মুহিব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনি যে ছাগলের লাদির মতাে বড়িগুলাে খাওয়াচ্ছিলেন সেগুলি কি খেয়েই যাব না খাওয়া বন্ধ করে দেব ?
তৌফিকুর রহমান কোনাে জবাব দিলেন না। মুখের সামনে খবরের কাগজ ধরলেন।
রাত দশটার দিকে মুহিব একটা সুটকেস এবং একটা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে খায়রুল মিয়ার ফ্ল্যাট বাড়িতে উঠে এলাে। খায়রুল মিয়ার আনন্দের সীমা রইল।
তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে কী করবে ভেবে উঠতে পারছে না। | সে তার হাঁসের মতাে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ভাইজান এখন থেকে এই বাড়ি আপনার বাড়ি। বুঝেছেন, কী বলেছি ? আপনার বাড়ি। যদি মনে করেন আমাকে লাথি দিয়ে বের করে দিবেন— কোনাে অসুবিধা নাই। আমার পাছায় । লাথি দিবেন।
মুহিব বলল, ঠিক আছে প্রয়ােজনে দেব। রাতে খানা কী খাবেন, বলেন।
উড়ালপঙ্খি-(শেষ)-পর্ব-হুমায়ুন আহমেদ
রাতে কিছু খাব না। শরীর ভালাে লাগছে না। কাল সকালে আমি চাকরিতে জয়েন করব। আমার টাই দরকার। টাই জোগাড় করে দেবেন। পারবেন?
আমি পারব না, কী বলেন আপনি ? আপনি বলেন কী! আপনার টাই কয়টা দরকার ? কী কালার ? | মুহিব জবাব দিল না। খায়রুল আগ্রহের সঙ্গে বলল, ভাইজান আপনি চাকরি পেয়েছেন? মুহিব জবাব দিল না।
খায়রুলের সকল প্রশ্নের জবাব দিতে তার ভালাে লাগে না। কোনাে এক বিচিত্র কারণে ক্লান্তিতে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তাকে প্রেসক্লাবের সামনে অবশ্যই যেতে হবে । হারুনের অবস্থাটা কী দেখে আসা দরকার।
মনােয়ারা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। নিজের ছেলেকে তাঁর অচেনা লাগছে। ফিটফাট সাহেব। সাদা প্যান্টের উপর হালকা সবুজ রঙের ফুলহাতা শার্ট। গলায় টাই ঝুলছে। টাইটার রঙও সবুজ। সবুজের উপর সবুজ দেখতে এত ভালাে লাগছে। টাইপরা অবস্থায় মুহিবকে তিনি আগে দেখেন নি। মনােয়ারা অবাক হয়ে বললেন, ব্যাপার কী রে ?
মুহিব বলল, তােমাকে সালাম করতে এসেছি। সালাম কী জন্যে ? চাকরিতে জয়েন করব। আজই জয়েন করার কথা। মনােয়ারা অবিশ্বাসী গলায় বললেন, সত্যি চাকরি পেয়েছিস ? বেতন কত ?
উড়ালপঙ্খি-(শেষ)-পর্ব-হুমায়ুন আহমেদ
মুহিব নিচু গলায় বলল, পনেরাে–বিশ হাজার হবে। মাস শেষ হােক। বেতনটা হাতে পাই তারপর বােঝা যাবে।
আমার সঙ্গে ফাজলামি করছিস না তাে ? মুহিব নিচু হয়ে মার পা ছুঁয়ে সালাম করল।
মনােয়ারা সন্দেহ মিশ্রিত গলায় বড় মেয়েকে ডাকলেন, বুলু, শুনে যা । মুহিব বলছে সে চাকরি পেয়েছে। স্যুট–টাই পরে সাহেব সেজে এসেছে।
বুলু রান্নাঘরে রান্না করছিল। সেখান থেকে গলা উঁচিয়ে ডাকল, মুহিব, শুনে যা এদিকে।
মুহিব রান্নাঘরের দরজার পাশে দাড়িয়ে উঁকি দিল। ভেতরে ঢুকল না। রান্নাঘর ধোয়ায় অন্ধকার। গরম এবং ধোঁয়ার মধ্যে ঢােকার কোনাে অর্থ হয় না।
বুলু বলল, তুই চাকরি পেয়েছিস?
মুহিব বলল, হু। জয়েন করতে যাচ্ছি, আজই জয়েনিং ডেট।
চাকরির কথা আগে কোনাে দিন শুনলাম না। আজ একেবারে জয়েনিং ডেট। এগুলি কেন করছিস, মাকে খুশি করার জন্য ? যাতে মা মনে করে আমার ছেলে চোর না । চাকরি–বাকরি করে। অফিসার সেজে অফিসে যায়। এতদিন শুনেছি চোরের মা’র বড় গলা। এখন দেখি চোরের তার চেয়েও বড় গলা।
উড়ালপঙ্খি-(শেষ)-পর্ব-হুমায়ুন আহমেদ
মুহিব বলল, চুরির ব্যাপারটা শুনেছ ?
বুলু বলল, কেন শুনব না ? তুই কি ভেবেছিলি চুরির ব্যাপার নিয়ে কেউ আলােচনা করবে না ? আমি তাে চিন্তাই করতে পারি নি কেউ তার ভাইয়ের টাকা চুরি করতে পারে।
অন্যের টাকা চুরি করার চেয়ে ভাইয়ের টাকা চুরি করা ভালাে না ? টাকা সংসারেই থাকল। বাইরে গেল না।
বুলু রাগী গলায় বলল, চুরির পক্ষে যুক্তি দেয়াও শুরু করেছিস ? লজ্জাও করছে না ? লায়েক তাে ভালােই হয়েছিস। আমাকে এখন যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, আপনার ভাইরা কী করে? আমি কী বলব ? এক ভাই ব্যাংকের এজিএম, আরেক ভাই প্রফেসর, সবচেয়ে ছােটটা চোর। শ্বশুরবাড়িতে আমার মুখ বলে কিছু আছে ? নিজের বাবা সম্পর্কেও কাউকে কিছু বলতে পারি না। ঘেন্না লাগে। ঐ দিন দেখি বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি করছে। সঙ্গে সঙ্গে জানালা বন্ধ করে দিয়েছি।
বাবা তােমার বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি করে ? মাসে এক দুইবার করে। লজ্জাহীন মানুষ হলে যা হয়। মুহিব বলল, আপা যাই। বুলু বলল, চা–টা কিছু খাবি ? নাশতা করে এসেছিস ? মুহিব বলল, চা খাব না। নাশতাও করে এসেছি। এখন যাচ্ছিস কোথায় ঠিক করে বল তাে ? মুহিব জবাব দিল না।।
উড়ালপঙ্খি-(শেষ)-পর্ব-হুমায়ুন আহমেদ
বুলু বলল, তােকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে— এটা কি সত্যি? নিজের ভাই বাড়ি থেকে বের করে দেয়— কী লজ্জার কথা! না–কি তাের লজ্জা লাগছে।
মুহিব বলল, আমিও খানিকটা বাবার মতাে লজ্জাহীন। আপা, আমি যাচ্ছি।
মুহিবের ঘড়িতে বাজছে সাড়ে সাতটা। হাতে অনেক সময় আছে। মতিঝিল পৌছতে আধ ঘণ্টার মতাে লাগবে। প্রেসক্লাবের সামনে কিছুক্ষণের জন্যে থামলে কেমন হয় ? মুহিব এই চিন্তাকে প্রশ্রয় দিল না। | একবার নামলে আটকা পড়ে যেতে হবে। অফিস থেকে সরাসরি প্রেসক্লাবের সামনে ফিরলেই হবে। তারচে‘ বরং বাবার সঙ্গে দেখা করে আসা যায়। মাকে সালাম করা হয়েছে। বাবাকে সালাম করা হয় নি। বন্ধুত্বের উপর কবি ইয়েটস–এর দু‘ লাইন কবিতা লিখিয়ে নিয়ে আসতে হবে। জটিল কবিতা, দু’লাইন শুনলে মুখস্থ হবে— এমন স্মৃতিশক্তি তার নেই।
প্রেসক্লাবের সামনে যাবে না যাবে না ভেবেও মুহিব সেখানেই আগে গেল। শুধু বাবাকে না, সফিককেও সালাম করতে ইচ্ছা করছে।
প্রেসক্লাবের সামনে সফিক একা বসে আছে। হারুন যে সতরঞ্জির উপর বসে ছিল সেটা খালি। তবে পােস্টারে পােস্টারে চারদিক ছয়লাপ। ছােট একটা তবুও খাটানাে হয়েছে। প্লাস্টিকের চেয়ারগুলি এখন তাঁবুর ভিতর। সফিক অসম্ভব। বিরক্ত। গত দু’দিনে শেভ করে নি বলে খােচা খোচা দাড়ি বের হয়ে তাকে দেখাচ্ছে পুরােপুরি জংলির মতাে।
উড়ালপঙ্খি-(শেষ)-পর্ব-হুমায়ুন আহমেদ
সফিক মুহিবের দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলল, তাের ঘটনা কী? এখানে কত সিরিয়াস ব্যাপার, আর তুই ডুব মারলি ? রাতে একবার আসবি না ? দোকানদার একটাকে পাঠিয়ে দিয়েছিস খায়রুল না বায়রুল কী যেন নাম— গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না, তারপরেও সারাক্ষণ কথা। সে তাে এসেই হারুনকে মিরপুরে তার কোন শাড়ির দোকানে চাকরি দিয়ে দিল। এইসব বেকুব। তুই কোথেকে জোগাড় করিস ?
মুহিব কিছু বলল না।
তুই না–কি ঐ বেকুবের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিস ? কেন ? বাড়ি থেকে লাথি দিয়ে বের করে দিয়েছে ?
ব্যাপারটা সে–রকমই। ভালােই হয়েছে, রাতে আড্ডা দেবার একটা জায়গা হয়েছে। সফিক সিগারেট ধরাল। তার মেজাজ ঠাণ্ডা হয়ে আসছে এটা বােঝা যাচ্ছে। সে নরম গলায় বলল, তাের কি আজ চাকরিতে জয়েনিং? সাজসজ্জা সে–রকমই মনে হচ্ছে।
মুহিব বলল, জি।
চাকরিতে জয়েনিং, তাহলে এখানে এসেছিস কেন ? প্রথম দিনেই অফিসে দেরি করে যাবি ? আমাদের কথা এখন একেবারেই মাথায় রাখবি না। মন দিয়ে চাকরি করবি।
মুহিব এগিয়ে এসে সফিকের পা ছুঁয়ে সালাম করল। সফিক বিরক্ত গলায় বলল, এইসব কী ? নিজের বাবা মাকে সালাম করেছিস?