দূর পাল্লার ট্রেনযাত্রায় আমার ইচ্ছে করে পরিচয়টা বদল করতে। চব্বিশ ঘণ্টা একই কামরায় থাকলে সহযাত্রীদের সঙ্গে একটু-আধটু আলাপ পরিচয় হবেই। তখন আমি অন্য মানুষ হতে যেতে চাই।
টিকিট ছিল চেয়ার কারের। ট্রেন ছাড়ার আগেই দেখলুম, সেখানে তিনজন আমার মুখচেনা। এদের মধ্যে একজনের সাহিত্য বাতিক আছে। আমি মনে-মনে প্রমাদ গুলুম, সারা রাস্তা বকবক করে যেতে হবে এদের সঙ্গে? অথচ দু-খানা না-পড়া বই সঙ্গে নিয়ে এসেছি। তা ছাড়া, চলন্ত প্রাকৃতিক ছবি দেখার সময় আমার কথা বলতে ভালো লাগে না।
পাশের কামরাটা এয়ারকন্ডিশানড টু-টায়ার শ্লিপার। ভাড়া অনেক বেশি। কিন্তু আমার এবারের দিল্লী যাত্রার ভাড়া কোনও এক গৌরী সেন দেবে। প্রায় শেষ মুহূর্তে যাওয়া ঠিক হয়েছে, তাই চেয়ার কার ছাড়া অন্য টিকিট পাওয়া যায়নি। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার পর সব ক্লাসেই দু-একটি ফাঁকা সিট থাকে।
বর্ধমান স্টেশনে নেমে আমি পাশের কামরার কণ্ডাক্টর গার্ডকে জিগ্যেস করলুম, আমাকে টু টায়ারের একটা সিট দিতে পারবেন?
এইসব ক্ষেত্রে কখনও-কখনও ঘুষের ব্যাপার থাকে আমি জানি। বিপন্ন ব্যক্তিরা পঞ্চাশ একশো টাকা বেশি দিয়েও সিট নিতে রাজি হয়। যেহেতু আমি যে-কাজ করি তাতে কোনওদিন ঘুষ পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। সেইজন্য আমিও কারুকে কখনও ঘুষ দিই না। ঘুষ আটকাবার একটা মোক্ষম ওষুধও আমার জানা আছে।
কালো কোট পরা লোকটির চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে আমি আবার বললুম, আমি খবরের কাগজে কাজ করি।
সঙ্গে-সঙ্গে কাজ হল। লোকটির কঠোর মুখখানা নরম হয়ে গেল। বিনীত গলায় বলল, একটু অপেক্ষা করুন। আসানসোল কোটা আছে, সেখানে যদি কেউ না ওঠে, তাহলে আপনি পেয়ে যাবেন।
আসানসোল পর্যন্ত আমি ঘুমের ভান করে রইলুম এবং তারপরেই সুটকেস হাতে নিয়ে চলে এলুম পাশের কামরায়। দুটি বার্থ খালি আছে, একটি এর মধ্যেই বিলি করা হয়েছে এক মাড়োয়ারি ভদ্রলোককে, আমাকে দেওয়া হল প্যাসেজের ধারে একটি ওপরের বাংক। তাই সই।
রিজার্ভ কম্পার্টমেন্টে মাঝপথে কেউ উঠলে অন্য যাত্রীরা সন্দেহের চোখে তাকায়। বিনা টিকিটের যাত্রী মনে করে। বসবার জায়গা দিতে চায় না। আজকাল আবার যখন তখন ট্রেনে ডাকাতের উপদ্রব।
সুটকেসটা একটা বাংকের তলায় চালান করলুম। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই যে দিনের বেলায় কেউ ওপরে উঠে শুয়ে থাকতে পারে না। তাছাড়া বাংলা-বিহার-উত্তর প্রদেশের পট পরিবর্তন দেখতে আমার সব সময়ই ভালো লাগে।
নীচের বাংকের পুরোনো যাত্রীরা সবাই সুজনি বিছিয়ি আধো শোয়া হয়ে আছে। আমার যেখানে জায়গা, তার নীচের বাংকে পুরোদস্তুর বিছানা পাতা। মিশমিশে কালো সিল্কের শাড়ি পরা। একজন প্রৌঢ়া মহিলা সেখানে পা ছড়িয়ে বসে একখানা পেপারব্যাক বই পড়ছেন। নিয়ম। অনুযায়ী দিনের বেলানীচে বসার আমার ন্যায্য অধিকার আছে। কিন্তু একজন মহিলা একেবারে বিছানা-টিছানা পেতে ফেলেছেন, তাঁকে নিয়ম দেখানো ঠিক সঙ্গত নয়।
আজকাল ট্রেনে ভদ্রতা-সভ্যতা উঠে গেছে, ডেলি প্যাসেঞ্জাররা যে-কোনও কম্পার্টমেন্টে যখন তখন উঠে পড়া, গা-জুয়ারি করে রিজার্ভ সিটের যাত্রীদের ঠেলেঠুলে বসে পড়ে। প্রতিবাদ করতে সাহস পাই না কিন্তু এসব দেখে মর্মাহত হই। ছোটবেলায় আমাদের শেখানো হত, অন্য কারুর জন্য নিজের সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে।
আমি পাশেই এক শুয়ে-থাকা ভদ্রলোককে জিগ্যেস করলুম একটু বসতে পারি?
তিনি উত্তর না দিয়ে দয়া করে পা-টা একটু সরালেন।
চোখ বুলিয়ে দেখলুম, এই কামরায় আমার কেউ চেনা নেই। সঙ্গে-সঙ্গে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আমি অন্য মানুষ হয়ে গেলুম।
ধানবাদ পৌঁছবার আগেই শুয়ে-থাকা লোকটি আমার সঙ্গে আলাপ জমাতে চাইলে আমি বেশ উচ্চকণ্ঠে জানালুম যে আমি একটা ওষুধের কোম্পানির ভ্রাম্যমাণ বিক্রয়-প্রতিনিধি, আমার নাম অর্জুন ভরদ্বাজ।
এক সময় সত্যি আমি কিছুদিন একটা ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করেছিলুম, সুতরাং ওষুধ বিপণনের ব্যাপারটা আমি কিছুটা জানি। দৈবাৎ কেউ যদি আমার পেশা সম্পর্কে জেরা করে তাহলে আমি বিশ্বাসযোগ্য উত্তর দিতে পারব।
ধানবাদ পেরুবার পর কণ্ডাক্টার গার্ড এলেন আমার কাছ থেকে এই কামরার অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে। আমি তাঁকে দিলুম একশো চুরানব্বই টাকা, তিনি রীতিমতন রশিদ লিখে দিলেন। তারপর তিনি অতিরিক্ত কর্তব্যপরায়ণ হয়ে বললেন, আপনার ওই ওপরের বাংক, দিনেরবেলা আপনি নীচে বসতে পারেন। ওইটা আপনার জায়গা।
কালো সিল্কের শাড়ি পরা মহিলাটির দিকে তিনি আঙুল তুলে বললেন, ম্যাডাম, দিনেরবেলা আপনার বিছানাটা গুটিয়ে নিতে হবে, এই জেন্টলম্যানটি ওইখানে বসবেন।
আমি সঙ্কুচিতভাবে বললুম, ঠিক আছে, ঠিক আছে, ওঁকে ডিসটার্ব করার দরকার নেই। আমি এখানেই বেশ আছি।
মহিলাটি বিছানাটি খানিকটা গুটিয়ে নিয়ে ইংরিজিতে বললেন, ইউ ক্যান কাম।
যেখানে আমি বসেছিলুম, সেখানকার ভদ্রলোকটি অযাচিতভাবে বললেন, যান না, নিজের জায়গাটা অকুপাই করে নিন।
অগত্যা আমাকে উঠে গিয়ে ভদ্রমহিলার পায়ের কাছে বসতে হল। তিনি বইখানা সরিয়ে আমাকে লক্ষ্য করছেন। আমিও ওঁর আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলুম। দিনেরবেলা এরকম কালো সিল্কের শাড়ি কেমন যেন বেমানান। কেমন যেন বোরখার কথা মনে পড়িয়ে দেয়। উত্তর প্রদেশের অনেক খানদানি মুসলমান পরিবারের মেয়েদের আমি কালো সিল্কের বোরখা পরতে দেখেছি। ভদ্রমহিলার গায়ের রং টুকটুকে ফরসা, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, এককালে নিশ্চয়ই বেশ রূপসী ছিলেন, এখন যৌবন ঢলে পড়েছে। তবে তিনি সহজে বার্ধক্য মেনে নিতে রাজি নন, মুখের চামড়ার মসৃণতা চলে গেলেও চোখে সুর্মা, ভুরুতে কাজল, মাথার চুল নিশ্চয়ই কালো রং করা।
এই বয়সের কোনও-কোনও রমণীর একটা বিষণ্ণ সৌন্দর্য থাকে, গোধূলির আলোর মতন, খাঁচায় আটকানো হরিণীর চোখের মতন।
ভদ্রমহিলা মুসলমান বলেই মনে হয়। কিন্তু এই বয়েসের মুসলমান রমণীরা কি একা-একা ভ্রমণ করেন? ওঁর উপস্থিতির মধ্যে একটা বেশ আভিজাত্য আছে।
আমি ওঁর সঙ্গে নিজে থেকে কথা বলার কথা ভাবতেই পারিনি। বই খুলতে যাচ্ছিলুম, উনিই প্রথম জিগ্যেস করলেন, আপনি কোথায় যাবেন?
আমি সংক্ষেপে বললুম, দিল্লি।
উনি আবার জিগ্যেস করলেন, তাহলে আপনার কাছ থেকে অত কম টাকা নিল কেন? দিল্লীর ভাড়া তো অনেক বেশি!
আমি দু-এক মুহূর্ত চুপ করে রইলুম। মহিলাটি ভেবেছেন, আমি বিনা টিকিটে এই কামরায় উঠে পড়ে কিছু টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে নিয়েছি। ওঁর এই ধারণাটানা ভাঙলে কী হয়? আমার যে চেয়ার কারের টিকিট ছিল, সেটা চেপে গিয়ে হেসে বললুম, প্রায়ই তো এ লাইনে যাতায়াত করি, ওরা চেনে, শস্তা করে দেয়।
মহিলা আমার কথা শুনে খুশি হলেন না। উনি পুরো ভাড়া দিয়েছেন, অথচ একজন হাফ-ভাড়া দেওয়া লোকের জন্য তাঁকে জায়গা ছেড়ে দিতে হল!
এখন আমি সত্যিই অর্জুন ভরদ্বাজ হয়ে গেছি। ভাবছি, দেখাই যাক না কী হয়!
মহিলাটি কিছুক্ষণ বইতে মন দিলেন। একসময় অন্যমনস্কভাবে তাঁর পা আবার ছড়িয়ে গেল, সেই পা আমার গায়ে এসে লাগল।
কোনও পুরুষ মানুষের পা হলে আমি নিশ্চয়ই আপত্তি জানাতুম। ফরসা রমণীর পা, হোক না যৌবনোত্তীর্ণ, তাতে আপত্তির কোনও কারণ নেই।
একসময় তাঁর খেয়াল হল। তাড়াতাড়ি পা সরিয়ে নিয়ে বললেন, আমি দুঃখিত, ক্ষমা চাইছি, আপনার গায়ে পা লেগেছে বুঝতেই পারিনি।
আমি বললুম, তাতে কিছু হয়নি।
—আমার হাঁটুতে একটা ব্যথা, পা-টা টান করে রাখলে ভালো লাগে।
—আপনি পা-টা ছড়িয়ে দিন না, আমার কোনও অসুবিধা হবে না। এমন সুন্দর, ফরসা পা, পরিষ্কার, তকতকে, এর ছোঁয়া পেতে ভালো লাগে!
কথাটা বলে ফেলেই আমি লজ্জা পেলুম। কোনও অচেনা মহিলাকে ভালো করে আলাপ হওয়ার আগেই এতখানি স্তুতি করা ঠিক আমার স্বভাবসঙ্গত নয়। তবু কেন এরকম বললুম? ওষুধ। কোম্পানির প্রতিনিধিরা খুব চটপটে হয়, কোনও কিছু বলতেই তাদের মুখে আটকায় না। আমি এখন সেই ভূমিকায়।
মহিলাটি আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। একসময় তিনি নিশ্চয়ই তাঁর রূপের অনেক স্তুতি শুনেছেন, ইদানীং আর কেউ এমনভাবে বলবে না। খানিকটা অবাক হয়েছেন মনে হল।
শেষপর্যন্ত পা-দুটো তিনি আবার ছড়ালেন। আমি চেষ্টা করে একটু সরু হয়ে বসলুম।
তিনি জিগ্যেস করলেন, আপনি কোন কোম্পানিতে কাজ করেন?
একসময় আমি অনেক ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির সঙ্গে মিশেছি, অনেকে এখনও আমার বন্ধু। আমার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু যে-কোম্পানিতে কাজ করে, সেই জার্মান কোম্পানিটির নাম বলে দিলুম। এবং সেইসঙ্গে যোগ করলুম, আমাকে দিল্লী-কানপুর-এলাহাবাদ এইসব অঞ্চলেই বেশি ঘুরতে হয়।
—আপনার সঙ্গে কার্ড আছে?
এইবার আমি প্যাঁচে পড়লুম। ঠিক তো, এইসব প্রতিনিধিদের সব সময় নিজস্ব কার্ড নিয়ে ঘুরতে হয়। এটা আমার খেয়াল হয়নি।
চোখের পাতা না কাঁপিয়ে বললুম, হ্যাঁ, আছে।
উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্ট ও শার্টের পকেট চাপড়ে বললুম, ও সুটকেসের মধ্যে রয়ে গেছে। আপনাকে দিচ্ছি একটু পরে।
মহিলা বললেন, আমি কানপুরে নামব। অনেক দেরি আছে। সেই রাত্তির তিনটের সময়। ট্রেনের দুলুনিতে আমার ঘুম পায় খুব। যদি রাত্তিরে ঘুমিয়ে থাকি, কণ্ডাক্টর গার্ড কি আমাকে ডেকে দেবে?
আমি বললুম, আমিও ডেকে দিতে পারি। ট্রেনে আমার ঘুম আসে না।
–ধন্যবাদ।
—আপনি কি ট্রেনে প্রায়ই যাতায়াত করেন?
—না। মানে, দশ বছর পর এই প্রথম।
আমি ভেবেছিলুম এই ট্রেন যাত্রায় কারুর সঙ্গে কথা না বলে চুপচাপ কাটাব। সেইজন্যই আমার ছদ্মবেশ ধারণ। কিন্তু আমি নিজে থেকেই এই মহিলার সঙ্গে বেশি-বেশি কথা বলছি যেন। বোধহয় আমার ছদ্মবেশটা ভুল হয়েছে। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা খুব সপ্রভিত হয়, তারা চটপট নতুন লোকের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলতে পারে।
মহিলাটি সমস্ত কথাই বলছেন ইংরেজিতে। উচ্চারণ নির্ভুল। তাতে একটু আশ্চর্য লাগে!
না না, মেয়েদের মুখে নির্ভুল উচ্চারণে ইংরেজি শোনা আশ্চর্যের কিছু নয়। কিন্তু যে-সব মহিলা ইংরেজি সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত তাদের কেউ কি গরমকালের দিনেরবেলা কালো রঙের সিল্কের শাড়ি পরে? শুধু তাই-ই নয়, ভদ্রমহিলার মাথায় ঘোমটা দেওয়া, লক্ষ্য করে দেখলুম, সেটা একটা আলাদা পাতলা কালো ওড়না।
দশ বছর ট্রেনে চাপেননি, এখন উনি একলা কোথায় যাচ্ছেন? তা জানার জন্য আমার এত কৌতূহলই বা কেন?
সন্ধে হয়ে এসেছে, ভদ্রমহিলা একবার নামলেন। বোধহয় বাথরুমে যাবেন।
আমি জানলা দিয়ে চেয়ে রইলুম বাইরের দিকে। বাংলার সরল ভূমি ছেড়ে এখন ট্রেন ছুটছে বিহারের পার্বত্য এলাকা দিয়ে। সূর্য ডুবে গেছে, তবু আকাশের সব আলো এখনও মিলিয়ে যায়নি। ছোট-ছোট পাহাড়গুলির ওপরে যেন স্মৃতির মতন ছায়া পড়ছে।
ভদ্রমহিলার নাম জানা হল না। জানা যাবেও না। মহিলার নাম অকারণে জিগ্যেস করা যায় না।
একটু বাদে মহিলা ফিরে এলেন বাথরুম থেকে। ওঁর শরীরের গড়নটি বেশ লম্বা। বয়েস হলেও কোমরে মেদ জমেনি। হাতে বা গলায় কোনও অলংকার নেই। এমনকি একটি আংটিও নেই। ট্রেনে ছিনতাইবাজদের ভয়ে খুলে রেখেছেন? তবু মেয়েরা একেবারে বিনা অলংকারে থাকে না সাধারণত, অন্তত নকল কিছু পরে।
বিছানার ওপর একটা নীল কাপড়ের ব্যাগ। ভদ্রমহিলা ওপরে উঠতে যেতেই তাঁর হাতের ধাক্কায় ব্যাগটা ছিটকে মাটিতে পড়ে গেল। ঝনঝন শব্দ হল। টাকা-পয়সার নয়, অন্য কিছুর।
আমি ব্যাগটা তুলে নিলাম মাটি থেকে। তাতে শব্দ হল আবার। মনে হল ঘুঙুরের শব্দ। হ্যাঁ, কোনও সন্দেহ নেই।
ভদ্রমহিলা যেন খানিকটা ব্যস্ত হয়ে কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে নিলেন আমার হাত থেকে। সেটা পিঠের কাছ রেখে জানালা দিয়ে তাকালেন বাইরে। অর্থাৎ এখন আমার সঙ্গে কথা বলতে চান না।
এক প্রৌঢ়া মহিলা সঙ্গে ঘুঙুর নিয়ে চলেছেন কেন? নর্তকী নাকি! এই বয়সে নাচ কি মানায়? ছাড়া উনি বললেন, ওঁর হাঁটুতে ব্যথা। হয়তো কারুর জন্য ঘুঙুর উপহার নিয়ে যাচ্ছেন।
ভদ্রমহিলা পা মুড়ে আমার দিকে পেছন ফিরে বসলেন। চকিতে তাকালেন দু-একবার। কিছু কি বলতে চান? উনি কি চান আমি কিছুক্ষণের জন্য উঠে যাই? প্রসাধন-ট্রসাধন করবেন?
এয়ার কন্ডিশন্ড কামরায় সিগারেট খাওয়ার জন্য এমনিই মাঝে-মাঝে বাইরে যেতে হয়। বেশ অনেকক্ষণ সিগারেট টানা হয়নি। আমি উঠে এলাম। কিন্তু কৌতূহল রয়ে গেল। কিছু যেন একটা রহস্য আছে। বাইরে থেকে যা দেখা যায়, তার ভেতর থেকে হঠাৎ একটা কী যেন উঁকি মারে।
কাচের দরজা, আমি একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি মারলুম। ভদ্রমহিলা হাঁটু গেড়ে বসেছেন, হাতে একটা ছোট্ট বই। যতদূর মনে হচ্ছে উর্দুতে লেখা। প্রথম দেখে আমার যা ধারণা হয়েছিল, দেখা যাচ্ছে সেটাই ঠিক। মহিলা মগরেবের নামাজ পড়ছেন।
ইনি শুধু মুসলমান নন, রীতিমতন ধর্মপ্রাণা। ট্রেনের মধ্যেও নামাজ পড়া বাদ দিতে চান না। অথচ ইনি শুধু ইংরিজিতে কথা বলেন। এর সঙ্গে একটা থলির মধ্যে ঘুঙুর। কোনওটার সঙ্গে কোনওটা মেলে না।
নামাজ শেষ করতে কতক্ষণ সময় লাগে আমার ঠিক ধারণা নেই। পরপর দুটি সিগারেট শেষ করলুম। তারপরেও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলুম বাইরের দরজায় ঠেস দিয়ে। আমি এখন অর্জুন ভরদ্বাজ। তবু আমার বুকের মধ্যে এত কৌতূহল ছটফট করছে কেন? অর্জুন ভরদ্বাজের কী এরকম হয়?
ফিরে এসে দেখলুম, প্রার্থনা শেষ হয়ে গেছে। মহিলাটি এখন একটা কৌটো খুলে কিছু খাচ্ছেন। আমার মনে পড়ল, উনি সারাদিন কিছুই খাননি, আমরা লাঞ্চ খেয়েছি, বিকেলের চা খেয়েছি, উনি বেয়ারাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন। এখন কি রোজার মাস চলেছে নাকি?
আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ভদ্রমহিলা চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত উনি আমার সঙ্গে বেশ গল্প করছিলেন। ওই ঘুঙুরের থলিটা আমি দেখে ফেলার পরেই কেমন যেন বদলে গেলেন। উনি ভাবছেন, আমি কি ওঁর ব্যাপারে কিছু সন্দেহ করেছি? না, সন্দেহ নয়, তবে একটু খটকা লেগেছে ঠিকই।
খানিকবাদে পৌঁছে গেলুম গয়া স্টেশনে। শরীরের আড়ভাঙার জন্য নেমে প্লাটফর্মে পায়চারি করতে লাগলুম খানিকটা। হিন্দিতে কী যেন একটা ঘোষণা হচ্ছে। কান পেতে শুনলুম একবার। অদ্ভুত ঘোষণা। বারবার একই কথা বলছে।
ঘোষণাটি হচ্ছে এই যে, যাত্রী সাধারণকে সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে, কোনও অচেনা সহযাত্রী যদি বিড়ি, সিগারেট, খৈনি, পান, চা বা প্রসাদের নাম করে খাবার আপনাকে দেয়, তা হলে তা খাবেন না! কারণ, কোনও অপরাধ-কর্মী ওই সব খাবারের মধ্যে বিষ মিশিয়ে দিতে পারে। আপনি ঘুমিয়ে পড়লে বা অজ্ঞান হয়ে পড়লে আপনার মালপত্র নিয়ে পালাবে। এই সব অপরাধ কর্মীদের থেকে সাবধান!
গয়া স্টেশনে বুঝি খুব ঠক আর ফেরেবাজ বেড়েছে? এতবার এই কথা বলে যাচ্ছে কেন?
সেই ঘোষণা থেকে আমি একটা শব্দ শিখলাম। অপরাধ-কর্মী, এই হিন্দি শব্দটা বাংলাতেও অনায়াসেই ব্যবহার করা যায়।
ভদ্রমহিলাও উঠে এসে কামরার দরজার কাছে দাঁড়িয়েছেন। একবার মুখ বাড়িয়ে বললেন, পান, এই পান!
এই প্রথম আমি তাঁর মুখ থেকে একটা অ-ইংরেজি শব্দ শুনলুম।
কাছাকাছি কোনও পান-বিড়িওয়ালা নেই। মহিলা আমাকে কি অনুরোধ করবেন পান খোঁজার জন্য? কিন্তু এবারেও আমার দিকে চোখ পড়তেই মুখ ফিরিয়ে চলে গেলেন ভেতরে।
তবু আমি কাছাকাছি খুঁজলাম। পান পাওয়া গেল না।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, আমাকে দৌড়ে এসে উঠতে হল।
এইসব ট্রেনের সব কামরার ভেতর দিয়ে যাতায়াত করা যায়। আমাদের এই কামরার পাশেই ডাইনিংকার। সেইজন্য মাঝে-মাঝেই কিছু লোক এখান দিয়ে যাচ্ছে।
আমি আমার সিটে সবে এসে বসেছি, হঠাৎ একটি যুবক আমাকে দেখে চেঁচিয়ে বলে উঠল, আরে সুনীলদা! আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
আমি আঁৎকে উঠলুম। ছেলেটির মুখ বেশ চেনা-চেনা যদিও নামটা মনে নেই। আর তো ছদ্মবেশ রাখা যাবে না।
অতি উৎসাহে ছেলেটি নানা রকম বকবক করতে লাগল। তাও শুধু বাংলায় কথা বললে নিষ্কৃতি ছিল। তার সঙ্গে তার এক বন্ধু, তার সঙ্গে সে ইংরিজিতে পরিচয় করে দিল আমার। কিউবিকলের কয়েকজন লোক চোখ সরু করে তাকাল আমার দিকে। এরা জেনে গেছে, আমার নাম অন্য, পেশা অন্য।
ছেলেটিকে বিদায় দেওয়ার পর আমি গল্পের বইতে মুখ আড়াল করে রইলুম। আমি নিজেই একটা খেলা খেলছিলুম তাতে কারুর তো কোনও ক্ষতি হয়নি।
মুশকিল হচ্ছে, কালো শাড়ি পরা মহিলার মুখোমুখি বসতে হয়েছে আমাকে। মুখ তুললেই চোখাচোখি হয়ে যায়। সঙ্গে-সঙ্গে তিনি মুখটা সামান্য একটু সরিয়ে নেন। এখন তাঁর ঠোঁটে যেন একটা পাতলা হাসি। যেন তিনি একটা প্রতিশোধের সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর ঘুঙুরের থলিটা দেখে ফেলে আমি তাঁর একটা গোপন ব্যাপার জেনে ফেলেছি। এবারে তিনিও আমারটা জেনেছেন।
যাক, কাটাকুটি হয়ে গেছে। তবু উনি আর আমার সঙ্গে কথা বলছেন না কেন? আমি ছেঁড়া আলাপ আবার জমাবার জন্য বললুম, বাইরের আকাশটা লাল, বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে!
ভদ্রমহিলা কোনও উত্তর দিলেন না।
আমি তাঁর পায়ের দিকে তাকালুম। এই পায়েই কি ঘুঙুর বাঁধা হয়? কিন্তু এঁর পেশা যদি নাচ হয়, তা হলে তিনি দশ বছর ট্রেনে চাপেননি? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? যে নিয়মিত নামাজ পড়ে তার পক্ষে নাচ-গান কি হারাম নয়? কিছুই যেন মেলাতে পারছিনা। পরের স্টেশনে আবার আমি। নামলুম সিগারেট খাওয়ার জন্য। সামনে দিয়েই একজন পানওয়ালা যাচ্ছে। আমার মনে পড়ে গেল, ভদ্রমহিলা পান খুঁজছিলেন। উনি কি পান খান, সাদা না জর্দা দেওয়া? জিগ্যেস করে আসার সময় নেই। আমি দুরকমের দুটি পানই নিলুম।
যাদের পানের নেশা তারা নিশ্চয়ই পান পেলে খুশী হয়। আমি কামরায় ঢুকে হাসি মুখে বললুম, আপনার জন্য পান এনেছি।
মহিলার মুখ অন্যদিকে ফেরানো।
আমি আরও কাছে এসে বললুম, আপনার জন্য পান এনেছি, আপনি খুঁজছিলেন।
ভদ্রমহিলা এবার মুখ ফিরিয়ে একটা বিস্ময়ের দৃষ্টি দিলেন। তারপর বললেন, আমি তো এখন পান চাই না।
আমি আন্তরিক অনুনয়ের সুরে বললুম, আপনি আগের স্টেশনে খুঁজছিলেন, আমি দুরকম পান…
উনি আবার বললেন, আমার পান দরকার নেই।
তারপর সেই ঘুঙুরের থলিটা তুলে শক্ত করে বুকে চেপে রইলেন।