একদিন চলিয়া যাব – হুমায়ূন আহমেদ

একদিন চলিয়া যাব – হুমায়ূন আহমেদ

আমার বড় মামা খুব অসুস্থ। মৃত্যুশয্যা পেতেছেন। তিনি শেষবারের মত তার সব প্রিয়জনদের দেখতে চান, এই খবর পেয়ে আমি ছুটে গেলাম নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। মামার সঙ্গে দেখা হল না। আমি পৌঁছলাম বিকেলে, তিনি মারা গেলেন সেইদিন সকালে। মৃত্যুশোকে পাথর হয়ে আছে আমার নানার বাড়ি। গিজ গিজ করছে মানুষ। মেয়েরা সুর করে কাঁদছে। মাদ্রাসার তালেবুল এলেমরা চলে এসেছে–তার কোরান পাঠ শুরু করেছে।


আমি প্রচণ্ড শোকেও চাপা এক উৎসবের ছোঁয়া পেলাম। বড় কোন উৎসবের। আগে যে উত্তেজনা থাকে, যে ব্যস্ততা থাকে–এখানেও তাই। মুরুব্বিরা উঠোনে গোল। হয়ে বসে আছেন। তারা গম্ভীর মুখে তামাক টানছেন। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাদের কাছ থেকে আসছে। মরা বাড়িতে তিনদিন কোন আগুন জ্বলবে না। খাবার আসবে বাইরে থেকে। এই খাবারের নাম তোলা খাবার। কোন কোন বাড়ি থেকে এই খাবার আসবে। তার তালিকা প্রস্তুত করতে হবে।


তোলা খাবার সবাই পাঠাতে চায়। কিন্তু সবার খাবার। নেয়া যাবে না। সামাজিক মানমর্যাদার ব্যাপার আছে। এ খান সাহেবের বাড়ি থেকে একবেলা তোলা খাবার পাঠানোর প্রস্তাব এসেছে। এই প্রস্তাবে সবাই বিব্রত। এই প্রস্তাব গ্রহণ করা যাচ্ছে না, আবার তাদের না বলাও যাচ্ছে না। তারা ক্ষমতাশালী। এই ভয়াবহ (!) সমস্যার সমাধান বের করার জন্যে মুরুব্বিরা। নিচু গলায় ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছেন। তামাক পুড়ছে প্রচুর।

মুরুব্বিদের দ্বিতীয়দল (এরা অনেক বয়স্ক। এদের কেউ কেউ অথর্ব পর্যায়ে চলে গেছেন। চলচ্ছক্তি নেই, চোখে দেখেন না–এমন ) অন্য সমস্যা নিয়ে বসেছেন–কে গোসল দেয়াবে? মড়ার গায়ে এক বালতি পানি ঢেলে দিলে তো হবে না। জটিল নিয়ম কানুন আছে। সবাই এইসব নিয়ম জানে না। যে জানে তাঁকে দিয়ে গোসল দেয়ানো যাবে না, কারণ সে শরাব খায়–এরকম গুজব সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে। মুরুব্বিদের একজন বললেন, আচ্ছা ফজলু কি মৃত্যুর আগে কিছু বলেছে–কে তারে। গোসল দিব? বা কবর কোনখানে হবে?

…………না, বলে নাই।

বলে গেলে কাজকর্মের সুবিধা হয়। বলে যাওয়া উচিত।

…….এ মৃতের উপর রাগ করা যায় না, তবে মৃতের বোকামির জন্যে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হওয়া। যায়।……ভেতর বাড়ি থেকে মেয়ের চিৎকার করে কাঁদছে। এত উঁচু স্বরে বিলাপ শরিয়তে নিষেধ করা হয়েছে। তাদেরকে গলা নিচু করতে বলা হল। তালেবুল এলেমরা কোরান শরীফ এত মাধা গলায় পড়ছে কেন? গলায় জোর নাই? তাদের মৃদু ধমক দেয়া হল।


আত্মীয়স্বজন সবাই কি খবর পেয়েছে? ভুলক্রমে কাউকে খবর না দেয়া হলে বিরাট জটিলতা হবে। যাদের খবর দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে কারা কারা উপস্থিত হয়েছে? সবাই উপস্থিত না হলে জানাজার সময় ঠিক করা যাবে না।

কবর দিতে দিতে হবে আসরে নামাজের পর পর। দেরি করা যাবে না। কবর দিতে দিতে মাগরেবের নামাজের সময় হয়ে যাবে। মসজিদে মাগরেবের নামাজ আদায়। করে গোরযাত্রীরা ঘরে ফিরবে।

কবরের জায়গা কি ঠিক হয়েছে?


…….হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে। বাড়ির পেছনে। গোরস্থানে কবর হলে মেয়েছেলেরা যেতে পারে না। মৃত ছেলের মা ছেলের কবর ঘরের পাশে চাচ্ছেন, যাতে তিনি যখন-তখন যেতে পারেন।

মসজিদের লাগোয়া গোরস্থানে কবর হলেই ভাল হত। তবু মার ইচ্ছাই বড়। বাড়ির পেছনে কবর খননের অনুমতি দেয়া হল। তখনই আসল সমস্যা দেখা দিল। যে কবর খুড়বে সে নেই। সে গিয়েছে শম্ভুগঞ্জ, তার মেয়ের বাড়ি। কি সর্বনাশ। শম্ভুগঞ্জ থেকে তাকে ধরে আনার জন্যে তৎক্ষণাৎ লোক ছুটল। মনে হচ্ছে বাদ আছর কবর হবে না। বিলম্ব হবে। উপায় কি? আল্লা আল্লা করে ঐ লোককে পাওয়া গেলে হয়।

আমি ভেবে পেলাম না, মোহনগঞ্জের মত এত বড় একটা জায়গায় কবর খোড়ার কি একজনই মানুষ? আমার অজ্ঞতায় সবাই মজা পেলেন। আমাকে জানানো হল, জালাল উদ্দিন কবর খোড়ার ব্যাপারে অঞ্চল-বিখ্যাত। তার মত সুন্দর করে কেউ কবর খুঁড়তে পারে না। তাকে না পাওয়া গেলে এক কথা। পাওয়ার সম্ভাবনা যখন আছে চেষ্টা করা যাক।

আমি নিচু গলায় বললাম, কবর খোঁড়ার মধ্যে সুন্দর-অসুন্দর কি আছে?

…………আমার নির্বুদ্ধিতায় আবারো সবাই বিরক্ত হলেন।

………….মানুষের আসল বাড়ি কবর। সেই বাড়িটা সুন্দর করে বানাতে হবে না? দালানকোঠা সুন্দর করে বানিয়ে ফয়দা কি?

জালাল উদ্দিন এসে পৌঁছলেন রাত দশটায়। রোগা পাতলা মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ। পানের ব্যবসা করেন। তুচ্ছ ধরনের ব্যবসা। কেউ তাকে পোছে না। কিন্তু কারো মৃত্যু হলে সবাই তার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। জালাল উদ্দিনকে লাগবে। যেখান থেকে পার তাকে ধরে আন।


তিনটা হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে কবর খোড়া শুরু হল। আমি গভীর আগ্রহে কবর খোড়া দেখছি। জালাল উদ্দিন মাটি কুপিয়ে কুপিয়ে তুলছেন। মনে হচ্ছে কাজটায় তিনি আনন্দ পাচ্ছেন। এক সময় মুখ তুলে হাসিমুখে বললেন, ফজলুর ভাগ্য ভাল। মাটি ভাল পাইছি। সচরাচর এমন ভাল মাটি পাওয়া যায় না।

মেয়েদের মধ্যে কে যেন এদিকে এসে পড়ল। তাকে প্রচণ্ড ধমক দেয়া হল। মেয়েদের কবর খোঁড়া দেখতে নেই। এটা পুরুষদের কাজ। কবর খোঁড়া শেষ হল রাত একটায়। জালাল উদ্দিন তার কাজ শেষ করে উঠে পড়লেন। হ্যাজাকের আলো ফেলা হল কবরে। আমি স্বীকার করতে বাধ্য হলাম–এটা সামান্য গর্তবিশেষ নয়। এ এক শিল্পকর্ম। পৃথিবীর অন্যান্য শিল্পকর্মের মত এই শিল্পকর্মের দিকেও মুগ্ধ হয়ে তাকানো যেতে পারে।


ভিড়ের মধ্য থেকে একজন বলল, ফজলুর ভাগ্য আসলেই ভাল। কবরটা যেন। হাসতেছে।

……….আমি বললাম, আমি একটু কবরে নেমে দেখতে চাই।

…….কেউ কোন আপত্তি করল না। শুধু বলা হল যেন অজু করে নামা হয়। আমি অজু করে কবরে নেমেছি। আমার চারদিকে মাটির দেয়াল। যারা উপরে আছে তাদের কথা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি না। হঠাৎ আমার মনে হল–আমাকে যেন আলাদা করে ফেলা হয়েছে–এই পৃথিবী, এই অনন্ত নক্ষত্রবীথির সঙ্গে আর আমার কোন যোগ নেই।

জীবনে কোন বড় ধরনের অতিপ্রাকৃত অনুভূতির মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। সেই মধ্যরাত্রের বিচিত্র অভিজ্ঞতাই প্রথম এবং এ পর্যন্ত শেষ। অভিজ্ঞতা।


Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *