আমরা সবাই বললাম না, আমাদের মধ্যে কোনাে দ্বিধা নেই।
ডাক্তার সেন বললেন, আপনারা কি মনে করেন, এই জটি হত্যার আগে তার আত্মীয়স্বজনদের মত নেয়া উচিত ? আমরা বললাম না, আমরা তাও মনে করি না।
যে লােহার দণ্ডটি থেকে স্যালাইন ওয়াটারের ব্যাগ ঝুলছিল আমি তা খুলে হাতে নিলাম। জটি এখন তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কী সুন্দর বড় বড় শান্ত চোখ! কী আছে ঐ চোখে ? ঘৃণা, দুঃখ, হতাশা ? জটা খাটের পা বেয়ে অর্ধেক উঠে গিয়েছিল। সেখানেই সে থেমে গেল । বােধহয় বুঝতে পেরেছে আর উঠে লাভ নেই।
প্রথম আঘাতটি করলাম আমি । সে অবিকল মানুষের মতাে গলায় ডাকল—মা, মা। তার মা সাড়া দিল না।
আমার হাত থেকে লােহার রডটি পড়ে গিয়েছিল । ডাক্তার সেন তা কুড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। হত্যাকাণ্ডে বেশি সময় লাগল না। | ডাক্তার হাসনা বানুকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। এই ঘটনার কী কোনাে ব্যাখ্যা আপনি দাঁড় করাতে পারেন ?
ডাক্তার হাসনা ক্লান্ত গলায় বলেছিলেন আমার কাছে কোনাে ব্যাখ্যা নেই, তবে এই ঘটনার প্রায় সাত বছর পর আমেরিকান জার্নাল অব মেডিক্যাল সােসাইটিতে এরকম একটি শিশুর জন্মবৃত্তান্তের কথা পাই। শিশুটির জন্ম হয়েছিল বলিভিয়ার এক গ্রামে। শিশুটির বর্ণনার সঙ্গে আমাদের জন্তুটির বর্ণনা হুবহু মিলে যায়।
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
ঐ শিশুটিকেও জন্মের কুড়ি মিনিটের মাথায় হত্যা করা হয় এবং রিপাের্ট অনুসারে সেও মৃত্যুর আগে ব্যাকুল হয়ে বলিভিয়ান ভাষায় মা’কে কয়েকবার ডাকে।আপনার কাছে কোনাে ব্যাখ্যা নেই ? না। তবে আমার একটা হাইপােথিসিস আছে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রকৃতি ইভােলিউশন প্রক্রিয়ায় হয়তাে নতুন কোনাে প্রাণ সৃষ্টির কথা ভাবছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। আমরা প্রাণপণে সেই প্রক্রিয়াকে বাধা দিচ্ছি।’ আপনার ধারণা এরকম ঘটনা আরাে ঘটবে ?
হ্যা। প্রকৃতি সহজে হাল ছাড়ে না। সে চেষ্টা চালিয়ে যাবে এবং সে লক্ষ রাখবে যাতে ভবিষ্যতে আমরা বাধা দিতে না পারি । ঐ যে মা আগে স্বপ্ন দেখলেন তার একটিই ব্যাখ্যা প্রকৃতি শিশুটি রক্ষার চেষ্টা করছে। এ ধরনের প্রােটেকশান দেবার চেষ্টা করছে। এখন সে পারছে না। তবে ভবিষ্যতে সে নিশ্চয়ই আরাে কোনাে ভালাে প্রােটেকশানের ব্যবস্থা করবে।
‘আপনি কি আপনার হাইপােথিসিস বিশ্বাস করেন ? | ডাক্তার হাসনা বানু জবাব দিলেন না। তাঁর কাছে এই প্রশ্নের জবাব নেই। জবাব থাকার কথাও নয়। কিছু কিছু সময় আসে যখন আমরা বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের সীমারেখায় বাস করি। তখন একই সঙ্গে আমরা দেখতে পাই এবং দেখতে পাই না। বুঝতে পারি এবং বুঝতে পারি না। অনুভব করি এবং অনুভব করি না। সে বড় রহস্যময় সময়।
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
দ্বিতীয়জন
প্রিয়াংকার খুব খারাপ ধরনের একটা অসুখ হয়েছে। অসুখটা এমন যে কাউকে বলা যাচ্ছে না। বললে কেউ বিশ্বাস করবে , কিংবা বিশ্বাস করার ভান করে আড়ালে হাসাহাসি করবে। একজনকে অবিশ্যি বলা যায়– জাভেদকে। জাভেদ তার স্বামী। স্বামীর কাছে কিছু গােপন থাকা উচিত নয়। অসুখবিসুখের খবর সবার আগে স্বামীকেই বলা দরকার।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে জাভেদের সঙ্গে প্রিয়াংকার পরিচয় এখনও তেমন গাঢ় হয়নি। হবার কথাও নয়। তাদের বিয়ে হয়েছে একুশ দিন আগে। এখনও প্রিয়াংকার তুমি বলা রপ্ত হয়নি। মুখ ফসকে আপনি বলে ফেলে। এরকম গম্ভীর, বয়স্ক একজন মানুষকে তুমি বলাও অবিশ্যি খুব সহজ নয়। মুখে কেমন বাধােবাধাে ঠেকে। প্রিয়াংকা চেষ্টা করে আপনি তুমি কোনটাই
বলে চালাতে। যেমন– “তুমি চা খাবে? না বলে সে বলে চা দেব ? এইভাবে দীর্ঘ আলাপ চালানাে যায় না, তার চেয়েও বড় কথা মানুষটা খুব বুদ্ধিমান। ভাববাচ্যে কিছুক্ষণ কথা বলার পরই সে হাসিমুখে বলে, তুমি বলতে কষ্ট হচ্ছে, তাই না ?
তুমি বলতে কষ্ট হওয়াটা দোষের কিছু না। প্রিয়াংকার বয়স মাত্র সতেরাে। তাও পুরােপুরি সতেরাে হয়নি। জুন মাসে হবে। এখনও দুমাস বাকি। আর ঐ মানুষটার বয়স খুব কম ধরলেও ত্রিশ। তার বয়সের প্রায় দ্বিগুণ। সারাক্ষণ গম্ভীর থাকে বলে বয়স আরাে বেশি দেখায়। বরের বয়স বেশি বলে প্রিয়াংকার মনে কোনাে ক্ষোভ নেই।
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
বরদের চ্যাংড়া চ্যাংড়া দেখালে ভালাে লাগে না। তাছাড়া মানুষটা অত্যন্ত ভালাে। ভালাে এবং বুদ্ধিমান। কমবয়েসী বোেকা বরের চেয়ে বুদ্ধিমান বয়স্ক বর ভালাে । | বিয়ের রাতে নানান কিছু ভেবে প্রিয়াংকা আতঙ্কে অস্থির হয়েছিল। ধক ধক করে বুক কাঁপছিল। কপাল রীতিমতাে ঘামছিল। মানুষটা সঙ্গে সঙ্গে তা বুঝে ফেলেছিল। কাছে এসে ভারী গলায় বলল, ভয় করছে ? ভয়ের কী আছে বলাে তাে ?
প্রিয়াংকার বুকের ধকধকানি আরাে বেড়ে গেল। সে হাঁ না কিছুই বলল । একবার মনে হলাে সে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। মানুষটা তখন নরম গলায় বলল, ভয়ের কিছু নেই । ঘুমিয়ে পড়াে। বলেই প্রিয়াংকার গায়ে চাদর টেনে দিল । তার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল । প্রিয়াংকার ভয় পুরােপুরি কেটে গেল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে য় পড়ল। অনেক রাতে একবার ঘুম ভেঙে দেখে লােকটি অন্যপাশ ফিরে ঘুমুচ্ছে। খানিকক্ষণ জেগে থেকে প্রিয়াংকা আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়, লােকটি তখন পাশে নেই।
একটা মানুষকে চেনার জন্যে একুশ দিন খুব দীর্ঘ সময় নয়। তবু প্রিয়াংকার ধারণা মানুষটা ভালাে। বেশ ভালাে। এরকম একজন মানুষকে তার অসুখের কথাটা অবশ্যই বলা যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে অসুখটার সঙ্গে এই মানুষটার সম্পর্ক আছে। এই কারণেই তাকে বলা যাবে না । কিন্তু কাউকে বলা দরকার। খুব তাড়াতাড়ি বলা দরকার। নয়তাে সে পাগল হয়ে যাবে । কিছুটা পাগল সে বােধহয় হয়েই গেছে। সারাক্ষণ অস্থির লাগে । সন্ধ্যা মেলাবার পর শরীর কাঁপতে থাকে। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকে। গ্লাসের পর গ্লাস পানি খেলেও তৃষ্ণা মেটে না।
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(১৬)-হুমায়ুন আহমেদ
সামান্য শব্দে ভয়ংকর চমকে ওঠে। সেদিন বাতাসে জানালার কবাট নড়ে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে অস্থির হয়ে গােঙানির মতাে শব্দ করল প্রিয়াংকা। হাতের চায়ের কাপ থেকে সবটা চা ছলকে পড়ল শাড়িতে। ভাগ্যিস আশপাশে কেউ ছিল না। কেউ থাকলে নিশ্চয়ই খুব অবাক হতাে। প্রিয়াংকার ছােট মামা যেমন অবাক হলেন ।
তিনি প্রিয়াংকাকে দেখতে এসেছিলেন। তার দিকে তাকিয়েই বিস্মিত গলায় বললেন, তাের কী হয়েছে রে ? প্রিয়াংকা হালকা গলায় বলল, কিছু হয়নি তাে! তুমি কেমন আছ মামা ?
‘আমার কথা বাদ দে, তােকে এমন লাগছে কেন ? ‘কেমন লাগছে?