চেয়ার-তারাপদ রায়

চেয়ার-তারাপদ রায়

মন্ত্রিমহোদয়ের ফোনটা এল পাঁচটা পঁচিশে। নিয়মমতো অফিস ছুটি হতে তখন আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। বিশেষ জরুরি কিছু না থাকলে মন্ত্রী সাধারণত ঠিক সাড়ে পাঁচটাতেই বেরিয়ে যান। সাত্যকির পক্ষে অবশ্য সেটা কোনও দিনই সম্ভব হয় না, দিনের কাজ শেষ করে বেরোতে বেরোতে তার প্রায় সাড়ে সাতটা-আটটা হয়ে যায়, কোনও কোনও দিন তার থেকেও দেরি হয়।

মন্ত্রিমহোদয়ের একটা ফোন প্রায় প্রতিদিনই ওই ছুটির মিনিট পাঁচেক আগে আসে। দিনের শেষে অফিস ছেড়ে যাওয়ার সময় দরকারি কোনও ব্যাপার থাকলে সেটা বলে যান।

আজও তাই হল, মন্ত্রী বললেন, মিস্টার পাল, একটু আসবেন? সাত্যকি পাল একটা গোলমেলে ফাইল দেখছিলেন, গত বছর যে কাজে বাহান্ন হাজার টাকা খরচ হয়েছে, এ বছর সেই একই কাজে এক লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কারণটা কী, যদি সত্যিই কোনও কারণ থেকে থাকে, সেটা খুঁটিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলেন।

মন্ত্রীর তলব পেয়ে সাত্যকি যথারীতি ফোনে তাঁকে জানালেন, ইয়েস স্যার, এখনই আসছি স্যার। টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে হাতের ফাইলটা বন্ধ করলেন সাত্যকি, তারপর নিজের টেবিলের দিকে তাকালেন। সাত্যকির টেবিল, সরকারি এলাকায় যাকে হেভি ডেস্ক বলে ঠিক তাই। সারাদিন ধরে গাদা গাদা ফাইল জমা হয়েছে, এর মধ্যে অনেকগুলিই বিশেষ জরুরি, ফেলে রাখা চলবে না। সব ফাইল খুঁটিয়ে দেখারও অবকাশ নেই। দায়সারা ভাবে সই করে ছেড়ে দিতে হয়।

গোলমেলে হিসেবের ফাইলটা বন্ধ করে মন্ত্রীর ঘরের দিকে যাওয়ার জন্যে সাত্যকি চপ্পলে পা গলিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠছিলেন, সে সময় মনে হল ফাইলটার যে জায়গাটা এইমাত্র দেখছিলেন, সেখানেই একটা গোঁজামিল রয়েছে। টেবিলের নীচে ঘেয়ো কুকুরের মতো লোম উঠে যাওয়া। কার্পেটের ওপরে পা থেকে চপ্পলটা খুলে দু মিনিটের জন্যে স্থির হয়ে বসলেন সাত্যকি। ফাইলটা আবার খুললেন।

এ অফিসে শান্তিতে মনোনিবেশ করে কোনও কাজ করার উপায় নেই। ফাইলটা খুলতে না খুলতে, একদল কর্মচারি তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইউনিয়নের নেতা, হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল। বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ এভাবে ঘরে ঢুকে পড়া সাত্যকি পাল পছন্দ করেন না। কিন্তু পছন্দ না করলেই বা উপায় কী, চাকরি করতে গেলে এসব মেনে নিতেই হয়।

আজকের ব্যাপার গুরুতর। কর্মচারি ইউনিয়নের মুখপাত্র আবিদ হোসেন জানালেন, স্যার, ডেসপ্যাঁচ সেকশনের মঞ্জু রায় হঠাৎ ভিরমি খেয়ে পড়ে গেছেন। মুখ দিয়ে ফেনা উঠছে আর গোঁ-গোঁ শব্দ বেরোচ্ছে।

ভিরমি খাওয়া ব্যাপারটা ঠিক কী সে বিষয়ে সাত্যকি পালের কোনও পরিষ্কার ধারণা নেই। তা ছাড়া মঞ্জু রায় কে, তিনি স্ত্রীলোক না পুরুষমানুষ, সে বিষয়েও তার অজ্ঞতা রয়েছে। তদুপরি এ ব্যাপারে তার দায়িত্ব বা কর্তব্য কতটুকু সে সম্পর্কে সাত্যকি পাল সন্দিহান।

সাত্যকির মনে আছে, এর আগে একটা বাইরের অফিসে সারাদিন ঝামেলা লেগেই থাকত। সেখানে একদিন সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ অফিসে পৌঁছানো মাত্র একদল কর্মচারি হইহই করে ছুটে এল। তাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে জলের গেলাস। গেলাসের জলটা ক্ষীণ লালচে মতন দেখতে। এই রংয়ের জল সাত্যকির চেনা, প্রতিদিনই অফিসে তাঁকে এই জলটা খেতে হয়।

এই অফিসে প্রথম এসে তাঁরও মনে খটকা লাগে এই জল দেখে। কিন্তু তিনি পরে খোঁজ নিয়ে দেখেছেন যে জলটাকে বিশুদ্ধিকরণ করতে গিয়ে পটাস পারমাঙ্গানেট ব্যবহারে এমন লালচে হয়ে যায়।

সুতরাং যখন বিপ্লবী কর্মচারিবৃন্দ গোটা দশেক লালচে জলের গেলাস হাতে সাত্যকিবাবুর ঘরে ঝাঁপিয়ে পড়ল, সাত্যকিবাবু মোটেই ভয় পেলেন না বা বিচলিত হলেন না, তিনি আন্দোলনকারীরা কিছু বুঝবার আগেই তার টেবিলের ওপরে রাখা গেলাসের সারি থেকে সামনের তিন চার গেলাস জল খেয়ে ফেললেন। তারপর আঃ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন। রঙিন জল নিয়ে আন্দোলন এর পরে আর বিশেষ গড়ায়নি।

আজকের সমস্যা অবশ্য সাত্যকি পাল আরও সহজে সমাধান করলেন। তিনি ধুরন্ধর আমলা, সরকারি কাজে দীর্ঘ পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতা তাঁর। তিনি মঞ্জু রায়ের লিঙ্গ নির্ণয়ে বা কেস হিস্ট্রিতে গেলেন না, সরাসরি প্রস্তাব দিলেন, আমার তো বেরোতে বেরোতে সাতটা-সাড়ে সাতটা হয়ে যাবে, আপনারা ওঁকে নিয়ে হাসপাতালে চলে যান, আমার গাড়িটা নিয়ে নিন। হাসপাতালে পৌঁছে গাড়িটা আমাকে ফেরত পাঠিয়ে দেবেন।

কর্মচারিরা আসলে গাড়ি চাইতেই এসেছিলেন। সেটা সাত্যকি জানেন তিনি এও জানেন যে সহজে ওরা গাড়ি ছাড়বে না। মঞ্জু রায়ের বাড়িতে গাড়ি যাবে, তার আত্মীয়স্বজনকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে। তারপর নেতারা নিজ নিজ ঠেকে বা পাড়ায় ফিরবেন। সে গড়িয়া থেকে মধ্যমগ্রাম পর্যন্ত যেকোনও জায়গা হতে পারে। একবার তো একজন শ্যামনগরে শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, বুদ্ধিমান ড্রাইভার তেল ফুরিয়ে যাবে এই ভয় দেখানোয় তিনি পানিহাটিতে নেমে যান।

সাত্যকির কিছু যায় আসে না। সরকারি গাড়ি, সরকারি তেল, চারদিকে কত রকম অপব্যয়, সব ব্যাপারে মাথা গলাতে গেলে চলে না। তা ছাড়া এই সন্ধ্যাবেলায় অফিসের গাড়ি ছেড়ে দিলেও তার নিজের বাড়ি ফেরার কোনও অসুবিধে নেই। কাছেই পাতাল রেলের চার স্টেশনের মাথায় পৈতৃক বাড়ি। সেখানেই বসবাস। সন্ধ্যার পরে পাতাল রেলে তেমন ভিড় থাকে না, একটু হেঁটে বউবাজার দিয়ে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে পৌঁছলে তারপর পনেরো মিনিটের পথ। ট্রাফিকের ঝামেলা নেই।

কর্মচারিরা গাড়ি পেয়ে মোটামুটি খুশি মনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে সাত্যকির মনে পড়ল মন্ত্রিমহোদয় তলব করেছেন। দেরি হয়ে গেছে, এবার উঠতে হয়।

কিন্তু চেয়ার ছেড়ে ওঠা কি সহজ?

