মিসেস হাসনা বানুর সঙ্গে এই হচ্ছে আমার পরিচয়ের সূত্র। পরিচয় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তিনি নিউক্লিয়ার মেডিসিন গবেষণায় একটি বৃত্তি নিয়ে আমেরিকায় জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাবার পর যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এখন যে গল্পটি বলব সেটি তাঁর কাছ থেকে শােনা। যেভাবে শুনেছি অবিকল সেইভাবে গল্পটি বলার চেষ্টা করছি
মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করে বেরুবার পরপর আমি একটা ক্লিনিকে চাকরি নিই। এখন যেমন চারদিকে ক্লিনিকের ছড়াছড়ি, তখন তেমন ছিল না। অল্প কয়েকটা ক্লিনিক ছিল— সবই মাতৃসদন। আমি যে ক্লিনিকে চাকরি নিই সেটা সেই সময়ের খুব নামী ক্লিনিক। ধনী পরিবারের মা’রাই শুধু আসতেন। সুযােগ-সুবিধা ভালাে ছিল। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিমছাম ক্লিনিক। সর্বসাকুল্যে পনেরােটা বেড ছিল । দশটি ‘এ’ ক্যাটাগরির, পাচটি বি’ ক্যাটাগরির। এ’ ক্যাটাগরির ঘরগুলিতে এয়ারকুলার বসানাে ছিল। আমরা ডাক্তার ছিলাম তিনজন। প্রধান ডাক্তার মেডিক্যাল কলেজের একজন অধ্যাপক।
আমি এবং নাসিমা আমরা দুজন সদ্য পাস করা ডাক্তার। অবিশ্যি সব কাজ আমরা দুজনই দেখতাম। যেহেতু ছােট্ট ক্লিনিক আমাদের কোনাে অসুবিধা হতাে না। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমাদের ক্লিনিকে আঠারাে-উনিশ বছরের একটি মেয়ে ভরতি হলাে। প্রথম মা হতে যাচ্ছে। ভয়ে অস্থির। আমি প্রাথমিক পরীক্ষা করে দেখলাম এখনও অনেক দেরি। একেকটা কনট্রেকসানের ভেতর গ্যাপ অনেক বেশি। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম। বললাম, ভয়ের কিছু নেই।
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ
মেয়েটি করুণ গলায় বলল, তুমি তাে বাচ্চা মেয়ে। তুমি পারবে ? তুমি জান সবকিছু ?
আমি হেসে ফেললাম। হাসতে হাসতেই বললাম, আমি বাচ্চা নই, তা ছাড়া আমি একজন খুব ভালাে ডাক্তার। আপনার কোনাে ভয় নেই। আমি ছাড়াও এখানে ডাক্তার আছেন। একজন প্রফেসর আছেন। তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাকে দেখবেন।
রুগিণী বললেন, ভাই তােমাকে তুমি করে বলেছি বলে রাগ করনি তাে ?
না।’ ‘আমার এমন বদভ্যাস, যাকে পছন্দ হয় তাকেই তুমি বলে ফেলি।’
আমি কাগজপত্র ঠিকঠাক করার জন্য ভদ্রমহিলার স্বামীকে নিয়ে অফিসে চলে এলাম। দেখা গেল খুবই ম আটটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে । হােমড়া-চোমড়া ধরনের কিছু মানুষ বিরক্তমুখে হাঁটাহাঁটি করছে। একজন অতি বিরক্ত গলায় বলছে, আপনাদের ব্যবস্থা
তাে মােটেই ভালাে না। ইমার্জেন্সি হলে পেশেন্টকে আপনারা কী করবেন ? এখানে কি অপারেশন করার ব্যবস্থা আছে ?
‘জী আছে।’
আপনাদের নিজস্ব জেনারেটর আছে ? ধরুন হঠাৎ যদি ইলেকট্রিসিটি চলে যায় তখন ? তখন কী করবেন ? মােমবাতি জ্বালিয়ে তাে নিশ্চয়ই
অপারেশন হবে না ?
লােকগুলি আমাদের বিরক্ত করে মারল । দাড়িওয়ালা এক ভদ্রলােক বললেন, আপনাদের এখান থেকে আমরা বেশকিছু টেলিফোন করব। দয়া করে বিরক্ত হবেন না। সব পেমেন্ট করা । মানি উইল নট বি এ প্রবলেম ।
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ
রুগিণী ভরতি হয়েছেন বিকেলে, রাত নটা বাজার আগেই স্রোতের মতাে মানুষ আসতে লাগল । অনেকের হাতে ফুলের গুচ্ছ, অনেকের হাতে উপহারের প্যাকেট। বিশ্রী অবস্থা । | আমি সহজে ধৈর্য হারাই না। আমারও শেষ পর্যন্ত মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমি বললাম, আপনারা কী শুরু করেছেন ? এটাকে একটা বাজার বানিয়ে ফেলেছেন। দয়া করে ভিড় পাতলা করুন। একজন শুধু থাকুন।
ডেলিভারি হােক তখন আসবেন।
আমার কথায় একজন ভদ্রমহিলা, সম্ভবত মেয়ের শাশুড়ি হবেন চোখ-মুখ লাল করে বললেন, আপনি কি জানেন এই মেয়ে কোন বাড়ির বউ ?
