চরু – হাসান আজিজুল হক

চরু

বনের একধারে আপনমনে ঘাস খাচ্ছিল চরু। চরু এক হরিণছানার নাম। বিকট একটা শব্দে চমকে উঠে সে মুখ তুলে দেখল বনের একটু উঁচুতে ঝোপের পাশ দিয়ে ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। আশেপাশে মা নেই। মা তো তার পাশেই ছিল। চরু মায়ের এক ছেলে, বয়স দুই মাসও হয়নি। সকালে মায়ের সঙ্গে বের হলেই মা তাকে বকে। কেন সে ঐরকম তিড়িং বিড়িং লাফায়! কেন সে মায়ের কাছ থেকে দূরে চলে যায়! সে কি জানে না বনে হালুম আছে। হালুম যে তার মতো হরিণের বাচ্চা এক গেরাসে খেয়ে নেবে। এই রকম করে কেবলই ধমকায় তাকে তার মা। সেই মা এখন কোথায় গেল! চরু এদিক-ওদিক ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে থাকে, গেল কোথায় তার মা? বনের বাইরে এখানটা একটুখানি ঢালু। ঢালুর পরে নোনা পানির খাল। ঢালু জমিতে সবুজ ঘন ঘাস। সেই ঘাস চরু খায় আর ভাবে, সারা জীবনে এতো ঘাস সে খেয়ে শেষ করতে পারবে না, আর এই ঘাস ছাড়া সে আর কিছু খাবেও না।


মাকে কোথাও দেখতে পেল না চরু, তখনই ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে একটা পোড়া গন্ধ নাকে এলো তার। সেই গন্ধ ধরে সে পায়ে পায়ে ঢালু ঘাসজমিটা পেরিয়ে বনের ধারে চলে এলো। তারপর হাল্কা পায়ে কাদার ওপর দিয়ে হেঁটে ঝোপের কাছে গিয়ে উঁকি দিতেই দেখতে পেল মা তার নিথর হয়ে শুয়ে রয়েছে। কাছে গিয়ে চরু মাকে শুকতে লাগল। সেই পোড়া গন্ধটা নাকে এলো। আর এলো রক্তের গন্ধ। মায়ের বুকের কাছে বড় একটা ফুটো। ফুটো দিয়ে রক্ত এখনো চুঁইয়ে পড়ছে। মায়ের চোখ খোলা। কেমন একটা নীলচে রং চোখটায়। চরু মাথা দিয়ে মাকে ঠেলতে লাগল, মায়ের মুখে মুখ ঘষতে লাগল। মনে মনে বলল, কেমন মেয়ে তুই এত সকালে কেউ শুয়ে থাকে। চরু একবার মায়ের মুখের কাছে যাচ্ছে, একবার পায়ের কাছে যাচ্ছে- এ সময় ঝপাং করে একটা দড়ির জাল এসে পড়ল চরুর ওপর। গায়ে জাল জড়িয়ে ধরে তাকে। হাতে-পায়ে, ঘাড়ে-মাথায় জাল জড়িয়ে শেষ পর্যন্ত মাটিতে শুয়ে পড়ে হাঁপাতে লাগল চরু। তার কানে এলো এক দঙ্গল মানুষের খি খি হাসি। তারা এগিয়ে এসে দুজনে মিলে কাঁধে নিল তার মরা মাটাকে। একজন এসে জালসুদ্ধ ঘাড়ে তুলল তাকে। আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো তার। সে আর কিছু জানে না।


খাল পেরিয়ে গাঁয়ের মধ্যে এক গেরস্ত বাড়িতে এলো চরু। জাল থেকে বের করে সরু দড়ি দিয়ে বাঁধা হলো তাকে। বাড়ির একটা ফর্সা ন্যাংটা ছেলে এসে তার গায়ে হাত বুলোতে লাগল, আর ততোক্ষণে দুজন লোক মিলে তার মায়ের চামড়া ছাড়িয়ে ফেলল। তারপর ছোট ছোট টুকরো করে একটা ঝুড়ি ভরে ফেলল তার মাংসে। খানিক ক্ষণের মধ্যেই চরুর চোখের সামনেই তার মা যেন উবে গেল। শুধু পড়ে রইল বাদামির ওপর সাদা ছিটেঅলা চামড়াটা আর দুটো নীল চোখ-অলা শিংসুদ্ধ মাথাটা। মাংস ভরা ঝুড়িটা নিয়ে একজন গাঁয়ের ভেতর চলে গেল বিক্রি করতে। সেদিকে চেয়ে রইল চরু। আর চরুর দিকে চেয়ে রইল তার মায়ের মুন্ডুর দুই খোলা নীল চোখ।


এই খারাপ বাড়িটায় চরু দিন দুই কিছুই খায় না। আর খাবেই বা কিসে? মায়ের দুধ খেত চরু। এখন তাকে কে দুধ দেবে? ফরসা ন্যাংটা ছেলেটা তার জন্যে কচি ঘাস, কেওড়ার পাতা এইসব আনতে লাগল, আর তার মুখে গুজে দেবার চেষ্টা করল নরম ঘাস, টক কেওড়ার পাতা। দুদিন পর চরু আর কিছুতেই বাঁচে না, চোখে কিছু দেখতে পায় না, কানে কিছু শুনতে পায় না। তখন বাড়ির লোকেরা বলল, ছানাটা যদি মরেই গেল তাহলে আমাদের আর লাভ হলো কী? ওর মাটার মাংস বেচে দুপয়সা হয়েছে এর মাংস তো এখনো বেচার মতো হয়নি। ছানাটাকে খাইয়ে-দাইয়ে বড় করে তুলতে পারলে তবে কিছু পাওয়া যাবে। এইসব কথা বলতে বলতে তারা গরুর দুধ নিয়ে এলো বোতলে ভরে চরুর জন্যে। বোতল থেকে চরু দুধ খেল, ঠিক যেন মায়ের দুধ খাচ্ছে। চরু একটু একটু করে সেরে উঠল।

ফরসা ন্যাংটা ছেলেটা সবসময়ে তার পেছনে লেগে আছে। ছেলেটা ট্যারা, মুখ দিয়ে সবসময় লালা গড়ায়। কেউ তাকে পেছন থেকে কথা বললে সে কিছুই শুনতে পায় না। গাঁয়ের মাঠে চরুকে নিয়ে গিয়ে দড়ি খুলে তাকে ছেড়ে দিল সে। চরুর আর একবারও মায়ের কথা মনে পড়ল না, সে খেলতে লাগল ফরসা ছেলেটার সঙ্গে। তার ন্যাংটা কোমরে ঘুনসিতে একটা ঘুঙুর বাঁধা। চরুর সঙ্গে যখন সে দৌঁড়ায়, ঠুনঠুন করে তার ঘুঙুরের শব্দ হয়।

ন্যাংটা ছেলেটা এসে তার গলা জড়িয়ে ধরে গলায় চুমু খায়।

এমনি করে কতদিন কেটে গেল। দুবার আমগাছে মুকুল এলো। চরুর গায়ের ফ্যাকাশে সাদা রং বদলে গিয়ে তার জায়গায় ঘন বাদামি রং দেখা দিল, আর দেখা দিল সাদা সাদা বুটি। একজোড়া ডালপালাঅলা শিং গজালো মাথায়। ফরসা ছেলেটাও এখন একটু বড় হয়েছে, সে আর ন্যাংটা থাকে না, একটা প্যান্ট পরে শুধু। বাড়ির বাবরিচুল হিংসুটে চোখ-অলা লোকটা আবার একদিন বিরাট একটা হরিণ কাঁধে নিয়ে বাড়ি এলো। এত বড় হরিণ, তাকে বয়ে আনতে লোকটার শিরদাঁড়া বেঁকে গেছে। তার পিঠ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত গড়াচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে হরিণটার মাংসের টুকরোয় দুটো ঝুড়ি ভর্তি হয়ে গেল। বাড়ির একজন এসে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল, মাংস কতটা হবে? বাবরিচুল লোকটা বলল, মণখানেক হতি পারে। অন্য লোকটা বলল, দশ টাকা স্যারের নিচে বেচা যাবে না।


দুজনে মাংসের ঝুড়ি দুটো মাথায় নিয়ে গাঁয়ের ভেতরে চলে গেল। পড়ে রইল হরিণটার বিরাট চামড়া আর তার শিং-অলা মুন্ডুর দুটি নীল চোখের স্থির চাউনি।

এই ঘটনার মাত্র কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যের সময় বাড়ির সবচেয়ে বড় ভাই রোগা চিমসে লোভী লোকটা বলল, বাড়ির হরিণটাকে আর রেখে লাভ কী হবে। শুধু শুধু খাওয়ানো খালি। আর যেরকম শিং হইছে, কোনদিন কাকে খুন করবে। ওর মাংস কতটা হতি পারে? বাবরিচুল লোকটা বলল, মণদেড়েক হতি পারে।

তালি কাল ওটাকে জবাই দিয়ে দে।

সকাল হচ্ছে। দাওয়ায় ঘেরা জায়গাটার ভেতর চরু এতোক্ষণ শুয়ে শুয়ে ঝিমুচ্ছিল। বেড়ার ফাঁক দিয়ে সকালের আলো আসতেই সে উঠে বসল। এক কোণে কালকের খানিকটা ঘাস ছিল। সে ঘাস চিবোতে লাগল চরু। দেখতে দেখতে বেড়ার ফুটো দিয়ে এইরকম চুলের মতো সরু সরু সূর্যের আলোর সূতো ঢুকে পড়ল চরুর অন্ধকারে ঘরের মধ্যে। তখুনি তার কানে এল বালিতে ছুরির ফলা ঘষার ঘষ ঘষ আওয়াজ। তারই জন্যে ছুরি শানানো হচ্ছে। চরু জানে না তার মাংস মানুষের কত প্রিয়!


আপনমনে ঘাস চিবোতে চিবোতে হঠাৎ সে দেখতে পেল দাওয়ার বাইরের দিকের বেড়া একটু একটু করে ফাঁক হচ্ছে। খানিকক্ষণের মধ্যেই মড়মড় শব্দে ভেঙে পড়ল বেড়াটা, আর ঘরে ঢুকল ফরসা বোবা-কালা ছেলেটা। আঁকড়ে ধরল সে চরুর গলা, আর হু হু করে কাঁদতে লাগল। কিন্তু দেরি করল না সে, খুঁটিতে বাঁধা চরুর দড়িটা খুলে হ্যাঁচকা একটা টান দিয়ে চরুকে নিয়ে সে ভাঙা বেড়ার তলা দিয়ে রাস্তায় এসে পড়ল। তারপর ছুট, ছুট! চরুর তো মজাই! লম্বা লম্বা লাফ দিয়ে গাঁয়ের বাড়িঘর পার হয়ে ওরা এসে পড়ল খালের ধারে। সেখানে একটা ছোট্ট নৌকা বাঁধা। ছেলেটা চরুকে ঠেলে সেই নৌকায় উঠিয়ে দিয়ে নিজেও উঠে বসল। তার পরেই ছেড়ে দিল নৌকা।

খালের মাঝ বরাবর এসেছে, এইসময় পেছনে বহু লোকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। মানুষের একটা দল ছুটে আসছে। সকলের আগে ছুটে আসছে বাবরি চুল-অলা হিংসুটে লোকটা। হাতে ছুরি। ছুরির ফলাটা সকালের আলোয় ঝকঝক করছে। তার পেছনে হায় হায় করতে করতে আসছে বাড়ির বড়ভাই রোগা চিমসে লোকটা। সবাই চিৎকার করে ডাকছে ছেলেটাকে, তাকে ফিরে আসতে বলছে চরুকে নিয়ে। এদিকে ছেলেটা বসে আছে ওদের দিকে পিছন ফিরে। কাউকে দেখতে পাচ্ছে না সে। শুনতেও পাচ্ছে না কোনো কথা। খালের ওপারে পৌঁছে গেল নৌকা। ঠিক সেইখানে, যেখানে চরু একদিন সকালে ঘাস খাচ্ছিল আর মরা মাকে দেখতে পেয়েছিল ঝোপের ধারে। যেখান থেকে জালে করে বেঁধে এনেছিল তাকে। নৌকা থামতেই ছেলেটা কাদার মধ্যে লাফিয়ে নেমে দড়িতে টান দিয়ে চরুকে নামালো। সূর্যের আলো পড়েছে ছেলেটার মুখে। চরুর গলাটা জড়িয়ে ধরল সে, অনেকবার চুমু খেল তার গলায়। নাকের সর্দিমেশা চোখের পানি মুছল তার ঘাড়ের লোমে, তারপর গলা থেকে দড়ি খুলে নিয়ে উস্ উস্ করে বিকট আওয়াজ বের করল গলা থেকে।

একটা লাফ দিয়ে চরু উঠে গেল ঢালু ঘাসজমিটায়। একবার ফিরে তাকালো সে। ছেলেটার কদাকার ভেজা মুখে আলো পড়েছে। একটু একটু করে হাসি ফুটে উঠল সেই মুখে। তখন কী সুন্দর দেখাচ্ছে সেই মুখ!

চরু আর ফিরে দেখল না। বড় বড় লাফ দিয়ে সে জঙ্গলের আড়ালে চলে গেল।

[ঈষৎ সংক্ষেপিত]


Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *