কহেন কবি কালিদাস পর্ব – ৫ হুমায়ূন আহমেদ

কহেন কবি কালিদাস পর্ব – ৫

আমরা দেখি নি। বাবা ডেডবিড নিয়ে একা গেছেন। তখন আমরা দুই বোনই অসুস্থ ছিলাম। ইথেনের ঠাণ্ডা লেগে নিউমোনিয়া হয়েছিল।তোমাদের মার দিকের কোনো আত্মীয়স্বজন কখনো তোমাদের বাড়িতে এসেছিলেন? বলো-না। কারণ এই প্রশ্নের উত্তরও না। আমি জানি।না।

এখন দুইয়ে দুইয়ে চার মিলালে কেমন হয়? আমি যদি বলি তোমাদের আদর্শ পিতা একটি হিন্দু মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। সেই হিন্দু মেয়ে তার ধর্ম ত্যাগ করে নি। কাজেই তাদের বিবাহ হয় নি। অর্থাৎ তোমরা দুই বোন জারজ সন্তান। হা হা হা।হাসবেন না।

হাসব না কেন? মজার ব্যাপার না? অতি ধাৰ্মিক বাবা দুই জারজ কন্যা নিয়ে ঘুরঘুর করছে! এর মধ্যে একজন আবার সন্তানসম্ভব। সেই সন্তানও একই জিনিস। জরিজে জারজে ধুল পরিমাণ। হা হা হা।লোকটা হাসছে। হাসির সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারা বদলে যাচ্ছে। গায়ের রঙ কালো হয়ে যাচ্ছে। দাঁত বের হয়ে আসছে। চুল হয়ে যাচ্ছে লালচে এবং লোকটার গা থেকে অদ্ভুত এক ধরনের গন্ধ আসতে শুরু করেছে। গন্ধটা পরিচিত। তবে আমি ধরতে পারছি না।

লোকটা বলল, তুমি কি কোনো গন্ধ পাচ্ছ? নিশ্চয়ই পাচ্ছি। তুমি ভাবছ গন্ধটা আমার শরীর থেকে আসছে। তা না, গন্ধ আসছে তুলসী গাছ থেকে। তুলসীর গন্ধ। তোমার মা। টবে তুলসী গাছ লাগিয়েছিলেন। হিন্দু মহিলার বাড়িতে তুলসী গাছ থাকবে না তা কি হয়? আচ্ছা তোমরা তুলসী গাছে ঠিকমতো জল দাও। পানি না বলে জল বলছি লক্ষ করছ?

হা হা হয়। মিথু তোমার সঙ্গে কথা বলে বড়ই আরাম পাচ্ছি। বোল হরি হরি বোল। মিথু শোন আমি এখন বিদায় হচ্ছি। আবার আসব। আসতেই থাকব। তোমার তোমার শিক্ষকের মতো পা দিয়ে ঘষাঘষি করব। ঠিক আছে লক্ষ্মী সোনা চাঁদের কণা।আমি বললাম, আমি যা দেখছি সবই স্বপ্ন। আপনি দূর হন।তুমি না বললেও দূর হয়ে যাব। দেহধারণ করে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। তবে তুমি যা দেখছি সবই স্বপ্ন এটা কিন্তু ঠিক না।

স্বপ্নে মানুষ গন্ধ পায় না। তুমি গন্ধ পেয়েছ। পবিত্র তুলসীর গন্ধ। সবই যদি স্বপ্ন হয় তা হলে গন্ধটা আসে কোত্থেকে! যাবার আগে একটা প্রশ্ন তোমার বোনের পেট খালাসের কী করেছ? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। ব্যবস্থা এখনই নেওয়া দরকার। তুমি বললে আমি নিজেও চেষ্টা নিতে পারি। ছাদ থেকে নিচে ফেলে দিতে পারি। তবে মানুষ মেরে আমি আনন্দ পাই না। মানুষ খেলিয়ে আরাম পাই।

মরে যাওয়া মানে শেষ। আর তাকে দিয়ে খেলানো যাবে না। যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিনই সে খেলবে। খেলা দেখব। আনন্দ পাব। আনন্দ পাব হাসব। হা হা হা।হাসির শব্দে আমার ঘুম ভাঙল। আমি বুঝলাম এতক্ষণ যা দেখেছি সবই স্বপ্ন। তবে পুরোপুরি স্বপ্নও বোধ হয় না। ঘরে তুলসীর গন্ধ। আমার মা বড় দুটা টবে তুলসী গাছ লাগিয়েছিলেন। গাছ দুটা খুব ভালো হয়েছে। ঝুপড়ির মতো হয়েছে।

এই ঘটনার ঠিক এক সপ্তাহ পরের ঘটনা, সেদিনও বৃহস্পতিবার। বাবা যথারীতি জিগিরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মাগরিবের নামাজ পড়ে চলে যাবেন ফিরবেন। পরদিন ফজরের নামাজের পর। সন্ধ্যা হয়—হয় করছে। ইথেন দুটা মগ হাতে আমার কাছে এসে বলল, আপা চল তো। আমি বললাম, কোথায়? ইথেন বলল, ছাদে। সন্ধ্যাকেল ছাদে বসে চ খেতে আমার ভালো লাগে। একা যেতে ভয়-ভয় লাগে তুইও চল।আমি বললাম, না।ইথেন বলল, তোকে যেতেই হবে।

ইথেন কিছু বলবে। আর তা করবে না তা কখনো হয় না। তার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। আমাকে ছাদে যেতে হল। আমাদের বাড়ির ছাদটা সুন্দর। মার বাগানের শখ ছিল। ছাদে বাগান করেছিলেন। বিশাল সাইজের টবে দেশী ফুল গাছ। কামিনী, গন্ধরাজ, বেলি। কয়েক রকমের বাগান বিলাসও আছে। এর মধ্যে একটার পাতা হালকা নীল রঙের। এই গাছটা নাকি তিনি আসামের শীলচর থেকে আনিয়েছিলেন।

ছাদের বাগান খুব সুন্দর লাগছিল। বাগান বিলাসের তিন চার রকম রঙ। বেলি ফুলের সিজন না বলে বেলি ফুল নেই। বেলি ফুল যখন ফুটত তখন মা প্রতিদিন সন্ধ্যায় ছাদের বাগানে বসে থাকত।আমরা দুই বোন বসে চা খাচ্ছি। ইথেনকে হাসিখুশি লাগছে। সে অবিশ্যি এমনিতেই হাসিখুশি তবে সেদিন তাকে অস্বাভাবিক উৎফুল্ল লাগছিল। সে বলল, আপা তোকে মজার একটা খবর দিতে পারি। দেব? আমি বললাম, না।

ইথেনের মজার খবর মানেই হল উদ্ভট কিছু যা শুনলে মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে। ইথেন বলল, তোকে আমি ছাদে নিয়ে এসেছি। মজার খবরটা দেওয়ার জন্য। খবরটা হল আমাদের মা ছিলেন হিন্দু ব্ৰাহ্মণ। মার নাম রমা গাঙ্গোপাধ্যায়।আমি বললাম, তোকে কে বলেছে?

ইথেন বলল, আমাকে কেউ কিছু বলে নি। আমি নিজেই মহিলা শার্লক হোমসের মতো বের করেছি। তালা ভেঙে পুরোনো ট্রাঙ্ক ঘাটাঘাঁটি করে অনেক কিছু পেয়েছি। বাবার হাতের লেখা দশটা চিঠি। সব চিঠির সম্বোধন-রমা। ইনিয়েবিনিয়ে লেখা ইষ্টিমিষ্টি চিঠি। বাবার লেখা প্রেমপত্র পড়ার মজাই অন্য রকম। আপা তুই পড়বি? আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।আমি বললাম, না।ইথেন বলল, পড়লে তোর ভালো লাগবে। একটু কড়া মিষ্টি। তোর বানানো চায়ের মতো বেশি মিষ্টি।আমি বললাম, ট্রাঙ্ক ঘেঁটে এইসব গোপন চিঠিপত্র বের করা কি ঠিক?

ইথেন বলল, ঠিক না। কিন্তু আমরা তো সব সময় ঠিক কাজটা করি না। মাঝে মধ্যে বেঠিক কাজ করি। তবে আপা তুই আমার দিকে এত কঠিন চোখে তাকাস না। এতক্ষণ তোর সঙ্গে মিথ্যা কথা বলেছি। আমি ট্রাঙ্কের তালা ভেঙে কোনো তথ্য বের করি নি। আমাকে যা বলার বলেছে। ইবলিশা শয়তান এবং আমার ধারণা ইবলিশের কথা ঠিক। আমরা এই বাড়িতে মোটামুটি সত্যবাদী একজন ইবলিশ পেয়েছি।ইবলিশ যে সত্যি কথা বলেছে তার প্রমাণ কী?

প্রমাণ বাবা স্বয়ং। আমি তাকে শক্ত করে ধরেছিলাম। তিনি খকখক করে কাশতে-কাশতে সব বলে দিয়েছেন। বাবা আসলে আমাকে ভয় পায়।তুই ভয় পাওয়ার মতোই মেয়ে।অবশ্যই। ইবলিশ নিজেও আমাকে ভয় পায়। আমাকে ডাকে ছোট আপা। হিহিহি।তোকে ছোট আপা ডাকে?

হুঁ। আমিও তাকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখি। গল্পগুজব করি। একটা মজার ব্যাপার জান আপঃ শয়তানের সব গল্প কিন্তু শিক্ষামূলক। ঈশপের গল্পের মতো। গল্পের শেষে মোরাল থাকে। শয়তানের একটা গল্প তোমাকে বলব স্বাপা? যদি মজা না পাও তা হলে আমি আমার নিজের নাম বদলে ফরমালডিহাইড রাখব। আপা ফরমালডিহাইডের ফর্মুলা HCHO না? আমি উঠে দাঁড়ালাম। ইথেন বলল, আপা চলে যাচ্ছিস? সন্ধ্যাটা মিলাক। সন্ধ্যা মিলাবার সময় একটা মজা হবে। মজাটা দেখে যা।কী মজা হবে?

মা ছাদের যে জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে নিচে লাফ দিয়ে পড়েছিল। আমি ঠিক সেই জায়গা থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ব। তোদের সমস্যার সমাধান করে দিয়ে যাব। আমার পেটের বাচ্চা নিয়ে তোদের চিন্তায় অস্থির হতে হবে না। আমি ইবলিশ ভাইজানের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করেছি। ভাইজান বলেছেন-ছোট আপা একটা  ভালো বুদ্ধি। হি হি হি।

ইথেনের সঙ্গে এই প্রসঙ্গে কথা বলার অর্থ হয় না। আজান পড়ে গেছে। আমি মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য নিচে নোমলাম। সবেমাত্র জায়নামাজে দাঁড়িয়েছি-ধূপ করে শব্দ হল। ইথেন ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ল।যেহেতু অস্বাভাবিক মৃত্যু ইথেনের সুরতহাল হয়েছিল। তার পেটে কোনো সন্তান ছিল না। পেটে সন্তানের পুরো বিষয়টাই ছিল তার বানানো।

আত্মজীবনীর তৃতীয় অধ্যায়

মৃত্যু ভয়াবহ একটি ব্যাপার। মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার কি আছে? অবশ্যই আছে। মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার আমি ঘটতে দেখলাম। ইথেন মারা গেল সন্ধ্যাবেলায়। রাত দশটায় পুলিশ এসে বাবাকে অ্যারেক্ট করে নিয়ে গেল। রমনা থানার ওসি জানালেন, থানায় এক মহিলা টেলিফোন করে জানিয়েছেন যে তিনি স্পষ্ট দেখেছেন ঘিয়া রঙের পাঞ্জাবি পরা দাড়িওয়ালা এক লোক ইথেনকে ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলেছে। আমাদের বাড়ির পাশের অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে তিনি থাকেন।

তিনি তার পরিচয় জানাতে চান না। এবং এই বিষয়ে আর কিছু বলতেও চান না। তিনি চান পুলিশ তদন্ত করে বিষয়টা বের করুক। মহিলার টেলিফোন কলের পরপরই পুলিশ একজন পুরুষ মানুষের কল পায়। তিনিও একই কথা বলেছেন।আমি ওসি সাহেবকে বললাম, ঘটনাটা যখন ঘটে তখন বাবা নামাজ পড়ছিলেন। আমিও একই ঘরে নামাজ পড়েছি। শব্দ শোনার পর দুজন একসঙ্গে ছুটে গেছি।ওসি সাহেব বললেন, আপনার কথা বুঝতে পারছি কিন্তু আমাদের তদন্ত করতেই হবে।

আমি বললাম, যে-মানুষটার মেয়ে মারা গেছে তাকে আপনি ধরে নিয়ে যাবেন। আজই নিতে হবে? দুই-একদিন পরে নিয়ে যান।আজই নিতে হবে। তদন্ত দ্রুত হতে হয়।ওসি সাহেবকে কিছু টাকা পয়সা দিলে কাজ হত। আমার মাথায় আসে নি। তারা বাবাকে নিয়ে গেল। শুধু যে বাবাকে নিয়ে গেল তা-না, ইথেনকে নিয়ে গেল। তার মৃত্যু অস্বাভাবিক। কাজেই পোষ্টমর্টেম করা হবে।

আমি এক বাসায় রইলাম। দুনিয়ার লোকজন ঘরে ঢুকছে। ঘর থেকে বের হচ্ছে। সবাই অপরিচিত। এর মধ্যে ক্যামের গলায় সাংবাদিকও আছে। সাংবাদিক ফ্ল্যাশ দিয়ে আমার একটা ছবি তুলল। তখন আমার মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। আমি চিৎকার করে বললাম, কেন আপনি আমার ছবি তুললেন? কোন সাহসে আপনি আমার ছবি তুললেন? কেউ আমার বাড়িতে থাকতে পারবেন না। কেউ না। যে বাড়িতে ঢুকবে তাকেই আমি খুন করে ফেলব।

সত্যি-সত্যি আমি রান্নাঘর থেকে বঁটি নিয়ে এলাম। আমার উন্মাদ চেহারা দেখে ভয়েই লোকজন বের হয়ে গেল। তবে পুরোপুরি গেল না। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে জটলা পাকাতে লাগল। কিছু রিকশা দাঁড়িয়ে গেল। রিকশার যাত্রীরা সিটের উপর দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছে। দর্শকদের কেউ কেউ আবার ঢ়িল ছুড়ছে। বাবাকে নিয়ে যাবার সময় ওসি সাহেব একটা ভদ্রতা করলেন। বাড়ির সামনে দুজন পুলিশ রেখে গেলেন। তাদের দায়িত্ব কাউকে ঘিরে ঢুকতে না দেওয়া।

ওসি সাহেব যখন বাবাকে নিয়ে যাচ্ছেন তখনো আমি বাবার মধ্যে তেমন কোনো অস্থিরতা দেখলাম না। তিনি সারাক্ষণই মাথা নিচু করে রাখলেন। আমাকে একসময় চাপা গলায় বললেন, ইবলিশের কাজ কেমন পরিষ্কার দেখলি? সে আরো অনেক কিছু করবে। সাবধান থাকবি।আমি বললাম, কীভাবে সাবধান থাকব?

বাবা বললেন, দমে-দমে আল্লাহ্‌র নাম নিবি। কিছুক্ষণ পরে-পরে আয়তুল কুরাসি পড়ে হাততালি দিবি। হাততালির শব্দ যতদূর যাবে ততদূর পর্যন্ত ইবলিশ আসবে না। ঘরে সব বাতি জ্বালিয়ে রাখবি। ঘর যেন অন্ধকার না থাকে। ইলেকট্রিক বালু। জুলছে। জুলুক। হারিকোনও জ্বালিয়ে রাখ।আমি চাচ্ছিলাম ইবলিশ শয়তান আসুক। তার সঙ্গে কথা বলি। দেখি সে আসলে কী চায়। আজ তার আসতে সমস্যা নেই। বাড়ি খালি। খালি বাড়িতে আমি একা হাঁটছি।

ইবলিশ শয়তান এল না। রাত বারোটার দিকে বাবা ফিরলেন। পুলিশের জিপ এসে বাবাকে নামিয়ে দিয়ে গেল। রমনা থানার সেকেণ্ড অফিসার ছিল বাবার ছাত্র। তার কারণেই বাবা বিনা ঝামেলায় ছাড়া পেয়ে গেলেন। ইথেনের ডেডবডি পাওয়া গেল না। তাকে রাখা হয়েছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মৰ্গে। তার পোষ্টমর্টেম হবে। পরদিন সকাল দশটায়। পোষ্টমর্টেম হবার আগে আমাদের কিছু করার নেই।বাবা প্রতি বৃহস্পতিবার যে পীর সাহেবের কাছে যেতেন।

ওনার কাছে খবর পৌছেছিল। উনি রাত একটার দিকে চলে এলেন। দোয়া-দরুদ পড়ে বাড়ি বন্ধন করলেন। বসার ঘরের মেঝেতে বিছানা করা হল। বিছানায় জয়নামাজ বিছানো হল। আগরবাতি জ্বালানো হল। বাবা তাঁর পীর সাহেবকে নিয়ে কোরান শরিফ পাঠ করা শুরু করলেন। বাবার এই পীর সাহেবকে আমার পছন্দ হল। তিনি সত্ত্বনাসূচক কোনো কথাবার্তায় গেলেন না। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি একটা কাজ হাতে নিয়ে এসেছেন। কাজটা সুন্দর মতো করবেন। এর বেশি কিছু না। আমাকে তিনি শুধু একটি কথাই বললেন, মাগো! সবই আল্লাহর ইচ্ছা।

রাত কত হয়েছে আমি জানি না। আমি বসে আছি ইথেনের ঘরে। টেবিলল্যাম্প জুলছে। টেবিলল্যাম্পের আলো ছাড়া ঘরে আর কোনো আলো নেই। ইথেনের বিছানা এলোমেলে। দুটা বালিশের একটা মেঝেতে। খাটের নিচে গাদা করে রাখা কাপড়। ধোপার বাড়িতে যাবার জন্য আলাদা করে রাখা। দেওয়ালে ইথেনের ছোটবেলার আঁকা ছবি। চারটা ছবি। ফ্রেম করে বাঁধানো। গ্রাম ঘর বাড়ি। নদীতে সূৰ্য অস্ত যাচ্ছে। রাখাল বালক বাঁশি বাজাচ্ছে।

আমাদের দু বোনের একটা ফটোগ্রাফও আছে। কক্সবাজারে সমুদ্রে নেমেছি। তার ছবি। ইথেন সমুদ্রের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য শাড়ি সামান্য উঁচু করছে। তার সুন্দর ফরসা পা দেখা যাচ্ছিল। এখন অবিশ্যি দেখা যাচ্ছে না। বাবা কালো স্কচ টেপ দিয়ে পায়ের এই অংশ ঢেকে দিয়েছেন।আমার অদ্ভুত লাগছে। আমি একজন মৃত মানুষের ঘরে বসে আছি। এখনো তার শরীরের গন্ধ ঘরে ভাসছে অথচ সে নেই। পাশের ঘর থেকে কোরান পাঠের আওয়াজ আসছে।

মাঝে-মাঝে আসছে আগেরবাতির গন্ধ। এই গন্ধটা মনে করিয়ে দিচ্ছে এই বাড়িতে মৃত্যু এসেছে।কোথায় রেখেছে ইথেনকে? এই চিন্তাটা অস্পষ্টভাবে আমার মাথায় আসছে! চিন্তাটা দূর করতে চাচ্ছি কিন্তু পারছি না। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ কেমন আমি জানি না। আরো অনেক বেওয়ারিশ লাশের সঙ্গে সে শুয়ে আছে? নাকি তাকে আলাদা রাখা হয়েছে? সে কি শুয়ে আছে ঠাণ্ডা মেঝেতে? নাকি টেবিলে রাখা হয়েছে? সকালবেলা ডাক্তাররা আসবেন। কাটাকুটি করবেন।

দরজায় টোকা পড়ছে। কেউ যেন খুব সাবধানে দরজা টানছে। আমি বললাম, কে? দরজার ওপাশ থেকে চাপা গলায় কেউ একজন বলল, আপা আসব? আমি এই গল চিনি। ইথেনের গলা। সামান্য ভাঙা ভাঙা। ঠাণ্ডা লাগলে ইথেনের গলা সামান্য ভেঙে যায়। আমি আবারো বললাম, কে? দরজার ওপাশ থেকে ইথেন বলল, আপা তুমি যদি ভয় না পাও তা হলে আমি ঘরে আসব। আসি?

আমি জবাব দিলাম না। আমার মাথা কাজ করছে না। ইথেনের ঘরে বসে তার কথা ভাবছিলাম বলেই কি আমি প্রবল ঘোরের জগতে চলে গেছি? হেলুসিনেশন হতে শুরু করেছে? আমার এখন কী করা উচিত? বাবাকে ডাকা উচিত। নাকি আমি ইথেনকে ঘরে ঢুকতে বলব?

দরজায় ইথেনের হাত দেখা যাচ্ছে। চুড়ি পরা ফরসা হত। সবুজ কাচের চুড়ি। কত উঁচু থেকে সে পড়েছে। হাতের সব চুড়ি ভেঙে যাওয়ার কথা! অথচ এখনো হাত ভর্তি চুড়ি। সে দরজা আস্তে করে ভেতরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই তো ইথেনকে দেখা যাচ্ছে। তার বড় বড় চোখ ফরসা শান্ত চেহারা।আপা তুমি কি ভয় পাচ্ছ? না।ওরা আমাকে ঠাণ্ডা একটা বাক্সে ভরে রেখেছে। ভয় লাগছিল বলে চলে এসেছি। বেশিক্ষণ থাকব না। আপা বসব? বোস।

বাতিটা নিভিয়ে দেবে? বাতির জন্য তাকাতে পারছি না। আলো চোখে লাগছে। আমি যন্ত্রের মতো হাত বাড়িয়ে বাতি নিবালাম। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার হল না। বারান্দার বাতি জুলছে। তার আলো খোলা দরজা দিয়ে আসছে। সেই আলোয় ইথেনকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমার ক্ষীণ সন্দেহ হল সে কি আসলেই ইথেন? নাকি ইবলিশ শয়তান ইথেনের রূপ ধরে এসেছে? নাকি পুরো ব্যাপারটাই একটা প্রবল ঘোর।আপা বাবার সঙ্গে ঐ লোকটা কে?

ওনার পীর সাহেব।তোকে একটা কথা বলতে এসেছি আপা! কথাটা বলে চলে যাব।বল কী কথা? তুই সাবধানে থাকিস। ইবলিশ শয়তান তোকে মারবে। সামান্য অসাবধান হলেই মারবে।কীভাবে সাবধানে থাকব? তাকে তুই ধাঁধার মধ্যে রাখবি। সে যেন তোকে পরিষ্কার কখনো বুঝতে না পারে।কী রকম ধাঁধা?

তুই যে তার মতলব জানিস এটা তাকে বুঝতে দিবি না। আমার বুদ্ধি কম আমি তার কাছে ধরা খেয়ে গেছি। তোর বুদ্ধি বেশি তুই পারবি।ইথেন আমার বুদ্ধি কিন্তু বেশি না।তা হলে এক কাজ কর। খুব বুদ্ধি আছে এমন কারোর কাছে যা।খুব বুদ্ধি আছে এমন কাউকে আমি চিনি না।এখন চিনিস না পরে চিনবি। অতি বুদ্ধিমান একজন মানুষের সঙ্গে তোর পরিচয় হবে। তার সাহায্য চাইবি। বুঝব কী করে সে অতি বুদ্ধিমান?

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *