করোনা ভ্যাকসিনের দ্বারপ্রান্তে বিশ্ব
নভেল করোনাভাইরাস বা SARS-CoV-2 ভাইরাসের তাণ্ডবে আজ পুরো বিশ্ব বিপর্যস্ত । এ মহামারি থেকে মানবজাতিকে বাঁচাতে পারে কার্যকর ভ্যাকসিন । ভ্যাকসিন তৈরির কাজে লেগে গেছে বহু দেশের বহু কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান । উদ্দেশ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের পর পৃথিবীর পৃথিবীর সামনে মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা, কোটি কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচানো । মানুষের হাতে ভ্যাকসিন পৌঁছে দিতে হবে অল্প সময়ের মধ্যেই । বিজ্ঞানীরা এমন আশাই দেখাচ্ছেন ।
আশা পূরণ হলে সেটি হবে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুততম সফল ভ্যাকসিন । ভেঙে দেবে ইবোলো ভ্যাকসিনের রেকর্ড, যেটা পেতে সময় লেগেছিল দীর্ঘ পাঁচ বছর । যেহেতু সময় অল্প, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরিতে বিজ্ঞানীরা আর আগের ভ্যাকসিন তৈরির পদ্ধতির ওপর ভরসা করতে পারছেন না । তারা বেছে নিচ্ছেন জিনভিত্তিক ভ্যাকসিন তৈরির পদ্ধতি । আর এর মাধ্যমেই করোনা ভ্যাকসিনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বিশ্ব।
অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন নিরাপদ ও কার্যকর
২০ জুলাই ২০২০ যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি AstraZeneca ‘র তৈরি COVID-19 ভ্যাকসিনের প্রথম ধাপের হিউম্যান ট্রায়ালের ফল প্রকাশিত হয় আন্তর্জাতিক মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেটে । এতে বলা হয়, ভ্যাকসিনটি মানবদেহে গুরুতর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখায়নি এবং শরীরে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরির পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম ।
ফলাফলে দেখা গেছে, পরীক্ষার ৫৬ দিন পর্যন্ত শক্তিশালী অ্যান্টিবডি উৎপাদন ও টি-সেল রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে । দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার পর এ ফল আরও বেশি হতে পারে ।
করোনার প্রথম ভ্যাকসিন রাশিয়ার
১১ আগষ্ট ২০২০ বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবহারপোযোগী একটি ভ্যাকসিনটি অনুমোদন দেয় রাশিয়া । স্থানীয়ভাবে তৈরি Sputnik-v নামের ভ্যাকসিনটি মানুষের ওপর পরীক্ষা করার পর এর ব্যবহারিক প্রয়োগের অনুমোদন দেয়া হয় । মানুষের ওপর দুই মাসেরও কম সময় পরীক্ষা চালানোর পর চূড়ান্ত পরীক্ষার আগেই অনুমোদন লাভ করে এ রুশ ভ্যাকসিন ।
অনুমোদন পাওয়ার পর ভ্যাকসিনটি নিবন্ধন করা হয় এবং এর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর পথ সুগম হয় । রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে Sputnik-v ভ্যাকসিনটি তৈরি করে গামালিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলজি অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজি । এর প্রাথমিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয় ১৮ জুন ২০২০ । প্রথম পর্যায়ের হিউম্যান ট্রায়ালের পর রাশিয়া জানায়, এ ভ্যাকসিন মানুষের শরীরে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে ।
এরপর দুই দফায় ভ্যাকসিনটির ট্রায়াল হয় । দুটি দলে ভাগ করে ভিন্ন ডোজে ভ্যাকসিন দেয়া হয় প্রাপ্তবয়স্ক স্বেচ্ছাসেবকদের । তারপর সরকারি হাসপাতালে তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয় । রাশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, প্রথম দলের সবার শরীরেই ভাইরাস মোকাবিলায় প্রতিরোধ ক্ষমতা সক্রিয় হয়েছে । কারো শরীরে টিকার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই । এ দলের স্বেচ্ছাসেবকদের ১৫ জুলাই ২০২০ হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হয় । দ্বিতীয় দলকে ছাড়া হয় ২০ জুলাই ২০২০ ।
