জনম জনম-পর্ব-(১)-হুমায়ূন আহমেদ

জনম জনম
জনম জনম-হুমায়ূন আহমেদ

 

পূর্বকথা 

‘মৌনব্রত’ নামে ‘দৈনিক বাংলায় একটা ধারাবাহিক লেখা শুরু করেছিলাম। সেখানে হঠাৎ তিথি’ নামের একটি চরিত্র চলে এল। নিশিকন্যা। লক্ষ্য করলাম, তার কথা লিখতে বড় ভাল লাগছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই জাতীয় মেয়েদের আমি চিনি 

শুধুমাত্র কল্পনার আশ্রয় করে তাে আর একটি লেখা দাঁড় করান যায় না। আমি নানান জনের কাছে যাই, কেউ তেমন সাহায্য করেন না। 

মজার ব্যাপার হল সাহায্য পেয়ে গেলাম অকল্পনীয় একটি সূত্র থেকে। এই ভূমিকায় গভীর মমতা ও ভালবাসায় সেই সূত্রের ঋণ স্বীকার করছি। 

বইটি শুরুতে রাত্রি” নামে ছাপা হচ্ছিল। একদিনের কথা, উপন্যাস লিখছি, আমার স্ত্রী রেকর্ড প্লেয়ারে গান বাজাচ্ছেন—হঠাৎ সমস্ত ইন্দ্রিয় চলে গেল গানে 

জনম জনম তব তরে কাঁদিব। গান শুনতে শুনতে নিজে খানিকক্ষণ কাঁদলাম এবং পরে উপন্যাসের নাম পাল্টে দিলাম, রাত্রি থেকে তা হয়ে গেল ‘জনম জনম’। 

আমার প্রকাশক খুব বিরক্ত হলেন। রাগী-গলায় বললেন, এসব কি করছেন রাত্রি নামে ফর্মা ছাপা হয়ে গেছে। আমি বললাম, হােক। প্রকাশক চোখের দৃষ্টিতে আমাকে ভস্ম করতে চাইলেন-পারলেন না। যে কম্পােজিটর এই বই কম্পােজ করত, সে আমার কাটাকাটির বহর দেখে চাকরি ছেড়ে পালিয়ে গেল—নানান যন্ত্রণা। তবু সব যন্ত্রণার পরেও বইটি বের হচ্ছে—এই আমার আনন্দ। 

হুমায়ূন আহমেদ শহীদুল্লাহ হল ঢাকা। 

জনম জনম-পর্ব-(১)-হুমায়ূন আহমেদ

তিথি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। | সামনে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক বােঝা যাচ্ছে না। অবশ্য আঠার-উনিশ বছরের মেয়েরা বিনা কারণেই আয়নার সামনে দাঁড়ায়। তিথির বয়স একুশ। সেই হিসেবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার একটা অর্থ করা যেতে পারে। এই বয়সের মেয়েরা অন্যের মাঝে নিজের ছায়া দেখতে ভালবাসে। যে কারণে পুকুর দেখলেই পুকুরের পানির উপর ঝুকে পড়ে। আয়নার সামনে থমকে দাঁড়ায়। নিজেকে দেখতে বড় ভাল লাগে। 

তিথির বয়স একুশ হলেও এইসব যুক্তি তার বেলায় খাটছে না। কারণ ঘর অন্ধকার। আয়নায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। যদিও বাইরে শেষ বেলার আলাে এখনাে আছে। সেই আলাের খানিকটা এ ঘরে আসা উচিত—কিন্তু আসছে না। বৃষ্টির জন্যে দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সারাদিন অবিশ্রান্ত বর্ষণ হয়েছে। এখন বৃষ্টি নেই। দরজা-জানালা অবশ্য ভােলা হয় নি। কারণ আবার বৃষ্টি আসবে। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। 

এই ঘরে সে ছাড়াও আরাে একজন মানুষ আছে, তার বাবা–শিয়ালজানি হাই স্কুলের রিটায়ার্ড অ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার জালালুদ্দিন সাহেব। জালালুদ্দিন সাহেব চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছিলেন। খানিকক্ষণ আগে তাঁর ঘুম ভেঙেছে। তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর চোখে সমস্যা আছে। চোখ প্রায় নষ্ট। কিছুই দেখতে পান না।

কড়া রােদে আবছা আবছা কিছু দেখেন। সত্যি দেখেন না কল্পনা করে নেন তা বােঝা মুশকিল। আজ তাঁর কাছে মনে হচ্ছে তিনি তাঁর বড় মেয়েকে এই অন্ধকারেও দেখতে পাচ্ছেন। শ্যামলা মেয়েটির বালিকাদের মত সরল মুখ, বড় বড় চোখ সব তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন। কি আশ্চর্য কাণ্ড! 

জনম জনম-পর্ব-(১)-হুমায়ূন আহমেদ

জালালুদ্দিন সাহেব প্রচণ্ড উত্তেজনা বােধ করলেন। তাঁর চোখ কি তাহলে সেরে গেল নাকি? গত সাতদিন ধরে একটা কবিরাজী অষুধ তিনি চোখে দিচ্ছেন নেত্র সুধা। ঔষুধটা মনে হচ্ছে কাজ করছে। জালালুদ্দিন চিকন গলায় ডাকলেন—ও তিথি। 

তিথি বাবার দিকে ফিরে তাকাল। কিছু বলল না। | চোখে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি রে মা। তাের পরনে একটা লাল শাড়ি না? পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। 

 তিথি বলল, শাড়ির রঙ নীল। বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। আজ সে বাইরে যাবে। বাইরে যাবার আগে কারাে সঙ্গে কথা বলতে তার ভাল লাগে না। 

তিথি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল—আবার বৃষ্টি আসবে কি বুঝতে চেষ্টা করল। বৃষ্টি আসুক বা না আসুক—তাকে বেরুতেই হবে। সে রান্নাঘরে ঢুকল। রান্নাঘরে তিথির মা মিনু চুলা ধরানাের চেষ্টা করছেন। কাঠ ভেজা। কিছুতেই আগুন ধরছে না। বােতল থেকে কেরােসিন ঢাললেও লাভ হয় না। ধপ করে জ্বলে উঠে কিছুক্ষণ পর আগুন নিভে যায়। কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া বেরুতে থাকে। তিথি একটা মােড়ায় বসে মাকে দেখছে। মিনু বিরক্ত গলায় বললেন-তুই বসে বসে ধোঁয়া খাচ্ছিস কেন? বারান্দায় গিয়ে বােস। তিথি নিঃশব্দে উঠে এল। বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আবার বৃষ্টি হচ্ছে। টিনের চালে ঝমঝম শব্দ। ঘাের বর্ষা! 

তাদের বাসাটা কল্যাণপুর ছাড়িয়েও অনেকটা দূরে। জায়গাটার নাম সুতাখালি। পুরােপুরি গ্রাম বলা যায়। চারদিকে ধানী জমি। তবে ঢাকা শহরের লােকজন বেশির ভাগ জমিই কিনে ফেলেছে। তিন ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘিরে সাইনবোের্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে—দিস প্রপাটি বিলংস টু… দেয়াল ঘেরা অংশে পানি থৈথৈ করে। পানির বুক চিরে যখন-তখন হলুদ রঙের সাপ সাঁতরে যায়। জায়গাটায় সাপখােপের খুব উপদ্রব। 

জনম জনম-পর্ব-(১)-হুমায়ূন আহমেদ

তুই আমার সঙ্গে কথা বলিস না। বাসায় যা। বাসায় গিয়ে ইলিশ মাছ ভাজা খা। 

ও রাতে ফিরবি তাে? ফিরলে কখন ফিরবি বলে যা, বাস স্ট্যাণ্ডে থাকব। দিন কাল ভাল না। 

আমার জন্যে কাউকে দাঁড়াতে হবে না। আর একটা কথা বললে আমি কিন্তু চড় লাগাব। ফাজিল কোথাকার। চোরের চোর। 

 আরে কি মুসিবত, মুখ খারাপ করছিস কেন? আমি তাের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করছি, তুই আমার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করবি। আমি কি গালাগালি করছি? 

 চুপ কর। ধমক দিচ্ছিস কেন? তাের বড় ভাই হই মনে থাকে না? সংসারকে দুটা পয়সা দিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছিস। পয়সা কিভাবে আনছিস সেটা বুঝি আমি জানি না? এই শৰ্মা মায়ের বুকের দুধ খান না। সব বুঝে। তাের ঐ পয়সায় আমি পেচ্ছাব করে দেই। আই মেক ওয়াটার। বুঝলি-ওয়াটার। আমার স্ট্রেইট কথা। পছন্দ হলে হবে। না হলে-নাে প্রবলেম। 

তিথি দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। সে কিছু-একটা বলতে গিয়েও বলল না। হীরু লম্বা লম্বা পা ফেলে বাড়ির দিকে রওনা হল। 

বারান্দায় উঠেই সে সহজ গলায় বলল-মা, মাছটা ধর তাে। তার বলার ভঙ্গি থেকে মনে হতে পারে যে সে কিছুক্ষণ আগে মাছ কেনার জন্যেই গিয়েছিল। কিনে ফিরেছে। 

মিনু রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। হীরু মার দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল, ঘরে সর্ষে আছে ? যদি থাকে, সর্ষে বাটা লাগিয়ে দাও। কুমড়াে পাতা খোঁজ করছিলাম। পাই নি। পেলে পাতুরি করা যেত। বর্ষা বাদলার দিনে পাতুরির মত জিনিস হয় না। 

মিনু শান্ত কণ্ঠে বললেন, তুই বেরিয়ে যা। হীরু অবাক হয়ে বলল, কোথায় বেরিয়ে যাব? 

নম জনম-পর্ব-(১)-হুমায়ূন আহমেদ

 যেখানে ইচ্ছা যা। এই বাড়িতে তােকে দেখতে চাই না। ? ঠিক আছে যেতে বলছ যাব। ? এক্ষুণি যা। 

আচ্ছা ঠিক আছে। মাছটা শখ করে এনেছি, রান্নাবান্না কর খেয়ে তারপর যাই। এক ঘন্টা আগে গেলেও যা পরে গেলেও তা। | মিনু মাছ উঠোনের কাদার মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। হীরু উচু গলায় বলল, আমার উপর রাগ করছ কর মাছের উপর রাগ করছ কেন? এই বেচারা তাে কোন দোষ করে নি। একের অপরাধে অন্যের শাস্তি—এটা কি রকম বিচার? 

মিনু রান্নাঘর থেকে চেচিয়ে বললেন- ঘরে ঢুকলে বটি দিয়ে তােকে চাকা চাকা করে ফেলব। খবরদার। হীরুর তেমন কোন ভাবান্তর হল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই হীরুকে দেখা গেল গামছা লুঙ্গির মত করে পরে বটি নিয়ে অন্ধকার বারান্দায় মাছ কুটতে বসেছে। কথা বলছে নিজের মনে। এমন ভাবে বলছে যেন রান্নাঘর থেকে মিনু শুনতে পান ।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *