সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র প্রথম খন্ড এর অংশ -১৪

ঘরের ভিতরে একধারে তক্তপােশের ওপর ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা গদি আর কয়েকটা তাকিয়া। কয়েকটা আলমারিতে আইনের বইপত্র ঠাসা। ঘরের অন্য অংশে অফিস ধরনের টেবিল চেয়ার পাতা। আমাদের গদি দেখিয়ে বসতে বললেন অলকবাবু। নিজে একটা চেয়ার টেনে সামনে বসলেন। মুখে অমায়িক হাসি। কর্নেল তাঁর নেমকার্ড দিলে চশমার কাছে ধরে খুঁটিয়ে পড়ে বললেন, কর্নেল নিলাদ্রি সরকার? আপনি কর্নেল?

কর্নেল সমগ্র ১ম খণ্ড

‘রিটায়ার্ড। ‘, তা নেচারিস্ট মানে? 

‘প্রকৃতিচর্চা করি। – অলকবাবু সকৌতুকে হাসলেন। কিন্তু আমি তাে আইনচর্চা করি কর্নেলসায়েব। প্রকৃতির সঙ্গে আইনের সম্পর্ক তত থাকার কথা নয়। 

‘এক্ষেত্রে আছে। কর্নেলও কৌতুকের ভঙ্গিতে বললেন। রাঙাটুলি প্রকৃতির স্বর্গ। কাজেই 

অলকবাবু চমকে উঠলেন। রাঙাটুলি ? রাঙাটুলির চৌধুরীবাড়িতে আমার জানাশােনা ছিল। বটুক চৌধুরী এম এল এ ছিলেন। ওঁদের ফ্যামিলির অনেক কেস আমি লড়েছি। বটুকবাবুর ছেলে রথীন খুন হয়েছিল। খামােকা রথীনের বউকে অ্যারেস্ট করল পুলিশ। রথীনের বউ আবার আমার আরেক মক্কেল হরনাথ সিংহের মাসতুতাে ভাই অজয়ের মেয়ে।‘চন্দ্রিকা রায়

‘চেনেন নাকি?’ অলকবাবু আরও অবাক হয়ে গেলেন। ব্যাপারটা খুলে বললে ভাল হয়। 

বটুকবাবুর ভগ্নীপতি অমরেন্দ্র সিংহরায় আমার বন্ধু। সেই সূত্রে চন্দ্রিকাকে চিনি। 

‘অ। কিন্তু চন্দ্রিকা তাে নিখোঁজ হয়ে গেছে ক’বছর আগে। 

‘জানি। আমি ওর বাবা অজয়বাবুর সম্পর্কে জানতে চাই। | ‘অজয় তাে কবে মরে গেছে। অজয়ের স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে হরনাথের কাছে উঠেছিল। হরনাথই ভুলটা করেছিল। রথীন হারামজাদার হারামজাদা। জেনেশুনে মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিয়েছিল। তাে আপনি অজয় সম্পর্কে জানতে চান। অমরেন্দ্রর কাছে আমার চেয়ে ভাল জানতে পারবেন। 

কর্নেল সমগ্র প্রথম খন্ড এর অংশ -১৪

‘আপনি বলুন, প্লিজ! 

অলকবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, বুঝেছি। আপনি মিলিটারিতে ছিলেন। কাজেই অজয় সম্পর্কে আপনার আগ্রহের কোনও কারণ আছে। কিন্তু সে তাে সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ব্যাপার। নতুন করে এতবছর পরে ফাইল খুলল কে? 

কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন, ‘সি বি আই।  ‘। তা-ই বলুন। আপনারা সি বি আই অফিসার। দেখুন কর্নেলসায়েব, আমি একজন লইয়ার। কাজেই আই মাস্ট কোঅপারেট উইদ ইউ। অজয় সম্পর্কে আমি যেটুকু জানি, তা আমার মক্কেল হরনাথের সূত্রেই জানি। অজয় রাঙাটুলির মিলিটারি বেসে কন্ট্রাক্টর ছিল। পরে কী কারণে নাকি কন্ট্রাক্টারি যায়। জেল খাটতেও হয়েছিল।

শুনেছি জেলে থাকা অবস্থাতেই সে মারা পড়ে।‘অজয়বাবুর স্ত্রী বেঁচে আছেন কি? | নাহ্। সে কবেকার কথা। চন্দ্রিকা তখন বাচ্চা মেয়ে। এখন চন্দ্রিকার বয়স বােধ করি পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে। বেশিও হতে পারে।

‘হ্যাঁ। বেবিফেস যাকে বলে। বয়স বােঝা যায় না। কর্নেল একটু হেসে বললেন, চন্দ্রিকার হয়ে আপনি কলকাতায় মামলা লড়েছিলেন। তার মানে রথীনবাবু খুন হয়েছিলেন কলকাতায়?’ 

‘ঠিক বলেছেন। বেহালায় রথীন থাকত। শুনেছি, অমরবাবুর ছেলেও বেহালায় থাকত। পাশাপাশি বাড়িতে থাকত ওরা। তাে সি বি আইয়ের কেসটা কিসের কর্নেল সায়েব? 

‘অজয়বাবুকে ব্রিটিশ সরকার কী অপরাধে ফাঁসিয়েছিলেন, তা নিয়ে তদন্ত উঠেছে। ‘কার তদ্বিরে? বটুকবাবু তাে শুনেছি বেঁচে নেই। কে গভর্মেন্টকে চাপ দিল এতদিন পরে? 

কর্নেল সমগ্র প্রথম খন্ড এর অংশ -১৪

‘আমাদের জানার কথা নয়। আমরা শুধু অজয়বাবু সম্পর্কে তথ্য খুঁজে বেড়াচ্ছি। 

বুঝেছি। চিন্তিত মুখে অলকবাবু বললেন, “চন্দ্রিকাকে খুঁজে বের করুন। বাবার কথা সে-ই আমার চেয়ে ভাল বলতে পারবে। রথীনকে খুনের দায়ে তাকে খামােকা পুলিশ ফাঁসিয়েছিল। তারপর মেয়েটা রাতারাতি নিখোঁজ হয়ে গেল। 

‘আপনি সম্ভবত আর প্র্যাকটিস করেন না ? 

করি না। আমার ছেলে করে। আমি অবশ্য কনসাল্ট্যান্টের কাজকর্ম করি আজকাল। কোর্টে ছােটাছুটি আর এ বয়সে সম্ভব নয়। আপনাদের জন্য চা বলি? | ‘থ্যাংকস। কর্নেল হাত তুলে নিষেধ করলেন। বাই এনি চান্স, আজ কেউ চন্দ্রিকা প্রসঙ্গে আপনার কাছে কথা বলতে এসেছিল কি? 

অলকবাবু মাথা নাড়ালেন। না তাে! কেন? ‘যদি কেউ আসে, পাত্তা দেবেন না—আমার অনুরােধ। আই মিন, সি বি আইয়ের পক্ষ থেকে এটা রিকোয়েস্ট। 

না, না! কী বলছেন?’ অলকরা ব্যস্তভাবে বললেন, ‘পাত্তাই দেব না। ‘আমাদের কথাও যেন বলবেন না প্লিজ! 

কক্ষনাে না। নেভার! আই অ্যাম আ ল-অ্যাবাইডিং সিটিজেন অব দিস কাষ্ট্রি। তাছাড়া আমি লইয়ার। আই অ্যাসিওর ইউ কর্নেলসাহেব।.. 

ফেরার পথে বললাম, ‘বড় অভুত ব্যাপার। মনে হচ্ছে, এবার আপনি একটা মহাভারত রহস্যে হাবুডুবু খাবেন। অসংখ্য এপিসােড!। অসংখ্য ট্র্যাজেডি। কোনটার সঙ্গে কোনটার সম্পর্ক আছে, খুঁজে বের করাই কঠিন। কিন্তু শুরু সামান্য একটা পরগাছা থেকে। 

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, তুমি ঠিক ধরেছ। তােমাকে গতরাত্রে বলেছিলাম অর্কিডের একটা ফুল থেকে ৪৭ লক্ষ বীজকণিকা ছড়িয়ে যাওয়ার কথা। 

বিষাক্ত ব্যাকটেরিয়াসহ। ‘য়ু আর ড্যাম রাইট, ডার্লিং। 

সত্যি বস্! আমি কোনও খেই পাচ্ছি না। কর্নেল চুপ করে গেলেন। চোখ বন্ধ। দাঁতে কামড়ানাে চুরুট। সারা পথ আর মুখ খুললেন না। আমি মহাভারত রহস্য থেকে এবার দূরে সরে থাকার চেষ্টা করছিলাম। 

ভেবেছিলাম, কর্নেলকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে কেটে পড়ব। মাথা ঝিমঝিম করছে। কিন্তু কর্নেল আসতে দিলেন না। তেতলার অ্যাপার্টমেন্টে ডােরবেলের সুইচ টিপলে ষষ্ঠী দরজা খুলে দিল। তারপর চাপাস্বরে বলল, নালবাজারের নাহিড়িসায়েব এসে বসে আছেন বাবামশাই? 

বসে আছে! বলিস কী রে?’ “আজ্ঞে। কোফি করে দিয়েছি। খাচ্ছেন।

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র প্রথম খন্ড এর অংশ -১৫

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *