সব কিছু না শুনেই রাগ। আরে আগে ঘটনাটা কি ঘটেছে শুনতে হবে না? না শুনেই চিৎকার, চেচামেচি। চাল কিনতে বাজারে ঢুকেছি। নাজিরশাল চাল। দেখেশুনে পছন্দ করলাম। বস্তার মধ্যে নিলাম বিশ সের। টাকা দিতে গিয়ে পকেটে হাত দিয়ে দেখি—পরিষ্কার। সাফা করে দিয়েছে। চাল না নিয়ে বাসায় ফিরি কিভাবে? চক্ষু টুকু মাথা নাড়ল। ভেতর থেকে জালালুদ্দিন ডাকলেন—তিথি, শুনে যা তাে মা। তিথি বারান্দা থেকে নড়ল না। সেখান থেকেই বলল—কি বলবে বল।
এই সন্ধ্যাবেলা কোথায় বেরুচ্ছিস? কি রকম ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে দেখছিস না। : আমার কাজ আছে।ঝড়বৃষ্টির মধ্যে কিসের কাজ? বাদ দে।
সে জবাব দিল না। জালালুদ্দিন বললেন, খবরদার বেরুবি না। কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকা মানুষ কি পিপড়া নাকি যে রাতদিন কাজ করবে।
মিনু ঝাঁঝাল গলায় বললেন, চুপ কর। সব সময় কথা বলবে না।
ও এই বৃষ্টির মধ্যে যাবে নাকি? . ও তােমাকে এটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। ও বৃষ্টিতে ভিজে একটা জ্বরজ্বারি বাঁধাবে… সিজন চেঞ্জ হচ্ছে। ও বললাম তাে তােমাকে মাথা ঘামাতে হবে না। | তিথি যখন বেরুল তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। চারদিক অন্ধকার। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। সে ঘর থেকে বেরুবার সময় কাউকে কিছু বলে বেরুল না। মিনু বারান্দাতেই ছিলেন-তাঁর দিকে তাকিয়ে একবার বললও না–মা, যাচ্ছি। যেন সে তাঁকে দেখতেই পায় নি।
জনম জনম-পর্ব-(২)-হুমায়ূন আহমেদ
ঘরে ছাতা নেই। তিথি মােটা একটা তােয়ালে মাথায় জড়িয়ে রাস্তায় নেমেছে। খালি পা। স্যান্ডেল জোড়া হাতে। কাঁচা রাস্তা, খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। টুকু আগে আগে যাচ্ছে। তার মাথায় কিছু নেই। বৃষ্টিতে মাথার চুল এর মধ্যেই ভিজে জবজবে। তিথি বলল, বাসায় গিয়ে ভাল করে মাথা মুছে ফেলবি। নয় তাে জ্বরে পড়বি।
টুকু মাথা কাত করল। মৃদু গলায় বলল, রাতে ফিরবে না আপা?
না। ও সকালে আসবে?
ও ই। এবার বর্ষা আগেভাগে এসে গেল তাই নারে টুকু। মনে হচ্ছে শ্রাবণ মাস। তাই না?
ওই।
গতবারের মত এবারও ঘরে পানি উঠবে কি-না কে জানে। তাের কি মনে হয় উঠবে?
টুকু জবাব দিল না। তার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
কলাবাগানের ভেতরের দিকে একটা বাড়ির সামনে তিথি এসে উপস্থিত হয়েছে। তার শাড়ি কাদা-পানিতে মাখামাখি। হোঁচট খেয়ে স্যান্ডেলের ফিতা ছিড়ে গেছে। নখের খানিকটা ভেঙে যাওয়ায় রক্ত পড়ছে। অনেকক্ষণ কড়া নাড়বার পর মাঝবয়েসী এক লােক দরজা খুলল। তার খালি গা। হাঁটু পর্যন্ত উচুতে লুঙ্গি উঠে আছে। পরার ধরন এমন যে মনে হয় যে কোন মুহুর্তে খুলে পড়ে যাবে।
তার কোলে তিন-চার বছরের একটি বাচ্চা। দ্রলােক বাচ্চাকে ঘুম পাড়াতে চেষ্টা করছেন। বাচ্চা ঘুমুচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে থাকে আবার মাথা তুলে ‘হিক’ জাতীয় বিচিত্র শব্দ করে। | তিথি বলল, নাসিম ভাই কেমন আছেন? নাসিম বিরক্ত গলায় বলল, এই তােমার বিকাল পাঁচটা, কটা বাজে তুমি জান?
জনম জনম-পর্ব-(২)-হুমায়ূন আহমেদ
তিথি চুপ করে রইল। নাসিম বলল, আটটা পচিশ। তিথি হালকা গলায় বলল, দূরে থাকি। ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। তাই দেরি হল।
না থাকব না।পরশু, তরশু একবার এসাে। দেখি যদি এর মধ্যে ভাল কোন পার্টি পাই। না পাওয়া গেলে ভাল – এ দলা নিল শি হলে শ থাকে না করে স । কিছু আছে বিরাট খর। চামড়া সাদা হলেই যে দরাজ দিল হয় এটা ঠিক না। সাদা চামড়ার মধ্যেই খর বেশি। | নাসিম নিজেই ছাতা হাতে তিথিকে বাসে তুলে দিতে গেল। যাবে—জানা কথা। যে অল্প কিছু ভাল মানুষের সংস্পর্শে তিথি এসেছে—নাসিম তার মধ্যে একজন সে বাসে তিথিকে শুধু যে উঠিয়েই দিয়ে আসবে তাই না বাসের ডাইভারকে বলে আসবে—একটু খেয়াল রাখবেন ভাইসাব, একা যাচ্ছে।
বৃষ্টি ধরে গেছে। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। রাস্তায় জায়গায় জায়গায় পানি উঠে গেছে। পানি ভেঙে যেতে হচ্ছে নাসিম বলল, এক ফোঁটা বৃষ্টি হলে দুই হাত পানি হয়ে যায়। এই রহস্যটা কি বুঝলাম না। তিথি কিছু বলল না। নাসিম বলল, তােমা: ভাই চাকরি-বাকরি কিছু পেয়েছে?
না।
জনম জনম-পর্ব-(২)-হুমায়ূন আহমেদ
ও মটর মেকানিকের কাজ শিখবে নাকি জিজ্ঞেস করাে তাে। লাগিয়ে দেব ভালমত কাজ শিখতে পারলে কাঁচা পয়সা আছে, জিজ্ঞেস করাে।
আচ্ছা জিজ্ঞেস কবে, ও টেলিফোন করতে চেয়েছিলে—কার কাছে টেলিফোন ? ও চেনা একজন।পাওয়ারফুল কেউ হলে যােগাযােগ রাখবে-কখন দরকার হয় কিছুই বলা যায় না ।
বাস স্ট্যাণ্ডে পৌছানাে মাত্র বাস পাওয়া গেল। যা বাস। পেছনের দিকে তিন চারজন মানুষ বসে আছে নাসিম বাসের ড্রাইভারকে বিনত ভঙ্গিতে বলল, ভাইজান একটু দেখেশুনে নামাবেন, মেয়েছেলে একা যাচ্ছে। | পকেট থেকে নিরেটের প্যাকেট বের করে একটা এগিয়ে নিল নাকি সিগারেট খায় না, অন্যকে দেবার জন্যে সব সময় সঙ্গে রাখে।
তিথির হাতে সে একশ’ টাকার একট: নােট গুজে দিল। এটা হচ্ছে পার হ’তে টাকা এলে শশাধ নিতে হবে।
বাস না ছাড়া পর্যন্ত নাসিম ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রইল তি িছােট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল— এই মানুষটা তার চমৎকার একজন বড় ভাই হতে পারত। কেন হল না?
জনম জনম-পর্ব-(২)-হুমায়ূন আহমেদ
হারিকেন জ্বালাতে গিয়ে মিনু দেখলেন তেল নেই। অথচ কাল হারিকেনে তেল ভরা: পরও তেলে চার আঙুলে মত অবশিষ্ট ছিল। গেল কোথায়? টুকু ফেলে দিয়েছে? সকালবেলা কেরােসিনের বােতল নিয়ে কি যেন কহিল। মিনুঃ শিশুর সীমা রইল
টুকু বড়ি নেই : সালে টুকে তিনি কিছু শাস্তি দিয়েছেন। দু’বার চুল ধরে দেয়ালে মাথা ঠুকে দিয়েছেন, সে নিঃশব্দে কেদেছে কিন্তু কিছু বলে নি। তিনি একাই চেচিয়েছেন—কঠিন কঠিন বাক্যবাণে বিদ্ধ করেছেন। টুকু শুধু শুনে গেছে, মাঝে ময়ে এমন ভঙ্গিতে তাকিয়েছে যাতে মনে হয় পৃথিবীর হৃদয়হীনতায় সে খুব অবাক হচ্ছে – এতে মিনুর রাগ আরও বেড়েছে, সেই রাগের চমতম প্রকাশ তিনি দেখালেন দুপুরে।