গেলে এসি বসানাে ঘর বরফ শীতল হয়ে যায়বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে কিনা জানতে পারলে ভালাে হতােঝুম বৃষ্টি হলে যেতে হবে নােরার কাছে

মুহিবের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে ইন্টারভিউ শেষ করে ঘর থেকে বের হয়েই সে দেখবে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছেরাস্তায় হাঁটু পানিযদি সেরকম হয় সে যে কাজটা করবে তা হলােরিকশা নিয়ে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলে যাবেসেখানে কদম ফুল বিক্রি হয়নােরার জন্যে কিছু কদম ফুল কিনতে হবেসিডি কিনতে হবেসিডির নাম উড়ালপখি

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ

উড়ালপখি মানে কী? যেই পাখি উড়ছে সেই পাখি ? তাহলে বসে আছে যে পাখি তারে কী বলা হবে ? বসালপঙ্খি ? মাই গড, মস্ত একটা ভুল হয়ে গেছেতােমাজন্যে ডিভিডি ভাড়া করে আনা হয় নিআজ রাতে বাসায় ফিরতে তার দেরি হবে মা ছটফট করতে থাকবে ছবির জন্যেছবির নাম কয়লা। 

আপনার চোখে কী হয়েছে

মুহিব অন্য কিছু ভাবছিল বলেই হয়তাে প্রশ্ন শুনে চমকে গেলতার বুক ধড়ফড় করে উঠলমনে হলাে প্রশ্নটা খুবই কঠিনএত কঠিন প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারবে নাতার চোখ যে ফুলে বন্ধ হয়ে আছে এটাও তার মনে ছিল না। 

মুহিব হড়বড় করে বলল, স্যার, চোখে কী হয়েছে আমি জানি নাসকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি এই অবস্থা। চোখ উঠে নি তাে ? বুঝতে পারছি না স্যার। 

ভদ্রলােক রিভলভিং চেয়ার সামান্য ঘুরালেনশান্ত গলায় বললেন১৯৭১ সনে সারা বাংলাদেশে চোখ উঠা রােগ হয়েছিলএমন কোনাে মানুষ ছিল না যার এই রােগ হয় নিরােগটার নাম দেয়া হয়েছিল জয় বাংলা রােগএমন 

প্রায়ই হয়েছে এই রােগে আক্রান্ত পাকিস্তানি মিলিটারিও চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে, আবার যে মুক্তিযােদ্ধাকে সে গুলি করে মারার জন্যে ধরে নিয়ে এসেছে সেও চোখ লাল করে মিলিটারির দিকে তাকিয়ে আছে। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ

মুহিব চুপ করে আছেএই গল্পটা শুনে তার কী রিঅ্যাকশন হওয়া উচিত সে বুঝতে পারছে নাসে কি হাসবে ? এটা কি হাসির গল্প ? মুহিব বললস্যার, আমার জন্ম ১৯৭১এর পরে। 

সেটা জানি, জন্ম তারিখ অ্যাপ্লিকেশন ফরমে লেখা আছেআমি আপনার ফাইল পড়ে দেখলামExtracurricular activitiesএর কলামে আপনি লিখেছেনআমার কোনাে প্রতিভা নেইআমি প্রতিভাশূন্য মানুষআপনার কি সত্যই ধারণা আপনার কোনাে প্রতিভা নেই

| জি স্যারআমার নিজের এবং আমার বন্ধুবান্ধবদের আমার সম্পর্কে এই ধারণা। 

একজন প্রতিভাশূন্য মানুষকে আমরা চাকরি দেব কী জন্যে ? চাকরি করার জন্য প্রতিভার দরকার হয় না স্যারকীসের দরকার হয় ? বুদ্ধির দরকারআমার বুদ্ধি আছেআমি পরিশ্রম করতে পারিবুদ্ধি আছে ? জি স্যার আছে। 

আমরা দুজনকে রিক্রুট করেছিএকজন ছেলে একজন মেয়েআপনি দুজনের মধ্যে একজনকী কারণে আপনাকে রিক্রুট করা হয়েছে সেটা অনুমান করে বলুনদেখি আপনার বুদ্ধি আছে কিনা। 

| মুহিব সহজ ভঙ্গিতে বলল, আমাকে চাকরি দেবার আলাদা কোনাে কারণ নেইআমার ধারণা আমাকে আপনারা নিয়েছেন কারণ আমার চেহারা সুন্দর। 