কোনো ভ্যাকসিন চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার আগে বড়সংখ্যক রোগীর ওপর এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালাতে হয়, যাকে বলে তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল । কিন্তুু সেই ধাপের আগেই রাশিয়া সরকার গামালিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ঐ ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়ে দেয় । তৃতীয় ধাপের চূড়ান্ত পরীক্ষার আগেই রাশিয়া তাড়াহুড়ো করে এ ভ্যাকসিন অনুমোদন দেয়ায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠেছে । আপত্তির মুখেই রাশিয়ার তৈরি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের প্রথম ব্যাচের উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয় বলে ১৫ আগষ্ট ২০২০ নিশ্চিত করে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ।
চীনা ভ্যাকসিনের সফলতা ও অনুমোদন
২০ জুলাই ২০২০ আন্তর্জাতিক মেডিক্যাল জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশিত হয় চীনের Cansino Biologics‘র তৈরি AD5-nCov ভ্যাকসিনের গবেষণা প্রতিবেদন । সেখানে বলা হয়, পাঁচ শতাধিক স্বেচ্ছাসেবককে দুটি দলে ভাগ করে ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করা হয় । এ ভ্যাকসিন মানবদেহের ফ্লু জাতীয় দুর্বল একটি ভাইরাস দিয়ে তৈরি করা হয়েছে । ১১ আগষ্ট ২০২০ এ ভ্যাকসিনের পেটেন্টের অনুমোদন লাভ করে Cansino Biologics । এটা চীনে অনুমোদন লাভ করা COVID-19 ভ্যাকসিনের প্রথম পেটেন্টে ।
১৪ আগষ্ট ২০২০ চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি Sonopham জানায়, কি্যনিক্যাল ট্রায়ালের প্রথম দুই ধাপে তাদের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন অ্যান্টিবডি তৈরি করছে । এ সংক্রান্ত নিবন্ধ প্রকাশিত হয় জার্নাল অব দ্য আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনে । পরে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরু হয় Sonopham ’র এ ভ্যাকসিনের ।
Sonopham ’র ভ্যাকসিনটি ২০২০ সালের শেষ নাগাদ খুচরা বিক্রির জন্য বাজারে আসবে । এর দাম হবে ১,০০০ ইয়েন বা ১৪০ মার্কিন ডলার । ২৮ দিনের ব্যবধানে দুই ধাপে ভ্যাকসিনটি দেয়া হবে ।
১৭ আগষ্ট ২০২০ চীন COVID-19 ’র ভ্যাকসিন অনুমোদন দেয়, যা তৈরি করে দেশটির পিপলস লিবারেশন আর্মির (PLA) সংক্রামণ রোগ বিশেজ্ঞ চেন ওয়েইব দল। ভ্যাকসিনটির দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় দেখা গেছে, এটি নিরাপদ ও প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম ।
অন্যান্য ভ্যাকসিন
১. দ্বিতীয় ধাপের সফলতার পর ২৭ জুলাই ২০২০ করোনা ভ্যাকসিন mRNA-1273’র তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরু করে মার্কিন ফার্মা জায়ান্ট moderna । ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অবহেলথের তত্ত্বাবধানে ৩৬,০০০ জনকে ভ্যাকসিন দেয়ার বৃহত্তর কর্মসূচি নেয় তারা । যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি Pfizer’র জার্মান প্রতিষ্ঠান BioNTech‘র সাথে হাত মিলিয়ে ,Moderna‘র মতোই RNA টেকনোলজিতে একটি ভ্যাকসিন তৈরি করেছে, যার নাম BNT162b1 । টিকাটিতে প্রথম পর্যায়ের ট্রায়ালের সাফল্যও মিলেছে । এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বের ট্রায়াল শুরু করেছে তারা । খুব দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে করোনা ভ্যাকসিনের গবেষণা । আশা করা যায়, শীঘ্রই আমরা বের হয়ে আসতে পারবো এ মহামারি থেকে ।
ভ্যাকসিনে বিদায় নেয়া রোগ
ভ্যাকসিন বা টিকার মাধ্যমে যেকোনো রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় মানব শরীরে । এজন্য যেকোনো সংক্রামক রোগের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে টিকা বা ভ্যাকসিনের গুরুত্ব অপরিসীম । এ মুহূর্তে অন্তত কয়েক ডজন রোগের টিকা চালু আছে পৃথিবীতে । ভিন্ন ভিন্ন রোগ প্রতিরোধে দেয়া হচ্ছে এসব ভ্যাকসিন । কিন্তুু এসব রোগ পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হয়নি । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ( ) বলছে, টিকা দেয়ার কারণে প্রতি বছর বিশ্বে ২০-৩০ লক্ষ শিশুর প্রাণরক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ছয়টি মহাদেশীয় অঞ্চলে মধ্যে অন্তত চারটিতে যদি কোনো রোগে এক দশক সময়ের মধ্যে কেউ আক্রান্ত না হন, তাহলে ধরে নেয় হয়, সেই রোগটি দূর হয়েছে । গেল দুেই শতাব্দীতে টিকার মাধ্যমে পৃথিবী থেকে রোগ নিমূর্ল হয়েছে মাত্র দু’টি গুটি বসন্ত ও রাইন্ডরপেস্ট ।