উড়ালপঙ্খি-(শেষ)-পর্ব-হুমায়ুন আহমেদ

মুহিব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনি যে ছাগলের লাদির মতাে বড়িগুলাে খাওয়াচ্ছিলেন সেগুলি কি খেয়েই যাব না খাওয়া বন্ধ করে দেব ? উড়ালপঙ্খি

তৌফিকুর রহমান কোনাে জবাব দিলেন নামুখের সামনে খবরের কাগজ ধরলেন। 

রাত দশটার দিকে মুহিব একটা সুটকেস এবং একটা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে খায়রুল মিয়ার ফ্ল্যাট বাড়িতে উঠে এলােখায়রুল মিয়ার আনন্দের সীমা রইল। 

তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে কী করবে ভেবে উঠতে পারছে না| সে তার হাঁসের মতাে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ভাইজান এখন থেকে এই বাড়ি আপনার বাড়িবুঝেছেন, কী বলেছি ? আপনার বাড়িযদি মনে করেন আমাকে লাথি দিয়ে বের করে দিবেনকোনাে অসুবিধা নাইআমার পাছায় লাথি দিবেন। 

মুহিব বলল, ঠিক আছে প্রয়ােজনে দেবরাতে খানা কী খাবেন, বলেন। 

উড়ালপঙ্খি-(শেষ)-পর্ব-হুমায়ুন আহমেদ

রাতে কিছু খাব নাশরীর ভালাে লাগছে নাকাল সকালে আমি চাকরিতে জয়েন করবআমার টাই দরকারটাই জোগাড় করে দেবেনপারবেন

আমি পারব না, কী বলেন আপনি ? আপনি বলেন কী! আপনার টাই কয়টা দরকার ? কী কালার ? | মুহিব জবাব দিল নাখায়রুল আগ্রহের সঙ্গে বলল, ভাইজান আপনি চাকরি পেয়েছেন? মুহিব জবাব দিল না। 

খায়রুলের সকল প্রশ্নের জবাব দিতে তার ভালাে লাগে নাকোনাে এক বিচিত্র কারণে ক্লান্তিতে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছেতাকে প্রেসক্লাবের সামনে অবশ্যই যেতে হবে হারুনের অবস্থাটা কী দেখে আসা দরকার। 

মনােয়ারা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেননিজের ছেলেকে তাঁর অচেনা লাগছেফিটফাট সাহেবসাদা প্যান্টের উপর হালকা সবুজ রঙের ফুলহাতা শার্টগলায় টাই ঝুলছেটাইটার রঙও সবুজসবুজের উপর সবুজ দেখতে এত ভালাে লাগছেটাইপরা অবস্থায় মুহিবকে তিনি আগে দেখেন নিমনােয়ারা অবাক হয়ে বললেন, ব্যাপার কী রে

মুহিব বলল, তােমাকে সালাম করতে এসেছিসালাম কী জন্যে ? চাকরিতে জয়েন করবআজই জয়েন করার কথামনােয়ারা অবিশ্বাসী গলায় বললেন, সত্যি চাকরি পেয়েছিস ? বেতন কত ?

উড়ালপঙ্খি-(শেষ)-পর্ব-হুমায়ুন আহমেদ

মুহিব নিচু গলায় বলল, পনেরােবিশ হাজার হবেমাস শেষ হােকবেতনটা হাতে পাই তারপর বােঝা যাবে। 

আমার সঙ্গে ফাজলামি করছিস না তাে ? মুহিব নিচু হয়ে মার পা ছুঁয়ে সালাম করল। 

মনােয়ারা সন্দেহ মিশ্রিত গলায় বড় মেয়েকে ডাকলেন, বুলু, শুনে যা মুহিব বলছে সে চাকরি পেয়েছেস্যুটটাই পরে সাহেব সেজে এসেছে। 

বুলু রান্নাঘরে রান্না করছিলসেখান থেকে গলা উঁচিয়ে ডাকল, মুহিব, শুনে যা এদিকে। 

মুহিব রান্নাঘরের দরজার পাশে দাড়িয়ে উঁকি দিলভেতরে ঢুকল নারান্নাঘর ধোয়ায় অন্ধকারগরম এবং ধোঁয়ার মধ্যে ঢােকার কোনাে অর্থ হয় না। 

বুলু বলল, তুই চাকরি পেয়েছিস

মুহিব বলল, হুজয়েন করতে যাচ্ছি, আজই জয়েনিং ডেট। 

চাকরির কথা আগে কোনাে দিন শুনলাম নাআজ একেবারে জয়েনিং ডেটএগুলি কেন করছিস, মাকে খুশি করার জন্য ? যাতে মা মনে করে আমার ছেলে চোর না চাকরিবাকরি করেঅফিসার সেজে অফিসে যায়এতদিন শুনেছি চোরের মাবড় গলাএখন দেখি চোরের তার চেয়েও বড় গলা। 

উড়ালপঙ্খি-(শেষ)-পর্ব-হুমায়ুন আহমেদ

মুহিব বলল, চুরির ব্যাপারটা শুনেছ

বুলু বলল, কেন শুনব না ? তুই কি ভেবেছিলি চুরির ব্যাপার নিয়ে কেউ আলােচনা করবে না ? আমি তাে চিন্তাই করতে পারি নি কেউ তার ভাইয়ের টাকা চুরি করতে পারে। 

অন্যের টাকা চুরি করার চেয়ে ভাইয়ের টাকা চুরি করা ভালাে না ? টাকা সংসারেই থাকলবাইরে গেল না। 

বুলু রাগী গলায় বলল, চুরির পক্ষে যুক্তি দেয়াও শুরু করেছিস ? লজ্জাও করছে না ? লায়েক তাে ভালােই হয়েছিসআমাকে এখন যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, আপনার ভাইরা কী করে? আমি কী বলব ? এক ভাই ব্যাংকের এজিএম, আরেক ভাই প্রফেসর, সবচেয়ে ছােটটা চোরশ্বশুরবাড়িতে আমার মুখ বলে কিছু আছে ? নিজের বাবা সম্পর্কেও কাউকে কিছু বলতে পারি নাঘেন্না লাগেদিন দেখি বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি করছেসঙ্গে সঙ্গে জানালা বন্ধ করে দিয়েছি। 

বাবা তােমার বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি করে ? মাসে এক দুইবার করেলজ্জাহীন মানুষ হলে যা হয়মুহিব বলল, আপা যাইবুলু বলল, চাটা কিছু খাবি ? নাশতা করে এসেছিস ? মুহিব বলল, চা খাব নানাশতাও করে এসেছিএখন যাচ্ছিস কোথায় ঠিক করে বল তাে ? মুহিব জবাব দিল না

উড়ালপঙ্খি-(শেষ)-পর্ব-হুমায়ুন আহমেদ

বুলু বলল, তােকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেএটা কি সত্যি? নিজের ভাই বাড়ি থেকে বের করে দেয়কী লজ্জার কথা! নাকি তাের লজ্জা লাগছে। 

মুহিব বলল, আমিও খানিকটা বাবার মতাে লজ্জাহীনআপা, আমি যাচ্ছি। 

মুহিবের ঘড়িতে বাজছে সাড়ে সাতটাহাতে অনেক সময় আছে। মতিঝিল পৌছতে আধ ঘণ্টার মতাে লাগবেপ্রেসক্লাবের সামনে কিছুক্ষণের জন্যে থামলে কেমন হয় ? মুহিব এই চিন্তাকে প্রশ্রয় দিল না| একবার নামলে আটকা পড়ে যেতে হবেঅফিস থেকে সরাসরি প্রেসক্লাবের সামনে ফিরলেই হবেতারচেবরং বাবার সঙ্গে দেখা করে আসা যায়মাকে সালাম করা হয়েছেবাবাকে সালাম করা হয় নিবন্ধুত্বের উপর কবি ইয়েটসএর দুলাইন কবিতা লিখিয়ে নিয়ে আসতে হবেজটিল কবিতা, দুলাইন শুনলে মুখস্থ হবেএমন স্মৃতিশক্তি তার নেই। 

প্রেসক্লাবের সামনে যাবে না যাবে না ভেবেও মুহিব সেখানেই আগে গেলশুধু বাবাকে না, সফিককেও সালাম করতে ইচ্ছা করছে। 

প্রেসক্লাবের সামনে সফিক একা বসে আছেহারুন যে সতরঞ্জির উপর বসে ছিল সেটা খালিতবে পােস্টারে পােস্টারে চারদিক ছয়লাপছােট একটা তবুও খাটানাে হয়েছেপ্লাস্টিকের চেয়ারগুলি এখন তাঁবুর ভিতরসফিক অসম্ভববিরক্তগত দু’দিনে শেভ করে নি বলে খােচা খোচা দাড়ি বের হয়ে তাকে দেখাচ্ছে পুরােপুরি জংলির মতাে। 

উড়ালপঙ্খি-(শেষ)-পর্ব-হুমায়ুন আহমেদ

সফিক মুহিবের দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলল, তাের ঘটনা কী? এখানে কত সিরিয়াস ব্যাপার, আর তুই ডুব মারলি ? রাতে একবার আসবি না ? দোকানদার একটাকে পাঠিয়ে দিয়েছিস খায়রুল না বায়রুল কী যেন নামগলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না, তারপরেও সারাক্ষণ কথাসে তাে এসেই হারুনকে মিরপুরে তার কোন শাড়ির দোকানে চাকরি দিয়ে দিলএইসব বেকুবতুই কোথেকে জোগাড় করিস

মুহিব কিছু বলল না। 

তুই নাকি বেকুবের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিস ? কেন ? বাড়ি থেকে লাথি দিয়ে বের করে দিয়েছে

ব্যাপারটা সেরকমইভালােই হয়েছে, রাতে আড্ডা দেবার একটা জায়গা হয়েছে। সফিক সিগারেট ধরালতার মেজাজ ঠাণ্ডা হয়ে আসছে এটা বােঝা যাচ্ছেসে নরম গলায় বলল, তাের কি আজ চাকরিতে জয়েনিং? সাজসজ্জা সেরকমই মনে হচ্ছে। 

মুহিব বলল, জি। 

চাকরিতে জয়েনিং, তাহলে এখানে এসেছিস কেন ? প্রথম দিনেই অফিসে দেরি করে যাবি ? আমাদের কথা এখন একেবারেই মাথায় রাখবি নামন দিয়ে চাকরি করবি। 

মুহিব এগিয়ে এসে সফিকের পা ছুঁয়ে সালাম করলসফিক বিরক্ত গলায় বলল, এইসব কী ? নিজের বাবা মাকে সালাম করেছিস

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *