ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৫)-হুমায়ুন আহমেদ

সবকিছুই ঠিকঠাকমতাে চলছিল। 

রাত দুটায় বাইরের দুজন পুরুষ-ডাক্তার এলেন। ছায়াসঙ্গীডেলিভারির সময় এঁরা থাকবেন। এঁদের মধ্যে একজন আমার পরিচিত। ডাক্তার সেন । বড় ডাক্তার এবং ভালাে ডাক্তার। 

আমাদের রুগিণী নতুন ডাক্তার দুজন দেখেই আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আমার হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, এরা কারা ? এরা আমার বাচ্চাকে খুন করবে। 

আমি বললাম, তুমি নিশ্চিত থাকো— আমি সারাক্ষণ এখানে থাকব। এক সেকেন্ডের জন্যে নড়ব না। তাছাড়া ডাক্তার সেনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাঁর মতাে ডাক্তার কম আছে । 

‘মনে থাকে যেন তুমি প্রতিজ্ঞা করেছ। ‘আমার মনে আছে। ‘প্রতিজ্ঞা ভাঙলে আমার অভিশাপ লাগবে। 

আমার মনে আছে।’ 

তার কিছুক্ষণ পরই ভদ্রমহিলার স্বামী আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। খুবই অল্প বয়স্ক একজন যুবক। তাকে বেশ ভদ্র ও বিনয়ী মনে হলাে। তবে যে কোনাে কারণেই হােক তাকে বেশ ভীত বলে মনে হচ্ছিল। ভদ্রলােক নরম স্বরে বললেন, আপা, আমার স্ত্রী সম্ভবত আপনাকে কিছু বলেছে। আপনি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। ও এসব কেন যে বলছে কিছু বুঝতে পারছি না। আমাদের বাচ্চাটা সংসারের প্রথম সন্তান। আমি আমাদের পরিবারের বড় ছেলে। অথচ ওর ধারণা… আমি ভদ্রলােককে আশ্বস্ত করার জন্যে বললাম, আপনি এসব নিয়ে মােটেই মাথা ঘামাবেন না। 

ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৫)-হুমায়ুন আহমেদ

সব ঠিকঠাক আছে তাে আপা ? 

সব ঠিক আছে।’ সিজারিয়ান লাগবে না ? 

নরমাল ডেলিভারি হবে। তাছাড়া ডাক্তার সেন এসেছেন। উনি খুবই বড় ডাক্তার এবং হাইলি স্কিলড। 

‘তাহলে আপনি বলছেন সব ঠিকঠাক হবে ? ‘হ্যা। 

রাত তিনটার পর থেকে দেখা গেল সব কেমন বেঠিক চলছে। বাচ্চা নেমে এসেছে বার্থ চ্যানেলের মুখে। এই সময় ডাক্তার সেন বললেন, বাচ্চার পজিশন তাে ঠিক নেই। মাথা উপরের দিকে। এতক্ষণ তােমরা কী 

মনিটর করেছ ? 

আমিও দেখলাম তাই। এরকম হওয়ার কথা নয়। কিছুক্ষণ আগেই সব পরীক্ষা করা হয়েছে। আমরা মুখ-চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম। প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে লাগল। এই সময় এত রক্তপাতের কারণই নেই। টকটকে লাল রঙের রক্ত যা ধমনি থেকে আসছে। সমস্যাটা কোথায় ? 

ব্লাড ক্রস ম্যাচিং করা ছিল রক্ত দেয়া শুরু হলাে, কিন্তু এটা সমস্যার কোনাে সমাধান নয়। মনে হলাে রুগিণী বাইরের রক্ত ঠিক গ্রহণ করতে পারছে না। ডাক্তার সেন গম্ভীর গলায় বললেন, সামথিং ইজ ভেরি রং। 

আমাদের সবার গা দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। ডাক্তার এসব কী বলছেন! 

ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৫)-হুমায়ুন আহমেদ

কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্বিতীয় সমস্যা দেখা দিল- হঠাৎ করে কনট্রেকশান বন্ধ হয়ে গেল। অথচ এই সময়ই কনট্রেকশান সবচে বেশি প্রয়ােজন। শিশুটি কি বার্থ চ্যানেলে মারা গেছে ? 

রুগিণী ফিসফিস করে বলল, আমার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। 

ডাক্তার সেন ফোরসেপ ডেলিভারির প্রস্তুতি নিলেন আর তখন ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। আজকাল বাতি চলে গেলেই ইমার্জেন্সি বাতি জ্বলে ওঠে, তখনকার অবস্থা তা ছিল না। তবে আমাদের কাছে টর্চ, হ্যাজাক, মােমবাতি সবসময় থাকে। সমস্যার সময় ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়া কোনাে নতুন ঘটনা নয়। কাজেই প্রস্তুতি থাকবেই। দ্রুত হ্যাজাক জ্বালানাে হলাে। 

প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরিশ্রম করে ডাক্তার সেন ডেলিভারি করালেন— যে জিনিসটি বেরিয়ে এল, আমরা চোখ বড় বড় করে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।

ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৫)-হুমায়ুন আহমেদ 

কুৎসিত কদাকার একটা কিছু যার দিকে তাকানাে যায় না। এ আর যা-ই হােক, মানবশিশু নয়। চেনাজানা পৃথিবীর সঙ্গে তার কোনাে যােগ নেই। ঘন কৃষ্ণবর্ণের একতাল মাংসপিণ্ড। এর থেকে হাতির শুড়ের মতাে আট-দশটি শুড় বেরিয়ে এসেছে। শুড়গুলি বড় হচ্ছে এবং ছােট হচ্ছে। তালে তালে মাংসপিণ্ডটিও বড়ছােট হচ্ছে। মানবশিশুর সঙ্গে এর একটিমাত্র মিল— এই জিনিসটিরও দুটি বড় বড় চোখ আছে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে দেখছে চারদিকের পৃথিবীকে । চোখ দুটি সুন্দর । কাজলটানা । 

ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৫)-হুমায়ুন আহমেদ

ডাক্তার সেন হতভম্ব গলায় বললেন, হােয়াট ইজ দিস ? হােয়াই ইজ দিস ? ফোরসেপ দিয়ে ধরা জন্তুটাকে তিনি মাটিতে ফেলে দিলেন। মেঝেতে সে কিলবিল করতে লাগল। মনে হচ্ছে শুড়গুলিকে পায়ের মতাে ব্যবহার করে সে এগুতে চাচ্ছে। আমার সঙ্গের সহকর্মী হঠাৎ পেটে হাত দিয়ে বমি করতে শুরু করল। 

আমাদের পরম সৌভাগ্য যে রুগিণীর জ্ঞান নেই। জ্ঞান থাকলে এই ভয়াবহ দৃশ্য তাকে দেখতে হতাে। 

ডাক্তার সেন বললেন- কিল ইট। এক্ষুনি এটাকে মেরে ফেলা দরকার। 

জন্তটি কি মানুষের কথা বুঝতে পারে ? ডাক্তার সেনের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র ও তীক্ষ্ণ শব্দ বের হয়ে এল। অত্যন্ত হাই ফ্রিকোয়েন্সি সাউন্ড যা মানুষের স্নায়ুকে প্রচণ্ড ঝাকিয়ে দেয়। 

ডাক্তার সেন বললেন— অপেক্ষা করছেন কেন ? কিল ইট। 

ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৫)-হুমায়ুন আহমেদ

জন্তুটি এগুতে শুরু করেছে। শুড়গুলি বড় হচ্ছে, ছােট হচ্ছে আর সে এগুচ্ছে তার মা’র দিকে। আমরা দেখছি সে মেঝে বেয়ে তার মা’র খাটের দিকে যাচ্ছে। খাট বেয়ে উপরে উঠছে। আশ্রয় খুঁজছে মা’র কাছে। যেন সে জেনে গেছে এই অকরুণ পৃথিবীতে একজনই শুধু তাকে পরিত্যাগ করবে না । 

ডাক্তার সেন বললেন, আপনারা অপেক্ষা করছেন কেন ? কিল ইট ।। 

আবার আগের মতাে শব্দ হলাে। জম্ভটি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডাক্তার সেনের দিকে। তার চোখ দুটি মানুষের চোখ । সেই চোখের ভাষা আমরা জানি। সেই চোখ করুণা এবং দয়া ভিক্ষা করছে। কিন্তু করুণা সে আমাদের কাছ থেকে পাবে না। আমরা মানুষ, আমরা আমাদের মাঝে 

তাকে গ্রহণ করব না। এই ভয়ংকর অসুন্দর ও কুৎসিতকে আমরা আশ্রয় দেব না। সে পশু হয়ে এলে ভিন্ন কথা ছিল। সে পশু হয়ে আসেনি। মানুষের সিঁড়ি বেয়ে এসেছে। 

| ডাক্তার সেন বললেন, এই জন্তুটিকে যে মেরে ফেলতে হবে এ বিষয়ে কি আপনাদের কারাে মনে কোনাে দ্বিধা আছে ? 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *