হ্যা, যায়।’ কীভাবে ? ‘অনেকভাবে।’
‘আপনার কথাবার্তার কোনাে ঠিক নেই। আপনি কী করে ভাবলেন। আমি একটা মানুষ মারতে পারি ?
‘সবাই পারে।‘ ‘আপনি পারেন ?
না।। ‘আপনি পারেন না কেন ? ‘আমি জানি না।’ ‘মানুষ মারা যে মহাপাপ এটা কি আপনি জানেন ? ‘আমি জানি না।‘ ‘আপনি আসলে কিছুই জানেন না। হতে পারে। ‘তা ছাড়া আপনি আরেকটা জিনিস ভুলে যাচ্ছেন— ধরুন আমি ঐ পচা মেয়েটাকে মেরে ফেললাম, তখন পুলিশ আমাকে ছেড়ে দেবে ? আমাকে ধরে নিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবে না ?’
‘তা দিতে পারে।’
‘আর ভাইয়ার অবস্থাটা তখন চিন্তা করে দেখুন। কীরকম রাগ সে করবে। টাকা-পয়সা দেয়া বন্ধ করে দেবে। আমরা তখন না-খেয়ে মারা যাব। বাবার এক পয়সা রােজগার নেই, আমাদের ব্যাংকে টাকা–পয়সা নেই। ভাইয়া প্রতি মাসে যে টাকা পাঠায় এটা দিয়ে আমরা চলি। ভাইয়া প্রতি মাসে কত পাঠায় বলুন তাে ?
‘আমি জানি না।’
‘একশাে ডলার । একশাে ডলারে বাংলাদেশী টাকায় কত হয় তা জানেন ?‘
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ
না। ‘বেশি না, সাড়ে তিন হাজার । মা এবার কী ঠিক করে রেখেছেন। জানেন ? মা ঠিক করে রেখেছেন–ভাইয়াকে বলবেন আরাে কিছু বেশি টাকা পাঠাতে। একশাে ডলারে হচ্ছে না। জিনিসপত্রের যা দাম। আপনাদের তাে আর কোনােকিছু কিনতে হয় না। আপনারা আছেন সুখে, তা–ই না ?‘
‘আমি জানি না। ‘আচ্ছা আপনার কী মনে হয় ভাইয়া টাকার পরিমাণ বাড়াবে ? ‘আমি জানি না।’
না বাড়ালে আমাদের খুব কষ্টের মধ্যে পড়তে হবে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে বাড়াবে না। বিয়ে করেছে, খরচ বেড়েছে। তাই না ?
হতে পারে।’
টাকা না বাড়ালে কী হবে বলুন তাে! আমার আরেক ভাই আছেন জসিম ভাইয়া। চিটাগাঙে থাকেন। তাঁর টাকা-পয়সা ভালােই আছে। কিন্তু সে আমাদের একটা পয়সা দেয় না। আমরা যদি না খেয়ে মরেও যাই সে ফিরে তাকায় না। কী করা যায় বলুন তাে ?
ক্লারাকে মেরে ফেলা যাক। বারবার আপনি এক কথা বলেন কেন ? আপনার কাছে বুদ্ধি চাচ্ছি। ‘ক্লারাকে মেরে ফেলাই একমাত্র বুদ্ধি।
যান। আপনার সাথে আর কথাই বলব না।’
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ
নাসরিন ওইজা বাের্ড বন্ধ করে ঘুমুতে গেল । আজ আর গতরাতের মতাে চট করে ঘুম এল না। একটু যেন ভয়-ভয় করতে লাগল । ওইজা বাের্ড টেবিলের ওপর রাখা হয়েছে। তার কাছেই একটা চেয়ার। নাসরিনের কেন জানি মনে হচ্ছে চেয়ারে ঐ মি. এক্স বসে আছেন। বুড়াে ধরনের একজন মানুষ, যার গায়ে চুরুটের গন্ধ। ঐ বুড়াে মানুষটার একটা চোখে ছানিপড়া। গায়ে চামড়ার কোট। সেই কোটেও এক ধরনের ভ্যাপসা গন্ধ ।
নাসরিন কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু তার স্পষ্ট মনে হচ্ছে কেউ একজন আছে ।
নাসরিন ভয়ে-ভয়ে বলল, আপনি কি আছেন ? চেয়ার নড়ে উঠল। সত্যি নড়ল ? না মনের ভুল ? নাসরিন ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনি দয়া করে বসে থাকবেন না । চলে যান। যখন আপনাকে দরকার হবে আমি ডাকব ।
আবার চেয়ার নড়ল । নিশ্চয়ই মনের ভুল।
নাসরিনের বড় ভয় লাগছে। জুন মাসের এই প্রচণ্ড গরমের রাতেও একটা চাদরে সারা শরীর ঢেকে সে শুয়ে রইল। ঘুম এল একেবারে শেষ রাতে। তাও গাঢ় ঘুম না। আজেবাজে সব স্বপ্ন। একটা স্বপ্ন তাে খুবই ভয়ংকর। তার শাড়িতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। সে অনেক চেষ্টা করছে আগুন নেভাতে পারছে না। যতই চেষ্টা করছে আগুন আরাে ছড়িয়ে পড়ছে। একজন বুড়ােমতাে লােক চুরুট-হাতে পুরাে ব্যাপারটা দেখছে, কিছুই করছে না।
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১১)-হুমায়ুন আহমেদ
টাকার পরিমাণ বাড়ানাের দাবি রাহেলা অনেক ভণিতার পর করলেন । বলতে তাঁর খুবই লজ্জা লাগল, কিন্তু কোনাে উপায় নেই।
আলাউদ্দিন তখন চা খাচ্ছিল। চায়ের কাপ নামিয়ে বিস্মিত গলায় বলল, টাকা বাড়াতে বলছ ?
‘হ্যা। ‘একশাে ডলারে তােমাদের হচ্ছে না ?’
‘তােমরা কি পাগল-টাগল হয়ে গেলে ? আমেরিকায় কি আমি টাকার চাষ করছি ? ট্রাকটার দিয়ে জমি চষে টাকার চারাগাছ বুনে দিচ্ছি ?
রাহেলা ক্ষীণস্বরে বললেন, সংসার অচল।
‘সংসার তাে আমারটা আরাে বেশি অচল। বিয়ে করেছি— নতুন সংসার । অ্যাপার্টমেন্ট নিয়েছি। একটা জিনিস নেই অ্যাপার্টমেন্টে। ক্লারা অফিস করে, তার একটা আলাদা গাড়ির দরকার। তােমাদের টাকা তাে বাড়াতে পারবই না, বরং কিছু কমিয়ে দেব বলে ভাবছি।
‘আমাদের চলবে কীভাবে?
‘জসিম ভাইকে বলাে। তারও তাে কিছু দায়িত্ব আছে। সে তাে গায়ে ফু দিয়ে ঘুরছে।
রাহেলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আলাউদ্দিন বিরক্ত স্বরে বলল, এরকম ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলবে না মা । নিশ্বাস ফেলে সমস্যার সমাধান হয় না।
নাসরিন ওইজা বাের্ড নিয়ে বসেছে । রাত প্রায় দুটো । আজ অন্যদিনের মতাে গরম নয়। সন্ধ্যাবেলায় তুমুল বর্ষণ হয়েছে। আকাশ মেঘলা । বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আবারও হয়তাে বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির ছাঁট আসছে বলে জানালা বন্ধ।
‘আপনি কি আছেন ? ‘হ্যা।’