আমি বললাম, আমি জানি না। আমি জানতেও চাই না। সে আমার পেশেন্ট এইটুকু শুধু জানি। আর দশটা পেশেন্টকে আমি যেভাবে দেখব তাকেও একইভাবে দেখা হবে।
‘আর দশটা বউ এবং আমার ঘরের বউ এক ? ‘আমার কাছে এক। ‘জান, আমি এই মুহূর্তে তােমার চাকরি খেতে পারি।’
আমি শীতল গলায় বললাম, আপনি আমার চাকরি খেতে পারেন না। চিকিৎসক হিসেবে আমার কোনাে ব্যর্থতা পাওয়া গেলে তবেই চাকরি যেতে পারে, তার আগে নয়। আপনি শুধু-শুধুই চাচামেচি করছেন।
ভদ্রমহিলা রেগে গিয়ে স্কাউনড্রেল, লােফার এইসব বলতে লাগলেন। একজন ভদ্রমহিলা এমন কুৎসিত ভাষায় কথা বলতে পারেন আমার জানা ছিল না। বিরাট হইচই বেধে গেল। আমাদের প্রফেসর এলেন । ভেবেছিলাম তিনি আমার পক্ষে কথা বলবেন। তা বললেন না। আমার ওপর অসম্ভব রেগে গেলেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে সবার সামনে উঁচু গলায় বললেন- হাসনা, তােমাকে এখানে চাকরি করতে হবে না। ইউ ক্যান লিভ ।
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ
আমি আমার নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমার প্রফেসর জানেন কত আগ্রহ, কত যত্ন নিয়ে আমি এখানে কাজ করি; অথচ তিনি…
আমি রিকশা নিয়ে বাসায় চলে এলাম। সহজে আমার চোখে পানি আসে না । কিন্তু রিকশায় ফিরবার পথে খুব কাঁদলাম। তখন বয়স অল্প। মন ছিল খুব স্পর্শকাতর। | রাত এগারােটায় প্রফেসর আমাকে নিতে এলেন। করুণ গলায় বললেন, হাসনা খুব কেলেঙ্কারি হয়ে গেছে। তুমি চলে আসার পর ক্লিনিকের কেউ কোনাে কাজ করছে না। অসহযােগ আন্দোলন। এরকম যে দাঁড়াবে কল্পনাও করিনি। এখন তুমি চলাে।
আমি বললাম, স্যার আমার যাবার প্রশ্নই ওঠে না। আপনি রুগীর আত্মীয়দের বলুন তাকে অন্য কোনাে ক্লিনিকে নিয়ে যেতে।
বলেছিলাম। পেশেন্ট যাবে না । সে এইখানেই থাকবে।’ এইখানেই থাকবে ? ‘হ্যা, এইখানেই থাকবে। এবং সে বলে দিয়েছে ডেলিভারির সময় তুমি ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি থাকতে পারবে না। এখন তুমি যদি না যাও আমার খুব মুশকিল হবে। আমি খুব বিপদে পড়ব । তুমি তাে বাইরের জগতের কোনাে
খি না। যদি রাখতে তা হলে বুঝতে এই মেয়ে কোন। পরিবারের মেয়ে। বাংলাদেশের মতাে দেশে এরা যা ইচ্ছা করতে পারে। তুমি চলাে।
স্যার, আমি যাব না। ওরা যা ইচ্ছা করুক। | ‘হাসনা, অন্য সবকিছু বাদ দাও । তুমি পেশেন্টের দিকে তাকাও। সে তােমার ওপর নির্ভর করে আছে। আমার ওপর তােমার রাগটা বড়, না পেশেন্টের প্রতি তােমার দায়িত্ব বড়?
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৩)-হুমায়ুন আহমেদ
আমি শালগায়ে বের হয়ে এলাম। ক্লিনিকে তখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। ওয়েটিংরুমে তিনজন শুধু বসে আছেন। রুগিণীর কাছে দুজন— একজন রুগিণীর শাশুড়ি। তিনি আমাকে দেখেই শীতল গলায় বললেন, রাগের মাথায় কী বলেছি কিছু মনে রেখাে না মা। রাগ উঠলে আমার মাথা ঠিক থাকে না।
আমি বললাম, আমি কিছু মনে রাখিনি ।।
‘বউমা তখন থেকে বলছিল, সে তােমাকে যেন কী বলতে চায়। তুমি ওর কথাটা শােনাে। ও খুব ভয় পেয়েছে।