নােরাদের বাড়ির গেটের দারােয়ানের নাম ইসকান্দর । নােরা এই নাম সংক্ষেপ করে নিয়েছে। সে ডাকে “ইস‘। ইসকান্দর থেকে ইস, কান্দর বাদ। নােরা যখন বলে, ইস ভাই, ছুটে চলে যান। খুব ঠাণ্ডা দেখে এক বােতল প্রাইট নিয়ে আসুন।.
গেট খােলা থাকুক। পাঁচ মিনিটের বেশি তাে আপনার লাগবে না। এই পাঁচ মিনিটে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটার সম্ভাবনা কম। ইস ভাই নিতান্তই অনিচ্ছার সঙ্গে যায়। ইস ভাইয়ের বয়স ষাটের কাছাকাছি। দীর্ঘ ত্রিশ বছর সে নােরাদের বাড়ির গেটের পাশে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাটিয়েছে। গেট থেকে সামান্য দূরে গেলেই সে মনে হয় অস্থির বােধ করে। হয়তাে নিজেকে সে গেটের অংশ বলেই এখন ভাবে।
তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও ইসকান্দরকে দেখা গেল ছাতা মাথায় দিয়ে টুলের উপর বসে আছে। মুহিব গেটের ওপাশ থেকে আনন্দিত স্বরে বলল, ইস ভাইয়া, গেটটা খুলুন।
ইসকান্দর তাকাল। রাগী গলায় বলল, আমারে ইস ভাইয়া ডাকবেন না। আমার পিতামাতা আমার একটা নাম দিয়েছিল।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ
মুহিব বলল, সরি, আর ডাকব না। গেটটা খুলুন। ইসকান্দর মুহিবের উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে বলল, গেট খােলা যাবে না। যাবে না কেন? আপা বাড়িতে নাই।
মুহিব পরিষ্কার বুঝতে পারছে এটা একটা মিথ্যা কথা। ইস ভাইয়া‘ ডাকায় দারােয়ান রেগে গেছে। দারােয়ানদের রাগের দৌড় গেট পর্যন্ত বলেই গেট খােলা হচ্ছে না। মুহিব বলল, ইসকান্দর শুনুন, আমি আপনার আপার কাছে এসেছি এটা আপনাকে কে বলল ? আমি নােরার বাবার সঙ্গে কথা বলার জন্যে এসেছি। উনি কি বাসায় আছেন ?
আছেন। উনাকে খবর দিন।
মুহিবের ধারণা ছিল এই কথায় দারােয়ানের হুঁশ হবে। সে গেট খুলে দেবে। মিনমিনে গলায় বলবে, আপা বাসায় আছে। আমার ইয়াদ ছিল না। আসেন, ভিতরে আসেন। সে–রকম কিছু ঘটল না। দারােয়ান টুল ছেড়ে ভেতরের দিকে চলে গেল।
মুহিবের বুক ঈষৎ কেঁপে গেল। সত্যি কি নােরা বাড়িতে নেই ? দারােয়ান কি নােরার বাবাকে খবর দিতে গিয়েছে ? মুহিবের হাতে সাতটা দোলনচাঁপা। প্রবল বৃষ্টিতেও ধবধবে সাদা ফুলগুলির কিছু হয় নি। বরং সে নিজে চুপসে
গেছে। ঠাণ্ডায় শরীর কাঁপছে। আয়নার সামনে দাড়ালে হয়তাে দেখা যাবে ঠাণ্ডায়। এবং বৃষ্টির পানিতে তার ঠোট নীলচে হয়ে গেছে। নােরার সিডি কেনা হয় নি। প্রধান কারণ— টাকা ছিল না। সিডি না কেনায় ভালােই হয়েছে। এই বৃষ্টিতে সিডি বাঁচানাের কোনাে উপায় থাকত না।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ
দারােয়ান ফিরে এসেছে। গেট খুলছে। তার চোখ–মুখ কঠিন হয়ে আছে। সে মুহিবের দিকে না তাকিয়েই বলল, আসেন। বড় সাহেব আপনাকে যেতে বলেছেন। মুহিব বলল, সে–কী!
| নােরার বাবার সঙ্গে মুহিবের কখনাে দেখা হয় নি। ভদ্রলােকের এমন অবস্থা যে বারাে মাসের ভেতর তের মাসই থাকেন দেশের বাইরে। বার হাত কাকুড়ের তের হাত বিচির মতাে অবস্থা। মাঝে মাঝে মেয়েকে ছবি পাঠান। ছবির পিছনে ছবি সম্পর্কে বর্ণনা থাকে। মুহিব এই ভদ্রলােককে প্রথম দেখে এরকম একটা ছবিতে। লম্বা ফর্সা এবং মাথাভর্তি আইনস্টাইনের মতাে ঝাঁকড়া চুলের এক ভদ্রলােক কালাে রঙের একটা পাথর হাতে দাড়িয়ে আছেন। পাথরের দিকে তাকিয়ে আছেন মুগ্ধ দৃষ্টিতে। যেন এটা কোনাে কালাে পাথর না। এটা তাজমহল । বনসাই করে ছােট করা হয়েছে।
ছবির উল্টা পিঠে ইংরেজিতে লেখা– মা নােরা, যে পাথর হাতে আমি দাড়িয়ে আছি এটা কোনাে সাধারণ পাথর না। এটা একটা meteorite. অতি দূর কোনাে নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে এটা পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে। ভালাে থেকো... | নােরার বাবা নাজমুল করিম সাহেব মুহিবকে দেখে চিন্তিত গলায় বললেন, এ–কী! তােমার কী অবস্থা! কতক্ষণ ধরে বৃষ্টিতে ভিজছ ? দাঁড়াও দাঁড়াও, আমি টাওয়েল নিয়ে আসি। আগে মাথাটা মুছ। ইসকান্দর আমাকে বলেছে তুমি নােরার বন্ধু। তােমার সঙ্গে আলাপ–পরিচয় করব। তার আগে ভেজা কাপড় বদলাও। এক্কেবারে নতুন, ব্যবহার করা হয় নি এমন এক সেট কাপড় দিলে তােমার কি পরতে আপত্তি আছে ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ
| মুহিবের খুব অদ্ভুত লাগছে। সে বসে আছে নােরার বাবার পাশে। তার গায়ে এই ভদ্রলােকের পায়জামা–পাঞ্জাবি। তাদের দু‘জনের হাতে চায়ের কাপ।
তােমার নাম মুহিব ? জি স্যার। স্যার বলছ কেন ?
মুহিব হকচকিয়ে গেল। আসলেই তাে, সে স্যার কেন বলছে ? ইন্টারভিউ দিয়ে দিয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে বলেই কি স্যার বলছে ? না–কি এই ভদ্রলােককে তাদের কলেজের কোনাে স্যারের মতাে লাগছে ? একজনের সঙ্গে অবশ্যি মিল
পাওয়া যাচ্ছে। আনন্দমােহন কলেজের ইতিহাসের স্যার, কুমুদ বাবু। ছাত্ররা সবাই তাকে ডাকত সেন্ট স্যার। উনি গায়ে সেন্ট না মেখে বাসা
থেকে বের হতেন না। পােশাকে–আশাকে ফিটফাট বাবু। ভদ্রলােক হঠাৎ পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতেন। কাউকে চিনতে পারতেন না, তবে ছাত্রদের দেখলেই চিনতেন। গল্প করার জন্যে খুব আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে যেতেন। মুহিবের সঙ্গে একদিন দেখা। তিনি হাসি হাসি মুখে
এগিয়ে এলেন। কোমল গলায় বললেন, তােমার নাম মুহিব না ?
মুহিব বলল, জি স্যার। সেকেন্ড ইয়ার ? জি স্যার। রােল থার্টি থ্রি ? জি স্যার।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ
দেখেছ, সব মনে আছে। পাগলদের কিছুই মনে থাকে না। আমার সবই মনে থাকে । ভালাে আছ বাবা ?
জি স্যার।
তুমি আমাকে এক শিশি সেন্ট কিনে দিতে পারবে ? অন্য কোনাে কিছুর অভাব বােধ করছি না। কাপড় ছাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছি তাতেও তেমন অসুবিধা হচ্ছে। না, তবে সেন্টের অভাবটা খুব বােধ করছি।
স্যার, আমি এক্ষুণি সেন্ট কিনে নিয়ে আসছি।
আমি তাে সব সময় হাঁটাহাঁটির মধ্যে থাকি। আমাকে খুঁজে নাও পেতে পার । সেন্টটা কিনে তুমি আমার মা‘র হাতে দিয়ে এসাে। বাসা চিন তাে ? বকুল গাছওয়ালা বাড়ি।
জি স্যার বাসা চিনি।
মুহিব সেদিনই সেন্ট কিনেছিল। দামি সেন্টই কিনেছিল। কুমুদ স্যারকে সেই সেন্ট দেয়া হয় নি। কারণ স্যারের মা পুরনাে বাসায় ছিলেন না। উনি। কোথায় গিয়েছেন কেউ বলতেও পারল না। সেন্টটা মুহিবের কাছে এখনাে আছে।
নােরার বাবা বললেন, কী চিন্তা করছ ? মুহিব চমকে উঠে বলল, কিছু চিন্তা করছি না।
তিনি হাসি হাসি মুখে বললেন, নােরা হঠাৎ করে বলল, ঝুম বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভে গেলে খুব নাকি মজা হবে। তুমি আমার মেয়ের বন্ধু,
তার নেচার তাে জানােই । যেই তার মাথায় চিন্তাটা এলাে অমনি টেলিফোন করে বন্ধু–বান্ধব জোগাড় করল। মাইক্রোবাস নিয়ে বের হয়ে গেল । তােমাকে টেলিফোন করে নি ?
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৭)-হুমায়ুন আহমেদ
জি–না। তােমার হাতের ফুলগুলি দোলনচাপা না ? জি।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কী জানাে ? আমি আমার মেয়ের নাম দোলনচাপা রাখতে চেয়েছিলাম । মেয়ের মা বলল, দোলনচাপা শুনলেই কবি নজরুলের বইয়ের কথা মনে হবে। সঙ্গে সঙ্গে চোখে
ভাসবে কবির ঝাকড়া চুলভর্তি ছবি। আমি ডাকব আমার মেয়েকে, চোখে ভাসবে কবি নজরুলের ছবি—তা হবে না। শেষে ডিসিশান পাল্টে ইবসেনের চরিত্রের নামে নাম রাখলাম— নােরা। নােরা নামটা তােমার কেমন লাগে? সুন্দর।
নােরা সুন্দর না–কি দোলনচাঁপা সুন্দর ? দোলনচাপা সুন্দর।