আপনার ধারণা ঠিক আছেআপনার বুদ্ধি ভালােঅফিসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুনঅ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে হাতে নিয়ে যানআগামী মাসের এক তারিখে চাকরিতে জয়েন করতে পারেনWelcome to the Aarons. | দ্রলােক হ্যান্ডশেক করার জন্যে হাত বাড়িয়েছেনমুহিবের ইচ্ছে করছে হেন্ডশেক না করে ভদ্রলােকের পা ছুঁয়ে সালাম করতেসবচেভালাে হয় সে যদি কার্পেটের উপর হামাগুড়ি দিয়ে ভদ্রলােকের দিকে এগিয়ে যায়ভদ্রলােকের পায়ে কিছুক্ষণ মুখও ঘষা যেতে পারেকুকুররা মনিবের কাছে গেলে কোলে উঠার জন্যে এরকম করে। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ

মুহিব ম্যানেজার সাহেবের ঘরে বসে আছেএই ঘরের বড় বড় জানালা খােলাপর্দা এক পাশে টেনে দেয়াদোতলার এই ঘর থেকে আকাশ দেখা যাচ্ছেরাস্তাঘাট দেখা যাচ্ছে মুহিব জানালা থেকে চোখ ফেরাতে পারছে নামুষলধারেবৃষ্টি হচ্ছেতার উচিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের কথা ভুলে গিয়ে রাস্তায় নেমে পড়াভিজতে ভিজতে নােরাদের বাড়িতে চলে যাওয়াকিছু কিছু বৃষ্টি আছে দেখলেই ভিজতে ইচ্ছা করেএখন সেই ধরনের বৃষ্টি হচ্ছেঅথচ তাকে ম্যানেজার সাহেবের ঘরে বসে থাকতে হচ্ছেতার সময় কাটছে নাম্যানেজার ভদ্রলােক স্বল্পভাষীএকবার শুধু বললেন, আপনি কবে জয়েন করবেন

মুহিব বলল, জানি না। 

ব্যস এই পর্যন্তই কথাম্যানেজার একজন বেয়ারাকে চোখের ইশারায় কী যেন বলল সে মুহিবকে এক কাপ চা দিয়ে গেল চাটা খেতে ভালােসুন্দরগন্ধএরকম চা পরপর দুকাপ খেতে হয়কিন্তু দ্বিতীয় কাপ চায়ের কথা তার বলতে ইচ্ছা করছে নামুহিব ভেতরে ভেতরে টেনশন বােধ করছেতার মনে হচ্ছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেতে পেতে বৃষ্টি থেমে যাবেআকাশেঅবশ্যি ঘনকালাে মেঘ এখনাে আছে। যেভাবে বৃষ্টি পড়ছেআকাশের সবমেঘ ধুয়ে মুছে চলে যাবেমুহিব চেয়ার ছেড়ে জানালার পাশে দাঁড়ালআকাশের দক্ষিণ দিকটা নজর করে দেখতে হবেদক্ষিণের সমুদ্র থেকে মেঘের সাপ্লাই যদি ঠিক থাকে তাহলে বৃষ্টি আরাে ঘন্টা দুই থাকবে

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ

রাতে দেখা স্বপ্নটা মনে পড়েছেতার মানে দুপুর হয়ে গেছেরাতের স্বপ্ন তার সব সময় দুপুরে কেন মনে পড়ে ? ম্যানেজার সাহেবকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে

মুহিব সাহেবজিনিনএইখানে সই করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা নিনকনগ্রাচুলেশন্স। 

মুহিব অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে নিল । অতিদ্রুত চোখ বুলালাে । অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। বেসিক পে দশ হাজার টাকা। হাউজরেন্ট, মেডিকেল অ্যালাউন্স সব মিলিয়ে পনেরাে হাজার ছয়শ’। প্রবেশনারি পিরিয়ড পার করলে রেগুলার পে-স্কেল শুরু হবে। রেগুলার পে-স্কেলটা কত ? প্রবেশনারি পিরিয়ডটাই বা কত দিনের ? মুহিব জানালা দিয়ে তাকাল। বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয় নি। বরং বৃষ্টির জোর আরাে বেড়েছে। মনে হচ্ছে পুরাে ঢাকা শহর আজ বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাবে । 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *