উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

নােরাদের বাড়ির গেটের দারােয়ানের নাম ইসকান্দর নােরা এই নাম সংক্ষেপ করে নিয়েছেসে ডাকে ইসইসকান্দর থেকে ইস, কান্দর বাদনােরা যখন বলে, ইস ভাই, ছুটে চলে যানখুব ঠাণ্ডা দেখে এক বােতল প্রাইট নিয়ে আসুন।.

উড়ালপঙ্খি

গেট খােলা থাকুকপাঁচ মিনিটের বেশি তাে আপনার লাগবে নাএই পাঁচ মিনিটে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটার সম্ভাবনা কমইস ভাই নিতান্তই অনিচ্ছার সঙ্গে যায়ইস ভাইয়ের বয়স ষাটের কাছাকাছিদীর্ঘ ত্রিশ বছর সে নােরাদের বাড়ির গেটের পাশে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাটিয়েছেগেট থেকে সামান্য দূরে গেলেই সে মনে হয় অস্থির বােধ করেহয়তাে নিজেকে সে গেটের অংশ বলেই এখন ভাবে। 

তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও ইসকান্দরকে দেখা গেল ছাতা মাথায় দিয়ে টুলের উপর বসে আছেমুহিব গেটের ওপাশ থেকে আনন্দিত স্বরে বলল, ইস ভাইয়া, গেটটা খুলুন। 

ইসকান্দর তাকালরাগী গলায় বলল, আমারে ইস ভাইয়া ডাকবেন নাআমার পিতামাতা আমার একটা নাম দিয়েছিল। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

মুহিব বলল, সরি, আর ডাকব নাগেটটা খুলুনইসকান্দর মুহিবের উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে বলল, গেট খােলা যাবে নাযাবে না কেন? আপা বাড়িতে নাই। 

মুহিব পরিষ্কার বুঝতে পারছে এটা একটা মিথ্যা কথাইস ভাইয়াডাকায় দারােয়ান রেগে গেছেদারােয়ানদের রাগের দৌড় গেট পর্যন্ত বলেই গেট খােলা হচ্ছে নামুহিব বলল, ইসকান্দর শুনুন, আমি আপনার আপার কাছে এসেছি এটা আপনাকে কে বলল ? আমি নােরার বাবার সঙ্গে কথা বলার জন্যে এসেছিউনি কি বাসায় আছেন

আছেনউনাকে খবর দিন। 

মুহিবের ধারণা ছিল এই কথায় দারােয়ানের হুঁশ হবেসে গেট খুলে দেবেমিনমিনে গলায় বলবে, আপা বাসায় আছেআমার ইয়াদ ছিল নাআসেন, ভিতরে আসেনসেরকম কিছু ঘটল নাদারােয়ান টুল ছেড়ে ভেতরের দিকে চলে গেল। 

মুহিবের বুক ঈষৎ কেঁপে গেলসত্যি কি নােরা বাড়িতে নেই ? দারােয়ান কি নােরার বাবাকে খবর দিতে গিয়েছে ? মুহিবের হাতে সাতটা দোলনচাঁপাপ্রবল বৃষ্টিতেও ধবধবে সাদা ফুলগুলির কিছু হয় নিবরং সে নিজে চুপসে 

গেছেঠাণ্ডায় শরীর কাঁপছেআয়নার সামনে দাড়ালে হয়তাে দেখা যাবে ঠাণ্ডায়এবং বৃষ্টির পানিতে তার ঠোট নীলচে হয়ে গেছেনােরার সিডি কেনা হয় নিপ্রধান কারণটাকা ছিল নাসিডি না কেনায় ভালােই হয়েছেএই বৃষ্টিতে সিডি বাঁচানাের কোনাে উপায় থাকত না। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

দারােয়ান ফিরে এসেছেগেট খুলছেতার চোখমুখ কঠিন হয়ে আছেসে মুহিবের দিকে না তাকিয়েই বলল, আসেনবড় সাহেব আপনাকে যেতে বলেছেনমুহিব বলল, সেকী

| নােরার বাবার সঙ্গে মুহিবের কখনাে দেখা হয় নিভদ্রলােকের এমন অবস্থা যে বারাে মাসের ভেতর তের মাসই থাকেন দেশের বাইরেবার হাত কাকুড়ের তের হাত বিচির মতাে অবস্থামাঝে মাঝে মেয়েকে ছবি পাঠানছবির পিছনে ছবি সম্পর্কে বর্ণনা থাকেমুহিব এই ভদ্রলােককে প্রথম দেখে এরকম একটা ছবিতেলম্বা ফর্সা এবং মাথাভর্তি আইনস্টাইনের মতাে ঝাঁকড়া চুলের এক ভদ্রলােক কালাে রঙের একটা পাথর হাতে দাড়িয়ে আছেনপাথরের দিকে তাকিয়ে আছেন মুগ্ধ দৃষ্টিতেযেন এটা কোনাে কালাে পাথর নাএটা তাজমহল । বনসাই করে ছােট করা হয়েছে

ছবির উল্টা পিঠে ইংরেজিতে লেখামা নােরা, যে পাথর হাতে আমি দাড়িয়ে আছি এটা কোনাে সাধারণ পাথর নাএটা একটা meteorite. অতি দূর কোনাে নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে এটা পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছেভালাে থেকো... | নােরার বাবা নাজমুল করিম সাহেব মুহিবকে দেখে চিন্তিত গলায় বললেন, কী! তােমার কী অবস্থা! কতক্ষণ ধরে বৃষ্টিতে ভিজছ ? দাঁড়াও দাঁড়াও, আমি টাওয়েল নিয়ে আসিআগে মাথাটা মুছইসকান্দর আমাকে বলেছে তুমি নােরার বন্ধুতােমার সঙ্গে আলাপপরিচয় করবতার আগে ভেজা কাপড় বদলাওএক্কেবারে নতুন, ব্যবহার করা হয় নি এমন এক সেট কাপড় দিলে তােমার কি পরতে আপত্তি আছে ?

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

| মুহিবের খুব অদ্ভুত লাগছেসে বসে আছে নােরার বাবার পাশেতার গায়ে এই ভদ্রলােকের পায়জামাপাঞ্জাবিতাদের দুজনের হাতে চায়ের কাপ। 

তােমার নাম মুহিব ? জি স্যারস্যার বলছ কেন

মুহিব হকচকিয়ে গেলআসলেই তাে, সে স্যার কেন বলছে ? ইন্টারভিউ দিয়ে দিয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে বলেই কি স্যার বলছে ? নাকি এই ভদ্রলােককে তাদের কলেজের কোনাে স্যারের মতাে লাগছে ? একজনের সঙ্গে অবশ্যি মিল 

পাওয়া যাচ্ছেআনন্দমােহন কলেজের ইতিহাসের স্যার, কুমুদ বাবুছাত্ররা সবাই তাকে ডাকত সেন্ট স্যারউনি গায়ে সেন্ট না মেখে বাসা

থেকে বের হতেন নাপােশাকেআশাকে ফিটফাট বাবুভদ্রলােক হঠাৎ পাগল হয়ে গিয়েছিলেনসম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতেনকাউকে চিনতে পারতেন না, তবে ছাত্রদের দেখলেই চিনতেনগল্প করার জন্যে খুব আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে যেতেনমুহিবের সঙ্গে একদিন দেখাতিনি হাসি হাসি মুখে 

এগিয়ে এলেনকোমল গলায় বললেন, তােমার নাম মুহিব না

মুহিব বলল, জি স্যারসেকেন্ড ইয়ার ? জি স্যাররােল থার্টি থ্রি ? জি স্যার

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

দেখেছ, সব মনে আছেপাগলদের কিছুই মনে থাকে নাআমার সবই মনে থাকে ভালাে আছ বাবা

জি স্যার। 

তুমি আমাকে এক শিশি সেন্ট কিনে দিতে পারবে ? অন্য কোনাে কিছুর অভাব বােধ করছি নাকাপড় ছাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছি তাতেও তেমন অসুবিধা হচ্ছেনা, তবে সেন্টের অভাবটা খুব বােধ করছি। 

স্যার, আমি এক্ষুণি সেন্ট কিনে নিয়ে আসছি। 

আমি তাে সব সময় হাঁটাহাঁটির মধ্যে থাকিআমাকে খুঁজে নাও পেতে পার সেন্টটা কিনে তুমি আমার মাহাতে দিয়ে এসােবাসা চিন তাে ? বকুল গাছওয়ালা বাড়ি। 

জি স্যার বাসা চিনি। 

মুহিব সেদিনই সেন্ট কিনেছিলদামি সেন্টই কিনেছিলকুমুদ স্যারকে সেই সেন্ট দেয়া হয় নিকারণ স্যারের মা পুরনাে বাসায় ছিলেন নাউনিকোথায় গিয়েছেন কেউ বলতেও পারল নাসেন্টটা মুহিবের কাছে এখনাে আছে। 

নােরার বাবা বললেন, কী চিন্তা করছ ? মুহিব চমকে উঠে বলল, কিছু চিন্তা করছি না। 

তিনি হাসি হাসি মুখে বললেন, নােরা হঠাৎ করে বলল, ঝুম বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভে গেলে খুব নাকি মজা হবেতুমি আমার মেয়ের বন্ধু

তার নেচার তাে জানােই যেই তার মাথায় চিন্তাটা এলাে অমনি টেলিফোন করে বন্ধুবান্ধব জোগাড় করলমাইক্রোবাস নিয়ে বের হয়ে গেল তােমাকে টেলিফোন করে নি

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ

জিনাতােমার হাতের ফুলগুলি দোলনচাপা না ? জি। 

ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কী জানাে ? আমি আমার মেয়ের নাম দোলনচাপা রাখতে চেয়েছিলাম মেয়ের মা বলল, দোলনচাপা শুনলেই কবি নজরুলের বইয়ের কথা মনে হবেসঙ্গে সঙ্গে চোখে

ভাসবে কবির ঝাকড়া চুলভর্তি ছবিআমি ডাকব আমার মেয়েকে, চোখে ভাসবে কবি নজরুলের ছবিতা হবে নাশেষে ডিসিশান পাল্টে ইবসেনের চরিত্রের নামে নাম রাখলামনােরানােরা নামটা তােমার কেমন লাগেসুন্দর

নােরা সুন্দর নাকি দোলনচাঁপা সুন্দর ? দোলনচাপা সুন্দর। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *