একটি মেয়ের আখ‍্যান -রজত বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

একটি মেয়ের আখ‍্যান -রজত বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

একটি মেয়ের আখ‍্যান

 

রজত বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

০২/০৫/২০২৪

 

প্রথম অঙ্ক

 

বহু বছরের পুরনো এক শীতের সকালে অরুণ একেবারে হতবম্ভ হয়ে গেছিল জীবনে প্রথমবার একজন মানুষের শবদেহ দেখে। দেহটি ছিল তার বাবার। সেদিন থেকে ঠিক ন’দিন পরে ক্লাস সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষা। সমীরের সঙ্গে প্রতিবার ফার্স্ট হওয়ার দড়ি টানাটানিটা সেবার অরুণের আর করা হয়ে ওঠেনি। পরীক্ষাটাই দেওয়া যায়নি।

 

মাসদুয়েক আগে থেকেই বড়দের চালচলন, নিজেদের মধ‍্যে নীচুস্বরের আলোচনা কথাবার্তা, যেমনতেমন করে রান্নাবান্না শেষ করা, এগুলোতে জীবনের সবকিছু ভালোভাবে না চলার একটা অস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। তবে সেই ইঙ্গিতের কেন্দ্র যে ঐ সকালেই একবারে সমূলে শেষ হয়ে যাবে এটা ওর পক্ষে ধারণা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। স্বাভাবিকভাবেই, ঘটনার আকস্মিকতায় অরুণ অত‍্যন্ত বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। আবার সেই বিহ্বলতা সহনীয় হয়ে ওঠার আগেই, মাত্র মাসদেড়েকের মধ্যে, ঘটে যাওয়া আরেকটি ঘটনা ওকে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে দেয়। অরুণকে একটা রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে ভর্তি করে সেখানকার হষ্টেলে রেখে দিয়ে আসা হয়েছিল স্কুলের একটা বছর নষ্ট হওয়া আটকাতে।

 

অপ্রত্যাশিত ঘটনা বা দুর্ঘটনাদুটির চাপ অরুণের বারো বছরের মস্তিষ্কের পক্ষে সামলানো দুরূহ ছিল; সামলাতে পারেওনি। অবশেষে বোধহয় অবচেতনভাবেই, বিভ্রান্তি, বিদ্ধস্ততা এবং বিহ্বলতায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাওয়া পর্যুদস্ত অরুণ স্রেফ নিজের জন‍্য একেবারে আলাদা একটা পৃথিবী তৈরি করে নেয়। অরুণের দ্বিতীয় পৃথিবী। নিজের তৈরি সেই পৃথিবীর সে ছিল একমাত্র বাসিন্দা, ঠিক গুটিপোকার গুটির মতন!

 

অরুণের প্রথম পৃথিবী মানুষকে নিজের হাতের তেলোয় রেখে গড়ে উঠতে শেখায়, ভেসে থাকতে শেখায়। সেই পৃথিবীতে অরুণও এতদিন ভাসতে ভাসতে গড়ে উঠছিল আর পাঁচজন সমবয়সী ছেলেমেয়েদের মতো, নিয়মিত এক মধ‍্যবিত্ত সংসারে। সেখানে যা যা থাকার সবই ছিল। সুযোগমতো ফাঁকি দেওয়া পড়াশোনা ছিল, অল্পস্বল্প চিটিং করা খেলাধুলো ছিল, ভোরবেলা জোর করে ঘুম থেকে ওঠার অত‍্যাচার ছিল, ভাইবোনদের মধ‍্যে ঝগড়াঝাঁটি, বন্ধুদের সঙ্গে বল নিয়ে মন কষাকষি, ভাইফোঁটাগুলোর সকালে ঠাণ্ডা জলে গোমরা মুখে প্রতিবাদি চান্, মাঝেমধ‍্যে চরিত্রশুদ্ধির জন্য দু’চারটে বকুনি বা চড় থাপ্পড়, হারমোনিয়মে অনিচ্ছের রেওয়াজ, প্রথম পাতের উচ্ছে জল দিয়ে গিলে ফেলা, অঙ্কে একশতে একশ পাবার চাপ, এইরকম সবকিছু ছিল এবং এসবের বাইরেও আরও কতকিছু!

 

সেই সপ্তাহছয়েকের মধ্যে তৈরি হয়ে যাওয়া নিজের নতুন পৃথিবীতে ঢুকে অরুণ প্রথমেই ঠিক করে নিয়েছিল সে তার নিজস্ব কোনো ব‍্যাপারে অন‍্য কারুর কাছে দায়বদ্ধ থাকবে না। পড়াশোনা, মেলামেশা, খেলাধুলো, বইপড়া সব যে পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছিল তা ঠিক বলা যাবেনা, তবে এটা বলা যায় যে মোটামুটি একরকম গা-ছাড়া ভাবে ঠেকা দিয়ে সবগুলোই কোনোমতে চালিয়ে যাচ্ছিল। পরিবার নামের গাছটিতে বাজ আগেই পড়ে গেছে, একসঙ্গে বেড়ে ওঠা প্রথম পৃথিবীর  বন্ধুরা অতীতে মিলিয়ে গেছে, এখনকার নতুন বন্ধুরা তার বন্ধু নয়, পরিচিতমাত্র, নতুন শিক্ষকরা অন‍্য গ্রহের মানুষ। এসবক্ষেত্রে যা অবশ‍্যম্ভাবী তাই হয়েছিল। হায়ারসেকেণ্ডারি পরীক্ষার মাস তিনেক আগের এক সন্ধ‍্যেয় হেডমাষ্টারমশায় অরুণ এবং আরও তিনচারজনকে নিজের অফিসে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। অনেকক্ষণ ধরে অনেককিছু বুঝিয়েছিলেন, বলেছিলেন। তাঁর বক্তব‍্যের সারকথা ছিল শেষ চেষ্টা হিসেবে মাস দুয়েক স্পেশাল টিউশন দিয়ে যদি দেখা যায় বিশেষকিছু হবার নেই, তাহলে সেবছরের জন‍্য এদের সবাইকে হোল্ডআপে রাখা হবে; অর্থাৎ সেবছর নয়, একবছর পর আবার পরীক্ষায় বসানোর আর একবার চেষ্টা করার কথা ভাবা হবে। যেকোনো ছাত্রের এইধরণের  কথোপকথন একটা রক্ত জল করা পরিস্থিতি। অরুণ কিন্তু ছিল সম্পূর্ণ নিষ্পৃহ, নির্বিকার, নিরুদ্বিগ্ন; ‘যা হবার হবে’ গোছের একটা মনোভাব। কারণ ও জানত যে চারবছরের অচেষ্টিত কাজ কোনভাবেই দুমাসে শেষ করা যায়না। যাইহোক, শেষপর্যন্ত অরুণদের সবাইকে সেবার পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়েছিল এবং সবাই পাশ করেছিল। অরুণও পাশ করেছিল। খুব ভালোভাবে তো নয়ই, তবে খুব যে একটা খারাপভাবে তাও কিন্তু নয়। অরুণের রেজাল্ট দেখে ক্লাসের ছাত্র, শিক্ষকরা একটু অবাকই হয়েছিল।

 

রেজাল্ট হাতে পেয়ে অরুণ নিজেও বেশ অবাক হযেছিল, আবার একটু ভালোও লেগেছিল। পাঁচবছরে এই প্রথম নিজেকে একটু ভালো লাগা! তিনটি উপলব্ধি হয়েছিল ওর। প্রথমটি হল, শূন‍্য চেষ্টাতে দেওয়া পরীক্ষার রেজাল্ট একেবারে ফেলে দেবার মতো খুব খারাপ না হওয়া। দ্বিতীয় ছিল, নিজের পৃথিবীতে ততদিনে এসে যাওয়া এবং একটু একটু করে কুড়েকুড়ে খাওয়া উদ্দেশ‍্যহীন দৈনন্দিন একঘেয়েমিতা, যেখানে সে সামনে পেছনে ডাঁয়ে বাঁয়ে কোনদিকে না এগোতে পারছিল না পিছোতে পারছিল, এক জায়গায় ভেসে ছিল মাত্র। ওর বতর্মান অবস্থান এবং অবস্থা অনেকটা জাহাজের মাস্তুলে আটকানো ফ্ল‍্যাগের মতন, হাওয়া না থাকলে উৎসাহও নেই, উদ্দীপনাও নেই। তৃতীয়টি হল, বছর চারেক আগের ছেড়ে আসা পুরনো পৃথিবীর সামান্য হলেও কিছুটা গন্ধ এখনো ওর মজ্জায় মিশে থাকা।

 

দ্বিতীয় অঙ্ক

 

ফার্স্ট ইয়ারের শেষের দিকে একদিন একটি অফ্ পিরিয়ডে অরুণরা সবাই মিলে ক্লাসের বাইরে বসে গল্পগুজব করছিল। একটুপরে অন‍্যান‍্য সাবজেক্টের দুতিনজন ছাত্রছাত্রী ঐ মজলিসে যোগ দেয়। অরুণ এদের চিনত না। আলাপ হলে নাম, সাবজেক্ট এসব জানতে পারে। ওদের মধ‍্যে একজন ছিল রাকা। ঐ নাম বা শব্দ কোনটাই ও আগে শোনেনি। পরে জেনে নিয়েছিল রাকার অর্থ পূর্ণিমার চাঁদের আলো। অর্থ জানার পরে নামটা ভালো লেগেছিল। কে জানে, পূর্ণিমার সেই আলোয় আমাদের অরুণ হয়ত একদিন তার গুটি কেটে প্রজাপতি হয়ে বেরিয়ে আসবে!

 

কলেজের দিনগুলো অরুণের কেটে যাচ্ছিল কলেজের দিনের মতো করে। চায়ের দোকানে গল্পগুজব, সিনেমা, স্টুডেণ্ট ইউনিয়নের ইলেকশন, ছুটির দিনে সাইকেল নিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হারিয়ে যাওয়া, হষ্টেলের রাইভাল গ্রুপের সঙ্গে নানা ব্যাপারে টেনশন ইত‍্যাদি ইত‍্যাদি। এসবের বাইরে, কখনো কদাচিৎ খুব দরকার পড়লে অথবা গল্পগুজব একঘেয়ে লাগলে সামান্য একটু পড়াশোনা। মাঝেমাঝে এইসব আড্ডায় রাকার সঙ্গে দেখা হয়ে যেত, গল্পটল্প হতো। কোনদিন আবার লাইব্রেরীতে গিয়ে দুজনে এক টেবিলে বসে  পড়াশোনা করার অনর্থক চেষ্টা করতো। রাকার সঙ্গে এইরকম মাঝেসাঝে দেখা হওয়া বা সময় কাটানো অরুণের ভালো লাগত।

 

এরকমভাবে চলতে চলতে প্রথম পৃথিবীর  কয়েকটা জিনিস অরুণের অজান্তেই অরুণের জীবনে নিঃশব্দে ফিরে আসতে শুরু করেছিল। যেমন, নিয়মকরে মাসে একটার বদলে প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে একটা করে চিঠি লেখা, লাইব্রেরি থেকে ঝুড়িঝুড়ি বই এনে গোগ্রাসে পড়ে ফেলা, বিকেলে খেলতে যাওয়া, লেকচার টপিকের ওপর ক্লাসে প্রশ্ন করা, অসুস্থ বন্ধুর দেখাশোনা করা, বন্ধুদের বন্ধু হিসেবে দেখা। অন‍্যদিকে, ডিপার্টমেন্টে ভালো ছাত্রছাত্রীদের একজন হিসেবে অরুণের নাম স্টাফরুমের আলোচনায় আসছিল। জুনিয়রদের কেউ কেউ তার কাছে নোটস্ চাইতে শুরু করেছিল। ঐসময়টাতে অরুণ নামের গুটিপোকার গুটি প্রায় কেটে গেছে। প্রজাপতি শুধু তার ডানা শুকনোর অপেক্ষায়।

 

বেশিরভাগ সন্ধ‍্যেগুলো রাকার সঙ্গে গল্প করে কেটে যেত। মাঝেম‍ধ‍্যে দুজনে একসঙ্গে সিনেমা যেত। কারণে অকারণে কখনোসখনো একটুআধটু মন কষাকষি হতো। কথন কূজনে ভরপুর ঐ সন্ধ‍্যেগুলোয় নানাধরণের গল্প হতো। বেশিরভাগ হতো অতীত আর বর্তমানের গল্প। বাড়ির গল্প, বাড়ির লোকজনের গল্প, ছেড়ে আসা বন্ধুদের গল্প, বহু আগের সেই পরীক্ষা না দিতে পারা স্কুলের গল্প, এখনকার গল্প। তবে অরুণের একটা চাপা অস্বস্তি ছিল ওর নিজের তৈরি দ্বিতীয় পৃথিবীর সবরকম অনুভব, অভিজ্ঞতা রাকাকে শোনাতে। আপত্তি ঠিক নয়, শুধু কোথায় যেন একটা চাপা অস্বস্তি। রাকা সেটা বুঝতে পারত। তবে কোনদিন জোর করত না সেসব শোনার জন‍্য। অরুণ নিজে থেকে যতটুকু বলত সেটুকুই সে শুনত। নিজস্ব ব‍্যাপারে রাকা ছিল অনেক বেশি খোলামেলা। তার নিজের বাড়ি অথবা চেনাপরিচিতদের সম্বন্ধে অরুণের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে অসুবিধা হতো না। দুজনের কাছে এই সন্ধ‍্যেগুলো খুব নিজস্ব ছিল। ছুটিছাটায় বাড়ি গেলে দিনের এই সময়টা অরুণ মিস করতো। হতে পারে, ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ঐ সন্ধ‍্যেগুলোর ওপর ও ভরসা রাখতে শুরু করেছিল।

 

তৃতীয় অঙ্ক

 

রাকা-অরুণদের প্রজন্মে পড়ুয়া ছেলেদের বান্ধবীকে বান্ধবী বলা হতো না, প্রেমিকা বলা হতো। একইভাবে পড়ুয়া মেয়েদেরও ছেলেবন্ধু হতো না, প্রেমিক হতো। সেই সূত্র ধরে কলেজে অরুণ আর রাকার পরিচিতি ছিল প্রেমিক প্রেমিকা হিসেবে। অন‍্যদের দেওয়া সেই পরিচিতি ঠিক ছিল নাকি ছিলনা তা নিয়ে তর্কের কোনো অবকাশ ছিল না। যাইহোক, পরিচিতি যে নামেরই হোক, সেই বছরচারেকের সান্নিধ্যে দুজনের কেউ কিন্তু একে অপরের কাছে একবারের জন‍্যও নিজেদের মধ্যেকার সম্পর্কের ভবিষ্যত নিয়ে মুখ খোলেনি। মনে হতো যেন দুজনেই অত‍্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। আবার এটাও হতে পারে যে দুজনের কেউই নিজেদের ভেতর কোনো সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা হয়তো ভাবেইনি। অন‍্যদের এইরকম মনে হওয়াটা হয়তো ঠিক, হয়তো বা বেঠিক। তবে, এখন সেসব কথা থাক্। পঞ্চাশ ষাট বছর পরে ওদের দুজনের তখনকার ভাবনাচিন্তার কারণ খুঁজতে যাওয়া সম্পূর্ণ অর্থহীন।

 

অবশেষে একদিন, পাঁচ বছর আগের মাঝসমুদ্রে ভেসে থাকা দিশাহীন সেই অরুণ, ইউনিভার্সিটির শেষ পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করে, তার নিজের হাতে তৈরি দ্বিতীয় পৃথিবীর গুটি কেটে, প্রজাপতি হয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। সাথী হিসেবে সঙ্গে পেয়েছিল ছেড়ে আসা দুটো পৃথিবীর অভিজ্ঞতা। সবার ওপরে ছিল রাকার সঙ্গে কাটানো এতদিনের সব সন্ধ্যেগুলো থেকে জমিয়ে রাখা অফুরন্ত এক কায়াহীন ভরসা, আর নিঃশব্দ কথন ও কূজন। সামনে ছিল নতুন তৃতীয় পৃথিবী তৈরির হাতছানি।

 

**********

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *