একটা ডিমও ভেজে নেব । তুমি দেরি করবে না।’
আমি ইয়াকুবকে কিছু টাকা দিলাম। সে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে দুই মেয়েকে একটা গরুর গাড়িতে তুলে রওনা হয়ে গেল। আমার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল । কেন যেন মনে হলাে মেয়েটা বাঁচবে না ।
আমি থাকি দোতলার দক্ষিণমুখী একটা ঘরে। ঘরটা বিশাল । দুদিকে জানালা আছে। আসবাবপত্র বলতে পুরনাে একটা খাট, খাটের পাশে লেখার টেবিল। লেখার টেবিলে হারিকেন ছাড়াও মােমদানে মােমবাতি। লেখালেখির জন্যে শুধু হারিকেনের আলাে যথেষ্ট নয় বলেই মােমবাতির ব্যবস্থা।
কেন জানি সন্ধ্যার পর থেকে ভয়-ভয় করতে লাগল। বিছানায় বসে লিখছি। হঠাৎ মনে হলাে কেউ-একজন দক্ষিণের বারান্দায় নরম পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। আমি কে কে বলতেই হাঁটার শব্দ থেমে গেল।
আমি দুর্বলচিত্তের মানুষ নই। তবে যে-কোনাে সাহসী মানুষও কোনাে কারণে বিশাল একটা বাড়িতে একা পড়ে গেলে একটু অন্যরকম বােধ করে। আমার কেমন অন্যরকম লাগতে লাগল। সেই অন্যরকমটাও আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারছিলাম না। একবার মনে হচ্ছে পানির পিপাসা হচ্ছে আবার পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে না, পানির পিপাসা না অন্যকিছু। অনেক চেষ্টা করেও কিছু লিখতে পারলাম না। লেখার জন্যে মাথা নিচু করতেই মনে হয় দরজার ফাক দিয়ে কেউ আমাকে দেখছে। তাকাতেই সরে যাচ্ছে। দুবার আমি বললাম- কে কে ? বলেই লজ্জা পেলাম। কে কে বলে চাচানাের কোনাে মানে হয় না ।
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ
এই সময় লক্ষ করলাম হারিকেনের আলাে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। তেল কমে এসেছে। এক্ষুনি হয়তাে দপ করে নিভে যাবে। এতে ভয় পাবার তেমন কোনাে কারণ নেই। আরাে একটি হারিকেন পাশের ঘরে আছে। সবুজ রঙের বড় একটা বােতলে কেরােসিন তেল থাকে। সেই বােতলটি একতলায় রান্নাঘরে। তা ছাড়া মােমবাতি তাে আছেই। | আমি নিবুনিবু হারিকেন নিয়ে একতলায় নেমে গেলাম। চা বানিয়ে খাব। হারিকেনে তেল ভরব। রাতে খাবার কিছু করা যায় কি না তাও দেখব।
| দেখলাম রাতে খাবার জন্যে চিন্তিত হবার কোনাে কারণ নেই । ইয়াকুব ভাত বেঁধে রেখে গেছে । কড়াইয়ে ডাল আছে । ডিম আছে। ইচ্ছা করলেই ডিম ভেজে নেয়া যায়।
চা বানিয়ে খেলাম। ফ্লাস্ক ভরতি করে চা নিয়ে দোতলায় উঠে এলাম। বারান্দায় পা দিতেই বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। মনে হলাে সবুজ রঙের ডুরে শাড়ি পরা একটি মেয়ে যেন হঠাৎ দ্রুত সরে গেল। মেয়েটার চোখ দুটি মায়া–মায়া। কিন্তু এই অন্ধকারে মেয়েটার চোখ দেখার কথা না। তা হলে আমি এসব কী দেখছি ?
বৃষ্টির বেগ খুব বাড়ছে। রীতিমতাে ঝােড়াে হাওয়া বইছে। আমি আমার ঘরে আগের জায়গায় ফিরে এলাম। জানালা বন্ধ করে দিলাম। শো
শোঁ শব্দ তবু কমল না ।
ঠিক তখন বজ্রপাত হলাে। প্রচণ্ড বজ্রপাত। সাউন্ডওয়েভের নিজস্ব একটা ধাক্কা আছে। এই ধাক্কায় মােমবাতির কিংবা হারিকেনের শিখা নিভে যায়। টেবিলের উপর হারিকেনের আলাে নিভে গেল। হঠাৎ চারদিক গাঢ়
অন্ধকার। .
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ
আমি তখন পরিষ্কার শুনলাম মেয়েলি গলায় কেউ-একজন বলছে আপনে বাইরে আসেন। আমি চেঁচিয়ে বললাম, কে ? সেই আগের কণ্ঠ আবার শােনা গেল—- ভয় পাইয়েন না। একটু বাইরে আইসা দাঁড়ান।
অল্পবয়স্ক মেয়েমানুষের গলা। পরিষ্কার গলা। আমি আবার বললাম, কে, তুমি কে ?
কোনাে জবাব পাওয়া গেল না। মনে হলাে কেউ যেন ছােট্ট করে নিশ্বাস ফেলল । ঘরের দরজা একটু ফাঁক করল ।
| আমি উঠে বারান্দায় চলে এলাম। বারান্দায় কেউ নেই। তবু মনে হলাে কেউ-একজন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সে চাচ্ছে কিছুটা সময় আমি বারান্দায় থাকি।
ধুপ ধুপ শব্দ আসছে। শব্দ কোথেকে আসছে ঠিক বােঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোদাল দিয়ে কেউ মাটি কোপাচ্ছে। এই ঝড়বৃষ্টির রাতে কোদাল দিয়ে মাটি কোপাচ্ছে কে ? আমি বারান্দায় রেলিঙের দিকে এগিয়ে গেলাম, তখন বিদ্যুৎ চমকাল। বিদ্যুতের আলােয় স্পষ্ট দেখলাম দক্ষিণ দিকের বাঁশবনের কাছে কোদাল দিয়ে একজন মাটি কোপাচ্ছে। যে মাটি
কোপাচ্ছে সে হলাে আমাদের ইয়াকুব।
কিন্তু ইয়াকুব এখানে আসবে কেন ? ও তাে মেয়ে নিয়ে শহরে গেছে। বিদ্যুৎচমক দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না। এক একবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর আমি তাকে দেখছি। সে খুব ব্যস্ত হয়ে মাটি কোপাচ্ছে। গভীর গর্ত করছে। সে কি কবর খুঁদছে। পাশে কাপড় দিয়ে মােড়া লম্বা এটা কী ?
ছায়াসঙ্গী-পর্ব-(৬)-হুমায়ুন আহমেদ
পরিষ্কার কিছু দেখছি না। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে তখনই শুধু দেখছি। বুঝতে পারছি এটা বাস্তব কোনাে দৃশ্য নয়। এই দৃশ্যের জন্ম আমার চেনাজানা জগতে নয়। অন্য জগতে অন্য সময়ে। | আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছি। মুষলধারে বর্ষণ হচ্ছে । বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আমি ইয়াকুবকে দেখছি। সে অতি ব্যস্ত। অতি দ্রুত কবর খুঁদছে। কার কবর ? সবুজ কাপড়ে মােড়া একটি মৃতদেহ পাশেই রাখা। বৃষ্টির পানিতে তা ভিজছে। এটা কি তার স্ত্রীর মৃতদেহ ? কী আশ্চর্য, হাত পাঁচেক দূরে বাচ্চা দুটি বসে আছে। এরা একদৃষ্টিতে মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে আছে।
| যে-রূপবতী স্ত্রীর পালিয়ে যাবার কথা ইয়াকুব বলে, এই কি সেই মেয়ে ? এই মেয়েটিকে সে-ই কি হত্যা করেছিল ? হত্যাকাণ্ডটি কোনাে-এক বর্ষার রাতে ঘটেছিল ? কোনাে-এক অস্বাভাবিক উপায়ে সেই মুহূর্তটি কি
আবার ফিরে এসেছে ? আমি দেখছি। ইন্দ্রিয়ের অতীত কোনাে-একটি দৃশ্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে ধরা পড়ছে আমার কাছে।
ম আমার এই জীবনে কোনাে অতিপ্রাকৃত বিষয়কে স্থান দিইনি। আজ আমি এটা কী দেখছি ?
ভদ্রলােক এইখানে গল্প শেষ করলেন। আমি বললাম, তারপর ? তারপর কী হলাে ?
তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনাকে একটা ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাচ্ছিলাম, বলা হলাে। এর আর তারপর বলে কিছু নেই।