উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ

শামসুদ্দিন সাহেব বেশ কয়েকবার মাথা নেড়ে বলেছেন, জি জি। 

এইসব লক্ষণ ভালাে লক্ষণ না তার ধারণা তিনি যেকোনাে একদিন শুনবেন তার চাকরি শেষতখন ভালাে ঝামেলায় পড়ে যেতে হবেকী ঝামেলা সে সব নিয়ে আগেভাগে চিন্তা করতে ভালাে লাগে নাউড়ালপঙ্খিরাতে ঘুম ভেঙে গেলে তিনি খুব চেষ্টা করেন সমস্যা নিয়ে চিন্তা না করতেখুবই আশ্চর্যের কথা তিনি ব্যাপারে সফলঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি জেগে থাকেনমাথায় কোনাে চিন্তা নেইফাকা মাথা যখন বৃষ্টি হচ্ছে বৃষ্টির শব্দ শুনছেনOxford 

ডিকশনারিতে Lodge শব্দ সম্পর্কে বলা হয়েছেA small house in a country where people stay when they want to take part in some types of out door sport

গত রাতে শামসুদ্দিন সাহেবের ঘুম ভালাে হয় নিশরীর খুব খারাপ লাগছিল বলে নটা বাজার আগেই শুয়ে পড়েছিলেনরাত এগারােটার দিকে ঝুম বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভেঙে গেলতারপর আর ঘুম আসে নামাথায় যন্ত্রণাবমি বমি ভাবশরীরে ব্যথাবিছানায় শুয়ে আরাম পাচ্ছেন নাকাত হয়ে শুলেমনে হয় চিৎ হয়ে থাকলে ভালাে লাগতচিৎ হয়ে থাকলে মনে হয় আগে যেভাবে শুয়েছিলেন সেটাই ভালাে ছিল

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ

কপালে হাত দিয়ে কোনাে জ্বর টের পাওয়া যাচ্ছে নাতারপরেও কৌতূহলবশত থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর দেখলেন একশ দুইএর সামান্য বেশিশিশু এবং বৃদ্ধদের জন্যে একশ দুই খুব বেশি জ্বর একশ তিনের উপর উঠলে মাথায় পানি ঢালার চিন্তা করতে হয়তাঁর জ্বর যদি আরাে বাড়ে তাহলে বাথরুমে ঢুকে কল ছেড়ে বসে থাকলেই হবে

মানুষের সকল অবস্থার জন্যে তৈরি থাকতে হয়এই ধরনের উচ্চ শ্ৰেণীর ভাব চিন্তা করে তিনি সময় কাটাতে লাগলেনমাঝে মাঝে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, তখন মনে হচ্ছে তিনি মহিষের গাড়িতে শুয়ে আছেনগাড়ি একবার এদিক হেলে যাচ্ছে, আরেকবার ওদিক হেলছেমহিষের গায়ের বােটকা গন্ধও তখন নাকে লাগছে। 

শেষ রাতে জ্বর আরাে বাড়লথার্মোমিটারে পারদ তিনের ঘর ছাড়িয়েও কিছু দূর উঠে গেলতিনি বুঝতে পারছেন তার উচিত বাথরুমে ঢুকে কল ছেড়ে দেয়াকিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ানাের মতাে শারীরিক জোরও তিনি পাচ্ছেন তিনি জেগে আছেনজাগ্রত অবস্থাতেই তাঁর মনে হচ্ছে, মহিষের গাড়িতে শুকনা খড়ের বিছানায় তিনি শুয়ে আছেনখানাখন্দে পড়ে গাড়িও আঁকাচ্ছেতিনি সারা শরীরে সেই ঝাকুনি অনুভব করছেন। 

সকাল এগারােটার দিকে মুহিব তার বাবাকে দেখতে এলােবাড়ির চারপাশে পানি থইথই করছেআরেকটু পানি বাড়লেই ঘরে পানি ঢুকে যাবেপানিভেঙে ঘরে ঢুকতে গিয়ে প্যান্টজুতা কাদায় মাখামাখি । 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ

শামসুদ্দিন সাহেব ছেলের দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বললেন, বাথরুমে ঢুকে সাবান ডলা দিয়ে পা ধুয়ে ফেলতাকের উপর সাবান আছেভেজা প্যান্ট খুলে একটা লুঙ্গি পরে নেআমার ধােয়া লুঙ্গি আছে। 

মুহিব বলল, বাবা তােমার শরীর খারাপ

রাতে সামান্য জ্বরের মতাে এসেছিলএখন শরীর ফিট হালকা ফুরফুরে লাগছে। 

কিছুক্ষণ আগেই তার খুবই খারাপ লাগছিলবিছানা থেকে নামতে ইচ্ছা করছিল নাছেলেকে দেখার পর থেকে সত্যি সত্যি ভালাে লাগছেমাথায় চাপ দিয়ে যে যন্ত্রণাটা বসে ছিল সেটাও নেইশরীরে এখন সত্যি সত্যি ফুরফুরে ভাব চলে এসেছেছেলের সঙ্গে মুখােমুখি বসে গল্প করবেন ভাবতেই ভালাে লাগছেভালাে লাগাটা এত তীব্র যে বুকে সামান্য ব্যথা বােধও করছেনতাঁর এই ছেলেটা মাঝেমধ্যে তাকে দেখতে আসেসহজস্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বার্তা বলেছেলেটা যখন আসে তখন তাঁর মনে হয় বেঁচে থাকা যথেষ্টই আনন্দের ব্যাপারএবং তার নিজের জীবনে কোনােই সমস্যা নেইকোনাে একটা কাজে সংসারের বাইরে বাস করছেনকাজ শেষ হলেই সংসারে ফিরবেন। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ

মুহিব, নাশতা খেয়ে এসেছিস ? মুহিব বাথরুম থেকে বলল, হুচা খাবি ? চা বানাব

বাড়ির খবর সব ভালাে তাে

শামসুদ্দিন সাহেব হেসে ফেললেনহুঁ হুঁ করে কথা বলা মুহিবের শৈশবের অভ্যাসএক দেড় বছর বয়সে বাচ্চারা কথা বলা শেখেএকবার বলা শুরু করলে অতি দ্রুত লম্বা লম্বা বাক্য তৈরি শুরু হয়মুহিবের বেলায় উল্টাটা হয়েছিলদেড় বছর বয়স পর্যন্ত সে শুধু হু বলতআর কিছু না, শুধুই হুঁ।  কেমন আছ গাে বাবা

পানি খাবে

হুঁ। 

নাম কী তােমার বাবা

ওরে সােনা, হুঁ ছাড়া তুমি আর কিছু বলতে পার না

শামসদিন তার ছােট ছেলের নাম দিয়েছিলেনহু বাবাশৈশবের অনেক অভ্যাসের তাে হুঁ বলা অভ্যাস মুহিবের বেলা স্থায়ী হয় নিতবে শামসুদ্দিন লক্ষ করেছেণ, মুহিব যখন অন্যমনস্ক থাকে তখন তার হুঁ বলা অভ্যাস ফিরেআসেতখন যে প্রশ্নই করেন মুহিব জবাব দেয় হুঁ দিয়ে। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ

মহিব তার চাকরিবাকরির কিছু হয়েছে ? | মহিব জবাব দিল নাশামসুদ্দিন বাথরুম থেকে পানি ঢালার শব্দ পেলেনতাঁর মন সামান্য খারাপ হলােছেলেকে এই প্রশ্ন করা ঠিক হয় নিচাকরি পেলে সে নিজেই এসে হাসি মুখে বলতবেচারার সমস্যার সমাধান কিছু হচ্ছে 

এই সময়ে সমস্যার কথা মনে করিয়ে দেয়া অন্যায় একটা কাজতিনি সব সময় ভাবে এই কাজ কখনাে করবেন নাচাকরির কথা জিজ্ঞেস করে ছেলেকে লজ্জা দেবেন নাঅথচ প্রতিবারই প্রশ্নটা করেন। 

মুহিব বাথরুম থেকে বের হয়েছেসে যে শুধু হাতপা ধুয়েছে তা না, মাথায়ও পানি দিয়েছেচুল বেয়ে পানি পড়ছেশামসুদ্দিন ছেলের দিকে তাকিয়ে খুশি খুশি গলায় বললেন, কাছে আয় মাথা মুছিয়ে দেইমুহিব আপত্তি করল নাএবার কাছে এগিয়ে গেলশামসুদ্দিন নিচু গলায় বললেন, চাকরি হচ্ছে কি হচ্ছে নাএই নিয়ে চিন্তা করে মাথা খারাপ করবি নাযখন হবার হবেভাগ্যে যা থাকার তাই হয়। 

উড়ালপঙ্খি-পর্ব-(৯)-হুমায়ুন আহমেদ

মুহিব বলল, তুমি কি নতুন বাড়ি খুঁজে পেয়েছ ? এই বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে বলেছিলে। 

শামসদিন সাহেবের আবার খানিকটা মন খারাপ হলােছেলে তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিবেচারার নিজের ঝামেলারই কোনাে পারাপার নেই, তাকে ভাবতে হর্মে অন্যের ঝামেলা নিয়ে। 

শামসুন্দিন সাহেব মিথ্যা করে বললেন, এখনাে খোঁজা শুরু করি নাইতাছাড়া লােকজনদের বলা আছেখুঁজতেও হবে নাতাছাড়া আমি একা মানুষ, আমার কিছু লাগবে নাএকা মানুষের জন্যে কিছু লাগে নাকথায় আছে— 

ভােজনং যত্রতত্র শয়নং হট্ট মসজিদমহিব বুলি, কথাটা হবে হট্ট মন্দিরতুমি মসজিদ বলছ কেন

এখানে মন্দির পাব কোথায়আর যদি পাইও ওরা কি মন্দিরে আমাকে ঘুমাতে দিবে 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *