জমির সাহেব বললেন, দরকার আছে বলে তাে মনে হয় না। চিঠি পাওয়ার পরেও তাে পনেরাে দিন হয়ে গেল। ‘হােক পনেরাে দিন, পাঠিয়ে দাও। আমার ভালাে লাগছে না।’ ‘আচ্ছা বলে দ্যাখাে। যদি যেতে রাজি হয় তাহলে যাক ।
সুমন যেতে রাজি হলাে। শুধু যে রাজি হলাে তা-ই না, তৎক্ষণাৎ যেতে রাজি। টাকা দিলে আজ রাতের ট্রেনেই রওনা হয়ে যায় এমন অবস্থা। ঠিক হলাে সে সােমবার সকালের ট্রেনে যাবে। জমির সাহেবও সঙ্গে যাবেন। পৈতৃক বাড়ি ঠিকঠাক করবেন, জমিজমার খোঁজখবর করবেন। সম্ভব হলে কিছু জমি বিক্রি করে আসবেন। টাকা-পয়সার খুব টানাটানি যাচ্ছে ।
তাদের যাবার কথা সােমবার। তার আগের দিন অর্থাৎ রােববার ভােররাতে পুলিশ এসে জমির সাহেবের বাড়ি ঘেরাও করে সুমনকে ধরে নিয়ে গেল। হতভম্ব জমির সাহেবকে পুলিশ সাবইন্সপেক্টর আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন আপনার ছেলের বিরুদ্ধে মার্ডার চার্জ আছে । সাত দিন আগে চারজনে মিলে খুনটা করেছে। কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার । আপনার ছেলে এই চারজনের একজন। আপনি বুঝিয়ে-সুজিয়ে ছেলেকে রাজসাক্ষী হতে রাজি করান। এতে আপনারও লাভ, আমাদেরও লাভ। না হলে কিন্তু ফাসিটাসি হয়ে যাবে। পলিটিক্যাল প্রেশারও আছে ।
ছায়াসঙ্গী-(শেষ)-পর্ব-হুমায়ুন আহমেদ
সুমন রাজসাক্ষী হতে রাজি হলাে না। দীর্ঘদিন মামলা চলল । রায় বেরুতে লাগল দুবছর। তিনজনের সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড, একজনের ফাঁসি । সেই একজন সুমন। অন্য তিনজন ছেলেটাকে ধরে রেখেছিল। খুন করেছে সুমন। ধারালাে ক্ষুর দিয়ে রগ কেটে দিয়েছে। | পাঁচ বছর কেটে গেছে । পরবর্তী বেয়ারিং চিঠিটা এল পাঁচ বছর কাটার পর । এই পাঁচ বছরে জমির সাহেবের সংসারে বড়রকমের ওলটপালট হয়েছে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। মিতুর বিয়ে হয়েছে কৃষিখামারের এক ম্যানেজারের সঙ্গে।
সে স্বামীর সঙ্গে গােপালপুরে থাকে। ছােট মেয়ে ইরার বিয়ে হয়েছে ওষুধ কোম্পানির এক কেমিস্টের সঙ্গে। তারা ঢাকা শহরেই থাকে। প্রায়ই বাবা–মাকে দেখতে আসে। বড় মেয়ের কোনাে ছেলেপুলে হয়নি। ছােট মেয়ের একটা ছেলে হয়েছে । ছেলের নাম ফরহাদ। এই ছেলেটি জমির সাহেবের খুব ভক্ত। তাঁর কাছে এলেই কোলে উঠে বসে থাকে, কিছুতেই কোল থেকে নামানাে যায় না। পাঁচ বছর পর একদিন পিওন এসে বলল, স্যার আপনার একটা বেয়ারিং চিঠি আছে, রাখবেন ? জমির সাহেব শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
সেদিন ইরারা বেড়াতে এসেছে। জমির সাহেবের কোলে ফরহাদ । তিনি ফরহাদকে মাটিতে নামিয়ে চিঠি হাতে নিলেন। হাতের লেখা চিনতে তার অসুবিধা হলাে না। সেই হাতের লেখা। সেই ন্যাপথালিনের গন্ধ! পিওন বলল, চার টাকা লাগবে।
ছায়াসঙ্গী-(শেষ)-পর্ব-হুমায়ুন আহমেদ
জমির সাহেব একবার ভাবলেন বলবেন, চিঠি রাখব না। তিনি তা বলতে পারলেন না। | যন্ত্রের মতাে পকেটে হাত দিয়ে টাকা বের করলেন। চিঠি পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিলেন, কাউকে কিছু বললেন না। তাঁর বমি-বমি ভাব হলাে। মাথা ঘুরতে লাগল।
রাতে তিনি কিছু খেলেন না। ইরাদের আসা উপলক্ষে ভালােমন্দ রান্না হয়েছিল, তিনি কিছুই মুখে দিলেন না। ইরা বলল, বাবা তােমার কী হয়েছে?
তিনি ক্ষীণস্বরে বললেন, কিছু হয়নি। শরীরটা ভালাে না।
‘রােজই তুমি বল শরীর ভালাে না, অথচ একজন ভালাে ডাক্তার দেখাও না। একজন ভালাে ডাক্তার দেখাও বাবা।
‘দেখাব। ‘আর মাকেও একজন ভালাে ডাক্তার দেখাও। ‘আচ্ছা।’ ‘আচ্ছা না বাবা। দেখাও।
মেয়ে-জামাই রাত নটার দিকে চলে গেল। ফরহাদ গেল না। সে নানার সঙ্গে থাকবে।
সারারাত জমির সাহেবের ঘুম হলাে না। পরদিন হুহু করে গায়ে জ্বর এসে গেল। জ্বরের মূল কারণ কাউকে বলতে পারলেন না। বেলা যতই বাড়তে লাগল জ্বর ততই বাড়তে লাগল। দুপুরের পর ঘাম হতে লাগল। ইরা হতভম্ব হয়ে বলল, বাবা চলাে তােমাকে ক্লিনিকে নিয়ে ভর্তি করি । আমার কিছু ভালাে লাগছে না। তুমি এরকম ঘামছ কেন ? হার্টের কোনাে সমস্যা না তাে?
জমির সাহেব ক্ষীণস্বরে বললেন, চিঠি পেয়েছি। ‘চিঠি পেয়েছি মানে ? কার চিঠি ? “বেয়ারিং চিঠি। ইরা দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, কী লেখা এবারের চিঠিতে ? ‘চিঠি পড়িনি।’ | ‘পড়ে দ্যাখাে। না পড়েই এরকম করছ কেন ? হয়তাে এবার কোনাে
এরকম করছ কেন ? হয়তাে এবার কোনাে ভালাে খবর আছে। জমির সাহেব কাঁপা গলায় বললেন, ভয় লাগছে রে ইরা!
ইরা চিঠি খুলে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে গেল । অন্যদের সেই চিঠি দেখাল। যারা দেখল প্রত্যেকেই গম্ভীর হলাে, কারণ চিঠিতে কিছু লেখা নেই। সাদা একটা পাতা, শেষে নাম সই করা বিনীত, তােমার সুস্মিতা। এই সাদা -লেখা অংশে কী বলতে চাচ্ছে সুস্মিতা ? কে সে ? কেনইবা সে চিঠি লেখে ? আবার আজ কেনইবা লিখল না ?