ইতিমধ্যে অবশ্য মন্ত্রিমহোদয়ের একান্ত সচিবের ফোন এসে গেছে, কী হল? দেরি করছেন কেন? মিনিস্টার আপনার জন্যে বসে আছেন।

এবার উঠতেই হয়। কিন্তু চপ্পলে পা গলিয়ে চেয়ার ছেড়ে ওঠার আগেই সাত্যকির ডেপুটি একটা আধা হলদে মতন কাগজ নিয়ে ঘরের মধ্যে ঝড়ের মতো ঢুকল। বলল, স্যার, সর্বনাশ হয়েছে।

কী হয়েছে? সাত্যকি এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার আগেই ডেপুটি সাহেব বললেন, স্যার, এই দেখুন সান্ধ্য সুতানুটি, হেডলাইন আমাদের নিয়ে, আমরা নাকি জোচ্চোর, আমাদের অফিস নাকি জোচ্চোরের অফিস।

সাত্যকি এ জিনিস অনেক দেখেছেন, একটি খেলো পত্রিকার সান্ধ্য সংস্করণ কতজনই বা পড়ছে, একবার পড়লেই বা কী এসে যায়। ডেপুটিকে এই কথা বোঝানোর চেষ্টা করলেন সাত্যকি। কিন্তু ততক্ষণে আরেক ডেপুটি দুটি ফাইল হাতে প্রবেশ করলেন, দুটিতেই জরুরি পতাকা লাগানো, এর মধ্যে একটি আবার গোপনীয় নথি। সাত্যকি তার দুজন ডেপুটিকেই বললেন, আমি মিনিস্টার সাহেবের ঘর থেকে একটু ঘুরে আসছি। আপনারা পনেরো মিনিট পরে আসুন।

এর মধ্যে একজনের একটু আগে আগে বাড়ি যাওয়ার তাড়া আছে। তিনিই প্রথমে সান্ধ্য সুতানুটি হাতে প্রবেশ করেছিলেন। সাত্যকি তাকে বললেন, আমার যদি খুব দেরি হয় আপনি চলে যাবেন, আমার জন্যে অপেক্ষা করবেন না। ভদ্রলোক হাসিমুখে বেরিয়ে গেলেন। এটা প্রায় নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, ভদ্রলোক শেষ বেলায় একটা হইহল্লা জুড়ে দিয়ে তারপর নিঃশব্দে কেটে পড়েন।

আটকিয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয় জনও অবশ্য খুশি হননি, দিনের শেষে কেই বা অফিসে বন্দি হয়ে থাকতে চায়। মিনিট দশেক বাদে আসছি বলে তিনিও গম্ভীর মুখে নিষ্ক্রান্ত হলেন।

অনেক দেরি হয়ে গেছে। এবার যেতে হয়, মন্ত্রিমহোদয় নিশ্চয় এতক্ষণে খুব চটে গেছেন।

কিন্তু এর পরেই হল, আসল মুশকিল, চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে সাত্যকি দেখলেন তিনি উঠতে পারছেন না। চেয়ারের সঙ্গে আটকে গেছেন।

চেয়ারটা নতুন। হালফিলের গদিমোড়া কালো রেক্সিনের রিভলভিং চেয়ার। পুরনো কাঠের হাতলওলা চেয়ারটা বদলিয়ে আজই ঘণ্টাখানেক আগে এটা দিয়ে গেছে। সাত্যকি চেয়ারটায় একটু আগে এসে বসেছেন, তারপর এই প্রথম ওঠা।

কিন্তু উঠতে পারছেন কোথায়? চেয়ারের সঙ্গে তিনি আষ্টেপৃষ্ঠে আটকিয়ে গেছেন। রিভলভিং হওয়ায় বাঁয়ে-ডাইনে, ডাইনে-বাঁয়ে ঠিকমতোই ঘুরছে কিন্তু ছেড়ে ওঠা যাচ্ছে না, শরীরটা কে যেন কেমিক্যাল আঠা দিয়ে আটকিয়ে দিয়েছে।

সাত্যকি কলিংবেল বাজালেন বেয়ারাকে ডাকার জন্যে, সেই সঙ্গে টেবিলের টেলিফোনটাও আবার ক্রিং ক্রিং করে উঠল।

এবার স্বয়ং মন্ত্রী ফোন করেছেন, কী হল? আমি আপনাকে ডাকছি, আপনি আসছেন না কেন?

একটু আমতা আমতা করে কিছুটা সত্যি কথাই বলে ফেললেন সাত্যকি। আর তা ছাড়া উপায়ই বা কী? একটু মোলায়েম করে সাত্যকি বললেন, স্যার, আমি একটু আটকিয়ে গেছি। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারছি না। খুব চেষ্টা করছি।

মন্ত্রিমহোদয়ের এত কথা শোনার ধৈর্য নেই, তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, না, না। এখনই চলে আসুন, আমি আপনার জন্যে বসে আছি।

মন্ত্রীর নির্দেশ শুনে সাত্যকি আরেকবার চেয়ার থেকে ওঠার চেষ্টা করলেন সমস্ত শরীরের শক্তি দিয়ে, অত ভারী চেয়ারটার পিছনের দিকটা এক ইঞ্চিটাক কাত হল, কিন্তু তাতে কী হবে, দেহটাই আটকিয়ে আছে।

কলিংবেল শুনে মন্মথ বেয়ারা ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছিল। সাত্যকি তাকে বললেন, মন্মথ আমাকে একটু টেনে তোলো তো।

মন্মথ প্রথমে বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা। সে চেয়ারের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল, সাত্যকি হাত দুটো তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, মন্মথ আমার হাত দুটো ধরে একটু জোরে টেনে তোলো তো।

মন্মথ জানে, খুব ভারী ও মোটা মানুষদের অনেক সময় টেনে তুলতে হয়, তারা শরীরের ভার নিয়ে বসা বা শোয়া থেকে উঠে দাঁড়াতে পারে না। কিন্তু পালসাহেব তত মোটা মানুষ নন, মেদহীন স্বাস্থ্যের লোক। মন্মথ ভাবল, তা হলে সাহেবের বোধহয় জোর ঝিঁঝি ধরেছে কিংবা কোমরে খিল ধরেছে।

মন্মথ পালসাহেবের দিকে এগিয়ে এল, তারপর ভেবে দেখল আচমকা হ্যাঁচকা টান দিয়ে তুলতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে, যদি সত্যি হাড়ে খিল লেগে থাকে, জোর টানে হাড়ের জোড় সরে গিয়ে বিপর্যয় ঘটতে পারে। সে ধীর পদে সাত্যকির দুই বগলের নীচ দিয়ে নিজের দুই হাত গলিয়ে তাকে ওপর দিকে ঠেলে তোলার চেষ্টা করতে লাগল।

দ্বিতীয় ডেপুটি, যাঁকে সাত্যকি মিনিট দশ-পনেরো পরে আসতে বলেছিলেন, তিনি সাত্যকির ঠিক সামনের একটা কিউবিকলে বসেন। সেখান থেকে সাত্যকির যাওয়া-আসা তিনি লক্ষ রাখেন। তিনি যখন দেখলেন যে এতক্ষণ পর্যন্ত সাত্যকি ঘর থেকে বেরোলেন না তখন তিনি ধরে নিলেন মন্ত্রী হয়তো চলে গেছেন, মি. পালের আর মন্ত্রীর ঘরে যাওয়ার দরকার নেই। সুতরাং এই সুযোগে তাকে জরুরি ফাইল দুটো দেখিয়ে নিলে হয়, এই ভেবে ফাইল দুটো হাতে নিয়ে সাত্যকির ঘরে প্রবেশ করলেন।

দ্বিতীয় ডেপুটি পালসাহেবের ঘরে ঢুকে যা দেখলেন, হতভম্ব হয়ে গেলেন। মন্মথ চেয়ারের পিছনে গিয়ে কাঁধের নীচে হাত দিয়ে পালসাহেবকে চেয়ার থেকে ঠেলে তোলবার চেষ্টা করছে, পালসাহেব মরে গেলাম, মরে গেলাম বলে কাতরোক্তি করছেন।

এ অফিসে কারও কারও হঠাৎ হঠাৎ পাগল হয়ে যাওয়ার একটা রীতি আছে। এই তো কয়েক মাস আগে অ্যাকাউন্টস সেকশনের তিনকড়ি পিয়ন কেন যেন খেপে গিয়ে বড়বাবুকে সিঁড়ির ওপরে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। টিফিনের সময় বড়বাবু আর নতুন টাইপ-দিদিমণি সিঁড়ি দিয়ে গল্প করতে করতে নামছিলেন, সেই সময়ে আচমকা এই ধাক্কা। দিদিমণিকেও তিনকড়ি ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তে একজন তাকে জাপটে ধরায় দিদিমণি রক্ষা পান।

ঘরের মধ্যে আজ এই মুহূর্তের দৃশ্যটির মুখোমুখি হয়ে দ্বিতীয় ডেপুটি ভাবলেন, সর্বনাশ, সেই তিনকড়ি কাহিনির মতো আরেকটা ঘটনা ঘটতে চলেছে। তিনি দ্রুত পদসঞ্চারে মন্মথকে তার কর্তব্যকর্ম থেকে নিবৃত্ত করতে এগোলেন।

মন্মথ দ্বিতীয় ডেপুটি সাহেবকে এগোতে দেখে ভাবল সাহেব আমাকে সাহায্য করতে আসছেন। কিন্তু তাঁর মুখমণ্ডলে প্রশ্নজটিল কুঞ্চন দেখে মন্মথ বুঝতে পারলে দুই নম্বর ছোটসাহেব ব্যাপারটা সম্যক অনুধাবন করতে পারেননি। মন্মথ দ্বিতীয় ডেপুটিকে বলল, বড়সাহেব চেয়ারের সঙ্গে সেঁটে গেছেন।

ব্যাপারটা বুঝতে দ্বিতীয় ডেপুটির একটু সময় লাগল। তাঁর দ্বিধান্বিত মুখভঙ্গি দেখে সাত্যকি পাল বুঝিয়ে বললেন, এই নতুন চেয়ারটার সঙ্গে আমি কেমন আটকিয়ে গেছি। মনে হচ্ছে নাট-বল্ট দিয়ে আমাকে কেউ আটকিয়ে দিয়েছে। চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারছি না।

বলা বাহুল্য, এই আজগুবি কথা বিশ্বাস করার লোক দ্বিতীয় ডেপুটি নন। প্রথম যৌবনে বহুদিন ফৌজদারি আদালতে হাকিমি করেছেন, বিস্তর আজগুবি, অলীক হেঁয়ালি শোনার তার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু ওপরওয়ালাকে তো আর মিথ্যেবাদী বলা যায় না সরাসরি মুখের ওপরে, তাই তিনি একটু ঘুরিয়ে বললেন, স্যার, আরেকবার আপনি ওঠার চেষ্টা করুন তো।

করুণ হাসি হেসে সাত্যকি ওঠার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। সাত্যকি কী করে যেন বুঝে গেছেন এ চেয়ার ছেড়ে ওঠা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু এখনও তার বুদ্ধিভ্রংশ হয়নি, তিনি দ্বিতীয় ডেপুটিকে বললেন, দেখুন, আমার চেয়ার ছেড়ে ওঠার ব্যাপারটা পরে হবে। আপনি চট করে একটু মন্ত্রীর ঘরে যান তো। মন্ত্রীমশায় আমার জন্যে অনেকক্ষণ বসে আছেন। উনি কী বলছেন একটু শুনে। আসুন আর ওঁকে বলে আসুন আমি চেয়ারে আটকিয়ে গেছি, চেষ্টা করেও উঠতে পারছি না। ভাল করে বুঝিয়ে বলবেন।

তবু যাওয়ার আগে দ্বিতীয় ডেপুটি নিজে একবার হাত বাড়িয়ে পাল সাহেবের দুই বাহু আকর্ষণ করে তাঁকে উত্তোলন করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। ব্যাপারটা অবৈজ্ঞানিক হলেও সত্যি, ভদ্রলোক সম্পূর্ণ আটকিয়ে গেছেন চেয়ারে।

অবস্থা দেখে দ্বিতীয় ডেপুটি তাড়াতাড়ি দ্রুতপদে হেঁটে মন্ত্রীর ঘরে চলে গেলেন। মন্ত্রিমহোদয়ের তখন ক্ষিপ্তপ্রায় অবস্থা, এরকম গাফিলতি, তাঁর আদেশ অবহেলা করে তার ঘরে না আসা তিনি বরদাস্ত করার লোক নন। দ্বিতীয় ডেপুটিকে দেখে তিনি ধমকিয়ে উঠলেন, আপনি কেন? পালসাহেব কোথায়?

দ্বিতীয় ডেপুটি বললেন, স্যার, পালসাহেব আমাকে পাঠালেন। পালসাহেব একটু আটকিয়ে গেছেন। চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারছেন না।

মন্ত্রিমহোদয় এ কথায় আরও রুষ্ট হলেন, এমন কী মহাকাৰ্য তিনি করছেন যে একবারের জন্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারছেন না। আমাকে আধঘণ্টা ধরে বসিয়ে রেখেছেন?

দ্বিতীয় ডেপুটি বোঝানোর চেষ্টা করলেন, না স্যার। ব্যাপারটা ঠিক ওরকম নয়, ব্যাপারটা খুবই গোলমেলে। পালসাহেবের শরীরটা স্যার চেয়ারের সঙ্গে সেঁটে গেছে।

মন্ত্রিমহোদয় এবার চেঁচিয়ে উঠলেন, কী বলছেন মশায়! আপনার কি মাথা খারাপ?

ইতিমধ্যে কিন্তু মন্মথের দৌলতে বড়সাহেবের চেয়ারে আটকিয়ে থাকার ঘটনাটা অফিসময় চাউর হয়ে গেছে, আশেপাশের অফিসেও পৌঁছেছে। অফিস ছুটির সময়, তাই তোকজন খুব নেই। তবুও পালসাহেবের ঘরে রীতিমতো ভিড় জমে গেছে। খাঁচায় বন্দি কোনও আজব জানোনায়ারকে লোকে যে রকম কৌতূহলের সঙ্গে দেখে, সবাই পাল সাহেবকে পর্যবেক্ষণ করছে। পালসাহেবও কী করবেন বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন।

খবরটা মন্ত্রীর ঘরেও পৌঁছাল। মন্ত্রী এবার একটু বিচলিত হলেন, তাই তো, ব্যাপারটা কী? দ্বিতীয় ডেপুটিকে বললেন, এসব কী আজগুবি ঘটনা! চলুন তো দেখে আসি।

সদলবলে মন্ত্রিমহোদয় পালসাহেবের ঘরে পৌঁছাতে উপস্থিত জনতা সম্রমভরে পথ করে দিল। মন্ত্রী সোজা পালসাহেবের চেয়ারের সামনে গিয়ে তার হাত ধরে একটা টান দিতে যাচ্ছিলেন কিন্তু ততক্ষণে পালসাহেব নিজেই মন্ত্রীকে দেখে অভ্যাসবশত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন, মন্ত্রীকে দেখে তার খেয়ালই ছিল না যে তিনি চেয়ারের সঙ্গে আটকিয়ে গেছেন।

পালসাহেব উঠে দাঁড়াতে মন্ত্রী বললেন, এসব বুজরুকি শুরু করেছেন কেন?

পালসাহেব বললেন, আপনি কেন কেউই বিশ্বাস করবে না। আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু এই নতুন চেয়ারটায় বসার পরে আপনার ফোন পেয়ে উঠতে গিয়ে দেখি আটকিয়ে গেছি। চেয়ার ছেড়ে কিছুতেই উঠতে পারছিলাম না।

মন্ত্রী বললেন, আপনি সরে আসুন তো দেখি। পালসাহেব সরে দাঁড়াতে মন্ত্রিমহোদয় চেয়ারের গদিটা একটু টিপে দেখে বললেন, ভালই তো চেয়ারটা এই বলে তিনি নিজে চেয়ারটায় বসে দেখতে গেলেন।

একটু বসেই উঠে পড়ার চেষ্টা করেছিলেন মন্ত্রী। কিন্তু পারলেন না, তিনি চেয়ারের সঙ্গে আটকিয়ে গেছেন। দু-তিনবার চেষ্টা করার পর তিনি ঘোষণা করলেন, আমিও যে আটকিয়ে গেলাম। চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারছি না। তারপর সাত্যকি পালের দিকে তাকিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, মশায় আপনার জন্যে আমি এই বেকায়দায় পড়লাম। খবরের কাগজ কি পাবলিক যদি খোঁজ পায় যে আমি আপনার চেয়ারে বসে আছি! আপনি আমাকে ডোবালেন।

সাত্যকি পালের এখনও ঘোর কাটেনি, আগের মতোই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না।

এদিকে বাইরে ভিড় বাড়ছে। মন্ত্রী আটকিয়ে গেছেন রটে যাওয়ার পরে রাস্তা থেকে, অন্য অফিস থেকে তোক আসা আরম্ভ হয়েছে। পুলিশ ও খবরের কাগজগুলো এল বলে। একটু পরে আর ভিড় সামলানো যাবে না।

কিন্তু এরকম চলতে দেওয়া যায় না। দ্বিতীয় ডেপুটির সঙ্গে পরামর্শ করলেন পালসাহেব। তারপর স্থির হল একটা লরি বা টেম্পো ডেকে তাতে চেয়ার সমেত মন্ত্রিমহোদয়কে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়াই ভাল।

মন্ত্রিমহোদয় ক্ষীণ আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু এ ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *