এই ভদ্রলােক কি প্রথম ইন্টারভিউ–র সময় ছিলেন ? মুহিব মনে করতে পারছে না। মনে হয় ছিলেন না। থাকলে চেহারা মনে থাকত। ভদ্রলােক একাই মনে হয় ইন্টারভিউ নেবেন। প্রথম প্রশ্নটা কী হবে— আপনার নাম ? বেশির ভাগ সময়ই এই প্রশ্ন দিয়ে শুরু হয়। দ্বিতীয় প্রশ্ন— এই নামের অর্থ কী ? নামের অর্থ শুনে তিনি হাসাহাসি শুরু করবেন না তাে ? এইবার নামের অর্থ জিজ্ঞেস করলে ভুল অর্থ বলতে হবে। নামের অর্থ প্রেমিক না বলে সে বলবে ‘সন্দেহকারী।
মুহিবের সামনের দ্রলােক রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন। যারা রিভলভিং চেয়ারে বসে তারা সারাক্ষণই চেয়ার নিয়ে কিছু নড়াচড়া করে। এই ভদ্রলােক তা করছেন না। প্রশ্ন করবার সময় হয়তাে করবেন। মুহিব প্রথম প্রশ্নের জন্যে অপেক্ষা করছে। ঘরটা বেশি ঠাণ্ডা। তার রীতিমতাে শীত করছে। হয়তােবা বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। বাইরের আবহাওয়া ঠাণ্ডা হয়ে গেলে এসি বসানাে ঘর বরফ শীতল হয়ে যায়। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে কি–না জানতে পারলে ভালাে হতাে। ঝুম বৃষ্টি হলে যেতে হবে নােরার কাছে।
মুহিবের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে ইন্টারভিউ শেষ করে ঘর থেকে বের হয়েই সে দেখবে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। রাস্তায় হাঁটু পানি। যদি সে–রকম হয় সে যে কাজটা করবে তা হলাে— রিকশা নিয়ে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলে যাবে। সেখানে কদম ফুল বিক্রি হয়। নােরার জন্যে কিছু কদম ফুল কিনতে হবে। সিডি কিনতে হবে। সিডির নাম ‘উড়ালপখি’ ।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ
উড়ালপখি মানে কী? যেই পাখি উড়ছে সেই পাখি ? তাহলে বসে আছে যে পাখি তারে কী বলা হবে ? বসালপঙ্খি ? মাই গড, মস্ত একটা ভুল হয়ে গেছে। তাে– মা‘র জন্যে ডিভিডি ভাড়া করে আনা হয় নি। আজ রাতে বাসায় ফিরতে তার দেরি হবে । মা ছটফট করতে থাকবে ছবির জন্যে। ছবির নাম ‘কয়লা।
আপনার চোখে কী হয়েছে ?
মুহিব অন্য কিছু ভাবছিল বলেই হয়তাে প্রশ্ন শুনে চমকে গেল। তার বুক ধড়ফড় করে উঠল। মনে হলাে প্রশ্নটা খুবই কঠিন। এত কঠিন প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারবে না। তার চোখ যে ফুলে বন্ধ হয়ে আছে এটাও তার মনে ছিল না।
মুহিব হড়বড় করে বলল, স্যার, চোখে কী হয়েছে আমি জানি না। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি এই অবস্থা। চোখ উঠে নি তাে ? বুঝতে পারছি না স্যার।
ভদ্রলােক রিভলভিং চেয়ার সামান্য ঘুরালেন। শান্ত গলায় বললেন—১৯৭১ সনে সারা বাংলাদেশে চোখ উঠা রােগ হয়েছিল। এমন কোনাে মানুষ ছিল না যার এই রােগ হয় নি। রােগটার নাম দেয়া হয়েছিল ‘জয় বাংলা রােগ‘। এমন
প্রায়ই হয়েছে এই রােগে আক্রান্ত পাকিস্তানি মিলিটারিও চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে, আবার যে মুক্তিযােদ্ধাকে সে গুলি করে মারার জন্যে ধরে নিয়ে এসেছে সেও চোখ লাল করে মিলিটারির দিকে তাকিয়ে আছে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ
মুহিব চুপ করে আছে। এই গল্পটা শুনে তার কী রি–অ্যাকশন হওয়া উচিত সে বুঝতে পারছে না। সে কি হাসবে ? এটা কি হাসির গল্প ? মুহিব বলল— স্যার, আমার জন্ম ১৯৭১–এর পরে।
সেটা জানি, জন্ম তারিখ অ্যাপ্লিকেশন ফরমে লেখা আছে। আমি আপনার ফাইল পড়ে দেখলাম। Extracurricular activities–এর কলামে আপনি লিখেছেন— আমার কোনাে প্রতিভা নেই। আমি প্রতিভাশূন্য মানুষ। আপনার কি সত্যই ধারণা আপনার কোনাে প্রতিভা নেই ?
| জি স্যার। আমার নিজের এবং আমার বন্ধুবান্ধবদের আমার সম্পর্কে এই ধারণা।
একজন প্রতিভাশূন্য মানুষকে আমরা চাকরি দেব কী জন্যে ? চাকরি করার জন্য প্রতিভার দরকার হয় না স্যার। কীসের দরকার হয় ? বুদ্ধির দরকার। আমার বুদ্ধি আছে। আমি পরিশ্রম করতে পারি। বুদ্ধি আছে ? জি স্যার আছে।
আমরা দু‘জনকে রিক্রুট করেছি। একজন ছেলে একজন মেয়ে। আপনি দু’জনের মধ্যে একজন। কী কারণে আপনাকে রিক্রুট করা হয়েছে সেটা অনুমান করে বলুন। দেখি আপনার বুদ্ধি আছে কি–না।
| মুহিব সহজ ভঙ্গিতে বলল, আমাকে চাকরি দেবার আলাদা কোনাে কারণ নেই। আমার ধারণা আমাকে আপনারা নিয়েছেন কারণ আমার চেহারা সুন্দর।
আপনার ধারণা ঠিক আছে। আপনার বুদ্ধি ভালাে। অফিসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে হাতে নিয়ে যান। আগামী মাসের এক তারিখে চাকরিতে জয়েন করতে পারেন। Welcome to the Aarons. | দ্রলােক হ্যান্ডশেক করার জন্যে হাত বাড়িয়েছেন। মুহিবের ইচ্ছে করছে হেন্ডশেক না করে ভদ্রলােকের পা ছুঁয়ে সালাম করতে। সবচে‘ ভালাে হয় সে যদি কার্পেটের উপর হামাগুড়ি দিয়ে ভদ্রলােকের দিকে এগিয়ে যায়। ভদ্রলােকের পায়ে কিছুক্ষণ মুখও ঘষা যেতে পারে। কুকুররা মনিবের কাছে গেলে কোলে উঠার জন্যে এরকম করে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ
মুহিব ম্যানেজার সাহেবের ঘরে বসে আছে। এই ঘরের বড় বড় জানালা খােলা। পর্দা এক পাশে টেনে দেয়া। দোতলার এই ঘর থেকে আকাশ দেখা যাচ্ছে। রাস্তাঘাট দেখা যাচ্ছে । মুহিব জানালা থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। মুষলধারে। বৃষ্টি হচ্ছে। তার উচিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের কথা ভুলে গিয়ে রাস্তায় নেমে পড়া। ভিজতে ভিজতে নােরাদের বাড়িতে চলে যাওয়া। কিছু কিছু বৃষ্টি আছে দেখলেই ভিজতে ইচ্ছা করে। এখন সেই ধরনের বৃষ্টি হচ্ছে। অথচ তাকে ম্যানেজার সাহেবের ঘরে বসে থাকতে হচ্ছে। তার সময় কাটছে না। ম্যানেজার ভদ্রলােক স্বল্পভাষী। একবার শুধু বললেন, আপনি কবে জয়েন করবেন ?
মুহিব বলল, জানি না।
ব্যস এই পর্যন্তই কথা। ম্যানেজার একজন বেয়ারাকে চোখের ইশারায় কী যেন বলল । সে মুহিবকে এক কাপ চা দিয়ে গেল । চা–টা খেতে ভালাে। সুন্দর। গন্ধ। এরকম চা পরপর দু‘কাপ খেতে হয়। কিন্তু দ্বিতীয় কাপ চায়ের কথা তার বলতে ইচ্ছা করছে না। মুহিব ভেতরে ভেতরে টেনশন বােধ করছে। তার মনে হচ্ছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেতে পেতে বৃষ্টি থেমে যাবে। আকাশে। অবশ্যি ঘনকালাে মেঘ এখনাে আছে। যেভাবে বৃষ্টি পড়ছে— আকাশের সব। মেঘ ধুয়ে মুছে চলে যাবে। মুহিব চেয়ার ছেড়ে জানালার পাশে দাঁড়াল। আকাশের দক্ষিণ দিকটা নজর করে দেখতে হবে। দক্ষিণের সমুদ্র থেকে মেঘের সাপ্লাই যদি ঠিক থাকে তাহলে বৃষ্টি আরাে ঘন্টা দুই থাকবে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ
রাতে দেখা স্বপ্নটা মনে পড়েছে। তার মানে দুপুর হয়ে গেছে। রাতের স্বপ্ন তার সব সময় দুপুরে কেন মনে পড়ে ? ম্যানেজার সাহেবকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে ?
মুহিব সাহেব। জি। নিন— এইখানে সই করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা নিন। কনগ্রাচুলেশন্স।
মুহিব অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে নিল । অতিদ্রুত চোখ বুলালাে । অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। বেসিক পে দশ হাজার টাকা। হাউজরেন্ট, মেডিকেল অ্যালাউন্স সব মিলিয়ে পনেরাে হাজার ছয়শ’। প্রবেশনারি পিরিয়ড পার করলে রেগুলার পে-স্কেল শুরু হবে। রেগুলার পে-স্কেলটা কত ? প্রবেশনারি পিরিয়ডটাই বা কত দিনের ? মুহিব জানালা দিয়ে তাকাল। বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয় নি। বরং বৃষ্টির জোর আরাে বেড়েছে। মনে হচ্ছে পুরাে ঢাকা শহর আজ বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাবে ।