শামসুদ্দিন সাহেব বেশ কয়েকবার মাথা নেড়ে বলেছেন, জি জি।
এইসব লক্ষণ ভালাে লক্ষণ না । তার ধারণা তিনি যে–কোনাে একদিন শুনবেন তার চাকরি শেষ। তখন ভালাে ঝামেলায় পড়ে যেতে হবে। কী ঝামেলা সে সব নিয়ে আগে–ভাগে চিন্তা করতে ভালাে লাগে না। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে তিনি খুব চেষ্টা করেন সমস্যা নিয়ে চিন্তা না করতে। খুবই আশ্চর্যের কথা তিনি এ ব্যাপারে সফল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি জেগে থাকেন। মাথায় কোনাে চিন্তা নেই। ফাকা মাথা । যখন বৃষ্টি হচ্ছে বৃষ্টির শব্দ শুনছেন। Oxford
ডিকশনারিতে Lodge শব্দ সম্পর্কে বলা হয়েছে— A small house in a country where people stay when they want to take part in some types of out door sport.
গত রাতে শামসুদ্দিন সাহেবের ঘুম ভালাে হয় নি। শরীর খুব খারাপ লাগছিল বলে নটা বাজার আগেই শুয়ে পড়েছিলেন। রাত এগারােটার দিকে ঝুম বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তারপর আর ঘুম আসে না। মাথায় যন্ত্রণা। বমি বমি ভাব। শরীরে ব্যথা। বিছানায় শুয়ে আরাম পাচ্ছেন না। কাত হয়ে শুলে। মনে হয় চিৎ হয়ে থাকলে ভালাে লাগত। চিৎ হয়ে থাকলে মনে হয় আগে যেভাবে শুয়েছিলেন সেটাই ভালাে ছিল।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
কপালে হাত দিয়ে কোনাে জ্বর টের পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরেও কৌতূহলবশত থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর দেখলেন । একশ দুই–এর সামান্য বেশি। শিশু এবং বৃদ্ধদের জন্যে একশ দুই খুব বেশি জ্বর একশ তিনের উপর উঠলে মাথায় পানি ঢালার চিন্তা করতে হয়। তাঁর জ্বর যদি আরাে বাড়ে তাহলে বাথরুমে ঢুকে কল ছেড়ে বসে থাকলেই হবে।
‘মানুষের সকল অবস্থার জন্যে তৈরি থাকতে হয়’– এই ধরনের উচ্চ শ্ৰেণীর ভাব চিন্তা করে তিনি সময় কাটাতে লাগলেন। মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, তখন মনে হচ্ছে তিনি মহিষের গাড়িতে শুয়ে আছেন। গাড়ি একবার এদিক হেলে যাচ্ছে, আরেকবার ওদিক হেলছে। মহিষের গায়ের বােটকা গন্ধও তখন নাকে লাগছে।
শেষ রাতে জ্বর আরাে বাড়ল। থার্মোমিটারে পারদ তিনের ঘর ছাড়িয়েও কিছু দূর উঠে গেল। তিনি বুঝতে পারছেন তার উচিত বাথরুমে ঢুকে কল ছেড়ে দেয়া। কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ানাের মতাে শারীরিক জোরও তিনি পাচ্ছেন । তিনি জেগে আছেন। জাগ্রত অবস্থাতেই তাঁর মনে হচ্ছে, মহিষের গাড়িতে শুকনা খড়ের বিছানায় তিনি শুয়ে আছেন। খানাখন্দে পড়ে গাড়িও আঁকাচ্ছে। তিনি সারা শরীরে সেই ঝাকুনি অনুভব করছেন।
সকাল এগারােটার দিকে মুহিব তার বাবাকে দেখতে এলাে। বাড়ির চারপাশে পানি থইথই করছে। আরেকটু পানি বাড়লেই ঘরে পানি ঢুকে যাবে। পানি। ভেঙে ঘরে ঢুকতে গিয়ে প্যান্ট–জুতা কাদায় মাখামাখি ।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
শামসুদ্দিন সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, বাথরুমে ঢুকে সাবান ডলা দিয়ে পা ধুয়ে ফেল। তাকের উপর সাবান আছে। ভেজা প্যান্ট খুলে একটা লুঙ্গি পরে নে। আমার ধােয়া লুঙ্গি আছে।
মুহিব বলল, বাবা তােমার শরীর খারাপ ?
রাতে সামান্য জ্বরের মতাে এসেছিল— এখন শরীর ফিট । হালকা ফুরফুরে লাগছে।
কিছুক্ষণ আগেই তার খুবই খারাপ লাগছিল। বিছানা থেকে নামতে ইচ্ছা করছিল না। ছেলেকে দেখার পর থেকে সত্যি সত্যি ভালাে লাগছে। মাথায় চাপ দিয়ে যে যন্ত্রণাটা বসে ছিল সেটাও নেই। শরীরে এখন সত্যি সত্যি ফুরফুরে ভাব চলে এসেছে। ছেলের সঙ্গে মুখােমুখি বসে গল্প করবেন ভাবতেই ভালাে লাগছে। ভালাে লাগাটা এত তীব্র যে বুকে সামান্য ব্যথা বােধও করছেন। তাঁর এই ছেলেটা মাঝে–মধ্যে তাকে দেখতে আসে। সহজ–স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বার্তা বলে। ছেলেটা যখন আসে তখন তাঁর মনে হয় বেঁচে থাকা যথেষ্টই আনন্দের ব্যাপার। এবং তার নিজের জীবনে কোনােই সমস্যা নেই। কোনাে একটা কাজে সংসারের বাইরে বাস করছেন। কাজ শেষ হলেই সংসারে ফিরবেন।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
মুহিব, নাশতা খেয়ে এসেছিস ? মুহিব বাথরুম থেকে বলল, হু। চা খাবি ? চা বানাব?
বাড়ির খবর সব ভালাে তাে ?
শামসুদ্দিন সাহেব হেসে ফেললেন। হুঁ হুঁ করে কথা বলা মুহিবের শৈশবের অভ্যাস। এক দেড় বছর বয়সে বাচ্চারা কথা বলা শেখে। একবার বলা শুরু করলে অতি দ্রুত লম্বা লম্বা বাক্য তৈরি শুরু হয়। মুহিবের বেলায় উল্টাটা হয়েছিল। দেড় বছর বয়স পর্যন্ত সে শুধু হু বলত। আর কিছু না, শুধুই হুঁ। কেমন আছ গাে বাবা ?
পানি খাবে ?
হুঁ।
নাম কী তােমার বাবা ?
ওরে সােনা, হুঁ ছাড়া তুমি আর কিছু বলতে পার না?
শামসদিন তার ছােট ছেলের নাম দিয়েছিলেন—হু বাবা। শৈশবের অনেক অভ্যাসের মতাে হুঁ বলা অভ্যাস মুহিবের বেলা স্থায়ী হয় নি। তবে শামসুদ্দিন লক্ষ করেছেণ, মুহিব যখন অন্যমনস্ক থাকে তখন তার হুঁ বলা অভ্যাস ফিরে। আসে। তখন যে প্রশ্নই করেন মুহিব জবাব দেয় হুঁ দিয়ে।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
মহিব তার চাকরি–বাকরির কিছু হয়েছে ? | মহিব জবাব দিল না। শামসুদ্দিন বাথরুম থেকে পানি ঢালার শব্দ পেলেন। তাঁর মন সামান্য খারাপ হলাে। ছেলেকে এই প্রশ্ন করা ঠিক হয় নি। চাকরি পেলে সে নিজেই এসে হাসি মুখে বলত। বেচারার সমস্যার সমাধান কিছু হচ্ছে
। এই সময়ে সমস্যার কথা মনে করিয়ে দেয়া অন্যায় একটা কাজ। তিনি সব সময় ভাবে এই কাজ কখনাে করবেন না। চাকরির কথা জিজ্ঞেস করে ছেলেকে লজ্জা দেবেন না। অথচ প্রতিবারই প্রশ্নটা করেন।
মুহিব বাথরুম থেকে বের হয়েছে। সে যে শুধু হাত–পা ধুয়েছে তা না, মাথায়ও পানি দিয়েছে। চুল বেয়ে পানি পড়ছে। শামসুদ্দিন ছেলের দিকে তাকিয়ে খুশি খুশি গলায় বললেন, কাছে আয় মাথা মুছিয়ে দেই। মুহিব আপত্তি করল না। এবার কাছে এগিয়ে গেল। শামসুদ্দিন নিচু গলায় বললেন, চাকরি হচ্ছে কি হচ্ছে না— এই নিয়ে চিন্তা করে মাথা খারাপ করবি না। যখন হবার হবে। ভাগ্যে যা থাকার তাই হয়।
উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ
মুহিব বলল, তুমি কি নতুন বাড়ি খুঁজে পেয়েছ ? এই বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে বলেছিলে।
শামসদিন সাহেবের আবার খানিকটা মন খারাপ হলাে। ছেলে তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি। বেচারার নিজের ঝামেলারই কোনাে পারাপার নেই, তাকে ভাবতে হর্মে অন্যের ঝামেলা নিয়ে।
শামসুন্দিন সাহেব মিথ্যা করে বললেন, এখনাে খোঁজা শুরু করি নাই। তাছাড়া লােকজনদের বলা আছে। খুঁজতেও হবে না। তাছাড়া আমি একা মানুষ, আমার কিছু লাগবে না। একা মানুষের জন্যে কিছু লাগে না। কথায় আছে—
ভােজনং যত্রতত্র শয়নং হট্ট মসজিদ। মহিব বুলি, কথাটা হবে হট্ট মন্দির। তুমি মসজিদ বলছ কেন ?
এখানে মন্দির পাব কোথায়। আর যদি পাইও ওরা কি মন্দিরে আমাকে ঘুমাতে দিবে