নােরার আরেকটা খাস বাঙালি নাম আছে। সেটা জানাে ? গানের ক্যাসেট বা সিডি যা বের হয় সেখানে তার বাংলা নামটা থাকে। জানাে বাংলা নামটা ? জি, চন্দ্রাবতী। চন্দ্রাবতী নামের অর্থ জানাে ? জি–না।
চন্দ্রাবতী নামের অর্থ হলাে চাঁদের সখী। নােরার একটা আরবি নামও আছে। আরবি নামটা আমার মা রেখেছিলেন— ‘ওয়ামিয়া‘। এই নামের অর্থ হলাে বৃষ্টি। মানুষের স্বভাবের উপর নামের প্রভাব পড়ে— এই কথাটা মনে হয়। সত্যি। বৃষ্টি নাম রাখার জন্যেই বােধহয় বৃষ্টি হলেই আমার মেয়ের মাথা খারাপের মতাে হয়ে যায় ।
মুহিবের ঝিমুনি ধরে গেছে। নােরার বাবারও মনে হচ্ছে কথা বেশি বলার অভ্যাস। তিনি ক্রমাগতই কথা বলে যাচ্ছেন । এখন আর তার কথা মুহিব মন। দিয়ে শুনছে না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ঘর অন্ধকার। মুহিবের ধারণা কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়বে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ
মুহিব । জি।
তুমি কর কী ? পড়াশােনা ? পড়াশােনা শেষ করেছি। আমি বেকার। ও আচ্ছা।
মুহিবের মনে হলাে সে নিজে ঘুমের মধ্যে কথা বলছে। সে বেকার না। তার পকেটে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আছে। ভিজে ন্যাতনাতে হয়ে গেছে। তাতে কী। সে কি ভুলটা শুদ্ধ করবে ? বলবে যে এখন সে এরনস ইন্টারন্যাশনাল নামের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করে। থাক, দরকার কী ।
মুহিব! জি স্যার। নােরার বন্ধুবান্ধদের আমি খুব পছন্দ করি। কেন জানাে ? জি–না।
পছন্দ করি কারণ বেশির ভাগ সময় আমি দেশের বাইরে থাকি। নােরাকে ঘিরে একগাদা বন্ধুবান্ধব আছে— এটা ভেবে নিশ্চিত বােধ করি। আমি কী বলার
চেষ্টা করছি বুঝতে পারছ ?
জি পারছি। তােমাদের বাসা কোথায় ? ঝিকাতলা ।। নিজেদের বাড়ি ? আমার বড়চাচার বাড়ি। সবাই এক সঙ্গে থাকি। ভালাে তাে। জয়েন্ট ফ্যামিলি উঠেই গেছে। বাবা–মা বেঁচে আছেন ? জি। শুনতেই তাে ভালাে লাগছে। পিতা–মাতা–পুত্র–কন্যা সব এক ছাদের নিচে।
মুহিব ঘুম ঘুম গলায় বলল, বাবা আমাদের সঙ্গে থাকেন না। আলাদা থাকেন।
কেন?
উনাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। উনি এখন আর আমাদের পরিবারের সদস্য না।
বলতে বলতে মুহিব আরাম করে ঘুমিয়ে পড়ল।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ
মুহিবের বাবা শামসুদ্দিন সাহেব পল্লবীতে থাকেন। দুই কামরার ঘর, পেছনে বারান্দা আছে। টিনের ছাপড়া দিয়ে বারান্দা ঢাকা। সেখানেই রান্নার ব্যবস্থা। গ্যাসের কারবার নেই, রাধতে হয় কেরােসিনের চুলায়। সেটা শামসুদ্দিন সাহেবের জন্যে কোনাে ব্যাপার না। তিনি একা মানুষ বিশাল বাড়ি দিয়ে তিনি কী করবেন! তার দরকার ঘুমাবার জন্যে একটা জায়গা। মাথার উপর ফ্যান । (তিনি গরম একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। শীতের সময়ও ফ্যান ছেড়ে রাখতে হয়।
তার জন্যে সবচে’ সুবিধা হতাে যদি এক কামরার একটা ঘর হতাে। ঘরের এক কোনায় রান্নার ব্যবস্থা থাকবে। টুক করে পানি গরম করে এক কাপ চা খেয়ে ফেলা। এক মুঠ চাল এক মুঠ ডাল দিয়ে খিচুড়ি। রান্নার শেষ পর্যায়ে চায়ের চামচে এক চামচ ঘি । ব্যস ফুরিয়ে গেল।
এক কামরার একটা ঘরই তার জন্যে যথেষ্ট ছিল। এখন যে বাড়িতে আছেন সেটাও খারাপ না। ফ্ল্যাট বাড়ি না। আলাদা বাড়ি। মাথার উপর টিনের ছাদ। রাতে টিনের চালে যখন বৃষ্টি হয় অদ্ভুত ভালাে লাগে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই বাড়িতে থাকতে পারলে খারাপ হতাে না। সেটা সম্ভব হচ্ছে না। বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। খুপড়ি খুপড়ি টিনের বাড়ি সব উঠে যাচ্ছে। বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স হবে। লিফট থাকবে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ
আলাদা জেনারেটর থাকবে। সব ভাড়াটেদের বাড়ি ছাড়ার নােটিশ দেয়া হয়েছে। বাড়ি ছাড়ার শেষ সময়ও পার হয়ে গেছে। বেশির ভাগই চলে গেছে। শামসুদ্দিন সাহেব যেতে পারেন নি। তিনি বাড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না। বৃদ্ধদের কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না। বাড়িওয়ালা চোখ বড় বড় করে বলে, একা থাকবেন ? আপনার ফ্যামিলি মেম্বাররা কোথায় ?
তারা ঢাকায়। তাদের সাথে আমার ঠিক অ্যাডজাস্টমেন্ট হয় না বলে আমি আলাদা থাকি ।
অ্যাডজাস্টমেন্ট হয় না কেন ?
শামসুদ্দিন সাহেব ধাঁধায় পড়ে যান। কী জবাব দেবেন বুঝতে পারেন না। অ্যাডজাস্টমেন্ট কেন হয় না— এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটা নিয়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে আলাপ করার কিছু নেই। ব্যাপারটা পুরােপুরি ব্যাখ্যা না করলে বাড়ি পাওয়াও যাবে না। বাড়িওয়ালাকে সন্তুষ্ট করতে হবে। আপনি করেন কী ? মানে আপনার সাের্স অব ইনকাম কী ? কোচিং সেন্টারে পড়াই।। কী পড়ান ?
ইংরেজি পড়াই। আমি একটা বেসরকারি কলেজের ইংরেজির শিক্ষক ছিলাম। রিটায়ার করেছি। আপনি যে একা থাকবেন অসুখ–বিসুখ হলে আপনাকে দেখবে কে? মেজাজ খারাপ হবার মতাে প্রশ্ন। আমাকে কে দেখবে
সেটা আমার ব্যাপার। তােমার মাসে মাসে ভাড়া পেলেই তাে হলাে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ
বাড়িওয়ালাকে এই ধরনের কথা বলা যায় না। বাড়ি ভাড়া নেবার আগে বাড়িওয়ালার মন জুগিয়ে কথা বলতে হয়। স্রোতের পাংগাশ হতে হয়। স্রোত যেদিকে পাংগাশ মাছ সেদিকে। বাড়িওয়ালা স্রোত, ভাড়াটে পাংগাশ ।
| শামসুদ্দিন সাহেব যথেষ্টই ঝামেলায় পড়েছেন। কেউ তাকে বাড়ি ভাড়া দেবে— এরকম মনে হচ্ছে না। শেষপর্যন্ত হয়তাে সস্তা ধরনের কোনাে হােটেলে। মাসকাবারি বন্দোবস্তে যেতে হবে। এটাও খারাপ না। হােটেলে থাকা মানেই লােকজনের মধ্যে থাকা। বয়–বাবুর্চির আনাগােনার মধ্যে থাকা। কোথাও টেলিফোনের দরকার পড়ল— ম্যানেজারের অফিস থেকে টেলিফোন। শরীরও এখন ভালাে যাচ্ছে না। কথা নেই বার্তা নেই হুট করে রাতদুপুরে একশ দুই একশ তিন জুর। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বয়কে খবর দিলে মাথায় এসে পানি। ঢালবে। পাঁচ–দশ টাকা বকশিশ ধরিয়ে দিলেই হলাে।
তিনি হােটেল খোজা এখনাে শুরু করেন নি। রােজই ভাবেন আগামীকাল থেকে শুরু হবে। ইত্তেফাক পত্রিকায় ছয়শ টাকা খরচ করে একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। তাতে কিছু হয় কি–না সেটা দেখে জোরেসােরে হােটেলে ঘর খোজা শুরু করবেন। ইত্তেফাকের বিজ্ঞাপনটা এরকম— লজিং চাই। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। থাকা–খাওয়ার বিনিময়ে লজিং চাই ।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ
এখনাে কোনাে জবাব আসে নি। ঢাকা শহরের লােকজন ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়ানাের ব্যাপারে আগ্রহী, তবে ঘরে টিচার রাখতে আগ্রহী না। ঘরে লজিং রাখার ব্যাপার মনে হয় ঢাকা শহরের লােকজন ভুলে গেছে। লজিং শব্দটা এসেছে Lodge থেকে।
তাড়াতাড়ি কোনাে একটা লজিং–এর ব্যবস্থা হলে ভালাে হয়। কারণ কোচিং সেন্টারে কিছু সমস্যা হয়েছে। কোচিং সেন্টারের মালিক চেংড়া এক ছেলে। মাসখানেক আগে তাকে ডেকে নিয়ে মুখ–চোখ কুঁচকে বলল— শামসুদ্দিন। সাহেব, আপনি দাড়ি রেখেছেন কেন ? এখন তাে আপনাকে দেখে মনে হয় মাদ্রাসার শিক্ষক। ছাত্রদের পড়াবেন ইংরেজি, গেটাপে স্মার্টনেস থাকবে। মুখভর্তি যদি মওলানার মতাে দাড়ি থাকে তাহলে চলবে কীভাবে ? আজ দাড়ি রেখেছেন, পড়শু থেকে ধরবেন লম্বা আচকান। তারপর চোখে দেবেন সুরমা। কয়েক দিন পরে মাথায় বেতের গােলটুপি। ভাই, আমরা তাে ব্যবসা করতে এসেছি। আমাদের শাে–শা’ থাকতে হবে। থাকতে হবে না ? শামসুদ্দিন বললেন, জি থাকতে হবে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৮)-হুমায়ুন আহমেদ
ব্যক্তিগতভাবে আপনি যত ইচ্ছা ধর্মকর্ম করেন। আমার কোনাে সমস্যা নাই । আমি নিজে পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ার চেষ্টা করি। দু‘বছর আগে ওমরা হজ করে এসেছি। বুঝতে পারছেন কী বলার চেষ্টা করছি ? | কিছু না বুঝেই শামসুদ্দিন সাহেব বললেন, জি বুঝতে পারছি।
আপনার বয়সও হয়েছে। আপনি লােডও ঠিকমতাে নিতে পারছেন না। আমার দরকার অ্যানার্জেটিক লােক। বুঝতে পারছেন ?
জি বুঝতে পারছি।
আপনার টিচিং অ্যাবিলিটি নিয়ে আমার কোনাে কমপ্লেইন নেই। আমি শুনেছি আপনি ভালাে শিক্ষক। কিন্তু বয়সের ব্যাপারটা মাথার মধ্যে রাখতে হবে।