ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ

আমি মেয়েটির পাশে এসে দাঁড়ালাম। 

মেয়েটি ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনারা ঘর থেকে যান মা। আমি ওর সঙ্গে একা কথা বলব। আর কেউ যেন না থাকে।ছায়াসঙ্গী

ভদ্রমহিলা দুজন নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে ঘর ছেড়ে গেলেন। মেয়েটা বলল, ভাই তুমি দরজাটা বন্ধ করে দাও। 

তার কি দরকার আছে

আছে। তুমি লক করাে। তােমার সঙ্গে আমার খুব জরুরি কথা, দরজা বন্ধ করে তুমি আমার পাশে এসে বসাে। আমি তাই করলাম। কনট্রেশানের সময় কমে এসেছে। ব্যথার ধকল সামলাতে মেয়েটির খুবই কষ্ট হচ্ছে। তার গলার স্বর পালটে গেছে। মনে হচ্ছে সে অনেকদূর থেকে কথা বলছে। সে আমার হাত ধরে বলল, ভাই তােমার কি রাগ কমেছে ? 

ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ

‘হ্যা কমেছে। ‘তুমি আমার গায়ে হাত দিয়ে বলাে যে তােমার রাগ কমেছে। আমি তার কপালে হাত রেখে বললাম, আমার রাগ কমেছে। 

‘আমি তােমাকে তুমি তুমি করে বলছি বলে রাগ করছ না তাে ? তুমি নিশ্চয়ই বয়সে আমার বড়। 

‘আমি মােটেই রাগ করিনি।’ 

‘আমি সবাইকেই তুমি তুমি বলি না। যাদের আমার খুব প্রিয় মনে হয়, খুব আপন মনে হয় তাদের আমি তুমি বলি । তােমাকে প্রথম দেখেই আমার ভালাে লেগেছে । তুমিও কিন্তু আমাকে তুমি বলবে। 

কথা বলতে তােমার কষ্ট হচ্ছে, তুমি বরং চুপ করে থাকো । বড় বড় করে নিশ্বাস নাও। আমার মনে হয় তােমার প্লাসেন্টা ভাঙতে শুরু করেছে। 

আর কত দেরি ? ‘এখনও দেরি আছে। রাত তিনটার আগে কিছু হবে না। রাত তিনটা পর্যন্ত তােমাকে কষ্ট করতে হবে।

ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ

‘এখন ক’টা বাজে?’ 

বারােটা একুশ। ‘মনে হচ্ছে ঘড়ি চলছেই না। 

আমি উঠে দাঁড়ালাম। কিছু রুটিনকাজ আছে। এগুলি সারতে হবে । নরমাল ডেলিভারির জন্য বাচ্চার পজিশন ঠিক আছে। তবু ইমার্জেন্সির জন্যে তৈরি থাকা ভালাে। 

মেয়েটি বলল, যেজন্যে তােমাকে বসিয়েছিলাম তা এখনও বলিনি। তুমি বসাে। উঠে দাঁড়ালে কেন ? আসল কথা তাে বলিনি । 

আমি বসলাম । মেয়েটি ফিসফিস করে বলল, ওরা আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলবে। 

ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ

আমি চমকে উঠলাম। এই মেয়ে এসব কী বলছে, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আবােল-তাবােল বকছে না তাে ? 

‘আমি জানি ওরা আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলবে। ‘কারা ? 

‘আমার শ্বশুরবাড়ির লোেকরা। ডাক্তার, নার্স সবাইকে টাকা দিয়ে কিনে ফেলেছে। তােমাকেও কিনবে । তারপর বাচ্চাটাকে মারবে। 

‘তুমি এসব কী বলছ ? ‘যা সত্যি আমি তা-ই বলছি। ‘ওরা বাচ্চাকে মারবে কেন? | মেয়েটি জবাব দিল না। ব্যথার প্রবল ঝাপটা সামলাবার চেষ্টা করল। আমি তাকে সময় দিলাম। আমার মনে হলাে মেয়েটা সম্ভবত পুরােপুরি সুস্থ। নয়। হয়তাে কিছু অস্বাভাবিকতা তার মধ্যে আছে।

ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ 

তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না। তাই না ? না। ‘যা সত্যি তা আমি বললাম। ‘তুমি জানলে কী করে ওরা বাচ্চাটাকে মেরে ফেলতে চায় ? ‘আমাকে বলেছে। ‘কে বলেছে ? ‘আমার বাচ্চাটা আমাকে বলেছে।’ 

আমি পুরােপুরি নিঃসন্দেহ হলাম মেয়েটার মাথা খারাপ । সম্ভবত সে পারিবারিক জীবনে খুব অসুখী। শ্বশুরবাড়ির কাউকে তার পছন্দ না । সবাইকেই সে শত্রুপক্ষ ধরে নিয়েছে। মেয়েটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, 

তুমি আমার কথা এক বর্ণও বিশ্বাস করনি, তাই না ? 

ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ

 ‘তুমি ঠিকই ধরেছ । বিশ্বাস করার কথা না। তােমার বাচ্চা তােমাকে কী করে বলবে ।

‘ও আমাকে স্বপ্নে বলেছে। একবার না, অসংখ্যবার বলেছে।’ 

‘স্বপ্নে বলেছে ? ‘হা স্বপ্নে। গতকাল শেষরাতেও স্বপ্নে দেখেছি। ‘কী দেখেছ ?’ 

‘দেখলাম আমার বাচ্চাটা আমাকে বলছে মা সবাই মিলে আমাকে মেরে ফেলবে । সবাই যুক্তি করে আমাকে মারবে। মা, আমি কী করি ? 

বলতে বলতে মেয়েটি থরথর করে কাঁপতে লাগল । 

আমি তাকে বললাম, প্রথমবার যেসব মেয়ে কনসিভ করে তাদের প্রায় সবাই ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখে। যেমন— তারা মারা যাচ্ছে, মৃত বাচ্চা হচ্ছে— এইসব। এর কোনাে মানে নেই। মেয়েরা সেই সময় খুব আতঙ্কগ্রস্ত থাকে বলেই এরকম স্বপ্ন দেখে। 

‘আমি জানি আমি যা স্বপ্নে দেখেছি তা-ই হবে, আমার স্বপ্ন অন্য মেয়েদের স্বপ্নের মতাে নয়। সবাই যুক্তি করে আমার ছেলেটাকে মারবে।’ 

আমি হাসতে হাসতে বললাম, তােমার কোলে যখন ফুটফুটে একটা বাচ্চা দিয়ে দেব, তখন তুমি বুঝবে যে কত বড় মিথ্যা সন্দেহ তােমার মধ্যে ছিল।’ 

মেয়েটার চোখ চিকচিক করতে লাগল । সে গাঢ় স্বরে বলল, সত্যি তুমি তা-ই করবে ? 

ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৪)-হুমায়ুন আহমেদ

‘অবশ্যই! 

‘তাহলে তুমি প্রতিজ্ঞা করাে। কোরান শরিফ ছুঁয়ে বলাে তুমি বাচ্চাটাকে মারবে না। ওরা যখন মারতে চাইবে তুমি মারতে দেবে না। 

তুমি ফেরাবে।’ 

‘একটা শিশুকে আমি খুন করব এটা তুমি বলছ ? ‘তুমি কোরান শরিফ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করাে। ‘প্রতিজ্ঞার কোনাে দরকার নেই।’ দরকার থাকুক বা না-থাকুক তুমি প্রতিজ্ঞা করাে। ‘কোরান শরিফ এখানে পাব কোথায় ? 

‘আমার সঙ্গে আছে। আমার ঐ কালাে ব্যাগটার ভেতর । আমি নিয়ে এসেছি। 

রুগীকে শান্ত করার জন্যেই প্রতিজ্ঞা করতে হলাে। রুগী শান্ত হলাে। । তার অস্থিরতা আরাে বেড়ে গেল। সে চাপাগলায় বলল, আমি জানি 

তুমি প্রতিজ্ঞা রাখতে পারবে না। যদি না রাখ তাহলে আমার অভিশাপ লাগবে। আমি তােমাকে একটা কঠিন অভিশাপ দিচ্ছি। | মেয়েটি সত্যি সত্যি একটা কঠিন অভিশাপ দিয়ে বসল।

মেয়েটার মাথার যে ঠিক নেই, সে যে অসুস্থ একটি মেয়ে তার আরেকটি প্রমাণ পেলাম। তবে তার এই অসুস্থতা, এই মানসিক যন্ত্রণা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। একটি হাসিখুশি শিশু তার সমস্ত কষ্ট ভুলিয়ে দেবে । 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *